সাঈদীর রায়: কিছু কথা কিছু বাস্তবতা

বৃন্দলেখক
Published : 27 Sept 2014, 03:26 AM
Updated : 27 Sept 2014, 03:26 AM

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে নানাবিধ আন্তর্জাতিক অপরাধে সংশ্লিষ্ট থাকবার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ট্রাইব্যুনালে ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিল আসামি দেলাওয়ার হোসেইন সাঈদী। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, উক্ত মামলাটির পরবর্তী নিষ্পত্তি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিলেট ডিভিশন আসামি সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডের দণ্ড হ্রাস করে তাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেবার রায় প্রদান করেন ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৪।

ইন্টারন্যশনাল ক্রাইমস রিসার্চ ফাউন্ডেশন [আইসিআরএফ] বাংলাদেশে বিদ্যমান আইন ও আদালতের প্রতি যদিও অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল, তথাপিও আইসিআরএফ মনে করে রায়টি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রদত্ত প্রাথমিক রায়ের তুলনায় অসামাঞ্জস্যপূর্ণ, বাঙালি জাতির জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক এবং আসামি সাঈদীর মাধ্যমে নির্যাতিত সকল পরিবার ও স্বজনদের প্রতি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পরিপন্থী।

সাম্প্রতিক সময়ে বর্তমান সরকারের সঙ্গে আলোচ্য আসামির রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর যে গোপন সমঝোতার সন্দেহ বাংলাদেশের সকল মানুষের মনে দানা বেঁধেছে সেই প্রেক্ষিতে আইসিআরএফ এখনও কোনো সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে উপনীত হয়নি। যদিও জনমনের এই জোরালো সন্দেহের অবস্থানের প্রেক্ষিতে আইসিআরএফ পুরো পরিস্থিতির উপর তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ করছে।

তবে আইসিআরএফ এ কথা স্পষ্টভাবে বলতে চায় যে, সরকার তাদের প্রসিকিউটরবৃন্দ ও তদন্ত সংস্থার মধ্যে সমন্বয় সাধনের ক্ষেত্রে আশানুরূপ সাফল্য দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে এই মামলার বিভিন্ন স্তরে আসামির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের প্রয়োজনে যে দলিল, তথ্য, প্রমাণ ও গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা অপরিহার্য ছিল সেগুলোর কোনো কিছুই আমরা যথাযথভাবে দেখতে পাইনি।

উল্লেখ করা যায় যে, আপিলেট ডিভিশনে মামলা চলাকালীন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা এই মামলার প্রয়োজনে ঘটনাস্থল ও নানাবিধ তথ্যাদি সংগ্রহে যখন স্বয়ং নিজেই উদ্যোগী হয়েছিলেন, তখনই বস্তুত এই মামলাটির হীনদশা সম্পূর্ণভাবে আমাদের বোধগম্য হয়েছিল। অথচ এই তথ্য-প্রমাণ কিংবা যে কোনো প্রয়োজনীয় নথি সংগ্রহ প্রাথমিকভাবে মূলত তদন্ত সংস্থা এবং মামলার সংশ্লিষ্ট আইনজীবীর গুরুদায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। রাষ্ট্রপক্ষের এই সকল ব্যর্থতা প্রাথমিকভাবে ট্রাইব্যুনালের রায়ের ভিত্তিতে হলেও, এই ব্যাপারে আরও স্পষ্টভাবে বলা যাবে আপিলেট ডিভিশনের পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে আসবার পর।

আসামি সাঈদীর মামলা চলাকালীন বেলজিয়াম-প্রবাসী যে ব্যক্তির সঙ্গে মাননীয় বিচারপতি নাসিমের কথোপকথনের অডিও এবং ইংল্যান্ড-প্রবাসী যে বিতর্কিত ব্যক্তির নাম বার বার গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল সেই ক্ষেত্রেও উল্লেখিত ওই দুই প্রবাসীর ব্যাপারে কোনো আইনানুগ ব্যবস্থা কিংবা তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ তদন্তের সংবাদ পরবর্তী সময়ে আমরা পাইনি।

