নোবেল বিজয়, ব্যাংক এবং ক্ষুদ্র ঋণ

এরশাদ মজুমদার
Published : 13 Jan 2011, 05:18 PM
Updated : 13 Jan 2011, 05:18 PM

গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. ইউনূসকে নিয়ে এখন দেশে তোলপাড় চলছে। সরকার ও সরকারী দল ড. ইউনূসের উপর ক্ষেপে গেছেন। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ইউনূসকে নিয়ে নানা কথা বলেছেন যা অশোভন পর্যায়ে পড়ে বলে আমার মনে হয়। ইতোমধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিপু মনি, দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ ও ছাত্রলীগের নেতারাও ইউনূসের বিরুদ্ধে অনেক কথা বলে ফেলেছেন। দেশের সুধীজন বলেছেন, অভিযোগের তদন্তের আগে এসব কথা বলা উচিত হয়নি। ইউনূস নিজেই সরকারী তদন্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। সুযোগ পেয়ে মিডিয়া ও নানা জন নানা কথা বলতে শুরু করেছেন। যাক শেষ পর্যন্ত সরকার তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। ড. ইউনূস এখন একজন বিশ্বনাগরিক। দরিদ্র গ্রামীণ নারীদের ভেতর বিনা বন্ধকে ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ করে বিশ্বব্যাপী নাম করেছেন। এজন্যে তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন। সে সময়ে দেশের মানুষ আনন্দে আত্মহারা ছিলেন। তখন সরকার বেসরকার সবাই দল বেঁধে ইউনূস সাহেবকে অভিনন্দন জানিয়েছে।

আমাদের দেশে জ্ঞানী-অজ্ঞানী সব মানুষই হুজুগে নাচতে থাকেন। বিখ্যাত এক প্রবাদ আছে, চিলে কান নিয়েছে তাই সবাই চিলের পিছনে দৌড়াতে থাকে। কানওয়ালা কখনও নিজের কানে হাত দিয়ে দেখে না। এখন নরওয়ের টিভিতে অনুসন্ধানমূলক রিপোর্ট প্রচারিত হওয়ার পর আমরা আবার খোঁজ খবর না নিয়েই নাচতে শুরু করেছি। হঠাত্‍ করে নরওয়ে টিভি এ কাজটা করলো কেন তা আমরা ভাবিনি। নরওয়ে সরকারের সাথে হঠাত্‍ করে ইউনূস সাহেবের বিরোধ বাঁধলো কেন।

শুধু গ্রামীণ ব্যাংক নয়, গ্রামীণ ফোন নিয়েও ফিল্ম তৈরি করে প্রচার করা হয়েছে। ওইসব বিশেষ রিপোর্টে বলা হয়েছে ইউনূস সাহেব নোবেল প্রাইজ নেয়ার সময় যে বক্তৃতা দিয়েছেন তাতে নাকি তিনি মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন। তিনি নাকি বলেছেন গ্রামীণ ফোন গ্রামের সাড়ে তিন লাখ দরিদ্র মহিলাকে মোবাইল ফোনের সিম দিয়েছেন। নরওয়ের রিপোর্টার বাংলাদেশে এসে গ্রামে গ্রামে ঘুরে দেখেছেন কোথাও কোন গ্রামের দরিদ্র মহিলাকে সিম দেয়া হয়নি। ওই রিপোর্টার আরও বলেছেন, গ্রামীণ ক্ষুদ্র ঋণের কারণে ঋণ গ্রহীতাদের দারিদ্র দূর হয়নি। তারা গ্রামের বহু মহিলার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন। ডকুমেন্টারি ওই ফিল্মের রিপোর্ট বিশ্বব্যাপী অন্যান্য মিডিয়াতেও প্রচারিত হয়েছে। তার ঢেউ এসে লেগেছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশ মিডিয়া গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. ইউনূস বিষয়ে মাঝে মধ্যে টুকটাক কিছু বললেও সিরিয়াসলি কখনই কিছু বলেনি। ড. ইউনূস নিজেও বাংলাদেশের মিডিয়াকে কখনই নিজের আস্থায় নিতে চাননি। ফলে দেশী মিডিয়া গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে সব সময়ই আলো আঁধারীতে ছিল এবং আছে। বেশির ভাগ মানুষই জানে না এই ব্যাংকটি সরকারি না বেসরকারি। এটি কি এনজিও? এটি সমবায় সংস্থা? এটি ব্যাক্তি মালিকানাধীন সংস্থা?

