দুটি জনমত জরিপ ও পৌরসভা নির্বাচন এবং ভুল বনাম বাস্তবতা

শফিক রেহমান
Published : 23 Jan 2011, 05:44 PM
Updated : 23 Jan 2011, 05:44 PM

দেশের দু'টি দৈনিক পত্রিকা, প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টার, দু'টি ভিন্ন জনমত জরিপ একই দিন, ৬ জানুয়ারি ২০১১-তে প্রকাশ করে। দু'টি পত্রিকাই তাদের প্রথম পৃষ্ঠায় বড়ভাবে এই জনমত জরিপ দু'টির সারাংশ প্রকাশ করে। দু'টি জরিপের বিস্তারিত রিপোর্ট গ্রাফিক্সসহ তারা প্রকাশ করে দু'টি ট্যাবলয়েড সাইজ ক্রোড়পত্রে। সারা দেশের পৌরসভার মেয়র ও কাউন্সিলর নির্বাচনের মাত্র পাঁচদিন আগে প্রকাশিত এই দু'টি জরিপ সঙ্গত কারণে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল, প্রার্থী, কর্মী, সমর্থক এবং ভোটার মহলে কৌতূহল সৃষ্টি করে। প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারের ওই দু'টি জরিপের মূল কথা কী ছিল এবং ১১ জানুয়ারি থেকে ১৮ জানুয়ারি ২০১১ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত পৌরসভা নির্বাচনের মূল ফলাফলের মধ্যে কী বিশাল পার্থক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সে বিষয়ে এখন ভোটার মহলে কৌতূহল উদ্দীপক আলোচনা চলছে। ভোটার মহল মনে করছে, বাস্তব ফলাফল হয়েছে খুবই ভিন্ন, সেহেতু এই দুটি জরিপের প্রকৃত লক্ষ্য কী ছিল সেটা গভীরভাবে বিবেচনা করা উচিত।

সাপ্তাহিক যায়যায়দিনে জনমত জরিপের সূচনা

এই বিষয়ে আলোচনার আগে আমি বিনয়ের সঙ্গে জানাতে চাই বাংলাদেশে রাজনৈতিক জনমত জরিপ সম্ভবত প্রথম সূচনা করেছিল সাপ্তাহিক যায়যায়দিন ১৮ মার্চ ১৯৮৬-তে। তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট হোসেন মোহাম্মদ এরশাদ ঘোষিত ৭ মে ১৯৮৬-র সাধারণ নির্বাচন বিষয়ে তখন খুব সহজ প্রশ্ন ভোটারদের করা হয়েছিল। মোট ১৫টি প্রশ্ন সংবলিত প্রশ্নমালা দু'টি ভিন্ন রংয়ের কাগজে সারা দেশব্যাপী ৭০০ রিডার্স রাইটস কমিটির (যায়যায়দিনের পাঠক সংঘ) ৭০,০০০ সদস্যকে পাঠানো হয়েছিল। তখন যায়যায়দিনের বিক্রিত কপির সংখ্যা ছিল প্রায় দেড় লক্ষ। শাদা প্রশ্নমালায় কমিটির সদস্যরা (অর্থাৎ যায়যায়দিনের পাঠকরা) উত্তর দেন এবং রঙিন প্রশ্নমালায় যারা যায়যায়দিনের পাঠক নন তাদের কাছ থেকে কমিটির সদস্যরা উত্তর সংগ্রহ করেন।
দু'টি ভিন্ন উত্তরের অর্থাৎ, পাঠকদের এবং যারা পাঠক নন তাদের ফলাফল ১৮ মার্চ ১৯৮৬-তে যায়যায়দিনে প্রকাশিত হয়েছিল। এই দু'টি ফলাফল বিষয়ে সম্পাদকীয় মন্তব্য ছিল, 'আমরা জানি কোনো জনমত জরিপই সম্পূর্ণভাবে সঠিক হতে পারে না। সুতরাং এই জরিপের ফলাফল যে জনমতের সম্পূর্ণ সঠিক প্রকাশ তেমন দাবি আমরা করবো না। তবে যেহেতু এই জরিপটি রিডার্স রাইটস কমিটির সহযোগিতায় পরিচালিত হয়েছে সেহেতু এটি হয়েছে দেশব্যাপী এবং এতে অংশগ্রহণ করেছেন বিভিন্ন বয়স ও পেশার ব্যক্তিরা। অবশ্য এই জরিপের একটি প্রধান সীমাবদ্ধতা হচ্ছে যে এতে কৃষক ও দিনমজুর কমই অংশ নিয়েছেন। আমরা আশা করছি ভবিষ্যতের জনমত জরিপে এই দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে।'

কিন্তু এর চার মাস পরেই যায়যায়দিন নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ায় এবং আমাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়ার ফলে আশির দশকে আর কোনো জনমত জরিপ করা সম্ভব হয়নি। ১৯৮৬-তে বাংলাদেশে কম্পিউটার প্রযুক্তি ছিল খুবই সীমাবদ্ধ। দেশের শীর্ষস্থানীয় চার্টার্ড একাউন্টেন্টস ফার্ম, রহমান রহমান হক-এ একটিও কম্পিউটার ছিল না। আমি তখন ওই ফার্মের সিনিয়র পার্টনার ছিলাম এবং রাজনৈতিকভাবে সচেতন আর্টিকলড ক্লার্কদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল। তাদের মধ্যে প্রায় পঞ্চাশজন আমার বাড়ির বিভিন্ন রুমে গ্রুপে গ্রুপে দুই দিন দুই রাত ধরে দূর দূরান্ত থেকে পাঠানো হাজার হাজার খাম খুলে উত্তরমালাগুলো দুই রংয়ে ভাগ করে ট্যাবুলেশনে অংশ নেন। আজ এই মুহূর্তে আমার সেই সব প্রিয় আর্টিকলড ক্লার্ক, যাদের প্রায় সবাই এখন জীবনে প্রতিষ্ঠিত, তাদের জানাচ্ছি আন্তরিক শুভেচ্ছা। এই জরিপে সহযোগিতা করেছিলেন বাংলাদেশ ডাক বিভাগের কর্মচারীরা। প্রতিটি রিটার্ন খামের ওপর আমরা রাবার স্ট্যাম্পে লিখেছিলাম 'জনমত জরিপ, দ্রুত প্রাপককে পৌছে দিন।' ডাক বিভাগের কর্মচারিরা আমাদের এই ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন। তারা অতি দ্রুত উত্তরমালাগুলো আমাদের অফিসে পৌছে দিয়েছিলেন। তখন কুরিয়ার সার্ভিস ছিল না। তাই জরিপের জন্য প্রয়োজনীয় বিশাল স্যাম্পলের জন্য প্রয়োজন ছিল হাজার হাজার উত্তরমালার। আজ এই মুহূর্তে আগাম পোস্টাল সার্ভিসের সেইসব গণতন্ত্রপ্রেমিক কর্মচারীদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

এই বিষয়টির উল্লেখ করলাম এই জন্য যে ধর্ম, ভাষা, খাবার অভ্যাস, পোশাক প্রভৃতি বিষয়ে বাংলাদেশ খুবই হোমোজেনিয়াস (Homogeneous) দেশ হলেও অর্থনৈতিক কারণে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের জীবনযাত্রার ধরন হোমোজেনাস নয়। তাই এই দেশের সঠিক জনমত জরিপের জন্য প্রয়োজন বড় স্যাম্পল এবং সেটা তখন সম্ভব হয়েছিল অনেক ট্যাবুলেটর, বহু উত্তর সংগ্রাহক এবং ডাক বিভাগীয় কর্মচারীদের শ্রম ও দক্ষতার ফলে। এর গুরুত্বটা যে কি সেটা পাঠকরা একটু পরেই বুঝবেন। মার্চ ৮৬-র সেই জরিপের ফলাফল কতটুকু সঠিক ছিল সেটা জানা যায়নি। কারণ খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সেই নির্বাচন বয়কট করেছিল।
তবে, ইনটারেস্টিং বিষয় এই যে, ওই জরিপের ১৫ নাম্বার বা শেষ প্রশ্নটি ছিল :
আপনার মতে বর্তমান সরকার (এরশাদ সরকার) কীভাবে ক্ষমতাচ্যুত হবে?

