বাঙালি মুসলমানের ধর্মীয় অনুভূতি

জায়েদুল আহসান পিন্টু
Published : 7 Oct 2014, 08:27 AM
Updated : 7 Oct 2014, 08:27 AM

বাঙালি মুসলমানের অনুভূতি যে ঠিক কোন জায়গায় এটা বোঝা বড় মুশকিল। কথায় কথায় বাঙালি মুসলমানের অনুভূতিতে আঘাত লাগে। তাদের অনুভূতি কি ক্রমশই প্রখর হচ্ছে? প্রায়ই এ প্রশ্ন আমার মনে উঁকি দেয়। হিসেব মেলাতে পারি না। শেষ পর্যন্ত এই বলে থেমে যাই যে, আমাদের ধর্মীয় অনুভূতি আসলে রাজনৈতিক। আবার ভাবি, তা-ই যদি হয় তাহলে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো ভোট পায় না কেন?

ওদিকে দেখি, বড় বড় দলগুলোর নির্বাচনী প্রচারণায় ইসলাম অনেক বেশি ঠাঁই পায়। মদিনা সনদ অনুযায়ী দেশ চলবে, কুরআন-সুন্নাহবিরোধী কোনো আইন পাস করা হবে না এমন অঙ্গীকারও করা হয়। আসলেই কি আমাদের অনুভূতি এমন, যে রকমভাবে রাজনৈতিক দলগুলো উপস্থাপন করে? নাকি সাধারণ বাঙালি এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না? আবার দেখা যায়, পয়লা বৈশাখে লাখো মানুষের ঢল, পুজায় মুসলমান নারী-পুরুষ দল বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছে– এসব দৃশ্য দেখে মনে হয় আমাদের অনুভূতি অত ঠুনকো নয়।

আমরা পাহাড়িদের কাছে যতটা 'বাঙালি', হিন্দুদের কাছে ততটাই 'মুসলমান' হয়ে উঠি কেন? আমরা রাজনীতিতে ইসলামের ব্যবহার বাড়িয়েই চলেছি। কিন্তু আচার-আচরণে ধর্মীয় অনুশাসন কি পুরোপুরি মেনে চলছি?

এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে মাথায় ঘুরপাক খায় হাজারো বিষয়। আমার মনে হয়, ব্যক্তিজীবনে আমরা ইসলামের অনুশাসনগুলো ঠিকমতো পালন করি না। কিন্তু ইসলাম নিয়ে একটি 'এদিক-সেদিক' কথা কথা বললেই আমাদের অনুভূতির চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটে। যেমন, ধরা যাক, ঘুষ ও দুর্নীতি। এর বিরুদ্ধে ইসলামের অবস্থান পরিস্কার। তাহলে দুর্নীতিতে বাংলাদেশ বারবার চ্যাম্পিয়ন হয় কী করে? নিশ্চয়ই আমরা ইসলামের বাণী অনুসরণ করি না!

দুর্নীতি আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে। এমন কোনো খাত নেই যেখানে দুর্নীতি নেই। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল যখন আমাদেরকে দুর্নীতিতে সারা বিশ্বে 'নাম্বার ওয়ান' বলে চিহ্নিত করে, তখন আমাদের অনুভূতিতে আঘাত লাগে না। মুসলিম-অধ্যুষিত একটি দেশকে দুর্নীতিপরায়ণ বলে 'গাল' দিলেও মুসলমান হিসেবে আমরা আহত হই না। আমরা তখন বাঙালি জাতি হয়ে যাই। আবারও মাথায় ঘুরপাক খায় রাজনৈতিক ইসলাম।

ইসলাম শান্তির ধর্ম। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ ইসলাম সমর্থন করে না। তাহলে জামায়াতে ইসলামী করছেটা কী? বিএনপি-জামাত জোট সরকারের সময় রাষ্ট্রীয়ভাবে জঙ্গিবাদে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যেভাবে জনগণকে আতঙ্কিত করে তোলা হয়েছিল এবং ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের আগে বিএনপি-জামাত বোমা মেরে যেভাবে মানুষ মেরেছে, তখন কি আমাদের অনুভূতিতে আঘাত লেগেছিল?

রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে হানাহানির সময় জামাত-শিবির কর্মীরা জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম থেকে বোমা ছুঁড়ে মারে, গুলি করে মানুষ মারে, জায়নামাজে আগুন দিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে, মুসল্লিদের মসজিদে ঢুকতে দেয় না, ইসলামের হেফাজতের নামে কোরআন শরীফে আগুন ধরিয়ে দেয়– তখন আমাদের অনুভূতি যায় কোথায়?

এ তো বললাম সন্ত্রাস ও দুর্নীতির কথা। জীবনের আর কোথায় আমরা ইসলামের অনুশাসন মেনে চলেছি? যখন ঘুষ খাই, কালোবাজারি করি, মিথ্যা বলি, অপরকে গালাগাল দিই, পরনিন্দা-পরচর্চা করি, তখন আমাদের ইসলাম থাকে কোথায়? প্রায় সব নির্বাচনের পরেই দেখি ভোট না দেওয়ার আভিযোগে হিন্দু বাড়িঘরে হামলা চালানো হয়, হিন্দু নারী ধর্ষণ করা হয়, পুজার সময় প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়, মন্দিরে আগুন দেওয়া হয়– এগুলো করে কারা? বরাবরই করে আসছে আমাদের মুসলিম ভাইয়েরা।

রামুর ঘটনা ছিল আরও ভয়ঙ্কর। এদেশের শান্তিপ্রিয় বৌদ্ধদের ওপর হামলা চালিয়ে তাদের ৩০০ বছরের পুরনো বৌদ্ধ মন্দির পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হয়েছে। সেখানেও জেনেছি আক্রমণকারীদের পরিচয়, তারা 'মুসলমান'। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামাত— সব দলের পরিচয় একাকার হয়ে গেছে ওখানে। আক্রান্তরা 'বৌদ্ধ', আক্রমণকারীরা 'মুসলমান'।

তাই প্রশ্ন জাগে, আমাদের অনুভূতিটা আসলে কী, এটা থাকে কোথায়? রাজনীতির মাঝে, নাকি মনের ভেতরে? মনটাও কি রাজনৈতিক? নাকি আমরা ধরেই নিয়েছি অনুভূতির একক অধিকার মুসলমানদের!

অতি সম্প্রতি আবদুল লতিফ সিদ্দিকী হজ্জ্ব নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন তাতে তিনি বাংলাদেশ দণ্ডবিধিতে শাস্তিযোগ্য অপরাধের আওতায় অভিযুক্ত হতে পারেন। কিন্তু তার ওই মন্তব্যের পর আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর যে প্রতিক্রিয়া দেখলাম, তাতে মনে হল, আমরা সবাই ধর্মপ্রাণ মুসলমান হয়ে গেছি! সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখার সুযোগ হয়নি। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে যে রকম প্রতিক্রিয়া দেখেছি তাতেও মনে হয়েছে আমরা খুবই ধর্মপ্রাণ!

আমি বলছি না আবদুল লতিফ সিদ্দিকী অন্যায় করেননি। আমি বলছি না তিনি 'খাঁটি' মুসলমানদের অনুভূতিতে আঘাত দেননি। কিন্তু আমরা যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছি মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, আমরা সবাই 'সাচ্চা' মুসলমান!

