মুসলিম ভাইবোনদের উদ্দেশে আবারও খোলা চিঠি

রেইনার এবার্ট
Published : 4 Oct 2014, 07:28 PM
Updated : 4 Oct 2014, 07:28 PM

২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৪। ভারতের ভুপালের পশুপাখির অধিকার সংরক্ষণ কর্মীরা তাজ-উল-মসজিদের সামনে প্ল্যাকার্ড নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন। প্ল্যাকার্ডগুলোতে ঈদ-আল-আজহাতে মুসলমানদের পশু কোরবানি না দেবার অনুরোধ সম্বলিত বাণী লেখা ছিল। তাঁদের বক্তব্য ছিল, নিরামিষ আহার স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো তো বটেই, উপরন্তু পরিবেশ, প্রকৃতি ও পশুপাখির জন্যেও ভালো।

বেনজির সুরাইয়া ছিলেন এই কর্মীদের একজন। তাঁর পরিধানে ছিল সবুজ রঙের হিজাব এবং লেটুস পাতা দিয়ে মোড়া পরিচ্ছ্দ। তাঁর হাতের প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল Make Eid happy for all, Try Vegan অর্থাৎ ঈদ যেন সবার জন্য আনন্দময় হয়, নিরামিষ খাবার খেয়ে দেখার চেষ্টা করতে পারেন।

এই আন্দোলনের আয়োজন করেছিল PETA নামে পশুপাখির অধিকার সংরক্ষণে নিয়োজিত মুম্বাইয়ের একটি সংস্থা যার সদস্যরা বিশ্বাস করে যে, এই পৃথিবীতে পশুকূলের অস্তিত্ব শুধুমাত্র আমাদের খাদ্য, পোশাক আর আমোদের চাহিদা পূরণ করবার জন্য নয়। কিন্তু জনতার ওপর তাদের এই বাণীর তীব্র প্রতিক্রিয়া হল। তারা PETA এর মহিলা কর্মীদের ওপর চড়াও হয়ে তাদের কিল-ঘুষি থেকে দেওয়া থেকে শুরু করে তাদের দিকে জুতো এবং পাথরও ছুঁড়ে মারতে লাগল। পুলিশ সেই কর্মীদের না বাঁচালে ঘটনা আরও খারাপের দিকে মোড় নিতে পারত। পরে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার জন্য পুলিশই আবার বেনজির সুরাইয়া ও আরও দুজন প্ল্যাকার্ড বহনকারীকে গ্রেপ্তার করেছিল।

দক্ষিণ এশিয়ায় অনেক ক্ষেত্রেই ধর্মীয় ব্যাপারে শান্তিপূর্ণভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নেই। কিন্তু আমার মতে, বেনজির সুরাইয়া ও তাঁর মতো আন্দোলনকারীরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে যে বার্তা ভারতের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন সেটি বাংলাদেশের জন্যও প্রযোজ্য। বেনজির বলতে চেয়েছিলেন পশুদের হত্যা না করেও পবিত্র ঈদ-উল-আজহা পালন করা সম্ভব, প্রাণি হত্যা না করে নিরামিষ পুষ্টিকর খাবার খেয়ে বেঁচে থাকা যায়, আর এভাবে একটি সুন্দর পৃথিবী গড়ে তোলা কঠিন নয়।

কিন্তু বেনজিরের এই কথা শুধুমাত্র ইসলামের জন্যই প্রযোজ্য নয়, পশুকুলের প্রতি দয়া সব ধর্মেরই মর্ম। মহাত্মা গান্ধী কলকাতার কালীঘাট মন্দিরে পশুর বলি দেখে খুবই মর্মাহত হয়েছিলেন। পরে আত্মকাহিনীতে তিনি লিখেছিলেন যে, একজন সাধুকে যখন তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, "এই পশুবলি কি আপনি ধর্ম বলে মনে করেন", তখন সাধু উত্তরে বলেছিলেন, "এমন কোনো মানুষ আছে যে পশুবলিকে ধর্ম বলে মনে করবে?"