এর সম্ভাব্য তিনটি উত্তর ছিল নির্বাচন, বিপ্লব (গণ অভ্যুত্থান) ও অন্যান্য।
উত্তর ছিল :
পাঠক অ-পাঠক
নির্বাচন ১৫% ২০%
বিপ্লব (অভ্যুত্থান) ৫৯% ৬২%
অন্যান্য ২৬% ১৮%

সেই মার্চ ৮৬-র জরিপের ফলাফল শেষ পর্যন্ত সঠিক প্রমাণিত হয়েছিল প্রায় পৌনে পাঁচ বছর পরে ডিসেম্বর ১৯৯০-এ যখন একটি গণঅভ্যুত্থানে প্রেসিডেন্ট এরশাদ ক্ষমতাচ্যুত হন।

প্রসঙ্গত আরো উল্লেখ করা যেতে পারে ৮ অক্টোবর ১৯৮৪-তে সাপ্তাহিক যায়যায়দিন তার যাত্রা শুরু করার পর সেই বছরেই পাঠকদের প্রতি আহ্বান জানায়, টেলিভিশনের শ্রেষ্ঠ কলাকুশলীদের নির্বাচিত করতে। তাদের এই ভোটাভুটির ফলাফল ঘোষিত হয় মার্চ ১৯৮৫-তে শেরাটন হোটেলে অনুষ্ঠিত একটি ফাংশনে যেখানে উপস্থিত ছিলেন তদানীন্তন অন্যতম বিরোধী নেত্রী শেখ হাসিনা। বস্তুত ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৬ পর্যন্ত যায়যায়দিনের পাঠক ও কর্মীরা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন নিয়মিত জরিপ কাজে। আর সেজন্যই কম্পিউটার অনুপস্থিতি ও আর্থিক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও মার্চ ৮৬-র বিশাল জনমত জরিপটি করা সম্ভব হয়েছিল।

স্পেকট্রাম রেডিও-তে প্রতি সপ্তাহে জনমত জরিপ

আগস্ট ১৯৮৬-তে আমাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়া হয় লন্ডনে। সেই সময়ে বৃটেনে রাষ্ট্রীয় রেডিও-টিভি প্রতিষ্ঠান বিবিসি এবং বেসরকারি কয়েকটি টিভি প্রতিষ্ঠান চালু থাকলেও সেখানে বেসরকারি রেডিও প্রতিষ্ঠান ছিল না। ফেব্রুয়ারি ১৯৮৭ থেকে আমি এবং আরো কিছু উৎসাহী ব্যক্তি বৃটেনে প্রাইভেট রেডিও স্টেশন চালু করার লক্ষ্যে কাজ করতে থাকি মার্গারেট থ্যাচার ছিলেন তখন বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী এবং আমার এলাকা, উত্তর লন্ডনে ফিঞ্চলি-র এমপি। আমাদের লক্ষ্য অর্জিত হয় ২৫ জুন ১৯৯০-এ। সেই দিন থেকে বৃটেনের প্রথম (এবং এখনো একমাত্র) বহুভাষাভিত্তিক বেতার কেন্দ্র স্পেকট্রাম রেডিও তার যাত্রা শুরু করে উত্তর লন্ডনে ব্রেন্ট ক্রস-এ। এই রেডিও স্টেশনের প্রতিষ্ঠাতা, ফাইনান্স ডিরেক্টর চিফ একজিকিউটিভ অফিসার (সিইও) হিসেবে কাজ করতে গিয়ে আমি আবার জড়িত হই জনমত জরিপের কাজে। তবে এবার জরিপের কাজটি করেন বৃটেনের দি জয়েন্ট ইনডাস্টৃ কমিটি ফর রেডিও অডিয়েন্স রিসার্চ (সংক্ষেপে জিকরার, JICRAR)। স্পেকট্রাম রেডিওতে তখন বাংলা, হিন্দি, উর্দু, চায়নিজ, ইটালিয়ান, পর্টুগিজ সহ ১৫টির বেশি ভাষায় অনুষ্ঠান প্রচারিত হতো। আমরা জানতে চাইতাম কোন ভাষার অনুষ্ঠান এবং কোন অনুষ্ঠান শ্রোতারা বেশি শুনছে। প্রতি সপ্তাহে এই জরিপ কাজ করতো জিকরার। তাদের রিপোর্টের ওপর নির্ভর করতো রেডিও স্টেশনের বিজ্ঞাপন প্রাপ্তি ও তার হার। এই সময়ে জনমত জরিপের আধুনিকতম পদ্ধতি ও তার ইতিহাসের সঙ্গে আমি পরিচিত হই।

জনমত জরিপের সূতিকাগার আমেরিকা

বিভিন্ন সূত্রের মতে জনমত জরিপের সূচনা হয় ১৯২৪-এ আমেরিকাতে। সেই সময়ে দি হামসবার্গ পেনসেলভিনিয়ান পত্রিকা একটি স্থানীয় জরিপের পর জানায় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদ নির্বাচনে দুই জন প্রার্থীর মধ্যে অ্যানড্রু জ্যাকসন এগিয়ে আছেন জন কুইন্সি অ্যাডামসের চাইতে। জরিপে জ্যাকসনের পক্ষে পড়েছে ৩৩৫ ভোট। আর অ্যাডামসের পক্ষে পড়েছে ১৬৯। এই ধরনের ছোট স্যাম্পল ও স্থানীয় জনমত জরিপ, যাকে বলা হয় স্ট্র পোল (Straw Poll) সাধারণত শহরেই করা হতো। ১৯১৬-তে লিটারারি ডাইজেস্ট পত্রিকা তাদের সার্কুলেশন বাড়ানোর লক্ষ্যে দেশব্যাপী জরিপ করে এবং সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী করে যে উডরো উইলসন প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হবেন। এই জরিপ কাজের জন্য লিটারারি ডাইজেস্ট কয়েক লক্ষ পোস্টকার্ড দেশ জুড়ে পোস্ট করেছিল এবং যেসব পোস্ট কার্ডে উত্তর এসেছিল সেসব হাতে গোনার ভিত্তিতে ফলাফল ঘোষণা করেছিল। লক্ষ্য করুন, ৭০ বছর পরে যায়যায়দিন-ও প্রায় একইভাবে জরিপ কাজ সম্পন্ন করেছিল। এরপর চারটি প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচনে লিটারারি ডাইজেস্ট জনমত জরিপের মাধ্যমে সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল।

১৯৩৬-এ লিটারারি ডাইজেস্ট ফেসে যায়। তাদের জরিপে ২৩ লক্ষ 'ভোটার' অংশ নেয় এবং এটা ছিল বিশাল স্যাম্পল। কিন্তু এই ভোটাররা প্রায় সবাই ছিল সচ্ছল শ্রেণীর এবং রিপাবলিকান পার্টির সমর্থক। ইলেকশনের এক সপ্তাহ আগে লিটারারি ডাইজেস্ট রিপোর্ট করে ডেমক্রেট প্রার্থী ফ্র্যাংকলিন রুজভেল্ট-এর চাইতে রিপাবলিকান প্রার্থী আলফ লন্ডন বেশি জনপ্রিয়। একই সময়ে জর্জ গ্যালাপ অনেক ছোট স্যাম্পল কিন্তু বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে একটি জরিপ কাজ করেন। গ্যালাপের এই জরিপে অংশগ্রহণকারীরা দেশের জনগোষ্ঠির প্রতিনিধিত্বমূলক ছিল। রুজভেল্ট যে বিপুল ভোটে বিজয়ী হবেন সেটা গ্যালাপ আগেই সঠিক বলেছিলেন। এরপর লিটারারি ডাইজেস্ট-এর জরিপ কাজ শেষ হয়ে যায়। পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। লক্ষ্য করুন ৭৫ বছর পরে লিটারারি ডাইজেস্ট-এর মতোই ৬ জানুয়ারি ২০১১-তে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার একই ভুল করেছে। তবে আলো-স্টার বন্ধ হয়ে যাবে না। তাদের খুটি আপাতত অনেক শক্ত।

বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে জনমত জরিপে এগিয়ে আসেন আরো একজন আমেরিকান, এলমো রোপার। প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাংকলিন রুজভেল্ট ১৯৩৬, ১৯৪০ ও ১৯৪৪-এ যে আবারও নির্বাচিত হবেন, সেটা পরপর তিনবারই এলমো রোপার সঠিক ফোরকাস্ট করেছিলেন। ১৯৪৭ থেকে লুইস হ্যারিস নামে আরেক আমেরিকান বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে জরিপ শুরু করেন। পরে তিনি এলমো রোপারের ফার্মে যোগ দেন।
ইতিমধ্যে জর্জ গ্যালাপ তার সাবসিডিয়ারি অফিস খোলেন বৃটেনে। ১৯৪৫-এ গ্যালাপ সঠিক ফোরকাস্ট করেন যে লেবার পার্টি বিজয়ী হবে। সেই সময়ে অন্য সবাই ফোরকাস্ট করেছিলেন, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের হিরো, উইনস্টন চার্চিলের নেতৃত্বে টোরি পার্টি নির্বাচনে জিতবে। ফলে গ্যালাপের বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়। বৃটেনে জনমত জরিপ একটা নিয়মিত বিষয় হয়।
কিন্তু আমেরিকা ও বৃটেনে কয়েকটি সময়ে জনমত জরিপ ভুল ফোরকাস্ট করেছিল। যেমন, আমেরিকায় ১৯৪৮-এ ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল, ডেমক্রেট হ্যারি ট্রুম্যান হারবেন ও রিপাবলিকান প্রতিদ্বন্দ্বী টমাস ডুইয়ি বিশাল ভোটের ব্যবধানে জিতবেন। এই ফোরকাস্ট করেছিলেন গ্যালাপ এবং রোপার-ও। কিন্তু জিতেছিলেন হ্যারি ট্রুম্যান।
ঠিক তেমনি বৃটেনে ১৯৭০-এ টোরি পার্টি এবং ১৯৭৪-এ লেবার পার্টি যে জিতবে সেটা জনমত জরিপকারীরা বলতে পারেনি। ১৯৯২-এ প্রায় সব ওপিনিয়ন পোল বলেছিল নিল কিনোক-এর নেতৃত্বে লেবার পার্টি বিজয়ী হবে। কিন্তু সেই নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিল জন মেজরের নেতৃত্বে টোরি পার্টি। এই কয়েকটি ভুল বাদ দিলে সাম্প্রতিক কালে আমেরিকা ও বৃটেনে জনমত জরিপ সঠিক ফোরকাস্ট করেছে।

গ্যালাপের সাজেশন

এরশাদের পতনের পর ১৯৯২-এ আমি স্বদেশে ফিরে এসে সাপ্তাহিক যায়যায়দিন পুনঃপ্রকাশ করি এবং আবার পাঠকের মাধ্যমে জনমত জরিপ শুরু করি রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক বিষয়ে। এক পর্যায়ে জরিপ কাজকে পত্রিকার বায়াস বা প্রভাবমুক্ত করার লক্ষ্যে সোশাল সার্ভে নামে একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান চালু করি। সোশাল সার্ভে পরিচালিত জরিপ কাজ যেন বিজ্ঞানসম্মত হয় সেই লক্ষ্যে আমি গ্যালাপ ইন্টারন্যাশনাল-এর তৎকালীন প্রধান কর্মকর্তা মিজ জেমস মেরিল-এর সঙ্গে ইস্ট এন্ড, লন্ডনে দেখা করি।
মিজ মেরিল আমাকে খোলাখুলিভাবে বলেন, গ্যালাপ ইন্টারন্যাশনালের ৯০% আয় হয় অরাজনৈতিক জরিপ কাজ থেকে। যেমন, কোকা কোলা মানুষ বেশি খায়, নাকি পেপসি কোলা? যদি কোকা কোলা বেশি খায় তাহলে তার কারণগুলো কী? স্বাদ? দাম? ক্যানের ডিজাইন ও রং? প্রাপ্তির সুবিধা? অথবা, কেএফসি বেশি জনপ্রিয় নাকি, পিৎজা হাট? কেন? ভোক্তারা কি বেশি মাংসাশী নাকি নিরামিষভোজী? ইত্যাদি। শুধু প্রডাক্টই নয়। মিজ মেরিল জানান, লন্ডনে হিথরো এয়ারপোর্ট সম্প্রসারণে হিথরো ও পার্শ্ববর্তী এলাকার জনমত কী সে বিষয়েও জরিপ কাজ হয়েছে। ওই সময়ে শব্দ দূষণের জন্য হিথরোর পাশের এলাকার মানুষ হিথরো এয়ারপোর্ট সম্প্রসারণের বিরোধিতা করছিল এবং বৃটিশ সরকার জানতে চাইছিল তাদের মতামত। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার আড়িয়াল বিলে বঙ্গবন্ধু এয়ারপোর্ট নির্মাণ কাজে হাত দেয়ার আগে এ রকম একটা জনমত জরিপ করবে কি? সে যাই হোক। মিজ মেরিল বলেন, ওপিনিয়ন পোল প্রতিষ্ঠানগুলোর সাধারণত এই ধরণের গভর্নমেন্ট কন্ট্রাক্ট অথবা মাল্টি ন্যাশনাল কম্পানিগুলোর প্রডাক্ট ও মার্কেটিং বিষয়ে জরিপের কাজ থেকে লব্ধ আয়ই প্রধান। রাজনৈতিক জরিপ কাজ থেকে আয় হয় কম এবং তা-ও সেই আয়ের বেশির ভাগ হয় প্রাক-নির্বাচন সময়ে। মিজ জেমস বলেন, বাংলাদেশে যেহেতু মালটিন্যাশনাল কম্পানি ও সরকারের পক্ষে জরিপ কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা কম, সেহেতু জরিপকারী প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িকভাবে সফল হওয়ার সম্ভাবনাও কম। তাই গ্যালাপ ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে কোনো ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। সাপ্তাহিক যায়যায়দিন জরিপ কাজ বন্ধ করে দেয়।
নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে বাংলাদেশের কিছু দৈনিক পত্রিকা জরিপ কাজ শুরু করে। তবে এসবই মূলত পাঠকদের মতামত জরিপ। ফলে এসব জরিপ শুধু পত্রিকার প্রভাবাধীন পাঠকদেরই মতামত জরিপ হয়, প্রভাবমুক্ত দেশবাসীর মতামত জরিপ হয় না। তাই এসব জরিপ সমাজের আংশিক মতামত প্রকাশ করতে পারে এবং এগুলো নির্ভরযোগ্য হয় না।

