একটি সংবাদপত্র, দুই সাংবাদিক এবং একজন সম্পাদক

মহিউদ্দিন আহমদ
Published : 26 Oct 2014, 07:26 PM
Updated : 26 Oct 2014, 07:26 PM

সংবাদপত্রটির নাম 'ওয়াশিংটন পোস্ট', সাংবাদিক দু'জনের নাম বব উডওয়ার্ড (Bob Woodward) এবং কার্ল বার্নস্টাইন (Carl Bernstein), আর সম্পাদকের নাম বেঞ্জামিন ব্র্যাডলি (Benjamin C. Bradlee)। গত ২১ অক্টোবর তিরানব্বই বছর বয়সে বেঞ্জামিন ব্র্যাডলি ওয়াশিংটন ডিসিতে তাঁর বাড়িতে মারা গিয়েছেন। আর তাঁর মৃত্যুর খবর দুনিয়ার সব দেশের গণমাধ্যমে, টিভি, রেডিও, পত্রপত্রিকায় গুরুত্বের সঙ্গেই প্রচার পেয়েছে। সে সঙ্গে প্রচার পেয়েছে 'ওয়াশিংটন পোস্ট' পত্রিকাটি এবং এই পত্রিকাটির তখনকার দুই তরুণ সাংবাদিক, বব উডওয়ার্ড এবং কার্ল বার্নস্টাইনের নামও। বস্তুত এই দুই সাংবাদিকের নামের দুটো আলাদা অংশ জোড়া দিয়ে দু'জন 'উডস্টাইন' নামেও সারা দুনিয়াতে তখন পরিচিত হয়ে উঠেন।

'ওয়াশিংটন পোস্ট'এর এমন দুনিয়াজোড়া নামডাকের পেছনে প্রধান কারণ ছিল, ১৯৭৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তখনকার প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের পতন ঘটিয়েছিল এই সংবাদপত্রটি। পত্রিকাটির এই দুই সাংবাদিক প্রেসিডেন্ট নিক্সনের ক্ষমতার অপব্যবহারের একটির পর একটি ঘটনা 'এক্সপোজ', উন্মোচন করতে থাকেন। দুনিয়ার সবচাইতে ক্ষমতাধর ব্যক্তির ক্ষমতার এমন অপব্যবহার তখন, ১৯৭৩-৭৪ সালে সারা দুনিয়াতেই আলোড়ন সৃষ্টি করে।

তার আগে, ১৯৭১এ 'পেন্টাগন পেপার্স' যৌথভাবে প্রকাশ করেও 'ওয়াশিংটন পোস্ট' এবং 'নিউইয়র্ক টাইমস' নিক্সন প্রশাসনের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। 'ডেনিয়েল এলসবার্গ' নামের মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা ভিয়েতনাম যুদ্ধের উপর অনেকগুলো গোপন দলিল 'নিউইয়র্ক টাইমস' এবং 'ওয়াশিংটন পোস্ট'কে দিয়েছিলেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিন প্রশাসন যেমন ছলচাতুরি চালিয়ে আসছিল, তার বর্ণনা ছিল এই 'পেন্টাগন পেপার্স'এ। কিন্তু অনেক বেশি বড় ভূমিকম্প সৃষ্টি করেছিল নিক্সন প্রশাসনের 'ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি'।

'ওয়ারটারগেট' হচ্ছে ওয়াশিংটন শহরের একটি হোটেল। ১৯৬৮ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির মনোনয়ন নিয়ে রিচার্ড নিক্সন ডেমোক্রেটিক পার্টির মনোনীত প্রার্থী হিউবার্ট হামফ্রের বিপরীতে লড়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯৭২এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবালিকান পার্টি থেকে আবারও প্রার্থী হন তিনি। তাঁর বিপরীতে ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে এইবার তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জর্জ ম্যাক্গভার্ন।

