ব্যবসায়ীরা মানুষের পেটে লাথি মারতে চায়

বেবী মওদুদ
Published : 4 June 2009, 04:10 PM
Updated : 15 Jan 2011, 02:56 PM

গণতন্ত্র ও অধিকার নিয়ে আমরা প্রশ্ন তুলি, প্রতিবাদ করি এবং আন্দোলনও করে থাকি। সবই আমাদের সাংবিধানিক ও মানবধিকার হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। কেউ কেউ ন্যায়সঙ্গত অধিকার হিসেবে বিশ্লেষণ করে থাকেন। আমরা দেখেছি, সাধারণ মানুষ এসবের কোন ব্যাখ্যা জানে না, এমনকি শুনতেও চায় না। শুধুমাত্র শাসকবর্গ, রাজনৈতিক নেতা কর্মী, বিশ্লেষকদের কাছেই গণতন্ত্র ও অধিকার শব্দটি উচ্চারিত হয়ে থাকে বেশি। সাধারণ মানুষ এর কোন সুফল পায় না বলেই হয়তো আগ্রহ কম দেখিয়ে থাকে। তবে ১৯৭১ সালে আমরা দেখেছি স্বাধীনতার প্রশ্নে সাধারণ মানুষ সামনের কাতারে এগিয়ে এসেছে, মুক্তিযুদ্ধ করেছে এবং জীবন দিয়েছে। তারা তখন জেনেছিল, তাদের গণতন্ত্র ও অধিকার কেমন করে পাকিস্তানী সামরিক শাসকরা দমন করার অপচেষ্টা করেছে। বৈষম্য-বঞ্চনায় কীভাবে পদদলিত করেছিল বুটের তলায়। বাঙালির প্রিয় নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পেছনে তারা সেদিন হিমালয় সমান শক্তি নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙালির ন্যায়সঙ্গত অধিকার। স্বদেশ ও স্বজাতির মুক্তির লক্ষ্যে সেদিন সমগ্র বাঙালি একাত্ম হয়েছিল। দেশপ্রেমের সেই চেতনা, সেই অনুভূতি, সেই সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায় হয়ে থাকবে। অশ্রু-বেদনা-আনন্দের মধ্য দিয়ে বাঙালির এই বিজয় অর্জন আমরা সেই সময়ের মানুষ হিসেবে দেখেছি এবং অংশগ্রহণ করতে পেরেছি।

গণতন্ত্র ও অধিকারের কথা বলছিলাম, সাধারণ মানুষ এসবের কোন ধার ধারে না। তারা মনে করে, এসব দেখা যাদের দায়িত্ব, এসব বাস্তবায়ন করা যাদের কর্তব্য – তারাই বুঝুক এবং তর্ক-বিতর্ক করুক। আর এজন্য শ্রেষ্ঠ স্থান হচ্ছে জাতীয় সংসদ, যেখানে তারা ভোট দিয়ে প্রতিনিধি হিসেবে সংসদ সদস্যদের পাঠিয়ে থাকে। কিন্তু দৃশ্যত আমরা সেটা দেখি না। আমরা যেটা দেখি সেটা হলো, সংসদে বিরোধীদলের অহেতুক অনুপস্থিতি, বাইরে মিডিয়ার সামনে ইচ্ছেমতো কথা বলা। গোলটেবিলে, মতবিনিময় ও টিভি চ্যানেলে টক শোর মাধ্যমে আজকাল আমরা তাতো সবসময় দেখছি। শাসকবর্গ সংসদে বসে অনেক বিল পাশ করেন, অনেক প্রস্তাব পাশ করেন, অনেক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন– এগুলোর তদারকী করা বিরোধীদলের কর্তব্য। এসব জনকল্যাণ বিরোধী ও জাতীয় স্বার্থ ক্ষুন্ন করে কিনা সেসব নিয়ে তো তারাই চুলচেরা বিশ্লেষণ করবেন, কিন্তু সে কাজটি হচ্ছে না। এজন্য সাধারণ মানুষ দায়ী করবে কাদের ? শাসকবর্গ ভালো করলে কেন ভালো, খারাপ করলে কেন খারাপ তা যুক্তিসঙ্গতভাবে বলার দায়িত্ব কাদের ?