বড় স্যাম্পল

তবে বাংলাদেশে ১৯৯৫ থেকে জনমত জরিপ কাজ চালিয়ে যেতে থাকে ডেমক্রেসিওয়াচ নামে একটি এনজিও। তাই প্রতিষ্ঠানটি কিছু স্ট্যাটিসটিশিয়ানকে নিয়োগ দিয়ে একটি রিসার্চ টিম গঠন করে। তাদের ট্রেইনিং দেয়া হয়। এই টিম গ্যালাপ নীতিমালা অনুসরণ করে কয়েকটি জরিপ কাজ করে। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল জুন ২০০১-এ ঢাকা শহরে (পিপিআরসি-র সহযোগিতায়) এবং সেপ্টেম্বর ২০০১-এ দেশব্যাপী জনমত জরিপ।
অক্টোবর-এর সাধারণ নির্বাচনের আগে সেপ্টেম্বর ২০০১-এর জনমত জরিপে ডেমক্রেসিওয়াচের স্যাম্পল ছিল ৫,০০০। মুখোমুখি প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে এই জরিপ সম্পন্ন হয়েছিল। ডেমক্রেসিওয়াচের এই জনমত জরিপে রিপোর্ট করা হয়েছিল আসন্ন নির্বাচনে বিএনপি জোট ৪২% ভোট পাবে। অক্টোবরের নির্বাচনে বিএনপি মোট ৪৭% ভোট পেয়ে বিজয়ী হয় এবং ডেমক্রেসিওয়াচের ফোরকাস্ট সঠিক প্রমাণিত হয়।
ওই নির্বাচনের আগে শোনা গিয়েছিল একাধিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ কয়েকটি জরিপ করিয়েছে এবং প্রতিটি জরিপেই আওয়ামী লীগের জয় ফোরকাস্ট করা হয়েছিল।
ডেমক্রেসিওয়াচের ফোরকাস্ট সঠিক হওয়ার কারণ ছিল : বড় স্যাম্পল (৫,০০০ ভোটার), জনগোষ্ঠির সঠিক প্রতিফলন, সহজ প্রশ্নমালা এবং প্রশিক্ষিত জরিপকারী। এখানে উল্লেখ করা উচিত, তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার, বিভিন্ন দূতাবাস, ডোনার এজেন্সি ও কয়েকটি রাজনৈতিক দলকে ডেমক্রেসিওয়াচ তাদের জরিপের রিপোর্ট দিলেও, বিভিন্ন কারণে এটি তারা প্রকাশ করেনি। এরপর নির্বাচনী অভিযানের সময়ে টেলিভিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নির্বাচন সম্পর্কিত প্রচারিত খবর এবং আলোচনার ওপর ডেমক্রেসিওয়াচ একটি জরিপ করে।

২০০০ সাল থেকে কম্পিউটার ব্যবহার প্রসারিত হবার ফলে বাংলাদেশে ক্রমেই বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় অনলাইন জরিপ প্রকাশিত হতে থাকে। তবে আগেই বলেছি এ সব জরিপ, পত্রিকার নিজস্ব পাঠককুলের জরিপ। এ ছাড়াও শোনা যায় ডিজিএফআই, এনএসআই, কিছু দূতাবাস ও কিছু রাজনৈতিক দল ও সংস্থা, বিভিন্ন সময়ে জনমত জরিপ করছে যার ফলাফল শুধু সরকারকে জানানো হয়।

নির্বাচনের ওপর জরিপের প্রভাব

৬ জানুয়ারি ২০১১-তে প্রকাশিত জনমত জরিপ দু'টি করেছে (১) প্রথম আলোর উদ্যোগে ওআরজি-কোয়েস্ট রিসার্চ লিমিটেড এবং (২) ডেইলি স্টারের উদ্যোগে এসি নিলসেন। এই দু'টি জরিপ সম্পর্কে বলার আগে প্রাসঙ্গিক কিছু তথ্য পাঠকদের দিতে চাই।
লন্ডনের ডেইলি মেইল পত্রিকার কলামিস্ট পিটার হিচেন্স তার বই দি ব্রোকেন কমপাস (The Broken Compass বা ভাঙ্গা কমপাস)-এ লিখেছেন, মানুষ তাদের ভোট কাকে দেবে সেই মনোভাব জনমত জরিপের মাধ্যমে প্রকাশ করার ফলে জনমতই প্রভাবিত হয়। এটা হতে পারে তিনভাবে।

এক. জনমত জরিপ প্রকাশের ফলে একটা ব্যান্ডওয়াগন এফেক্ট (Bandwagon Effect) হয়। জনমত জরিপে যে প্রার্থী এগিয়ে থাকেন, তারই ব্যান্ডে বা দলে যোগ দিতে থাকেন অন্যান্য ভোটাররা। সম্ভাব্য বিজয়ীর সঙ্গে থাকলে ভবিষ্যতে লাভবান হওয়া যাবে এই মনোভাব তখন ভোটারদের মধ্যে কাজ করতে থাকে।
দুই. জনমত জরিপ প্রকাশের ফলে বিপরীতমুখী মনোভাব কাজ করতে পারে। একে বলা হয় আন্ডারডগ এফেক্ট (Underdog Effect)। যে প্রার্থী জরিপে পিছিয়ে থাকেন তাকে সহানুভূতিসূচক ভোট দিতে এগিয়ে আসেন ভোটাররা। এর ফলে শেষ মুহূর্তে পিছিয়ে থাকা প্রার্থী বেশি ভোট পেয়ে বিজয়ী হতে পারেন।
তিন. জনমত জরিপ প্রকাশের ফলে কিছু ভোটার ট্যাকটিকাল ভোটিং (Tactical Voting) বা কৌশলগত ভোট দিতে পারে। যেমন, বৃটেনের ১৯৯৭-এর সাধারণ নির্বাচনে টোরি মন্ত্রী মাইকেল পোরটিলোর জন্য উত্তর-পূর্ব লন্ডনে এনফিল্ড-সাউথগেইট একটি নিরাপদ আসন রূপে বিবেচনা করা হতো। জনমত জরিপে জানা যায়, সেখানে লেবার প্রার্থী স্টিফেন টুইগ ক্রমেই ভোটারদের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য হচ্ছেন। তখন, যেসব ভোটার পোরটিলোর ঘোর বিরোধী ছিলেন, তারা তৎপর হয়ে যান টুইগ-কে জেতানোর জন্য। ওই নির্বাচনে টুইগ জেতেন। পোরটিলো রাজনীতি থেকে বিদায় নিয়ে এখন কলামিস্ট ও টিভি শো প্রেজেন্টার হয়েছেন।

এসব ঘটনা থেকে বোঝা যায় ভোটাভুটির আগে প্রকাশিত জনমত জরিপ জনমতকেই প্রভাবিত করতে পারে। এ কারণে রাজনৈতিক দলগুলো এবং তাদের সমর্থক মিডিয়া তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে পরিচালিত ও গৃহীত জনমত জরিপের ফলাফল প্রকাশ করে। পৌরসভা মেয়র ও কাউন্সিলর নির্বাচনের পাঁচ দিন আগে ৬ জানুয়ারি ২০১১-তে আলো-স্টারের প্রকাশিত জনমত জরিপ দু'টির একই উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু তারা সফল হয়নি। কেন?

টুইনস অফ ইভিল

সে প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগে পাঠকদের মনে করিয়ে দিতে পারি যে যদিও দু'টি পত্রিকাই আলো বিচ্ছুরণ করছে (বাংলা পত্রিকাটি প্রভাতের আলো এবং ইংরেজি পত্রিকাটি রাতের আলো) তবুও এই দু'টি পত্রিকা একই মা, ট্রান্সকম ব্যবসায়িক গ্রুপের গর্ভজাত যমজ সন্তান।
যমজ সন্তান মানুষের কৌতূহল সৃষ্টি করে বহু কারণে। এ নিয়ে হলিউডে বেশ কয়েকটি মুভি হয়েছে। এই সময়ে অন্তত দু'টি মুভির কথা আমার মনে পড়ছে।
এক. টুইনস (Twins, যমজ)। ১৯৮৮-র এই মুভিতে দুই যমজ ভাইয়ের ভূমিকায় অভিনয় করেন আর্নল্ড শোয়ার্জেনেগার ও ড্যানি ডি ভিটো। যারা হলিউড মুভি দেখতে অভ্যস্ত তারা জানেন শোয়ার্জেনেগার (যিনি বর্তমানে ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের গভর্নর) লম্বা এবং ড্যানি ডি ভিটো খাটো। যমজ ভাই হলে তাদের যদিও প্রায় একই রকম দৈহিক ফিচার হওয়া উচিত ছিল, সেটা হয়নি, কারণ মুভির কলাকাহিনীতে তাদের জন্ম হয়েছিল একটি জেনেটিক এক্সপেরিমেন্টের ফলে। তাই শুধু তাদের শারীরিক আয়তনই যে ভিন্ন ছিল তা নয়, তাদের আচার আচরণও ছিল ভিন্ন। লম্বা শোয়ার্জেনেগার ছিলেন সৎ এবং খাটো ডি ভিটো ছিলেন অসৎ। লম্বা ভাই খুঁজে পান তার খাটো ভাইকে এবং তাকে সংশোধনের চেষ্টা শুরু করেন।
দুই. টুইনস অফ ইভিল (Twins of Evil, যমজ শয়তান)। ১৯৭১-এর এই মুভিতে একই চেহারার দুই যমজ ভাই ভ্যামপায়ার বা রক্তচোষার পূজারি হন।