ডেমোক্রেটিক পার্টির নির্বাচনী প্রচারণার জন্যে অফিস খোলা হয়েছিল 'ওয়াটারগেট' হোটেলে। এই হোটেলে ডেমোক্রেটিক পার্টি কী ধরনের নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছে, তা বের করে আনার জন্য কিছু সিঁধেল চোর ১৯৭২এর ১৭ জুন ওয়াটারগেট কমপ্লেক্সে ডেমোক্রেটিক পার্টির হেডকোয়ার্টারে ঢুকে পড়লে, হোটেলের সিকিউরিটি গার্ড 'ফ্রাঙ্ক উইলস'এর হাতে ধরা পড়ে।

এই অপরাধের বিচার শুরু হওয়ার পর যতসব ঘটনা উন্মোচিত হতে থাকে, তাতে এক পর্যায়ে দেখা গেল এমন অবৈধ কাজে প্রেসিডেন্ট নিক্সনেরও সম্মতি ছিল। আর তাতেই ক্ষোভে, আক্রোশে ফেটে পড়ল সারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই দেশটির লোকজন প্রশ্ন করতে থাকল, তাদের প্রেসিডেন্ট কী করে এমন একটি অবৈধ কাজ করতে পারেন? ধরা পড়ার পর নিক্সনের লোকজন বাঁচার জন্য একটির পর একটি মিথ্যার আশ্রয় নিতে থাকল; আর তাতে অপরাধের সংখ্যা এবং 'সিরিয়াসনেস'ও আরও বাড়তে লাগল।

২.

প্রেসিডেন্ট নিক্সন ১৯৭২এর ৩ নভেম্বর নির্বাচনে প্রত্যাশিতভাবে আবারও জিতলেন ঠিকই; প্রথাগত শপথও নিলেন তিনি ১৯৭৩এর ২০ জানুয়ারি। ১৯৭২এ চীন সফরে গিয়ে সারা দুনিয়াকে চমকেও দিলেন। তাঁর প্রশাসনের বৈদেশিক নীতিতে আরও বেশ কতগুলো বড় বড় সাফল্যও ছিল। তাঁর আমলেই ১৯৬৯এর জুলাইতে চাঁদে দুই আমেরিকান অবতরণ করলেন। আবার তাঁর আমলেই ১৯৭৩এর অক্টোবরে তৃতীয় আরব-ইসরাইল যুদ্ধ শুরু হয়, শেষও হয়।

কিন্তু দিন যতই যেতে থাকল, 'ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি' রিচার্ড নিক্সনকে গ্রাস করল। ১৯৭৪ সালে তাঁর বিরুদ্ধে মার্কিন কংগ্রেসে অভিশংসন বিল তোলা হল। ১৯৭৪এর জুলাই-আগস্টের দিকে যখন বুঝতে পারলেন, তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিশংসন মার্কিন কংগ্রেসে গৃহীত হতে যাচ্ছে, তখন চরম অবমাননা এড়াতে তিনি ১৯৭৪এর ৮ আগস্ট সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে পরদিন থেকে কার্যকর তাঁর পদত্যাগের ঘোষণা দিলেন।

রিচার্ড নিক্সন ১৯৫২ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইসেন হাওয়ারের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু ১৯৬০এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী জন এফ কেনেডির কাছে পরাজিত হন। পরে কালিফোর্নিয়ার গভর্নর পদেও কালিফোর্নিয়ার বর্তমান গর্ভনর জেরি ব্রাউনের বাবা প্যাট ব্রাউনের কাছে পরাজিত হন। পরপর দুইবার পরাজিত হওয়ার পর মার্কিনিরা ধরেই নিয়েছিল, রিচার্ড নিক্সনের রাজনৈতিক জীবনের অবসান ঘটেছে।

কিন্তু সকল জ্যোতিষী এবং হস্তরেখা বিশারদকে ভুল প্রমাণ করে ১৯৬৮তে তাঁর দীর্ঘ প্রত্যাশিত প্রেসিডেন্ট পদে জিতে আসেন নিক্সন। জিতে আসেন আবার ১৯৭২এ-ও। কিন্তু ধরে রাখতে পারেননি এই বিজয়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ-বিদ্বেষী এই মার্কিন প্রেসিডেন্ট। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে এই লোক এবং তাঁর নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার সরাসরি এবং খোলামেলাভাবেই আমাদের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন; খোলামেলাভাবেই পাকিস্তানের জেনারেল ইয়াহিয়া খানের 'বাঙালির গণহত্যা' সমর্থন করে গিয়েছিলেন।

৩.

