সংস্কৃতির জট

সৈয়দ বেলাল আহমেদ
Published : 27 Jan 2011, 12:52 PM
Updated : 27 Jan 2011, 12:52 PM

আমি বরাবরই নিজেকে একজন সাংস্কৃতিক কর্মী হিসাবে ভাবি। আসলে দীর্ঘকাল বিলেত থাকলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে দেশের রাজপথের একজন সাংস্কৃতিক কর্মী হিসাবেই আমার বড় হওয়া। স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের বাংলা সংস্কৃতির বিকাশ আগের তুলনায় অনেক বেশি অবাধ হয়েছে। কারণ এটি এখন স্বাধীন একটি দেশের সংস্কৃতি। এটি এখন ১৫ কোটি মানুষের সংস্কৃতি। এছাড়া প্রবাসী বাঙালিরা তো আছেনই। আগে একুশে ফেব্রুয়ারী ছিলো কেবল বাঙালির প্রাণের স্পন্দন, এখন তা সারা বিশ্বের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃত। হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থাকলেও মূলত স্বাধীনতা লাভের পরই আমরা এর চর্চাকে অনেক বেশি এগিয়ে নিতে পেরেছি। এই সাংস্কৃতিক বিকাশে রাষ্ট্রের ভূমিকা রয়েছে। তার চেয়েও বেশি রয়েছে আমাদের নিবেদিতপ্রাণ শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতি কর্মীদের। তাদের প্রতি দেশের মানুষের রয়েছে অকৃত্রিম ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা এবং তারা আমারও নমস্য।

এরপরও আমার মতো অনেক সংস্কৃতি পিপাসুরা চাইবেন,"প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ।" আমি মনে করি সংস্কৃতির এই বিকাশ আরো হতে পারতো। অনেকের মতো আমিও এ ব্যাপারে অতৃপ্ত। বিশ্বের ষষ্ঠ ভাষাভাষী এই জাতির শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতির ছোঁয়ায় সারা বিশ্ব উদ্ভাসিত হতে পারতো। আমাদের সাফল্য অনেক আছে অস্বীকার করি না, কিন্তু এই বিশ্বায়নের যুগে তা আরো হতে পারতো। আমার ধারণা আমাদের পিছিয়ে পড়ার কারণ মূলত, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, নীতিমালা ও উদ্যোগের অভাব।

সত্যি বলতে কী, সংস্কৃতি হলো দেশের ভিতরের ও বাইরের একটা ইমেজ। সে ইমেজটাকে আমরা ঠিক মতো বিশ্বের দরবারে সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারছি কিনা -এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের একটা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় রয়েছে, নিশ্চয়ই এই মন্ত্রণালয় অনেক ভালো ভালো কাজ করে। কিন্তু চোখে পড়ার মতো কিছু নয়। কোথাও একটা সমস্যা আছে।

কেবল ঢাকার যানজট নয়, দেশের সবখানে যেনো কোথায় জট লেগে আছে। সংস্কৃতিতেও জট লেগে আছে; এগুচ্ছে না। স্বাধীনতার প্রায় চল্লিশ বছর পরেও আমরা এই ঢাকা শহরে অন্তত চারটা থিয়েটার হল গড়ে তুলতে পারি নি। অথচ যে সাংস্কৃতিক চেতনায় এই দেশ স্বাধীন হয়েছে, কম হলেও চল্লিশটা হওয়ার কথা ছিলো। গ্যালারী, কনসার্ট হল, লাইব্রেরী– এগুলো কোথায়? এফডিসির পাশ দিয়ে যখন গাড়ি নিয়ে যাই, তখন সহাস্য বেদনায় প্রশ্ন করি: এই আমাদের চিত্রপুরী! না, আমি শিল্পী, কলা কুশলীদের অবজ্ঞা করছি না। এই অবস্থায় কীভাবে শিল্প সংস্কৃতির বিকাশ সম্ভব?

তবে তথ্য প্রযুক্তির কারণে ও ব্যক্তি উদ্যোগে আমাদের সংস্কৃতির বিকাশ কিছুটা ঘটেছে বটে, কিন্তু সেখানে রাষ্ট্রের কি কোন ভূমিকা থাকবে না? মানুষের চিন্তাচেতনার বিকাশ ঘটানোর জন্যই ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ অনেক আগে এরকম একটি নীতি গ্রহণ করে যে, প্রতি দশ মিনিট পায়ে হাঁটার দূরত্বের মধ্যে তারা একটি করে লাইব্রেরি গড়ে তুলবে। শত বছরে তাই গড়ে উঠেছে। আর আমাদের?