যমজ কিন্তু ভিন্ন

আলো-স্টার টুইনস অথবা টুইনস অফ ইভিল কিনা, সেটা পাঠকরাই বিবেচনা করবেন। এখন দেখুন আলো-স্টার যমজ হওয়া সত্ত্বেও জরিপ দু'টির ক্ষেত্রে তাদের কয়েকটি ভিন্নতা।
আলো স্টার
জরিপকারী সংস্থা ওআরজি-কোয়েস্ট এসি নিলসেন
ভোটারদের পছন্দ :
আওয়ামী লীগ ৪৬% ৩৯%
বিএনপি ৩৯% ২২%
জাতীয় পার্টি ৬% ৪%
সাবটোটাল ৯১% ৬৫%

জামায়াত অজানা ২%
অন্যান্য অজানা ১%
না-ভোট দেবেন অজানা ৩%
ভোট দেবেন না অজানা ৩%
কোনো উত্তরই দেননি অজানা ২৬%
টোটাল ১০০%

লক্ষ্য করুন, ডেইলি স্টার জানিয়েছে ২৬% কোনো উত্তর দেননি এবং জামায়াতসহ অন্য চার ক্যাটেগরির ভোটাররা কী মতামত দিয়েছেন। প্রথম আলো এসব কোনো তথ্য দেয়নি এবং তাদের ট্যাবুলেশন অসম্পূর্ণ রেখেছে, অর্থাৎ টোটাল ফিগার দেয়নি।
সাবটোটালে প্রথম আলো দেখিয়েছে ৯১% উত্তরদাতার মধ্যে আওয়ামী লীগকে ৪৬% এবং বিএনপিকে ৩৯% ভোট দিতে চেয়েছে। অথচ ডেইলি স্টার দেখিয়েছে উত্তরদাতাদের মধ্যে আওয়ামী লীগকে ভোট দিতে চেয়েছে ৩৯% এবং বিএনপিকে মাত্র ২২%।
যেহেতু দু'টি পত্রিকা শুধু মালিকানার ভিত্তিতেই নয়, অবস্থানগতভাবেও খুবই কাছাকাছি (ঢাকার এয়ারপোর্ট রোডে কয়েক গজ ব্যবধানে প্রায় মুখোমুখি) সেহেতু ধারণা করা যেতে পারে দু'টি পত্রিকাই জানতো ভোটিং ইনটেনশনের এই বড় ভিন্নতা। ফলাফল প্রকাশের আগে পত্রিকা দু'টির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে নিশ্চয়ই আলোচিত হয়েছিল এই ভিন্নতা বিষয়ে। শেষ পর্যন্ত তারা ভিন্ন ফলাফলই প্রকাশ করেছে তবে আওয়ামী লীগ যে এগিয়ে সেটা দু'টি পত্রিকাই বলে। অবশ্য প্রথম আলো বলে আওয়ামী লীগ ৭% এগিয়ে। আর ডেইলি স্টার বলে আওয়ামী লীগ ১৭% এগিয়ে। দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলের মধ্যে ভোটিং ইনটেনশন ৭% থেকে ১৭% ব্যবধান কিছুতেই গ্রহণযোগ্য না হলেও অজানা কারণে সেভাবেই জরিপের ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে।

আরো দুটি ভিন্নতা

জরিপ ফলাফল প্রকাশে পত্রিকা দু'টির মধ্যে আরো দু'টি ভিন্নতা লক্ষণীয়। ডেইলি স্টার তার ক্রোড়পত্রের শেষ পৃষ্ঠায় শুধু দু'টি প্রশ্ন এবং উত্তর বড় করে চার্টে ছেপেছে। প্রথম প্রশ্নটি আগেই বলেছি, আগামীকাল যদি নির্বাচন হয় তাহলে কোন পার্টিকে আপনি ভোট দেবেন? স্টারের দ্বিতীয় প্রশ্ন ও উত্তরটি ছিল, সবশেষে আমি জানতে চাই গত নির্বাচনে কোন পার্টিকে আপনি ভোট দিয়েছিলেন। এর উত্তর ছিল :
আওয়ামী লীগ ৫৩%
বিএনপি ২০%
জাতীয় পার্টি ৩%
জামায়াত ১%
অন্যান্য ২%
না-ভোট দাতা ১%
ভোট দেননি ১০%
ভোটার ছিলেন না ১%
কোনো উত্তর দেননি ১০%
টোটাল ১০১%

লক্ষ্য করুন, এখানে টোটাল ১০০ না হয়ে ১০১ হয়েছে। প্লিজ, স্টারের এই ভুলকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখুন।

কিন্তু প্রথম আলো তাদের জরিপে এই শেষ প্রশ্নটি করেনি। অথবা করলেও উত্তর প্রকাশ করেনি। কারণ সম্ভবত এতে দেখা যায় আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তায় ধস নামা শুরু হয়েছে। যেমন, ডেইলি স্টারের জরিপে উত্তরদাতাদের ৫৩% গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ভোট দিলেও মাত্র ৩৯% পরবর্তী নির্বাচনে ভোট দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। অর্থাৎ, দুই বছরে ১৪% ভোটার আওয়ামী লীগ বিমুখ হয়েছে।
ডেইলি স্টার যেখানে তাদের ক্রোড়পত্রের শেষ পৃষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ দু'টি প্রশ্নের উত্তর বারচার্ট সহ ছেপেছে সেখানে প্রথম আলো দু'টি প্রশ্নেরই উত্তর চেপে গিয়েছে। প্রথম প্রশ্ন (আগামীকাল যদি নির্বাচন হয় তাহলে কোন পার্টিকে আপনি ভোট দেবেন?) এবং তার আংশিক উত্তর প্রথম আলো ক্রোড়পত্রে না ছেপে দায়সারাভাবে অন্যত্র ছেপেছে।
ডেইলি স্টারের তুলনায় প্রথম আলোর সার্কুলেশন অনেক বেশি। তাই এই দু'টি স্পর্শকাতর প্রশ্নের উত্তর বিষয়ে প্রথম আলো খুব সতর্ক থেকেছে। বলা যায়, মাইনাস টু তত্ত্বের অন্যতম প্রবক্তা প্রথম আলো সম্পাদক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরাগ প্রশমনের লক্ষ্যে এই সতর্কতা অবলম্বন করেছেন।

ভুল জনমত জরিপ

কিন্তু তাতে বাস্তবতা চাপে পড়েনি।
প্রথম আলো, ডেইলি স্টার তথা আওয়ামী লীগের জন্য কঠিন বাস্তবতা হলো ওই দু'টি জনমত জরিপের ফলাফলকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত করেছে পৌর নির্বাচন।
আলো-স্টারের জরিপের সঙ্গে তুলনা করার জন্য ভিন্ন সূত্রে আমি চেষ্টা করেছিলাম নির্বাচন কমিশনের কাছে জানতে সব পৌরসভার নির্বাচনের পূর্ণ ফলাফল। কিন্তু তারা জানিয়েছেন, পূর্ণ ফলাফল যোগ করতে কিছু সময় লাগবে। সেক্ষেত্রে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হিসাবে জানা যায় (এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত) দেশের সাতটি বিভাগে ২৩৬টি পৌরসভায় মোট ভোট পড়েছে ৭০%। এর মধ্যে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের চাইতে বেশি ভোট পেয়েছে। বিএনপির ভোটের পরিমাণ ১,৮৫১,৩৩৭ যা প্রদত্ত ভোটের প্রায় ৪১%। অন্য দিকে আওয়ামী লীগের ভোটের পরিমাণ ১,৭৮০,৫৭৫ যা প্রদত্ত ভোটের প্রায় ৩৯%। ফলে এখন পর্যন্ত ঘোষিত ২৩৬ পৌরসভায় মেয়র পদে বিএনপির ৯৭ জন প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। অন্য দিকে আওয়ামী লীগের ৯৩ জন প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন।