এহেন নিক্সনকে হোয়াইট হাউজ থেকে তাড়ালেন 'উডস্টাইন' টিম। আর তাদের প্রবলভাবেই সমর্থন দিয়ে গেলেন পুরো দুটো বছর তাদের সম্পাদক বেঞ্জামিন ব্র্যাডলি। বেঞ্জামিন ব্র্যাডলিকেও সমর্থন দিতে থাকলেন 'ওয়াশিংটন পোস্ট'এর মালিক মিসেস ক্যাথরিন গ্রাহাম। মিসেস ক্যাথরিন গ্রাহামের স্বামী ফিল গ্রাহাম বেঞ্জামিন ব্র্যাডলিকে নির্বাহী সম্পাদক পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন ১৯৬৯ সালে। তবে ব্র্যাডলি এই পত্রিকায় আরও আগে থেকেই সাংবাদিকতা করছিলেন। শেষ পর্যন্ত পত্রিকাটির নির্বাহী সম্পাদকের পদ থেকে অবসর নেন ১৯৯২ সালে।

ব্র্যাডলি সম্পাদক থাকাকালে ১৯৮১তে তাঁর এই বিশ্ববিখ্যাত এবং বিশ্বনন্দিত পত্রিকা অন্য এক রিপোর্টারের কারণে সারা দুনিয়াতে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তীব্র ভাষায় নিন্দিতও হয়েছিল। জ্যানেট কুক নামের এক আফ্রিকান আমেরিকান তরুণী রিপোর্টার ওয়াশিংটনের 'জিমি' নামের এক শিশুর মাদকাশক্তির উপর এক রিপোর্ট লিখে 'পুলিৎজার' পুরস্কার জিতে নেয়। কিন্তু ওয়াশিংটন ডিসির মেয়রের লোকজন শিশুটির চিকিৎসার জন্য বাড়ি বাড়ি খুঁজেও এই শিশুকে পায় না।

তখন সন্দেহ জাগে, জ্যানেট কুক হয়তো পুরো 'জিমিস ওয়ার্ল্ড' স্টোরিটা ঘরে বসে, বানিয়ে বানিয়েই লিখেছে। কঠোর কঠোর সব প্রশ্নের মুখে জ্যানেট কুক তার অপরাধ স্বীকার করে। তারপর তাকে বরখাস্ত করা হয়। বেঞ্জামিন ব্র্যাডলি ফিরিয়ে দেন পুলিৎজার প্রাইজটি, নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেন ওয়াশিংটনের মেয়রের কাছে, ওয়াশিংটন সিটি কর্পোরেশনের লোকজনকে এমনভাবে হয়রানি হেনস্তা করার কারণে।

তারপরও বেঞ্জামিন ব্র্যাডলির মৃত্যুর পর তাঁকে 'লিজেন্ডারি এডিটর' হিসেবে বর্ণনা করে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন দুনিয়ার অনেকেই। শোক বার্তা দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। গত বছর এই লিজেন্ডারি এডিটরকে হোয়াইট হাউজে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে আমেরিকার সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার 'প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম'এ ভূষিত করেন ওবামা।

৪.

