মেধাস্বত্ব: একটি লোককাহিনীর আধুনিক পটভূমি

মনজুরুর রহমান
Published : 25 Jan 2011, 04:52 AM
Updated : 25 Jan 2011, 04:52 AM

স্রষ্টার কাজ সৃষ্টি করা। স্রষ্টা গভীর অভিনিবেশসহ তার মনন ও মেধাকে কাজে লাগিয়ে জীবনের শ্রেষ্ঠ কর্মটি সৃষ্টি করতে চান। তিনি কথাশিল্পী হোন আর সঙ্গীত শিল্পী বা চিত্রশিল্পী বা অন্য কোন সৃজনশীল কর্মের জনকই হোন না কেন। স্রষ্টার সব কর্মই যে সবসময় যথাযথ মানসম্পন্ন হবে বা কালোত্তীর্ণ হয়ে জনপ্রিয়তার শীর্ষ বিন্দুকে স্পর্শ করবে এমন নিশ্চয়তা কেউই তা কর্ম প্রকাশের আগে দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারেন না। আর সব সময় স্রষ্টার পক্ষে নিজের কর্ম প্রকাশের সঙ্গতি, সামর্থ বা ব্যবস্থাপনার যোগ্যতাও থাকে না। সে কারণেই সারা পৃথিবী জুড়ে প্রকাশকের গুরুত্ব অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।

২.
বইয়ের ক্ষেত্রে পুস্তক প্রকাশক, সঙ্গীতের ক্ষেত্রে ফনোগ্রাম প্রডিউসার, চিত্রকলার ক্ষেত্রে গ্যালারির মালিক যেন মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। একের সাহায্য ছাড়া অন্যপক্ষ স্থবির ও অচল। সারা পৃথিবীতেই স্রষ্টা-প্রকাশক সম্পর্ক পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সমঝোতা ও বিশ্বাসের বিষয়। স্রষ্টা ও ভোক্তার মাঝখানে প্রকাশক কাজ করেন সংযোগকারী হিসেবে। যে প্রকাশক প্রকাশনা বিষয়ে যত বেশি আন্তরিক ও দক্ষ তার হাত দিয়ে স্রষ্টার সৃষ্টি তত বেশি নান্দনিক ও আকর্ষণীয় হয়ে ভোক্তার কাছে উপস্থাপিত হয়। প্রকাশক অনেক সময় কাজ করেন ধাত্রী মায়ের মতো। কখনো কখনো নতুন স্রষ্টার কর্ম প্রকাশ করতে গিয়ে প্রকাশককে বড় মাপের ঝুঁকিও নিতে হয়। আবার প্রকাশকের সব লগ্নী সব সময় সাফল্যের মুখও দেখে না। তবু সৃষ্টিশীল কর্মের প্রতি তার আন্তরিকতা ও বাণিজ্যবোধের কারণে প্রকাশককে গ্রহণ করতে হয় নিত্য নতুন চ্যালেঞ্জ।

স্রষ্টা প্রকাশক সম্পর্ক তাত্বিক বিবেচনায় সর্বদা ইতিবাচক হওয়ার কথা থাকলেও স্বল্পন্নোত দেশগুলোতে অনেক সময় সে সম্পর্ক কাংখিত পর্যায়ে থাকে না। এ বিষয়ে স্রষ্টা বা লেখকবৃন্দ প্রকাশক সম্পর্কে প্রায়শই পোষণ করেন নেতিবাচক ধারণা।

পুস্তক প্রকাশনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এ পরিস্থিতি মোটেই সুখকর নয়। হাতে গোনা কয়েকজন জনপ্রিয় লেখক ছাড়া গ্রন্থ প্রকাশের পূর্বে প্রকাশকের কাছ থেকে অগ্রিম বা পরে রয়্যালিটি না পাওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে অধিকাংশ লেখকেরই। সব প্রকাশকই যে এমনটি করেন তাও নয়। কপিরাইট আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল প্রকাশকের সংখ্যাও হাতে গোনা;  বললে অত্যুক্তি হবে না যে, অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে খুঁজে বের করার মত পরিস্থিতি বর্তমান বাংলাদেশে বিরাজমান। দেশে এমন বহু প্রকাশক আছেন যারা লেখকের রয়্যালিটি প্রদান না করে প্রতি বছর তার ব্যবসার পরিধি সম্প্রসারণ করে চলেছেন। লেখকের রয়্যালিটি না দেয়ার পক্ষে প্রকাশকের যুক্তি ও অজুহাত বই বিক্রি না হওয়া, যা কপিরাইট ধারণার সম্পূর্ণ পরিপন্থি। এ ক্ষেত্রে কপিরাইট সম্পর্কিত জ্ঞানের দীনতা প্রকাশক কর্তৃক লেখকদের প্রতারিত হওয়ার ক্ষেত্রে প্রভূত ভূমিকা পালন করে।