অথচ প্রথম আলোর জরিপ অনুযায়ী ভোট পড়লে বিএনপির ৯২ জন প্রার্থীর (অর্থাৎ ২৩৬৩৯%) এবং আওয়ামী লীগের ১০৯ জন প্রার্থীর (২৩৬৪৬%) বিজয়ী হওয়ার কথা ছিল।
আর ডেইলি স্টারের জরিপ অনুযায়ী ভোট পড়লে বিএনপির ৫২ জন প্রার্থীর (অর্থাৎ ২৩৬২২%) এবং আওয়ামী লীগের ৯২ জন প্রার্থীর (২৩৬৩৯%) বিজয়ী হওয়ার কথা ছিল।
নির্বাচন কমিশন থেকে প্রদত্ত ভোটের পূর্ণাঙ্গ হিসাব না পাওয়া পর্যন্ত, দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে উপরের এই সরলীকৃত হিসাবটি করা হয়েছে। আশা করি পাঠকরা বুঝতে পারছেন দু'টি পত্রিকার দু'টি জরিপই কতো বড় ভুল করেছে। উভয় জরিপেই বিএনপির পরাজিত হওয়ার কথা ছিল। অথচ বাস্তবে বিএনপি বিজয়ী হয়েছে।

বিএনপির ভোট আরো বেশি ছিল

এখানে আরেকটি কথা বলা উচিত। পৌরসভা নির্বাচনের অব্যবহিত আগে ৮ জানুয়ারিতে উত্তর বাংলাদেশে নির্বাচনী অভিযানে শেখ হাসিনা ও তার মহাজোটের পার্টনার জাতীয় পার্টির নেতা এরশাদ একই মঞ্চে উঠেছিলেন। সেই ১৯৮৬-তেও শেখ হাসিনা নির্বাচনী গাটছড়া বেঁধেছিলেন এরশাদের সঙ্গে। এবার লং ড্রাইভে নয়, প্লেনে শর্ট রাইডে তারা এক সঙ্গে সেখানে যান। হাসিনা ও এরশাদ উভয়েই ভেবেছিলেন এরশাদের ভোট ব্যাংক রূপে পরিচিত উত্তর বাংলায় তাদের পক্ষে বেশি ভোট পড়বে এবং সেই ব্যান্ডওয়াগন এফেক্টে পরবর্তী কয়েক দিনে অনুষ্ঠিতব্য পৌরসভা নির্বাচনে তাদের জয়লাভ সহজ হয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। রংপুর ও রাজশাহী বিভাগে বিএনপির বিশাল জয়ে উদ্বিগ্ন কিছু আওয়ামী নেতা-কর্মী পরবর্তী পৌরসভা নির্বাচনে প্রচণ্ড সহিংসতার আশ্রয় নেন। যেমন, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও ফেনীতে হয়েছে। বরিশালে ভোটারদের ভীত করার সংবাদ পাওয়া গেছে। ২০টি কেন্দ্রে নির্বাচন পরিত্যক্ত হয়। এ ধরনের ঘটনাগুলো যদি না ঘটতো তাহলে বিএনপির পক্ষে আরো বেশি ভোট পড়তো এবং আলো-স্টারের জরিপ আরো বেশি ভুল রূপে প্রমাণিত হতো। এসব সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে ঘোষিত ২৩৬ পৌরসভা নির্বাচন ফলাফল হচ্ছে :

বিএনপি ৯৭
আওয়ামী লীগ ৯৩
আ.লীগ বিদ্রোহী ১৬
বিএনপি বিদ্রোহী ৮
জামায়াত ৫
জাতীয় পার্টি ১
এলডিপি ১
নাগরিক কমিটি ১
স্বতন্ত্র ১৪
টোটাল ২৩৬

ট্রানজিট দিলে লাভ কার?

প্রথম আলোর ক্রোড়পত্রে ৩৩টি প্রশ্নের উত্তর এবং ডেইলি স্টারের ক্রোড়পত্রে ৬১টি প্রশ্নের উত্তর প্রকাশিত হয়েছে। ইনডিয়াকে ট্রানজিট দেয়া প্রসঙ্গে উভয় জরিপে বলা হয়েছে, ভোটারদের মত হচ্ছে ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশ লাভবান হবে। দেখুন, দু'টি পত্রিকার প্রশ্ন ও উত্তর।

প্রশ্ন : বর্তমান সরকারের আমলে ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ কি লাভবান হবে?

উত্তর প্রথম আলো স্টার
হ্যাঁ ৫৩% ৪৬%
না ৩৮% ৯%
ইনডিয়ার লাভ হবে – ১৩%
দুই দেশের লাভ হবে – ৩%
জানি না ৯% ২৯%
টোটাল ১০০ ১০০

লক্ষ্য করুন এখানেও দুই জরিপের উত্তরে যথেষ্ট ব্যবধান আছে। প্রথম আলোর জরিপ বলেছে দেশের অর্ধেকেরই বেশি মানুষ মনে করে ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশ লাভবান হবে। ডেইলি স্টারের জরিপ বলেছে দেশের অর্ধেকের কম মানুষ মনে করে ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশ লাভবান হবে।
পৌরসভার নির্বাচনী ফলাফলে যখন দু'টি পত্রিকার জরিপ ভুল প্রমাণিত হয়েছে তখন ট্রানজিট বিষয়েও যে জরিপ দু'টি ভুল সিদ্ধান্তে এসেছে সেটা বলা যায়। কিন্তু ট্রানজিট বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং, উভয় পত্রিকারই উচিত হবে অবিলম্বে শুধু ট্রানজিট বিষয়ে একটি জরিপ করে সঠিক জনমত জানানো।

জনমত জরিপে ভুলের পরিমাণ

কোনো জনমত জরিপে কি ভুল হতে পারে না?
হ্যাঁ, ভুল হতেই পারে। তবে ফলাফল প্রকাশিত হবার পরে বিবেচনা করতে হবে ভুলগুলোর আয়তন বা পরিমাণ কতো। উন্নত দেশে ১,০০০ স্যাম্পলে ৩% মার্জিন অফ এরর (margin of error বা প্রথম আলোর ভাষায় প্রান্তিক ভুল) গ্রহণযোগ্য হতে পারে।
প্রথম আলো তার রিপোর্টে বলেছে, 'এই জরিপে প্রান্তিক ভুল ধরা হয়েছে কম বেশি ১ দশমিক ৭৯ শতাংশ।' কিন্তু বাস্তব ফলাফল তাদের এই দাবি যে কতোখানি অসার ও হাস্যকর ছিল সেটা প্রমাণ করে দিয়েছে।
ডেইলি স্টার এক্ষেত্রে সতর্কতার পরিচয় দিয়েছে। তারা তাদের রিপোর্টে বলেনি মার্জিন অফ এরর কতোখানি হতে পারে। সুতরাং তারা ধরা পড়ার হাত থেকে বেঁচে গিয়েছে।

কেন এত বড় ভুল?