এবার দেখা যাক রাজনৈতিক দলগুলো কে কী বলেছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে লতিফ সিদ্দিকীকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, লতিফ সিদ্দিকীর মন্তব্য তার নিজস্ব, সরকার বা দলের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। এখানে ধর্ম নিয়ে যদি কোনো কথা না বলতেন লতিফ সিদ্দিকী, যদি তিনি অন্য কোনো বিতর্কিত বিষয় নিয়ে আরও বিতর্ক তুলে দিতেন, তাহলে হয়তো তাকে চাকরি হারাতে হত না।

বেচারা এখন দেশেই সহসা ফিরতে পারবেন না। যেভাবে ১৯৭৩ সালে কবি দাউদ হায়দারকে বিমানে তুলে দিতে হয়েছিল– ১৯৯৪ সালে তসলিমা নাসরিনকে দেশ ছাড়তে হয়েছিল– সেভাবে।

আওয়ামী লীগ বিরোধীদের হাতে কোনো ইস্যু তুলে দিতে চায়নি। তাই তারা একদণ্ডও দেরি করেনি, তারা জানে এদেশের মানুষ কখন 'বাঙালি' আর কখন 'সাচ্চা মুসলমান' হয়ে যায়। আওয়ামী লীগও এই দুই পরিচয় নিয়ে রাজনীতি করে যাচ্ছে।

বিএনপি আরও একধাপ এগিয়ে আছে আমাদের অনুভূতির 'সম্মান' দেওয়ার ক্ষেত্রে। তারা বলেছে, আবদুল লতিফ সিদ্দিকী দেড়শ কোটি মুসলমানের প্রাণের স্পন্দন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছেন। এই দলটি ২০০১ সালে ক্ষমতায় গিয়ে '৭১ এ ইসলামরক্ষার নামে যারা বাঙালিদের খুন-ধর্ষণ করেছে তাদের মন্ত্রী বানিয়েছে। ওরা ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গেই হিন্দুদের উপর যে ভয়াবহ নির্যাতন চালানো হয়েছিল, তখন ওই দলের নেতা-কর্মীদের মনে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়নি।

তাদের আমলেই আবার দেখি বাংলা ভাই, শায়খ আবদুর রহমানরা বোমা মেরে মানুষ মারছে, গির্জায় হামলা চালাচ্ছে। তাদের পক্ষে বিএনপি-জামাত সরকারের মন্ত্রীরা সাফাই গাইছেন পর্যন্ত। তখন তখন তাদের অনুভূতি কি বন্দি ছিল?

হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদকে দেখলাম বিএনপির চেয়ে বেশি অনুভূতিপ্রখর। তিনি তো লতিফ সিদ্দিকীকে 'মুরতাদ' আখ্যা দিয়ে তার ফাঁসিই দাবি করেছেন! তার ভাষায়, যে মহানবী (স.) কে অপমান করে, সে মুরতাদ। সে মুসলমান থাকতে পারে না, ফাঁসি দিয়ে তার বিচার করতে হবে। এই এরশাদের লাম্পট্যের কথা বাদ-ই দিলাম, কিন্তু ঘরে স্ত্রী রেখে আরেক নারীর সঙ্গে প্রেমের কথা স্বীকার করে সংবাদপত্রে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তিনি নিজে। তখন তার ইসলাম কোথায় থাকে, সেটা আমাদের প্রশ্ন।

আর জামায়াতে ইসলামী বলছে, "লতিফ সিদ্দিকী সারা বিশ্বের মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হেনেছেন। তিনি সারা বিশ্বের মুসলমানদের ঈমান আক্বিদা ও ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি যে আঘাত দিয়েছেন তা ক্ষমার অযোগ্য। তার এ মন্তব্যে বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ জনগণ বিক্ষুব্ধ, উত্তেজিত ও মর্মাহত। সারা বাংলাদেশের মুসল্লিগণ লতিফ সিদ্দিকীর ফাঁসির দাবিতে রাজপথে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে …।"