সবাই জানে ১৯৭৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক থাকা কালে ড. ইউনূস জোবরা গ্রামে তার ক্ষুদ্র ঋণ আইডিয়াটি চালু করেন জনতা ব্যাংকের আর্থিক সহযোগিতা নিয়ে। কিন্তু যে পরিবার ঋণ নিয়েছিল তাতে তাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়নি। পরে তিনি তার এই চিন্তা-ভাবনা নিয়ে প্রেসিডেন্ট জিয়ার সাথে দেখা করেন। জিয়া সাহেব ড. ইউনূসকে উত্‍সাহিত করার জন্যে বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশ দেন। বাংলাদেশ ব্যাংক ড. ইউনূসের আইডিয়াকে একটি প্রকল্প হিসাবে গ্রহণ করে তাকেই প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়। আমি যত দূর জানি, এটাই ছিল গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্পের যাত্রা শুরু। তখন ড. ইউনূস কিছুদিন বাংলাদেশ ব্যাংকেও অফিস করেছেন। গ্রামীণ ব্যাংকের অফিসিয়াল ওয়েব সাইটে গেলে প্রতিষ্ঠানটির ব্যাকগ্রাউন্ড ইনফরমেশনগুলো পাওয়া যায় না। শুধু বলা হয়েছে ১৯৭৬ সালে ড. ইউনূস ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পটি চালু করেন। ১৯৮৩ সালে প্রেসিডেন্ট এরশাদের আমলে সরকার গ্রামীণ ব্যাংককে পূর্ণাঙ্গ ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে একটি আইন পাশ করে। এটা মূলত একটি সরকারী প্রতিষ্ঠান। শুরু থেকেই বাংলাদেশ সরকার গ্রামীণ ব্যাংককে আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে আসছে। সাইফুর রহমান সাহেবের আমলে ৩০০ কোটি টাকা ঋণও দেয়া হয়েছিল। এক সময় এই ব্যাংকের সরকারি মালিকানা ছিল ৬০ শতাংশ। পরে আস্তে আস্তে সরকারের মালিকানা ২৫ শতাংশে নেমে আসে। এই ব্যাপারে সরকারের গাফেলতিও কম নয়।

নোবেল পুরস্কার লাভের পর আমি লিখেছিলাম এই প্রাইজ পাওয়া উচিত ছিল বাংলাদেশ সরকার ও ড. ইউনূসের। কিন্তু পেল গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. ইউনূস। কারণ সরকারই এই ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা। ওই সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর ড. সালেহ উদ্দিনও বলেছিলেন এই ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা সরকার। ড. ইউনূস শুরু থেকেই এই ব্যাংকের প্রতিষ্ঠার ইতিহাসকে গোপন করার চেষ্টা করেছেন। আমি একটি চিঠি লিখে বিষয়টি সম্পর্কে নোবেল পিস কমিটিকে জানিয়েছিলাম। আমার চিঠির একটি অংশ তখন নিউ এজ বা ডেইলি স্টার পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। সেই সময়ে বিদেশী কোন কোন কাগজে বলা হয়েছিল ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে একটি মুসলিমপ্রধান দেশে সুদকে জনপ্রিয় করেছেন। কথাটি মহাসত্য। বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে গরীব মানুষ জানতে ও বুঝতে পেরেছে সুদ এবং গ্রামীণ ব্যাংক কী জিনিস। গ্রামের লাখ লাখ মানুষ গ্রামীণ ব্যাংকের ফাঁদে পড়ে সর্বহারা ও গ্রামছাড়া হয়েছে। ঠিক এ সময়ে শেরে বাংলার ঋণ সালিসী বোর্ডের কথা মনে পড়েছে। তখন সুদী মহাজনের জালে আটকা পড়ে লাখ লাখ গরীব মানুষ সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছিল। তখন বেশির ভাগ সুদী মহাজন ছিল হিন্দু ধনী। তারপর এদেশে আসে কাবুলিরা। শেরে বাংলা ঋণ সালিসী বোর্ড করে গরীব মানুষদের রক্ষা করেছিলেন। এনজিওদের কাছ থেকে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে যারা সর্বস্বান্ত হয়েছে তাদের বাঁচাবার জন্যে সরকার এখনও ঋণ সালিসী বোর্ড গঠন করেন নি। ও রকম কিছু করার কোন আলামত দেখছি না। বিগত ৩০ বছরে ক্ষুদ্রঋণের ফলে আমাদের গরীব গ্রামের মানুষের কী উপকার হয়েছে তা দেশবাসী এখনও জানে না। সাবেক অর্থমন্ত্রী মরহুম সাইফুর রহমান সাহেব একবার বলেছিলেন ৩০ বছরে গ্রামীণ ব্যাংক ৬০ লাখ গরীব মানুষের মাঝে ঋণ বিতরণ করেছে। দারিদ্র বিমোচনের কাজটি এই হারে চললে তিনশ' বছরেও বাংলাদেশের গ্রামীণ দারিদ্র যাবে না। সরকারও ইউনূস সাহেবের নীতি অনুসরণ করতে পারবে না।