গান্ধী মনে করতেন, পশুবলি এমন একটি পাপ যার স্থান নেই কোনো ধর্মেই।

কয়েক বছর আগে প্রায় ৯০ জন বাংলাদেশি মুসলমান বন্ধুর সঙ্গে মিলে আমি একটি চিঠিতে সই করি। চিঠিটি অনেকগুলি বাংলাদেশি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল। আমরা চিঠিটিতে ঈদের সময় পশু কোরবানি রীতিটির পুনর্বিবেচনা করার অনুরোধ করেছিলাম।

[চিঠির মন্তব্য বিভাগে প্রচুর মানুষ এর বিরুদ্ধে বিরূপ সমালোচনা করেন, আমাদের সৌভাগ্য যে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ইট-পাটকেল ছোঁড়া যায় না।]

আমরা লিখেছিলাম যে, ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) যিনি "পুরো সৃষ্টির রহমত" হিসেবে এসেছিলেন (আল কুরান ২১:১০৭), তিনি পশুদের প্রতি সদয় ব্যবহার করতে বলেছিলেন। সুন্নি ইসলামের অন্যতম হাদিস গ্রন্থ, শাহী-আল-বুখারিতে লেখা একটি ঘটনার বিবরণ এ রকম–

হযরত মুহাম্মদ (স.)কে একবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল–

''পশুপাখির প্রতি দয়ামায়া দেখালে কি পরকালে কেউ পুরস্কৃত হয়?''

হযরত মুহাম্মদ (স.) উত্তরে বলেন–

"যে কোনো প্রাণিকে দয়ামায়া দেখালে তার পুরস্কার নিশ্চয়ই আছে।"

কিন্তু ঈদের সময় পশুর সঙ্গে যে দুর্গতি ঘটে তা দয়ামায়া থেকে অনেক দূরে। কুরবানির আগে এই পশুকুলকে বহুদূর (অনেক সময় ভারত থেকে) থেকে পানি ও খাবার ছাড়া হয় হাঁটিয়ে নিয়ে আসা হয়, অথবা ট্রাকে গাদাগাদি করে অবর্ণনীয় দুদর্শার মধ্যে চালান দেওয়া হয়। এমনকি একটি ক্ষেত্রে ভারত সীমান্তের ঐ পার থেকে পাহাড়ের ঢাল দিয়ে পশুদের ঠেলে গড়িয়ে দেবার ঘটনাও আছে। তাই এর মধ্যে অনেক পশুই গরমে, না খেতে পেয়ে অথবা অন্যান্য অত্যাচারে যাত্রা শেষ হবার আগেই মারা যায়।

কুরবানির সময় এই প্রাণিকূলের পা বেঁধে গলার উপর দিয়ে ছুরি চালালে জীবন ও মরণের মধ্যে লড়াইয়ে প্রাণিগুলো ছটফট করতে থাকে, শেষনিশ্বাস না পড়া পর্যন্ত কয়েক মিনিট পার হয়ে যেতে পারে। আর এই মর্মান্তিক দৃশ্যটি সংঘটিত হয় বাদবাকি অপেক্ষারত আতঙ্কিত পশুকূলের সামনে।

এই পুরো ব্যাপারটা না মানবিক না হালাল। যে ইসলাম আমাদের ভালোবাসা ও দয়ামায়ার ব্যাপারে সংবেদী হতে শেখায় তার সঙ্গে এর কোনো সঙ্গতি নেই। তাই আমরা সেই চিঠিতে লিখেছিলাম, আমিষ পদার্থের বদলে সবজি, ফলমূল অথবা অর্থ ইত্যাদি দান করলে ইসলামের নীতি মেনে চলাও হবে এবং হযরত ইব্রাহিমের কাহিনি স্মৃতিতে জাগ্রত রাখা যাবে।

আল কুরআনে লেখাই আছে–

''আল্লাহতালার কাছে কুরবানি দেওয়া পশুটি বা তার রক্ত পৌছায় না, পৌঁছায় শুধু মানুষের ধর্মানুরাগ।''

[আল কুরআন, ২২: ৩৭]

আজ আমি আবার আমার সব মুসলমান বন্ধুদের কাছে পশু কোরবানি দেবার রীতি পুনর্বিবেচনা করার অনুরোধ জানাচ্ছি। ইসলামের মর্ম যদি উদারতা ও সমবেদনাই হয় তাহলে পশু কুরবানি দেওয়া ছাড়াও আরও অনেক পদ্ধতি খুঁজে নেওয়া যাবে পবিত্র ঈদ পালন করার জন্য।

ঈদ শুধু মানুষের জন্য নয়, সৃষ্টিকর্তার সকল প্রাণির জন্য আনন্দের উৎসব করে তুলুন।

সবাইকে ঈদ মুবারক।