জামাত বলছে দেশের ধর্মপ্রাণ জনগণ বিক্ষুব্ধ! এই জামাত '৭১ এ কী-না করেছে ধর্মের নামে! মহান মুক্তিযুদ্ধে ইসলামের নামে যা হয়েছে তার বিস্তারিত আর বললাম না। তখন জামাত মানুষ হত্যা করেছে ইসলামের নামেই, ধর্ষণ করেছে ইসলামরক্ষার নামে। এখনও কি তাদের চরিত্র পাল্টেছে? হিন্দুদের বাড়িঘর লুটপাট আর ধর্ষণ, কোনোটা থেমে নেই। এখনও হিন্দুদের পুজায় বাধা দেওয়া হয়, প্রতিমা ভাঙা হয়– হিন্দুদের অনুভূতির খোঁজ নিই না আমরা। তখন আমরা হয়ে উঠি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ!

নারায়ণগঞ্জে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ থেকে লতিফ সিদ্দিকীর মাথার দাম ৫ লাখ টাকা ঘোষণা করা হয়েই গেছে। হেফাজতিদের নিয়ে বেশি কিছু বলার নেই। ভয়টা হয় তখন যখন দেখি ওই সমাবেশে বিএনপি নেতারা বক্তৃতা দেন। এই হেফাজতিরা ২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানীতে যে ভয়াবহ তাণ্ডব চালিয়েছে, সে সময় কোনো ধর্ম তাদের দমিয়ে রাখতে পারেনি। তারা কোরআন পুড়িয়ে দিতেও দ্বিধা করেনি।

ওই সমাবেশ সফল করতে, হেফাজতিদের খাইয়ে-দাইয়ে সহাযোগিতা করতে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া দলের প্রতি নির্দেশ দিয়েছিলেন। এরশাদ মাঠে নেমে তাদের পানি দিয়ে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। সরকারের মন্ত্রীদেরও দেখলাম হেফাজতের সঙ্গে সমঝোতা বৈঠক করতে। এই হেফাজত কোনো মানুষের মাথার দাম যখন ঘোষণা করে তখন সেটা ফৌজদারি অপরাধ হয় না? আমাদের ধর্মীয় অনুভূতি তখন জেগে উঠে না?

এবার দেখা যাক কীভাবে আমরা ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত দেওয়ার অপরাধের জন্য দিন দিন শাস্তির মাত্রা বাড়িয়ে যাচ্ছি। বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে এখন স্বাধীন মতপ্রকাশ আর মুক্তচিন্তার ধারণা বিকশিত হওয়ার পাশাপাশি, ধর্মীয় অবমাননার দায়ে শাস্তির মাত্রা কমিয়ে আনা হচ্ছে। ফৌজদারি অপরাধেও শাস্তির মাত্রা কমিয়ে আনার কথা ভাবছে অনেক দেশ। মৃত্যুদণ্ডের বিধান অনেকে দেশ উঠিয়েই দিয়েছে। অথচ বাংলাদেশে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অপরাধে শাস্তির মাত্রা বাড়ানো হচ্ছে।

বাংলাদেশ দণ্ডবিধিতে প্রথমে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার জন্য শাস্তির বিধান রাখা হয়। ১৮৬০ সালে এটি প্রণীত হলেও, ধর্ম অবমাননায় সাজার বিষয়টি যুক্ত করা হয় ১৯২৭ সালে। দণ্ডবিধির ২৯৫ থেকে ২৯৮ ধারায় এসব বিষয়ে বিস্তারিত বলা আছে। এর মধ্যে মসজিদ, মন্দির কিংবা ধর্মীয় স্থাপনা ভাঙা, ধর্মীয় অবমাননার উদ্দেশে খোঁচাখুঁচিমূলক লেখালেখি, নামাজ, পুজা ইত্যাদিতে বাধা দেওয়া, কবর ধ্বংস করা, শেষকৃত্যে বাধা দেওয়া, ধর্ম অবমাননাকর আওয়াজ, অঙ্গভঙ্গি ইত্যাদি অপরাধে সাজার কথা বলা হয়েছে। এ ধরনের অপরাধে সর্বোচ্চ সাজার মেয়াদ ২ বছর কারাদণ্ড। ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ৯৯ ধারায় ধর্মীয় বিদ্বেষে উস্কানি দিলে পত্রিকা বাজেয়াপ্ত করার বিধানও রয়েছে।