সুদী ব্যবসা দ্বারা গরীবের দারিদ্র যায় না। রাষ্ট্রীয় নীতি ছাড়া পৃথিবীর কোথাও দারিদ্র দূর হয়নি। শুধু রাষ্ট্রকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে কতদিনে সে তার জনগণকে দারিদ্র থেকে মুক্তি দিতে চায়। সুদ যে গরীবকে আরও গরীব করে দিতে পারে তা আল কোরান সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে। তাই আল কোরান সুদকে হারাম ঘোষণা করেছে। আল্লাহর রাসুল বিদায় হজ্বের ভাষণে মহাজনদের সকল সুদ মওকুফ করে দিয়েছিলেন। ওই ঘোষণার মাধ্যমে তত্‍কালীন মক্কা এবং আশেপাশের মানুষ মুক্তিলাভ করেছিলো।

আমরা সত্যিই বড়ই হতভাগ্য। আল কোরান ও রাসুলের (সাঃ) ঘোষণার প্রায় দেড় হাজার বছর পরেও আমরা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সুদী ব্যবসায় জড়িয়ে আছি। শুধু তাই নয়, এই হারামকে রাষ্ট্র প্রশংসিত করেছে। ড. ইউনূস বলেছেন, তিনি ব্যবসা করেন। গ্রামীণ ব্যাংক কোন দাতব্য ব্যবসা নয়। গ্রামীণ ব্যাংক বিনা সিকিউরিটিতে গরীবদের ঋণ দেয়। গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ নিয়ে কতজন গরীব গরীবানা ত্যাগ করতে পেরেছেন তা কোনদিন সরকার বা সমাজ জানতে চায়নি। গ্রামীণ ব্যাংক ৩০/৩৬ পার্সেন্ট সুদ গ্রহণ করে এটা জানার পরও সরকার কখনও কিছু বলেনি। কারণ আজও অজানা। সুদের ব্যবসা করে ড. ইউনূস শান্তিতে নোবেল পাওয়ার পর আমরা নেচেছি গেয়েছি। এখন দল বেঁধে তাকে গালিগালাজ করছি। আবার কেউ কেউ বলছেন, ইউনূসের নামের সাথে বাংলাদেশের মর্যাদা জড়িত। মানে তাকে আর গালাগাল করা ঠিক হবে না।