এ তো গেলো দেশের চিত্র। আসুন, দেখি দেশের বাইরে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের দূতাবাস রয়েছে। সেসব নাকি অর্থনৈতিক কূটনীতিতে ব্যস্ত। ভালো কথা, কতটা বাণিজ্য হয়েছে এবং কী পরিমাণ ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট আনতে এসব দূতাবাস সক্ষম হয়েছে তা সবার জানা দরকার।

দূতাবাসগুলো যদি অন্তত বিদেশে সফলভাবে আমাদের সাংস্কৃতিক ইমেজটা তুলে ধরতে পারতো, তবু কিছুটা কাজ হতো। বিদেশে বাংলাদেশের বহু দূতাবাস দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। কিন্তু দূতাবাসগুলোর অভ্যন্তরে প্রবেশ করলে আমাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতির কোন ছাপ দেখি না। কেবল কদাচিৎ চোখে পড়ে সেই চিরাচরিত 'ভিজিট বাংলাদেশ' নামে পর্যটনের কিছু পোস্টার, এর বাইরে নেতানেত্রীর ছবি ছাড়া আর তেমন কিছু নয়।

আমার মনে হয়, অর্থনৈতিক কূটনীতি না করে, সাংস্কৃতিক কূটনীতি করলে আমাদের দূতাবাসগুলো অনেক সফল হতো। আমি ঢালাওভাবে বলছি না, যারা কূটনীতির জন্য নিয়োগ পান, বিদেশে নিজেদের নিয়ে অনেকটা ব্যস্ত থাকেন। আর ব্যস্ত থাকেন বিদেশে সফররত মন্ত্রী-আমলাদের সেবায়। দেশের কাজ করার খুব একটা সময় হাতে থাকে না।

দূতাবাসের অভ্যন্তরে জয়নুল, কামরুল, সুলতান কিংবা বর্তমান কালের শিল্পীদের প্রদর্শনী করলে হয়তো বিদেশীদের আরো বেশি আকর্ষণ করতে পারতো আমাদের দূতাবাসগুলো। হয়তো পরবর্তীতে এরা এই ঐতিহ্যবাহী দেশে বিনিয়োগেও আগ্রহী হতো।
বহু দেশের সাথে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সাংস্কৃতিক চুক্তি রয়েছে। নতুন বছরের শুরতে ভুটানের সাথে আমাদের সাংস্কৃতিক চুক্তি হয়েছে। আসলে বাস্তবে কতটুকু সাংস্কৃতিক আদান প্রদান হয়, আমরা জানি না। তাহলে এসব চুক্তির মানে কী? বিশ্বের দরবারে এ পর্যন্ত নজরকাড়া কোন প্রদর্শনী বা উৎসব আমরা উপস্থাপন করতে পেরেছি? এটা নয় যে, আমাদের প্রতিভার অভাব রয়েছে।
এই তো, একুশের বইমেলা সামনে। এ নিয়ে আমরা গর্ব করি, করার মতো উৎসব বটে। এটাকেও একটা আন্তর্জাতিক উৎসবে রূপান্তরিত করা যেতো। আমাদের ইংরেজি অনুবাদ সাহিত্য এত দুর্বল যে, বিশ্বের খুব কম মানুষ জানে আমাদের সাহিত্য সম্পর্কে। ও হ্যাঁ, কলকাতাসহ কিছু বিদেশি সাহিত্য সেবীরা নিশ্চয়ই আসবেন, কিন্তু এটাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের 'প্রবেশ' হিসাবে ধরে নিতে পারি না। হতে পারতো বিশ্বের বিভিন্ন দেশের লেখকদের সমাবেশ, সম্মিলন। তারা আসুক, জানুক, দেখুক আমাদের এই মিলনমেলা। তখন ওরা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের শেকড়ের সন্ধান পাবে। ঠিক জানি না, হয়তো এমনই আয়োজন চলছে। হলে ভালো, সাধুবাদ জানাবো।

আমাদের মহান স্বাধীনতা দিবস সামনে। নিশ্চয়ই ঘটা করে পালনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। শুনেছি এবার স্বাধীনতা পদকের জন্য প্রয়াত ব্রিটিশ শিল্পী জর্জ হ্যারিসনকে মনোনীত করা হয়েছে। সত্যি মিথ্যা জানিনা, তবে সত্যি হলে খুশী হবো। প্রায়ই মরে যাবার পর আমরা সম্মান দেখাই। দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা নেই অবস্থা। এর মাঝে আবার টেন্ডারের আগমন কতটুকু শুভ হবে জানি না। পরে কিনা কোন দলের ছাত্র বা যুব সংগঠন এই টেন্ডার নিয়ে যায়, এই ভয়ে ভীত আছি।

যাই হোক প্রয়াত জর্জ হ্যারিসনকে সম্মান দেখানো একটা উপযুক্ত কাজ হবে। চল্লিশ বছর আগে জর্জ হ্যারিসনের এই 'কনসার্ট ফর বাংলাদেশ' সারা বিশ্বের মানুষের মন স্পর্শ করেছে এবং মানবতার সাহায্যে এগিয়ে এসেছে বিশ্ববাসী। আমরা তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ। তার চেয়েও আরো বেশি কৃতজ্ঞ পণ্ডিত রবি শংকরের কাছে। তিনি এই কনসার্টের ছিলেন অন্যতম মূল উদ্যোক্তা। আমরা কি তাঁকে ভুলে গেলাম? তিনি তো এখনো জীবিত।

সৈয়দ বেলাল আহমেদ :লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক। সম্পাদক, কারি লাইফ।