আমাদের সাধারণ মানুষের চাওয়া পাওয়া খুব সামান্য। তিনবেলা পেটভরে খাওয়া, শান্তিতে ঘুমান, নিশ্চিন্ত মনে কাজ-কর্ম করে ন্যায্য আয় করা আর একটু চিত্ত বিনোদন। এটুকু পেলেই তারা শান্ত থাকে। এর বাইরেও অবশ্য কিছু চাওয়ার আছে। সেটা হলো নিজের জন্য একটা ছোট্ট হলেও ঘর, ছেলেমেয়েরা যেন শিক্ষার্জন করতে পারে এবং কর্মসংস্থান হয়, যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকে। আরও একটা ভীষণ বড় চাওয়া আছে সেটা হলো ভোট দেবার অধিকার। আমরা জানি, জন্ম নিলেই অধিকার জন্মে। সেটা হলো মৌলিক অধিকার। সেগুলো হচ্ছে অন্ন,বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও কর্মসংস্থান। এটা এখন সর্বজন-স্বীকৃত। কল্যাণকামী রাষ্ট্রগুলির প্রথম ও প্রধান কাজ হচ্ছে এটাই। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমাদের দেশে মানুষের দুরবস্থা কি কমেছে ?
বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, আমাদের দেশে শতকরা পঁচিশ ভাগ মানুষ হতদরিদ্র। দারিদ্র সীমার মধ্যে বসবাস শতকরা পঁয়তাল্লিশ ভাগ মানুষ। এর ওপর রয়েছে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত। উচ্চবিত্তের মধ্যে কোটিপতির সংখ্যা এখন সাত লক্ষ। অথচ স্বাধীনতার পূর্বে এই সংখ্যা সাতজনও ছিল না। বাংলার সম্পদ লুটপাট করে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী ও তাদের দোসররা কোটিপতি হয়েছে। বাংলার মানুষকে দারিদ্রের অভিশাপে মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য করেছে।

বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সরকারের স্থায়িত্ব ছিল মাত্র সাড়ে তিন বছর। তিনি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের ভিত একটা শক্ত অবস্থানে প্রতিষ্ঠার পর যখন অর্থনৈতিক মুক্তির ডাক দিলেন, তখনই তাকে হত্যা করলো পরাজিত শক্তির দেশী-বিদেশী দোসররা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর পাকিস্তানের দালালচক্র এবং সামরিক শাসক গোষ্টী দেশকে পাকিস্তানী শাসন ধারায় চালাতে থাকে। তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধকে ধ্বংসের ষড়যন্ত্র শুরু করে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের সকল ঐতিহ্যকে বিনষ্ট করার এবং বাঙালির হৃদয় থেকে তাদের প্রিয় নেতা শেখ মুজিবকে মুছে দেয়ার ঘৃণ্য অপচেষ্টা চালায়। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয় বঙ্গবন্ধু বিরোধী কিছু রাজনৈতিক নেতা, বুদ্ধিজীবী বিশেষণধারী একদল শিক্ষাবিদ, আইনজীবী, সাংবাদিক, সাহিত্যিক ইত্যাদি শ্রেণীর মানুষ। তারা বঙ্গবন্ধু সরকারের তীব্র সমালোচনা করে থাকে। দুর্ভিক্ষের কারণে মানুষ মৃত্যুর জন্য অভিযোগ তোলে। দূর্নীতির দোষারোপ করতে থাকে এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কথা বড় গলায় বলতে থাকে। দ্রব্য মূল্যবৃদ্ধির অভিযোগ তুললেও তারা নিজেরাই পরবর্তীতে রেশন প্রথা নিষিদ্ধ করে চাল, ডাল, তেল, চিনি, লবনের দর সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে নিয়ে যায়। তারপর দ্রব্যমূল্য ক্রমান্বয়ে দু'দশক ধরে তারা নিয়ন্ত্রন করে চলে। এরপর ধীরে ধীরে একটি সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে। বিশেষ করে ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা প্রশাসন– সবাই যেন এই সিন্ডিকেট চক্রের ধারক বাহক হয়েছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। উৎসব পালা পার্বন ছাড়াও ঝড়, বৃষ্টি ও খরার মৌসুমেও দ্রব্য মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জন্য শ্বাসকষ্ট হয়ে উঠেছে। আমাদের ব্যবসায়ীরা সরকারী বেসরকারি নানা সুবিধা ভোগ করেন, আরও সুবিধার দাবি করে থাকেন। তাদের ভাগ্যোন্নয়নের কোন কমতিও নাই, ঘাটতিও থাকে না। দুর্ভাগ্য, দুর্গতি ও দুরবস্থা শুধু সাধারণ মানুষের। যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়, তাদের অবস্থান তো আরও শোচনীয়।

দ্রব্য মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে অতীতে আমাদের দেশের মন্ত্রীদের মুখে শুনেছি, 'মিডিয়া মিথ্যা প্রকাশ করে থাকে', 'বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়ে থাকে,' 'বাংলাদেশের মানুষ বেশি খায়,' 'গরীব মানুষ ডিম খায় না, মূল্য বৃদ্ধি পেলে তাদের কিছু যায় আসে না' ইত্যাদি নানা কথা। যারা দায়িত্বহীন তাদের কন্ঠে এসব মানায়। কেন মূল্য বৃদ্ধি ঘটছে তার কারণ সন্ধানের চেষ্টা না করে এভাবে সমস্যা সমাধানের নামে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মশকরা করা নিশ্চয় প্রতারণা হিসেবে বিবেচনা করা ছাড়া উপায় থাকে না।