নোবেল পুরস্কার নিয়ে ইতোমধ্যে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে গণচীন। চীনের ভিন্ন মতাবলম্বী গণতন্ত্রী বলে পরিচিত জিউ বাওকে নোবেল পুরস্কার দেয়ায় চীন ক্ষুব্ধ হয়েছে। চীন সরকার তাদের মনোভাব নোবেল কমিটিকে জানিয়েছে। চীনকে সমর্থন করে বিশ্বের অনেক দেশ পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেনি। ফলে নোবেল পুরস্কার বিতর্কিত হয়ে পড়েছে। নোবেল শান্তি পুরস্কার একটি রাজনৈতিক পুরস্কারে পরিণত হয়ে পড়েছে। সরকার বা রাষ্ট্রের আপত্তিকে অগ্রাহ্য করে এর আগেও ইরানের শিরিন এবাদি এবং মায়ানমারের অং সাং সুচিকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া হয়েছে। যুদ্ধরত ফিলিস্তিন ও ইজরায়েলের নেতা আরাফাত ও শ্যারনকে শান্তি পুরস্কার দেয়া হয়েছে। নোবেল শান্তি পুরস্কার সম্পর্কে লোকে নানা ধরনের তামাশা করে। বলে, আপনি আপনার মায়ের বিরুদ্ধে বদনাম করুন আপনাকে পশ্চিমারা নোবেল দিয়ে দিতে পারে। সবচেয়ে মূল্যবান ইস্যু হলো এখন ইসলাম। আপনি ইসলামের বিরুদ্ধে বলুন আপনাকে নোবেল দিয়ে দিবে।

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আহমদ শাফি নোবেল নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন যা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রকাশ করেছে। আমি ড. শাফির সাথে একমত। শান্তি পুরস্কার প্রদানের শক্তিশালী মাপকাঠি হলো এখন রাজনীতি। ড. শাফি বলেছেন বিশ্বের সব পুরস্কারের ক্ষেত্রেই নানা ধরনের রাজনীতি হয়ে থাকে। এশিয়ার নোবেল বলে বহুল প্রচারিত ম্যগ সাই সাই এওয়ার্ডও তেমনি একটি পুরস্কার। বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন মানুষ এ পুরস্কার পেয়েছেন। এদের মাত্র কয়েকজনকে পাঠক হয়ত চেনেন। বাকিরা অপরিচিত। কিন্তু পুরস্কারদাতারা তাদের চেনেন। সম্প্রতি আমাদের দেশের একজন নামজাদা এনজিও ব্যবসায়ী স্যার উপাধি পেয়েছেন বৃটেনের রানীর কাছ থেকে। তাঁর পূর্বপুরুষও নাকি ইংরেজদের কাছ থেকে খান বাহাদুর টাইটেল পেয়েছিলেন। আর শুনে একেবারেই আমরা গদগদ। এই ইংরেজরাই ১৯০ বছরে এদেশে কোটি কোটি লোককে হত্যা করেছে। এই দেশটাকে পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশে পরিণত করেছে। চীনারা একটি সম্মানিত জাতি বলেই পশ্চিমাদের ফাঁদে পা ফেলে না। জাপানিরা এখনও চীনের কাছে ক্ষমা চেয়ে কুল পাচ্ছে না পূর্বপুরুষের অপরাধের জন্যে।

আমাদের দেশে নানা ধরনের সরকারী পুরস্কার আছে। সব পুরস্কারই এখন রাজনৈতিক পুরস্কারে পরিণত হয়েছে। সরকারের যাকে পছন্দ তাকেই রাষ্ট্রীয় পুরস্কার দেয়া হয়। কেন দেয়া হয় তার কোন কারণ নেই। কবি শিল্পী বুদ্ধিজীবীদেরও রাজনৈতিক ভাগ আছে। একদল হলো আওয়ামী বুদ্ধিজীবী, আরেক দল বিএনপি বুদ্ধিজীবী। এ নিয়ে নাকি প্রচুর তদবির করতে হয়। শুনেছি, গল্প কিনা জানি না, আমাদের এক বন্ধু মন্ত্রীকে বলেছিলেন তাকে একুশে পুরস্কার না দিলে সে সচিবালয়ের ন'তলা থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করবে। সেবার সে একুশে পদক পেয়েছিলো। সরকারকে ধন্যবাদ তাকে পুরস্কার দেয়ার জন্যে। তাই সে এখনও বেঁচে আছে।

এরশাদ মজুমদার : প্রবীণ সাংবাদিক, কলামলেখক ও ঔপন্যাসিক।