ব্রিটিশরা যখন এই আইন করে তখন ইন্টারনেট বলে কিছু ছিল না। ইন্টারনেটেও যে ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়ে কারও অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া যায় এটি বাংলাদেশের সরকার বুঝতে পারে ২০০৬ সালে। তখন বিএনপি-জামাত জোট সরকার ক্ষমতায়। তাদের প্রণীত 'তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন' এ ধর্ম অবমাননার সাজা ছিল সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদণ্ড। ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগ এটা সংশোধন করে সর্বোচ্চ সাজার মেয়াদ করেছে ১৪ বছর।

এসব আইনের কোথাও বলা নেই যে, ধর্মীয় অনুভূতি শুধু মুসলমানদেরই থাকবে। সব ধর্মের কথাই বলা আছে, কিন্তু আমরা এমন কোনো উদাহরণ খুঁজে পাই না যে, মন্দির ভাঙার দায়ে এই আইন প্রয়োগ হয়েছে। যে ক'টি উদাহরণ আমরা স্মরণ করতে পারি তার মধ্যে অতি সম্প্রতি ৪ ব্লগারকে আটক, ২০০৭ সালে দৈনিক 'প্রথম আলো' র ফান ম্যাগাজিন 'আলপিন' এ কার্টুন প্রকাশের দায়ে কার্টুনিস্টকে ২ মাসের সাজাপ্রদান, তসলিমা নাসরিন ও হুমায়ুন আজাদের বই নিষিদ্ধকরণ ইত্যাদি। এসব ব্যবস্থাই নেওয়া হয়েছে মুসলমানদের অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অপরাধে।

এবার দেখা যাক আমাদের সংবিধান ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে কী বলেছে আর এটা কতভাবে কাঁটাছেড়া করা হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো কি আমাদের অনুভূতি যাচাই করে বারবার সংবিধান সংশোধন করেছে নাকি ভোটের কথা ভেবে করেছে সেটা একটা প্রশ্ন। অন্য কোনো মহলকে খুশি করতেই কি তারা এসব করেছে সে প্রশ্নও করতেই হয়। বাঙালি মুসলমানদের অনুভূতির কথা ভেবেই সংবিধান সংশোধন করা হয়ে থাকলে, সংশোধনের আগে কি মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতি ছিল না?

এক নজরে দেখে নিই সংবিধানের কোথায় কোথায় ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে কী লেখা আছে।

সংবিধানের 'প্রজাতন্ত্র' ভাগে ২ ক ধারায় বলা আছে:

''প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন।''

সংবিধানে 'রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি' ভাগে ১২ ধারায় ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রসঙ্গে বলা আছে:

''ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি বাস্তবায়নের জন্য–

(ক) সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা,

(খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান,

(গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার,

(ঘ) কোনো বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ন, বিলোপ করা হইবে।''

সংবিধানের 'মৌলিক অধিকার ভাগে' ৪১ ধারায় ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রসঙ্গে বলা আছে:


''(১) আইন, জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতা-সাপেক্ষে–

(ক) প্রত্যেক নাগরিকের যে কোনো ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রহিয়াছে;

(খ) প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায় ও উপ-সম্প্রদায়ের নিজস্ব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের স্থাপন, রক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার অধিকার রহিয়াছে;

(২) কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যোগদানকারী কোনো ব্যক্তির নিজস্ব ধর্ম-সংক্রান্ত না হইলে তাহাকে কোনো ধর্মীয় শিক্ষাগ্রহণ কিংবা কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা উপাসনায় অংশগ্রহণ বা যোগদান করিতে হইবে না।''

সংবিধান অনুযায়ী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি ধর্মনিরপেক্ষতা– এ রকম স্ব-বিরোধিতার নজির বিশ্বের আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি!