কিন্তু কেন দু'টি পত্রিকারই জরিপে এত বিশাল মাপের ভুল হলো?
এর বিশদ উত্তর দিতে গেলে আমাকে আলো-স্টারের জরিপ কনসালটেন্ট রূপে কাজ করতে হবে এবং সে ইচ্ছা আমার মোটেও নেই। তবু দেশের রাজনীতি, মিডিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা ও আলো-স্টারের গ্রহণযোগ্যতা রক্ষার চেষ্টায় কয়েকটি কারণ খুব সংক্ষেপে বলছি।

এক. ১৯৮৬-তে সাপ্তাহিক যায়যায়দিন এবং ২০০১-এ ডেমক্রেসিওয়াচ তাদের জরিপে খুব কম প্রশ্ন করেছিল ও সহজ প্রশ্ন করেছিল। সবচেয়ে বড় কথা স্যাম্পল সাইজ ছিল ৫,০০০ অথবা তার বেশি এবং দেশব্যাপী। ভাষা, খাবার অভ্যাস (ভাত-ডাল-সবজি-মাছ) ও ধর্ম (মুসলিম ৮৮%) বাদ দিলে বাংলাদেশের মানুষ হোমোজেনিয়াস নয়। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের কাছে কেএফসি-পিৎজা হাট জাতীয় ফাস্টফুড খাওয়া একটি বিলাসিতা, কোক-পেপসি হচ্ছে অতিথি আপ্যায়নে আন্তরিকতার চরম নিদর্শন, বিয়ার, ওয়াইন, হুইস্কি তারা দেখেনি, অ্যানুয়াল হলিডে বা বছরে কমপক্ষে দুই সপ্তাহ বিদেশে, সমুদ্র তীরে অথবা কোন হেলথ রিসর্টে ছুটি কাটানোর বিষয়টি অজানা, আকাশে প্লেন দেখেছে কিন্তু খুব কম ব্যক্তিই চড়েছে, তারা গাড়ি চড়েছে (বাসে) গাড়ির (প্রাইভেট কার) মালিক হবার স্বপ্ন খুব কম মানুষই দেখেছে, অধিকাংশ ঘরে এখনো বিদ্যুৎ-গ্যাস নেই। ফলে বাংলাদেশে বৃহত্তর জনগোষ্ঠির সঙ্গে অন্য জনগোষ্ঠির পার্থক্য অনেক এবং এই পার্থক্যটা বেড়েই চলেছে। এসব ফ্যাক্টর চিন্তা করে র‌্যানডম স্যাম্পলিং বা দৈব চয়নের পাশাপাশি সিলেকটেড স্যাম্পলিং বা সুনির্দিষ্ট চয়নও করতে হবে এবং সেসব স্যাম্পলিং হতে হবে ১০,০০০ ঊর্ধ্ব।

৩,০০০ নমুনা সংখ্যা দেশের মানুষের মতের প্রতিফলন হিসেবে কতখানি বিশ্বাসযোগ্য এ প্রশ্নের উত্তরে প্রথম আলোর জরিপকারি সংস্থার ম্যানেজিং ডিরেক্টর মঞ্জুরুল হক প্রথম আলোতেই বলেছেন, 'যথাযথ নমুনায়ন করা হলে ১,২০০ নমুনাই যথেষ্ট। জরিপের নমুনা হিসেবে এ সংখ্যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে সাধারণত ১,০০০ নমুনা নিয়ে জরিপ পরিচালনা করা হয়। জরিপের পরিধি আরও বিস্তৃত এবং জনমতের প্রতিফলন আরও বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য আমরা ৩,০০০ নমুনা নিয়েছি। এটাকে আমরা যথেষ্ট বলে মনে করি। নমুনায়নে দৈব চয়ন পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে সব শ্রেণীর, সব স্তরের জনগণের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে।'

কিন্তু আমেরিকানদের মধ্যে অর্থনৈতিক পার্থক্য অনেক বেশি থাকলেও ধরা যায়, তাদের কাছে কেএফসি-পিৎজা হাট-ম্যাকডোনাল্ডস প্রভৃতি জাংক ফুড, কোক-পেপসি পানির মতো সাধারণ ড্রিংক, বিয়ার, ওয়াইন, হুইস্কি কমবেশি সবাই জীবনে এক সময়ে খেয়েছেন, অ্যানুয়াল হলিডে জীবনের একটি অংশ, প্লেনে চড়াটা, টাকার বিষয় নয় শুধু ইচ্ছার বিষয়, প্রাইভেট কার চালাতে এবং মালিক হতে পারেন অনেকে এবং বিদ্যুৎ-গ্যাস বিহীন জীবন অকল্পনীয়। অর্থাৎ এসব ক্ষেত্রে আমেরিকানরা হোমোজেনিয়াস। শুধু তাই নয়, দেখা যাবে কোনো পাড়ায় একই রাস্তায় প্রায় বাড়িই একই ধরনের এবং সেখানে প্রায় একই ইনকাম রেঞ্জের মানুষ থাকে।

কিন্তু বাংলাদেশে শহরে বাড়ির পাশেই থাকে বস্তি যাদের কোনো নাম্বার নেই। আমি নিজে থাকি ইস্কাটন গার্ডেনস-এ যে রাস্তাটির এক মাথায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মা ও হোলি ক্রিসেন্ট হসপিটাল, মাঝখানে একটি স্কুল, লেডিস ক্লাব, পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সরকারি বাসভবন ও ফার্স্ট ক্লাস অফিসার্স কোয়ার্টার্স এবং অন্য মাথায় নৌবাহিনী প্রধানের সরকারি বাসভবন নৌভবন। এই রাস্তাতেই আমার গেইটের সামনের ফুটপাথে এবং বিপরীত ফুটপাথেও গড়ে উঠেছে ছিন্নমূল মানুষের নীল পলিথিনে ঢাকা আস্তানা। অর্থাৎ এই রাস্তার অধিবাসীরা হোমোজেনিয়াস নন এবং এখানে দৈব চয়নের ভিত্তিতে জনমত জরিপ করলে দেশের মানুষের মতের প্রতিফলন ঘটবে না।

দুই. বেশি প্রশ্ন করা উচিত হবে না। এমন প্রশ্ন করা উচিত হবে না, যা ভোটারদের বোধগম্য না-ও হতে পারে অথবা প্রশ্নটির বিষয়ে ভোটাররা সম্পূর্ণ অজ্ঞ থাকতে পারেন। যেমন ধরুন প্রথম আলোর দু'টি প্রশ্ন।
১. শিক্ষা ক্ষেত্রে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ সফল নাকি ব্যর্থ হয়েছে? এই প্রশ্নটির উত্তর কি একজন নিরক্ষর চাষী দিতে পারবেন? তিনি হয়তো বলবেন জানি না এবং সেই উত্তর হবে বেশি। অথচ প্রথম আলোর পাই চার্টে দেখানো হয়েছে মাত্র ১% উত্তরদাতা বলেছেন ১% জানি না!
২. পরের প্রশ্নটি হচ্ছে, বর্তমান সরকারের আমলে কৃষি খাতে সরকারের নেয়া পদক্ষেপে কৃষক কি লাভবান হয়েছে? এই প্রশ্নটির উত্তর শহরের ডিজুস প্রজন্মের তরুণরা এবং আরো অনেক শহরবাসী দিতে পারবে না। অথচ এই প্রশ্নের উত্তরে প্রথম আলোর বার চার্টে দেখানো হয়েছে মাত্র ২% উত্তরদাতা বলেছেন জানি না!
আলো-স্টারের উচিত ছিল এত বহুমুখী বিষয়ে প্রশ্ন না করে সীমিত বিষয়ে সুনির্দিষ্ট সেক্টরাল ভোটারদের প্রশ্ন করা। যেমন, শিক্ষা বিষয়ে শিক্ষক, ছাত্র ও অভিভাবকদের প্রশ্ন করা। যেমন, কৃষি বিষয়ে কৃষক ও কৃষিকাজে সংশ্লিষ্টদের প্রশ্ন করা।
আলো-স্টারের এই খিচুড়ি প্রশ্নমালায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, সুশাসন ও অর্থনীতি, সরকারের কর্মকাণ্ড, সরকারের দলীয়করণ, জীবনযাত্রার মান, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, গণমাধ্যমের প্রতি সরকারের মনোভাব, গত দুই বছরে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে বিরোধী দলগুলোর মনোভাব, গত দুই বছরে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের কর্মকাণ্ড, আওয়ামী লীগের ভূমিকা, বিরোধী দলের ভূমিকা, ট্রানজিট, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, বিচার বহির্ভূত হত্যা, সংবিধান, সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, দ্রব্যমূল্য, খালেদা জিয়ার বাড়ি থেকে উচ্ছেদ, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।

