আন্দোলন নয় সংসদে গিয়ে কথা বলুন

আতাউস সামাদ
Published : 10 Jan 2010, 06:28 PM
Updated : 10 Jan 2010, 06:28 PM

সালতামামি বাংলাদেশের গণ-মাধ্যমকে দখল করে রেখেছিল গত সপ্তাহটা জুড়ে। তার কারণও ছিল। এক তো হলো যে ইংরেজী নতুন বছরের শুরুতে আগের বছরের হিসাব নিকাশটা তখনও চলছিল। অন্য যে কারণটা ছিল সেটা আরও বড়।

তা হলো, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মহাজোট তথা আওয়ামী লীগ সরকারের এক বছর পূর্ণ হলো গত ৬ জানুয়ারি। তাও আবার প্রথম বছর। এছাড়াও কিছু কারণ ছিল সরকারের প্রথম বছরের দিকে বিশেষ করে নজর দেবার।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তুলনামূলকভাবে নবীনদেরকে নিয়ে তাঁর এবারের মন্ত্রিসভা গঠন করেছিলেন। দ্বিতীয়ত, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব তিনি নিজের হাতে রেখেছেন এবং আর তিন নারী মন্ত্রীকে দিয়েছেন তিনটি কঠিন বিষয়ের দায়িত্ব, যথা স্বরাষ্ট্র, কৃষি ও পররাষ্ট্র।

তাছাড়া, এই সরকারের কাজকর্মকে এর ঠিক আগের অনির্বাচিত ও সেনাসমর্থিত যে সরকার জরুরি অবস্থার আইন দিয়ে দুই বছর দেশ শাসন করেছে তার সাথে এবং তার আগে বিএনপি জামায়াত জোটের পাঁচ বছরের শাসনামলের সাথে তুলনা করেও দেখা হচ্ছিল। তদুপরি জাতীয় সংসদে বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুবিধা কেমনভাবে কাজে লাগাচ্ছে আওয়ামী লীগ তাও বিবেচ্য বিষয় ছিল বছর শেষে।

বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি'র মধ্যে রাজনৈতিক মেরুকরণ খুবই তীব্র একথা ঠিক বটে কিন্তু মধ্যবর্তী অবস্থানেও আছেন অনেকে। গত ৬ জানুয়ারি তারিখে বর্তমান সরকারের প্রথম বছরপূর্তি উপলক্ষে বাংলাদেশের দৈনিক পত্রিকাগুলোতে এই বিভিন্ন ধারার অভিমতের প্রতিফলন দেখা গেছে।

দেশের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলো এদিন প্রধান শিরোনামে লিখেছিল, 'মোটামুটি সঠিক পথে সরকার।' দৈনিক সমকাল শিরোনাম করেছিল, 'সরকারে আস্থা এখনো অটুট।' এই দু'টি পত্রিকা তাদের উদ্যোগে পরিচালিত আলাদা আলাদা জনমত জরিপের ভিত্তিতে সেদিন তাদের প্রধান খবর ও শিরোনাম করেছিল। দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার প্রধান শিরোনাম ছিল, 'ব্যর্থতার পাল্লা একটু ভারি।' উল্লেখ করা যেতে পারে যে, এই পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক সালমা ইসলাম বর্তমানে জাতীয় সংসদে জেনারেল এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির মনোনীত মহিলা সদস্য। বর্তমানে সরকার বিরোধী পত্রিকা আমার দেশ শিরোনাম করে, 'মামলাবাজির এক বছর।'

প্রাচীন দৈনিক পত্রিকা ইত্তেফাকের শিরোনাম ছিল, 'এক বছরে সরকারের ব্যর্থতার চাইতে সাফল্য বেশি।' আর দৈনিক ইনকিলাব শিরোনাম করে, 'মহাতমসায় আলোর ঝর্ণাধারা।' ইংরেজী দৈনিক ডেইলী স্টার শিরোনামে লিখেছিল, 'A year of bold initiatives and timid implementation', আর অপর একটি ইংরেজী দৈনিক ইন্ডিপেনডেন্ট 'Mixed bag of suceess and failure', দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলোয় প্রকাশিত মতামত জরিপে দেখানো হয়েছে জরিপভুক্ত ১৫০০ ব্যক্তির মধ্যে শতকরা ৪৬ (ছেচল্লিশ) জন বলেছেন 'দেশ কিছুটা সঠিক পথে' চলেছে।

দৈনিক সমকাল পত্রিকার জরিপে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাজের মূল্যায়ন করে 'মোটামুটি সন্তোষজনক' বলেছেন শতকরা ৫৩.২৯ জন। আর দি ডেইলি স্টার পত্রিকার জরিপ বলছে শতকরা ৫৩ জন সরকারের কাজে সন্তুষ্ট।

এসব শিরোনাম দেখে ও জরিপের সার সংক্ষেপ পড়ে আমার কাছে মনে হয়েছে যে দেশে কেউই চান না যে একটা নির্বাচিত সরকার এক বছরের মাথায়ই বিদায় হয়ে যাক। অধিকাংশ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে, মাত্র এক বছর সময় কোন সরকারের কাজের মূল্যায়নের জন্য যথেষ্ট সময় নয়। এবং এদের অনেকেই সরকারকে সহানুভূতির চোখে দেখছেন। তাঁরা চান সরকার তার কাজকর্মে ও দেশের বিভিন্ন সমস্যা সমধানের জন্যে আন্তরিকভাবে সচেষ্ট থাকুক। জরিপগুলোতে দেখা যায যে, যাঁরা মতামত জানিয়েছেন তাঁদের প্রায় সবাই বিডিআর বিদ্রোহ দমন এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার উচ্চতম আদালতে সম্পন্ন করাকে বর্তমান সরকারের সাফল্য হিসাবে মনে করছেন।