সত্য কথা বলতে কী বাংলাদেশের লেখক প্রকাশক সম্পর্ক মোটেই গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে নেই। দু'পক্ষের মধ্যে এক ধরনের লুকোচুরি খেলা যেমন চলে, তেমনি অস্বচ্ছতাও বিরাজ করে অনেক সময়। লেখকের অজ্ঞতা ও উদাসীনতার কারণে অধিকাংশ প্রকাশক লেখকের সঙ্গে কোন ধরনের লিখিত চুক্তি করেন না। কত কপি বই প্রকৃত অর্থে প্রকাশক ছাপেন তার কোন গ্রহণযোগ্য প্রমাণ লেখক কোন দিনই দেখতে পারেন না। বছর শেষে লেখকের কোন বই কত কপি বিক্রি হয়েছে সে সংক্রান্ত তথ্য লেখককে জানানোর নিশ্চিত রীতি এখনো দেশে গড়ে ওঠেনি। অনেক সময় নিরীহ লেখক তার গ্রন্থ প্রকাশের আনন্দে বিভোর হয়ে রয়্যালিটি প্রাপ্তির বিষয়টি স্বপ্নেও কল্পনায় আনেন না! কবি বন্ধুদের কাছে শুনেছি শামসুর রাহমানের মতো সৃষ্টিশীল মানুষকেও বারংবার বঞ্চিত হতে হয়েছে রয়্যালিটি থেকে। প্রবাসী কিছু লেখক নামের মানুষ আছেন যারা একুশে বইমেলার কিছু আগে বিদেশে উপার্জিত অর্থ নিয়ে দেশে আসেন, সঙ্গে প্রকাশনার অযোগ্য পাণ্ডুলিপি! কথিত সেইসব লেখক অখ্যাত ও বিবেক বিবর্জিত প্রকাশকের এক হাতে পাণ্ডুলিপি আর অন্য হাতে তুলে দেন ডলার অথবা ঐ জাতীয় কোন বৈদেশিক মুদ্রা। বিনিময়ে প্রকাশক সেই গ্রন্থ প্রকাশ করেন। সংবাদও ফলাও করে প্রচার করা হয় প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায়। সেই বই খুব বেশি বাজার পায় না। লেখকই নিজের অর্থে কিনে নেন তার অধিকাংশ কপি। মেলা শেষে কথিত লেখক কিছু বই নিয়ে ফিরে যান প্রবাসে, লেখক নাম ধারণ করে! স্বচ্ছতার সঙ্গে এ বিষয়গুলোর সমাধান যতদিন না হবে ততদিন লেখক প্রকাশক হাসি মুখে পরস্পর শুভেচ্ছা বিনিময় করলেও মনে অবিশ্বাসের কাঁটা নিয়ে পথ চলবেন অনেক দূর!

৩.

বাংলাদেশে সঙ্গীতশিল্পী-পারফর্মার ও ফনোগ্রাম প্রডিউসার সম্পর্ক গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে আছে মর্মে বিশ্বাস করার কোন যৌক্তিক কারণ নেই। শিল্পীদের অভিযোগ: মেয়াদোত্তীর্ণ চুক্তি বলে শিল্পীদের বঞ্চিত করে প্রডিউসাররা ক্রমাগত অর্থ উপার্জন করছেন। অন্যদিকে ফনোগ্রাম প্রডিউসারদের দাবি কর্মের জন্য এককালীন বিপুল পরিমাণ অর্থ শিল্পীদের প্রদান এবং লগ্নীর পরও অস্তিত্ব বিনাশী লোকসানের ঘানি টানতে হচ্ছে তাদের।

উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, চুক্তিগুলো পরীক্ষা করলে দেখা যাবে দু'পক্ষের বক্তব্য ও চুক্তিতে ব্যবধান বিস্তর। অনেক ক্ষেত্রে আইনের শর্তও পূরণ করেনি চুক্তিগুলো। যেমন, স্বত্বনিয়োগের মেয়াদ কত দিনের হবে বা চুক্তির বলে উৎপন্ন পণ্য কোন্ ভৌগোলিক সীমায় বাজারজাত হবে তার কোনই উল্লেখ নেই; যদিও বাংলাদেশের কপিরাইট আইনের ধারা ১৯ এর উপ-ধারা ৫ ও ৬-এ বিষয়টি স্পষ্ট করে উল্লেখ রয়েছে । ফলে, অকার্যকর বেআইনী চুক্তির অজুহাতে কেউ কেউ একদা সৃষ্ট মধুর সম্পর্ক দিনের পর দিন তেতো করে চলেছেন। বিষয়টি নিয়ে উভয় পক্ষের ইতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করা জরুরি।

শিল্পী-পারফর্মার সমাজকে মনে রাখতে হবে , ফনোগ্রাম প্রডিউসার ছাড়া অনেক ভালো সঙ্গীতও মাঠে মারা যেতে পারে, অথবা ভোক্তা বঞ্চিত হতে পারেন উৎকৃষ্ট কোন মহৎ শিল্পভোগের অসীম আনন্দ থেকে। অন্যদিকে, ফনোগ্রাম প্রডিউসারকেও মনে রাখতে হবে, কেবল উন্নত মোড়ক আর আকর্ষণীয় লেবেল লাগিয়ে সঙ্গীত বিহীন তথাকথিত পণ্য বোদ্ধা ক্রেতার স্পর্শ থেকে বঞ্চিত হতে বাধ্য। সুতরাং পরস্পর নির্ভরযোগ্যতার বিষয়টি মাথায় রেখে উভয় পক্ষের কর্তব্য মীমাংসাযোগ্য সমস্যাগুলোর সম্মানজনক সমাধান দ্রুত নিশ্চিত করা!

৪.
পারস্পরিক স্বচ্ছতার জন্য তাই অপরিহার্য আইনানুগ কর্মকৌশল। স্বচ্ছতা বিষয়ে বাংলাদেশের কপিরাইট আইনে এ সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট বিধান না থাকলেও পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশের আইনে তা স্পষ্ট করে বলা আছে। উদাহরণ হিসেবে সুইডেনের The Copyright Act থেকে উদ্ধৃতি উপস্থাপনযোগ্য। বর্ণিত আইনের On Publishing Contracts শীর্ষক অধ্যায়ের 35 অনুচ্ছেদে প্রকাশনা চুক্তি সংক্রান্ত স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হয়েছে :

Article 35. The publisher shall provide the author with a certification from the printer of whoever else reproduces the work concerning the number of copies produced.

If during the fiscal year sales have taken place for which the author is entitled to remuneration, the publisher shall render account to him within nine months from the end of the year, stating the number of copies sold during the year and the number in stock at the end of the year. At his request, the author is also otherwise entitled to obtain a statement of the number in stock by the end of the year.১

সুইডিশ আইনের ইতিবাচক পদ্ধতিগুলো কি আমরা আমাদের কার্যক্রমে প্রতিফলিত করতে পারি না?

৫.
একুশে বইমেলার পূর্বে স্রষ্টা প্রকাশক সম্পর্ক সংকট তীব্রভাবে চোখে পড়ে। পারস্পরিক অভিযোগের পাল্লা ভারি হয়ে ওঠে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের অন্যতম উপায় দেশীয় আইন ও আন্তর্জাতিক রীতি-নীতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তা বাস্তবায়নের ইতিবাচক উদ্যোগ গ্রহণ করা। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কপিরাইট আইনের ১৯ ধারার বিধান প্রতিপালন করা হলে অবস্থার প্রভূত উন্নতি সাধন সম্ভব। অথচ কপিরাইট আইনে কম গুরুত্বহীন বিধান (ধারা ৬২) যেমন-প্রকাশিত গ্রন্থের কপি জাতীয় গ্রন্থাগারে জমা দিয়ে রশিদ সংগ্রহের বাধ্যবাধকতা একুশের বই মেলায় স্টল প্রাপ্তির বিষয়ে অন্যতম শর্ত হিসেবে যুক্ত করা হয়। জাতীয় গ্রন্থাগারে বই জমা হলে লেখকের মর্যাদা বা রয়্যালিটি প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত হয় না। কিন্তু ১৯ ধারার বিধান প্রতিপালন করা গেলে লাজুক লেখক বিপুলভাবে তার অধিকার অর্জনের আইনানুগ ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে দুষ্ট প্রকাশকদের প্রতিহত করতে পারেন। মেলা হয়ে উঠতে পারে মেধাস্বত্ববান।