'৭২ এর মূল সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম বলে কিছু ছিল না। সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ১৯৮৮ সালে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী করে তাতে রাষ্ট্রধর্ম যুক্ত করেন। অজুহাত হিসেবে বলা হয় যে, এদেশের ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান, তাদের ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এই বিধান করা হয়েছে।

আমার মনে প্রশ্ন দেখা দেয়, সংবিধানের এই 'মুসলমানি'র আগে কি ৯০ ভাগ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি ছিল না?

ওই সংশোধনীতেই হাইকোর্ট বেঞ্চ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দেওয়ার বিধান করা হয়েছিল। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট সেই বিধান 'সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক' বলে বাতিল করে দিয়েছিল। বিচারপতিরা রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র হনন করার বিষয়টি বাতিল করার সাহস দেখাননি। তাঁরাও মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতির বিষয়টিতে 'সম্মান' দিয়েছেন!

তাঁরাই যখন আবার সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে '৭২ এর সংবিধানে ফেরত গিয়ে সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল করতে বলেন, তখন রাষ্ট্রধর্মটি বাতিল করার কথা বলেন না।

ধর্মনিরপেক্ষ নীতির দল আওয়ামী লীগ সরকার সুপ্রিম কোর্টের রায়ের অজুহাত দেখিয়ে সংবিধান সংশোধন করে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল রেখে ''হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্মপালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন'' লিখে দিয়ে দায় সেরে নেয়।

সংবিধানের এ রকম কাটাছেঁড়া নিয়ে কারও তেমন উচ্চবাচ্য দেখি না। অন্য ধর্মের মানুষের অনুভূতি কী হচ্ছে সে খোঁজও আমরা রাখি না। এমন সব ক্ষেত্রে আমরা সবাই 'মুসলমান' হয়ে যাই।

রাজনৈতিক দলগুলো ধর্ম নিয়ে এ রকম কেন করে? সংবিধানে ধর্মের উল্লেখ থাকলেই কী আর না থাকলেই-বা কী, এ প্রশ্নের সদুত্তর মেলে না। '৭২ এর সংবিধানে 'বিসমিল্লাহ' শব্দটি ছিল না। জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে এটা অন্তর্ভুক্ত করেন, এর আগে পর্যন্ত কি এদেশের মুসলমানরা 'বিসমিল্লাহ' বলত না?

১৯৮৮ সালে, জেনারেল এরশাদের সময়ে, সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী করা হয়। তার আগে কি এদেশের মুসলমানদের ধর্মকর্ম করতে সমস্যা হয়েছিল? প্রশ্ন জাগে, আমরা কি 'গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ' এ বাস করছি, নাকি 'ইসলামী প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ' এ? কোন দেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছি? ধীরে ধীরে আমরা কেন এত ধর্মীয় 'অনভূতিপ্রবণ' হয়ে উঠছি?

কেউ কেউ বলেন, ভোটের রাজনীতির কারণে এমন হচ্ছে। আমি এর কোনো যুক্তি খুঁজে পাই না। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যত নির্বাচন হয়েছে তার কোনোটিতেই ধর্মভিত্তিক দলগুলো সব মিলিয়ে ৫ শতাংশের বেশি ভোট পায়নি। হেফাজত হোক, জামাত হোক, ইসলামী ঐক্যজোট হোক সব মিলেও তো ৫ শতাংশ ভোট পায় না। এদেশের অধিকাংশ মানুষ শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ আর বিএনপিকেই ভোট দেয়।

ভোটের সময় 'বাঙালি মুসলমান'এর অনুভূতিটা কোথায় থাকে? তখন কি ভোট আর ধর্ম আলাদা হয়ে যায়? যদি তা-ই হয় ধর্ম নিয়ে এত রাজনীতি কেন?