সরকার কৃষিতে ভর্তুকি, বর্গাচাষি ঋণ, সার ও কৃষি উপকরণ সহজলভ্য করছেন বলে থাকেন। বাজেটের সময়ও বলা হয়ে থাকে। তারপরও কৃষকের উন্নতি হয় না। কৃষিজাত খাদ্যের দামও নিয়ন্ত্রিত দেখি না। ব্যবসায়ীরা সুবিধা হিসাবে আমদানী শুল্ক হ্রাস, সহজ শর্তে ঋণ পেলেও আমদানি করা দ্রব্যের মূল্যও চড়তে থাকে। তারা সস্তায় কিনে এনেও দেশে দাম বাড়িয়ে দেয় যা একেবারে চক্ষু লজ্জাকে ছাড়িয়ে যায়। বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় থাকাকালে প্রতি কেজি চালের দর সর্বনিম্ন ১০-১২ টাকা ছিল, ২০০১ সালে বিএনপি-জামাত সরকারের সময় তা উঠে দাড়ালো ৩০-৩৪ টাকায়, ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ৩৮-৪৫ টাকায় গিয়ে থামলো। ২০০৯ সালে আওয়ামী সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করার পর চালের দর সর্বনিম্ন প্রতি কেজি ১৮ টাকায় নেমেছিল। এখন আবার ২৮-৩৬-৪২ টাকা হয়েছে। কেন এমন হবে?

দ্রব্য মূল্যবৃদ্ধি সিন্ডকেট ভাঙ্গতে পারছে না কেন সরকার ? তারা কি এমনই শক্তিশালী যে সরকার তাদের কালো হাত গুঁড়িয়ে দিতে পারেন না? এটাও কি আমাদের বিশ্বাস করতে হবে? কৃষক যে ফসল ফলাচ্ছে, তা কেন খুব সহজভাবে বাজারজাত বা সরকারি গুদামজাত করা হবে না? কেন সেখানে লাভ উঠাতে ব্যবসায়ীরা পাগল হয়ে উঠবে ? প্রকৃত কৃষককে ক্ষতিগ্রস্থ না করে সরকার খুচরো ও পাইকারি বাজার দর নির্ধারণ কেন করবে না ? কেন গ্রাম-থানা পর্যায়ে প্রতি কেজি টমেটু দশ টাকা আর রাজধানি ঢাকা ও অন্যান্য শহরের বাজারে প্রতি কেজি ৫০ টাকা হবে ? প্রতিদিন ভোরবেলা কেন সাধারণ মানুষ দুশ্চিন্তা নিয়ে বাজারে কেনাকাটা করতে যাবে ? খাদ্য গ্রহণের সঙ্গে পুষ্টি-ক্যালরি ও শারীরিক-মানসিক সুস্থতা নির্ভর করে। ডিমের হালি ২০ টাকা থেকে মাত্র ক'দিনেই ২২ টাকা হবে কেন? দেশে তো কোন খরা, দুর্ভিক্ষ, ঝড়, বন্যা হয়নি। তাহলে কেন এই ভরা সব্জির মৌসুমে লাফিযে লাফিয়ে দর বৃদ্ধি করা হবে?

দেশে অনেক বড় বড় কাজ হয়, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হয়। ব্যবসায়ীরা দয়া করে সেখান থেকে অর্থোপার্জন করুক, প্রশাসনও সেখান থেকে ঘুষ খেতে বা অর্থ চুরি করতে পারে। আমি খুব সহজ অর্থে কথাটা বলতে বাধ্য হলাম। সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধিতে তাদের উৎসাহ কেন ? এখানে তারা কি ছাড় দিতে পারে না? রোজার মাসে যেখানে তারা অধিক মুনাফা করার লোভ সামলাতে পারেনা সেখানে তাদেরকে ধর্মভীতি বা মানবতার কথা শুনিয়ে লাভ কী? সম্প্রতি তারা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বেশ বড় সভা করেছে। তাদের নাকি ব্যবসা-বাণিজ্যের মহা ক্ষতি হচ্ছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ে তো তারা কখনও কোন সভা করেন না। সেটা কি তাদের স্বার্থবিরোধী হয়? সরকার তেলের দর বেধে দিলো, সেটাও তারা অগ্রাহ্য করে নিজেরাই দর বাড়িয়ে দিল কেন? তারা ব্যাংক ঋণ, কম দামে বাণিজ্যিক প্লট, আমদানী শুল্ক হ্রাস বা ছাড়, নানা ধরণের সাবসিডি ইত্যাদি সুবিধা পেয়ে থাকেন। একজন ব্যবসায়ী একটা ব্যবসায়ে সন্তুষ্ট থাকেন না। তারও শত রকম ব্যবসা থাকে। তারপরও তাদের লাভ হচ্ছে না, ক্ষতি হচ্ছে বলে বড় গলায় কথা বলতে দেখা যায়। এতো অমানুষ হবেন কেন ? মানুষের জন্য কল্যাণকর কাজ করে নিজের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতেও তো পারেন। দ্রব্য মূল্যবৃদ্ধির পাগলা ঘোড়া থেকে নামুন, সাধারণ মানুষের পেটে লাথি মেরে আর নিজেদের পকেট ভরবেন না।

বেবী মওদুদ : শিশুসাহিত্যিক ও কলামলেখক।  সোশ্যাল অ্যাফেয়ার্স এডিটর, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।