তিন. দুটি জরিপে দেখা গেছে, কয়েকটি বিষয়ে গত দুই বছরের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরার জন্য প্রশ্ন করা হয়েছে। কিন্তু এসব প্রশ্নের উত্তর খুবই সাসপেক্ট বা সন্দেহজনক। লন্ডনে আমি যখন জিকরারকে দিয়ে প্রতি সপ্তাহে রেডিও স্টেশনের জনপ্রিয়তা বোঝার তুলনামূলক চিত্র জানার জন্য জরিপ করতাম তখন সেটা করা হতো রোলিং স্যাম্পল (Rolling Sample)-এর ভিত্তিতে। অর্থাৎ, ধরুন ১,২০০ উত্তরদাতার কাজে প্রথম সপ্তাহে প্রশ্ন করা হলো। দ্বিতীয় সপ্তাহে এদের মধ্য থেকে ১০০ জনকে বাদ দিয়ে নতুন ১০০ উত্তরদাতা যোগ করে তাদের প্রশ্ন করা হতো। এভাবে নতুন উত্তরদাতা সংযোজিত হলেও উত্তরের মধ্যে একটা ধারাবাহিকতা রেখে তুলনামূলক সাপ্তাহিক চিত্র পাওয়া যেত।

আলো-স্টারের জরিপ কাজের দুর্বলতা বিষয়ে বিস্তারিত সমালোচনা করতে গেলে আমাকেও একটি ক্রোড়পত্র প্রকাশ করতে হবে। সে কাজটি আমি করবো না।
প্রশ্ন উঠতে পারে কেন এত বিশাল খরচ করে ও ক্রোড়পত্র ছেপে অবাস্তব, অবিশ্বাস্য ও অগ্রহণযোগ্য দু'টি জনমত জরিপ করলো আলো-স্টার?

অনির্বাণ রাজনৈতিক অভিলাষ

এর উত্তর হতে পারে পত্রিকা দুটির সম্পাদক দুজনের অনির্বাণ রাজনৈতিক অভিলাষ। পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে আছে এই সম্পাদক দুজন ছিলেন মাইনাস টু ফর্মুলার প্রবক্তা এবং ওয়ান-ইলেভেনের অন্যতম স্রষ্টা।
বলা যায় এখন বাংলাদেশে তিনটি প্রধান রাজনৈতিক শক্তি বিরাজ করছে।
এক. বিএনপি ও তার সমমনা দল। দুই. আওয়ামী লীগ ও তার সমমনা দল। এবং তিন. ওয়ান-ইলেভেনের প্রবক্তা যেখানে আছেন মিডিয়ার একাংশ, সুশীল সমাজের একাংশ এবং সম্ভবত সেনা অফিসারদের একাংশ।
১৯৯১-এর পর বিএনপি তিনবার সরকার গঠনের সুযোগ পেয়েছে। আওয়ামী লীগ দুইবার সরকার গঠনের সুযোগ পেয়েছে। সুতরাং ওয়ান-ইলেভেন প্রবক্তারা অর্থাৎ তৃতীয় শক্তি আরেকবার সরকার গঠনের অভিলাষ পোষণ করতেই পারেন। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ব্যর্থ হলে বিএনপিকে আবার ক্ষমতায় তারা আসতে দিতে চান না বলেই এসব তথাকথিত জনমত জরিপ প্রকাশ করা হচ্ছে। এই তৃতীয় শক্তি বলেই চলেছে আওয়ামী লীগ ফেইল করেছে এবং বিএনপির প্রতিও মানুষ সন্তুষ্ট নয়। আর তাই, প্রথম আলোর জনমত জরিপ বিষয়ক ক্রোড়পত্রে শিরোনাম ছিল, 'রাজনীতি নিয়ে মানুষের হতাশা বেড়েছে।'

ডেইলি স্টার জানিয়েছে এটি ছিল এই পর্যায়ে তাদের চতুর্থ জনমত জরিপ। ধারণা করা যায়, আগামী সাধারণ নির্বাচনের আগে এই ধরণের আরো জরিপ করবে আলো-স্টার। তারা চাইবে দ্বিতীয় ওয়ান-ইলেভেনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে। কিন্তু আমি আশা করি গত ওয়ান-ইলেভেন সরকারের ব্যর্থতার পর তাদের সুবুদ্ধির উদয় হবে।

গত ওয়ান-ইলেভেনের সময়ে তাদের হাতে ট্রাম্প কার্ড (তারা মনে করেছিল) বা তুরুপের তাশ আছেন নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস। কিন্তু তিনি তাদের প্রস্তাব নাকচ করে দেন এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের এক মধ্যম শ্রেণীর সাবেক আমলা ড. ফখরুদ্দীন আহমেদ-কে (যার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য আমৃত্যু চাকরি করে যাওয়া) তাদের ফ্রন্টম্যান বা কলের পুতুল রূপে নিয়োগ দানের সাজেশন দেন। এখন ওয়ান-ইলেভেন প্রবক্তাদের ড. ইউনূসও নেই, ড. ফখরুদ্দীনও নেই। তারা কাকে সেনাসমর্থিত বেসামরিক সরকার প্রধান করবেন? তাই তারা যদি শুভবুদ্ধিসম্পন্ন হন তাহলে এই ধরণেরর ক্যু ও কুঅভিলাষ থেকে নিজেদের ঊর্ধ্বে রাখবেন। গণতন্ত্র, সেটা যতই খোড়া হোক না কেন, তাকে আরো সুযোগ দিতে তারা সচেষ্ট হবেন।
ও হ্যাঁ।

পৌরসভা নির্বাচনের প্রথম পর্যায় শেষ হবার পরে ডেইলি স্টারের (১৫ জানুয়ারি ২০১১) প্রথম পৃষ্ঠায় হেডলাইন ছিল AL surprised at BNP's gain (আওয়ামী লীগ বিস্মিত বিএনপির সুফলে)।
যদি আমরা স্টারে এর মাত্র নয় দিন আগে প্রকাশিত জনমত জরিপের ফলাফল বিবেচনা করি, তাহলে বলতেই হবে ওই হেডলাইনটি হওয়া উচিত ছিল, Star surprised at BNP's gain (স্টার বিস্মিত বিএনপির সুফলে)।
কিন্তু না।
স্টার হয়তো সারপ্রাইজড না হয়ে, অন্য কিছু হয়েছে।
কি সেটা?
একটা গল্প মনে পড়ছে।

আমেরিকান লেক্সিকোগ্রাফার নোয়াহ ওয়েবস্টার (১৭৫৮-১৮৪৩) চিরখ্যাত হয়ে আছেন বিভিন্ন ডিকশনারি লেখার জন্য। তার লেখা এ কমপেনডিয়াম ডিকশনারি অফ দি ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ (১৮০৬), ইংলিশ গ্রামার (১৮০৭) এবং দুই খণ্ডে আমেরিকান ডিকশনারি অফ দি ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ (১৮২৮), এখন যেটি ওয়েবস্টার্স নিউ ইন্টারন্যাশনাল ডিকশনারি অফ দি ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ নামে পরিচিত) প্রতিটি ইংরেজি ভাষী লেখকের জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয়।

নোয়া ওয়েবস্টারের স্ত্রী ছিলেন সুন্দরী ও পুরুষমোহন রমণী।
একদিন দুপুরে অতি অপ্রত্যাশিতভাবে নোয়া বাড়িতে ফিরে এসে তার বেডরুমে আবিষ্কার করলেন তারই এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সঙ্গে মিথুনরত তার স্ত্রী।
নোয়ার বন্ধু কোনো রকমে বিছানার চাদরে নিজেকে ও নোয়ার স্ত্রীকে ঢেকে, বিছানায় শুয়েই নোয়াকে বললেন, আই বেট, তুমি সারপ্রাইজড হয়েছ (আমি বাজি ধরছি তুমি নিশ্চয়ই বিস্মিত হয়েছ!)।
সঠিক শব্দ চয়নে খুব খুঁৎখুতে নোয়া উত্তর দিলেন, নো, আই অ্যাম নট। ইউ আর সারপ্রাইজড। আই অ্যাম অ্যাসটাউন্ডেড (না, আমি নই। তুমি বিস্মিত হয়েছ! আমি স্তম্ভিত হয়েছি।'
স্টার হয়তো স্তম্ভিত হয়েছে।

২৩-০১-২০১১

শফিক রেহমান : লেখক, সম্পাদক এবং টিভি অনুষ্ঠান উপস্থাপক।