এই কথোপকথন এবং বিচারপতির ই-মেইল অ্যাকাউন্ট হ্যাক করবার পরবর্তী সময়ে এই মামলার একজন রাষ্ট্রপক্ষীয় সাক্ষী মোস্তফা হাওলাদারকে রাতের আঁধারে দুর্বৃত্তরা এসে খুন করে চলে গেলেও, সরকার সাক্ষীদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বরাবর উদাসীন অবস্থানেই থেকেছেন, যদিও এই ঘটনাগুলোর মধ্যে স্পষ্ট যোগসাজশ রয়েছে বলেই দৃশ্যমান হয়। বিচার বিতর্কিত করবার জন্য এমন বিদেশি ষড়যন্ত্রের সুষ্ঠু প্রতিকার ঘটনার দুই বছর অতিবাহিত হয়ে গেলেও পাওয়া যায়নি যা এই বিচারের নিরাপত্তা তীব্রভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

এই রায় কেন্দ্র করে জনমনে যে হতাশা তৈরি হয়েছে এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে ঐতিহাসিক গণজাগরণ মঞ্চের যে প্রতিবাদ এবং অবস্থান সেটির মূল দর্শনের সঙ্গে আইসিআরএফ একমত; যদিও আমরা আগেও বলেছি যে, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সমঝোতার চলমান ধারণাটি এখন পর্যন্ত আইসিআরএফ-এর কাছে পর্যবেক্ষণমূলক অবস্থায় রয়েছে। গণজাগরণ মঞ্চের এই নৈতিক প্রতিবাদের মুহূর্তে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক তাঁদের ওপর যে অত্যাচার, নির্যাতন ও প্রহসনের ঘটনা ঘটেছে সেই ঘটনার তীব্র নিন্দা আমরা জানাচ্ছি। সরকারি কর্তৃপক্ষের এহেন কার্যকলাপ অবশ্যম্ভাবীভাবেই আলোচিত "আঁতাত কিংবা সমঝোতা"-র সন্দেহ আরও বেগবান করে তুলছে বলেই আইসিআরএফ মনে করে।

যদিও আমরা এই রায়ে অত্যন্ত ব্যথিত এবং বিস্মিত, তথাপিও আমরা মনে করি রায় নিরবচ্ছিন্ন রাখাটাই মূলত সরকারের জন্য এখন সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কিংবা এর প্রতি শ্রদ্ধার জায়গার যে বিস্তর ফারাক আমরা দল ভেদে বরাবর দেখতে পাই, সেটি মাথায় রেখেই বর্তমান বাংলাদেশ সরকার সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদের ব্যাপারে মনোযোগী হবেন, এই বিশ্বাস আমরা করতে চাই।

সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদে মহামান্য রাষ্ট্রপতির হাতে দণ্ডিতের যে দণ্ড হ্রাসের ক্ষমতা বিদ্যমান সেটির ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্টভাবে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনে দণ্ডিত ব্যক্তির সাজা হ্রাস করবার ক্ষমতা অনতিবিলম্বে লোপ করে সংবিধান সংশোধিত হলেই জনমনে আশার সঞ্চার হবে। সে ক্ষেত্রে সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের অপরাধীদের ক্ষমা পাবার যে সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে, তা রহিত হবে এবং সর্বোচ্চ সাজাহীন শাস্তিগুলোর ব্যাপারে একটি চিরনিশ্চয়তার স্থান তৈরি হবে।

সংবিধান পরিবর্তনের পাশাপাশি এই মামলায় কিংবা এই ট্রাইব্যুনালে অন্যান্য মামলার ক্ষেত্রে যে গাফিলতির প্রশ্ন এসেছে তদন্ত কিংবা প্রসিকিউশন দলের বিরুদ্ধে, সেটির ক্ষেত্রেও একটি শুদ্ধি অভিযান চালানো আবশ্যক বলে আইসিআরএফ মনে করে। বিচার চলাকালীন যে প্রসিকিউটর বা তদন্ত কর্মকর্তাদের নিয়ে সন্দেহজনক ''নানাবিধ গুজব" রটেছে তাদের বিরুদ্ধেও আবশ্যিকভাবে তদন্তের প্রয়োজন রয়েছে।

আমরা বাংলাদেশ সরকারের কাছে উল্লিখিত বিষয়গুলোর দিকে লক্ষ্য করবার জন্য বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি।

বৃন্দলেখক: লেখকগণ ইন্টারন্যশনাল ক্রাইমস রিসার্চ ফাউন্ডেশন [আইসিআরএফ]-এর সদস্য।