জরিপে অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশ কৃষিখাতে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের প্রশংসা করেছেন। তবে অধিকাংশই নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত থাকার উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং সরকার সমর্থকদের টেন্ডারবাজির (অর্থাৎ প্রতিযোগিদের টেন্ডারপত্র ছিনিয়ে নেওয়া বা তাদেরকে টেন্ডার জমা দিতে না দেওয়া) সমালোচনা করেছেন। এটাকে তাঁরা দুর্নীতি বন্ধ করার পথে বড় বাধা বলেও মনে করছেন (সূত্র: সমকাল)। ক্ষমতাসীনরা যে চাকরি বাকরি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দলীয়করণ চালাচ্ছেন এবং এই কাজটা যে ঠিক নয় সেই অভিমত ব্যক্ত করেছেন অধিকাংশ। বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা ক্রসফায়ার দ্বারা হত্যার বিরুদ্ধে মত দিয়েছেন অধিকাংশ।

তিনটি পত্রিকার মতামত জরিপে বিরোধী দল বিএনপি'র পক্ষে পাওয়া যায় নাই কিছুই। প্রথম আলো পত্রিকার বছর শেষের জনমত জরিপে দেখা গেছে জরিপভুক্ত শতকরা ৮৮ জন প্রধান বিরোধী দলের সংসদ বর্জন সমর্থন করেন না। আর দৈনিক সমকাল পত্রিকার জনমত জরিপে দেখা যাচ্ছে জরিপে মতাদানকারীদের শতকরা ৮৫.৩৯ ভাগ বিরোধী দলের টানা সংসদ বর্জন অননুমোদন করছেন। আমার নিজের কাছে মনে হচ্ছে, দেশের মানুষ যেহেতু গণতন্ত্র দেখতে চান যে, গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত ও স্থায়ী হোক এবং যেহেতু এজন্য তাঁরা আগ্রহ ভরে ও বিপুল সংখ্যায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দেন তাই তাঁরা চান যে, বিরোধী দল যেন অবশ্যই সংসদ অধিবেশনে অংশগ্রহণ করে এবং সেখানে যেভাবেই হোক যতদূর সম্ভব জনগণের অভাব অভিযোগের কথা তুলে ধরে। দ্বিতীয়ত, যে সমস্ত অভিযোগ তুলে বিএনপি সংসদ অধিবেশন বর্জন করে চলেছে সেগুলো সাধারণ মানুষের কাছে ব্যক্তিকেন্দ্রিক বলেও প্রতিভাত হচ্ছে বলে মনে হয়। আমি যাদের সাথে এ বিষয়ে কথা বলেছি তাদের অনেকেই মনে করেন যে, কোন জাতীয় প্রশ্নে বড় বজর্নের আন্দোলন তৈরি করতে পারলে তার সমর্থনে সংসদ বর্জন অর্থপূর্ণ বা গ্রহণযোগ্য হতে পারে।

জনগণের কাছে অস্পষ্ট বা বৃহত্তরভাবে জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট নয় এমন বিষয় নিয়ে সংসদ বর্জনের পক্ষে জনসমর্থন বা গণ আন্দোলন তৈরি হবে এমন আশা করা অযৌক্তিক। এছাড়া বিএনপি এখনও অতীতের ভার থেকে মুক্ত নয়। বিএনপি'র ভিতরে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোন শুদ্ধি অভিযান হয়নি। বরঞ্চ সম্প্রতি বিএনপি'র যেসব কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে সেগুলিতে দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত ও বিচারাধীন এমন অনেকে আছেন।

যদি একথা বলা হয় যে, উচ্চ আদালতে এঁদের অপরাধ এখনো প্রমাণিত হয়নি তাই এঁদের দলে স্থান দেওয়া যায় – আর এমন কথা বিএনপি নেতারা বলছেন – তার উত্তরে একথা বলতে হয় যে, সাধারণ মানুষের চোখে যে ব্যক্তি দুর্নীতিপরায়ণ বলে প্রতীয়মান হচ্ছেন তিনি দলের প্রতি জনসমর্থন নয় বরঞ্চ সমালোচনা বা রোষ সৃষ্টি করেন। এটা বাংলাদেশের রাজনীতিতে একাধিকবার প্রমাণিত হয়েছে।

দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্তদের দলে গুরুত্বপূর্ণ পদ দিয়ে বিএনপি যখন সমালোচিত হচ্ছে সেই সময় দলটির লাগাতার সংসদ বর্জন নীতি সংগঠনটিকে যে আরও বিতর্কিত করে তুলছে তা খুবই স্পষ্ট। এই পরিস্থিতিতে সরকার নানাবিধ ব্যর্থতার পরিচয় দিলেও চট করে কোন মহাবিপাকে পড়বে না। তবে সরকারকেও মনে রাখতে হবে যে, জনগণের সহানুভূতি নিঃসীম নয়।