একজন নির্ভীক সম্পাদক এবং তাঁর দুই তরুণ সাংবাদিক সততা, দক্ষতা এবং নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে পতন ঘটিয়েছিলেন রিচার্ড নিক্সনের। অনেক হুমকি ভয়ভীতি ছিল তাঁদের প্রতি। কিন্তু কিছুই গ্রাহ্য করেননি তাঁরা। প্রফেশনের সর্বোচ্চ নীতিমালা অনুসরণ করে দায়িত্ব পালন করেছেন। আর সারা দুনিয়াতে সাংবাদিকদের 'রোল মডেল' হিসেবে নন্দিতও হয়েছেন।

বব উডওয়ার্ড এবং কার্ল বার্নস্টাইন যৌথভাবে 'অল দ্য প্রেসিডেন্টস মেন' শিরোনামের বইতে ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির ঘটনাসমূহ এবং এই প্রসঙ্গে তাদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। পরে এই বইটির উপর ১৯৭৬এ নির্মিত হয় ১৩৮ মিনিটের আর এক বিশ্বনন্দিত ছবি, 'অল দ্য প্রেসিডেন্টস মেন'। তাতে বব উডওয়ার্ডের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন রবার্ট রেডফোর্ড, কার্ল বার্নস্টাইনের ভূমিকায় ডাস্টিন হফম্যান; আর বেঞ্জামিন ব্র্যাডলির ভূমিকায় জ্যাসন রবার্ডস।

এই ছবিটি সেই বছরের বেশ কতগুলো অস্কার পুরস্কারও জিতে নেয়। তার মধ্যে একটি ছিল 'বেস্ট সাপোর্টিং অ্যাক্টর'এর। বেঞ্জামিন ব্র্যাডলির ভূমিকায় অভিনয় করে এই পুরস্কার পেয়েছিলেন জ্যাসন রবার্ডস। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের আরও অনেকগুলো পুরস্কারে ভূষিত হয় ছবিটি। আমেরিকার ১০০টি শ্রেষ্ঠ ছবির তালিকায় এই ছবিটি আছে ৭৭ নম্বরে।

ছবিটিতে দেখা যায়, এই দুই তরুণ সাংবাদিক, ছোট একটি তথ্যের জন্য কতসব জায়গায় যাচ্ছেন, কত সব মানুষের সঙ্গে কথা বলছেন, কত কত ঘণ্টা ব্যয় করছেন।

বয়স তখন তাঁদের ত্রিশের নিচে। জীবিত অবস্থায়, তা-ও যখন তারা একেবারেই তরুণ, 'ওয়াশিংটন পোস্ট'এ তাঁদের দুনিয়াকাঁপানো সাংবাদিকতা নিয়ে নির্মিত ওই ছবিটি তাঁদের দুনিয়াজোড়া খ্যাতি-সম্মান এনে দেয়। সারা দুনিয়ার লক্ষ লক্ষ সাংবাদিকের কাছে তাঁরা অনুসরণীয় মডেল হয়ে উঠেন। এখানে উল্লেখ করা যায় যে, বব উ্ডওয়ার্ড এখন 'ওয়াশিংটন পোস্ট' এর এসোসিয়েট এডিটর; তবে কার্ল বার্নস্টাইন কয়েক বছর পর 'ওয়াশিংটন পোস্ট'এর চাকরি ছেড়ে দেন। দুজনের বয়সই এখন সত্তরের কোঠায়।

বাংলাদেশে আমরা যখন এতসব ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছি, আমি আশা করি না আমাদের কোনো সম্পাদক বেঞ্জামিন ব্র্যাডলির মতো সাহস দেখাবেন বা 'উডস্টাইন' টিমের দুই সদস্যের মতো পরিশ্রমী এবং দায়িত্ব পালনে সচেতন থাকবেন। কিন্তু আমার ছোট প্রশ্নটি– আমাদের কয়জন সাংবাদিক বা সম্পাদক এদের উপর নির্মিত এই ছবিটি দেখেছেন?

আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, সরকার এবং বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতা আদায়ে বিকল্প কোনো কার্যকর ব্যবস্থার অবর্তমানে, আমাদের গণমাধ্যমই এখনও আমাদের দেশের উপেক্ষিত, নির্যাতিত, বঞ্চিত, শোষিত মানুষজনের শেষ ভরসা। উদাহরণ দিচ্ছি, একজন দুঃস্থ মুক্তিযোদ্ধা রিকশা চালিয়ে কোনোভাবে জীবনধারণ করে চলেছেন। এই খবরটি আমি দেখি পত্রিকার পাতায় বা টিভির খবরে। কিন্তু যে মুক্তিযোদ্ধা রিকশাচালক এমন এক জীবন-মরণ সংগ্রামে কোনোভাবে বেঁচে আছেন, ঐ এলাকায় তাঁর তো আছেন একজন ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য– শহর হলে ওয়ার্ড কমিশনার; তাঁর আছেন একজন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান– শহর হলে মেয়র; তারপর তাঁর আছেন একজন সংসদ সদস্য।

কিন্তু আজ এত বছরের গণতন্ত্রেও কোনো নির্বাচিত প্রতিনিধির এমন কোনো দুঃস্থ মুক্তিযোদ্ধা রিকশাচালক বা যৌতুকের জন্য নির্যাতিতা মহিলার পক্ষে এতটুকু ভূমিকা পালনের খবর কোথাও পড়িনি, টিভিতে দেখিনি বা কারও কাছে শুনিওনি। খাসজমি, নদী-নালা, বনবাদাড় দখলদার আমাদের এইসব নির্বাচিত প্রতিনিধিরা দলীয় ক্যাডার, শালা-শালি-সম্বন্ধী, আত্মীয়-স্বজন তোষণে এবং অবৈধ ব্যবসায়-বাণিজ্যের তরক্কীতে বেশি আগ্রহী এবং ব্যস্ত থাকেন।

ধর্ষিতা কোনো শিশু, কিশোরী বা নারীর পক্ষ নিয়ে সামান্য কিছু করতেও তো এদের দেখা যায় না। কোনো লঞ্চ বা স্টিমারডুবির পর ঘটনাস্থলে জড়ো হওয়া মৃতদের বিপন্ন আত্মীয়স্বজন, মা, বাবা, ভাইবোন, স্ত্রী– এদের জন্য শুধু খাবার পানি সরবরাহ করতে স্বেচ্ছাসেবক লীগ বা স্বেচ্ছাসেবক দলের কারও কোনো ভূমিকা তো আমি এই এত বছরে একবারও দেখ্লাম না।

কিন্তু এই ভূমিকাটা কাউকে না কাউকে তো পালন করতে হবে। এখানে, এই 'ভ্যাকুয়ামে' সাংবাদিকদের প্রবল উপস্থিতি এখনও মানুষজনকে কিছুটা হলেও 'রিলিফ' দেয়। আমাদের দেশের মানুষ বিপদে পড়লে তার নির্বাচিত প্রতিনিধিকে নয়, খোঁজে একজন সাংবাদিককে। তারা প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে, বিক্ষোভ দেখায়, ভিতরে প্রেস কনফারেন্স করে, পত্রিকা অফিসে যায় তাদের দুঃখ-কষ্ট বর্ণনা, অত্যাচার-নির্যাতনের কথা জানাতে। আমাদের দেশের এমনসব মানুষ বিশ্বাস করে, গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হলে অন্তত কিছুটা 'রিলিফ' পাওয়া যাবে। সরকার, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিরাও তখন জনমতের চাপে পড়েন।

এই যে ঝালকাঠির লিমন নামের ছেলেটিকে 'র‌্যাব' গুলি করে পঙ্গু করে দিল, তা তো আমরা জানলাম পত্রপত্রিকা, টিভি, রেডিওতে। তাকে যে মিথ্যা মামলাগুলো থেকে অব্যাহতি দেওয়া হল, তা-ও তো পত্রপত্রিকা, টিভি, রেডিওতে অব্যাহত অভিযানের কারণে। কিন্তু লিমন এবং তার মা'র এলাকায় তো একজন সংসদ সদস্যসহ অন্তত পাঁচ জন নির্বাচিত প্রতিনিধি আছেন। লিমনের জন্য তার এলাকার সংসদ সদস্য কি আদৌ কিছু করেছেন? তার নাম কি আমরা জানি? সেদিন নাটোরের বড়াইবাড়িতে যে ৩৬ জন নিরীহ মানুষ দুই বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত হল, ওখানকার সংসদ সদস্যের নাম কী? তিনি কি নিহত-আহত বাসযাত্রীদের জন্য কিছু করেছেন? সড়ক দুর্ঘটনা রোধে তার কি কোনো ভূমিকা আশা করা যায়?