সম্প্রতি দেশের স্বনামখ্যাত একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের বিরূদ্ধে তীব্রভাবে লিখিত অভিযোগ এসেছে লেখকদের রয়্যালিটি না দেয়ার ও অসৌজন্যমূলক আচরণের। মেলা কমিটির সভায় উপস্থিত একজন প্রকাশকের বক্তব্য থেকে জানা যায়, সর্বজন শ্রদ্ধেয় বিচারপতি হাবিবুর রহমান ও প্রফেসর ড. রফিকুল ইসলামের মত ব্যক্তিবর্গের সঙ্গেও ঐ প্রতিষ্ঠানের আচরণ শোভন নয়। লেখকদের সম্মিলিত স্বার্থ দেখার নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের অভাবের কারণে এ অবস্থার উদ্ভব হয়েছে মর্মে বিশ্বাস করার যৌক্তিক কারণ বিদ্যমান।

একুশের বইমেলা একুশের চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। স্রষ্টা-প্রকাশক তাদের নিজ নিজ অবস্থানে থেকে স্ব স্ব অধিকার যথাযথ প্রাপ্ত হবেন এটাই কাঙ্ক্ষিত এবং একুশের চেতনার সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ। কিন্তু স্রষ্টার মেধার ফসল ব্যবহার করে উৎপাদিত গ্রন্থের সমূদয় আর্থিক সুবিধা কেবল উৎপাদকের পকেটে যাবে তা কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে  না। এ প্রসঙ্গে লোককাহিনীর সেই কুমীর ও শেয়ালের গল্প মনে পড়ে যায় : কোন এক নদীর চরে একদিন দেখা হয় এক চতুর শিয়াল ও এক বোকা কুমীরের। অনেকদিন একই এলাকায় বসবাসের কারণে দু'জনের নিবিড় সখ্য গড়ে ওঠে। দু'বন্ধুর আলোচনায় ঠিক হয় চাষাবাদ করে ফসল উৎপাদন করে লাভবান হবে। বুদ্ধিমান শিয়াল প্রস্তাব করলো আলু চাষ করার। সিদ্ধান্ত হলো উৎপাদিত ফসলের ওপরের অংশ পাবে কুমীর আর নিচের অংশ শিয়াল। ফসল ঘরে তোলার সময় হলে শেয়াল তার প্রাপ্ত অংশ নিয়ে আনন্দিত হলো, মন খারাপ হলো কুমীরের।

কুমিড়ের অবস্থা দেখে চতুর শিয়াল নতুন প্রস্তাব নিয়ে এলো:এবার চাষ হবে ধান। নিচের অংশ যাবে কুমীরের ঘরে আর ওপরের অংশ পাবে শিয়াল। বঞ্চনার কষ্ট ভুলে বোকা কুমীর আনন্দিত হয়ে কঠোর শ্রমে উৎপাদন করলো ধান। যথাসময়ে সোনালী ধান কাটা হলো। ওপরের অংশ চলে গেল শিয়ালের গোলায়। কুমীরের ভাগের খড়-নাড়া পড়ে রইলো মাঠে। বোকা কুমীর উপলব্ধি করলো তার বঞ্চনার বাস্তবতা; ধূর্ত শিয়ালের ক্রমাগত ঠকানোর অপকৌশল। বিরত হলো তৃতীয় কোন যৌথ উৎপাদনে যেতে।

৬.

স্রষ্টা সম্প্রদায় বেশিদিন বঞ্চিত হতে থাকলে বাংলাদেশে নতুন কোন আধুনিক লোককাহিনীর সৃষ্টি হতেও পারে!

১.Henry Olsson, the Copyringt System in Sweden: The Copyright Act, the Ministry for Justice, Stockhome, 2008..

মনজুরুর রহমান : লেখক এবং  কপিরাইট রেজিস্ট্রার।