এখানেই সম্পাদক, বার্তা সম্পাদকদের কাছে আমার একটি নতুন প্রস্তাব। যখনই এমন স্টিমার-লঞ্চ, ট্রেন, বাসের দুর্ঘটনা ঘটে, ঘটনাস্থলের এমপি, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, স্থানীয় রাজনৈতিক দল এবং তাদের অঙ্গ সংগঠনগুলোর নেতা-উপনেতাদেরও আহত-নিহতদের জন্য তাদের কে কী করেছেন জিজ্ঞাসা করতে আপনাদের রিপোর্টারদের নির্দেশ দিন। আমাদের সাংবাদিক, বার্তা সম্পাদক এবং সম্পাদকরাই এইসব নির্বাচিত প্রতিনিধি এবং তাদের দলের নেতা, উপনেতাদের জবাবদিহিতা আদায় করতে পারেন। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে খবরে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের বক্তব্য, মন্তব্য থাকে। কিন্তু থাকে না কোনো নির্বাচিত প্রতিনিধির।

বড়াইগ্রামে এতবড় একটি দুর্ঘটনা ঘটল, অথচ বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিকদের 'সর্দার' নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানের কোনো মন্তব্য কোনো পত্রিকায় বা টিভিতে দেখ্লাম না। অথচ 'খানসেনা'দের এই 'সর্দার'এর হুমকি, ধামকি, সন্ত্রাসের কারণে 'খানসেনা'দের কোনো রকমের নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে আনা যাচ্ছে না। বিআরটিসি বন্ধ করে দেওয়া এই 'সর্দার' শাজাহান খানের ঈমানের একটি অঙ্গ। তার 'খানসেনা'রা এমনকি 'নিরাপদ সড়ক চাই' আন্দোলনের প্রবক্তা ইলিয়াস কাঞ্চনকেও লাঞ্ছিত করেছে।

'সর্দার' শাজাহান খান একই সঙ্গে মন্ত্রী, সড়ক শ্রমিকদের 'সর্দার' এবং তিনি একজন বাসমালিকও। আমাদের যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সড়ক দুর্ঘটনা রোধে যতই ব্যবস্থা নিন না কেন, এককালের জাসদ সন্ত্রাসী 'সর্দার' শাজাহানের খানের ক্ষমতা এবং দাপট অনেক বেশি। ''তিনি মন্ত্রিসভায় থাকলে সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধ হবে কীভাবে''– আজ আমাকে প্রশ্ন করলেন দেশের একজন বিশিষ্ট সাহিত্যিক। তাকেও এখন মন্ত্রিসভা থেকে তাড়ানো 'ফরজ' হয়ে পড়েছে।

যে দেশে সাগর-রুনি দম্পতির হত্যারহস্য দুই-আড়াই বছরে একটুও এগোয় না, সেই দেশে বেঞ্জামিন ব্র্যাডলি বা বব উডওয়ার্ড এবং কার্ল বার্নস্টাইনের মতো 'সাহস প্রদর্শন' প্রত্যাশা করি না। আমাদের দেশের অনেক সাংবাদিক তো নিয়মিত বেতন-ভাতা বা নিয়োগপত্রই পায় না। সুতরাং তারা কেন এমনসব ঝুঁকি নেবে?

এমন সম্পাদক বা সাংবাদিক সারা দুনিয়াতেই-বা কয়জন আছেন? তারপরও বলি, সৎ সম্পাদক, সাংবাদিকরাই এখনও আমাদের দেশের মানুষজনের শেষ ভরসা।

'শিউলীতলা', উত্তরা; শুক্রবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১৪।

মহিউদ্দিন আহমদ: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সচিব, কলাম লেখক; শৌখিন মিডিয়া মনিটর।