যুদ্ধাপরাধ বিচারের ভিত্তি হবে মুক্তিযুদ্ধ

মোহাম্মদ সেলিম
Published : 25 Sept 2014, 03:40 PM
Updated : 25 Sept 2014, 03:40 PM

সাঈদীর রায় নিয়ে নানা রকমের আলোচনা, বিতর্ক, বিশ্লেষণ হচ্ছে। সংবাদপত্র, রাজনৈতিক দল, ব্যক্তিবিশেষ, গণ-পরিবহন থেকে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত সাঈদীর রায়ের আলোচনা শুনতে হচ্ছে। সাঈদী নানা কারণে প্রভাবশালী। অর্থ, বিত্ত, আর্ন্তজাতিক যোগাযোগ, জাতীয় সংসদ সদস্য, জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর, সর্বোপরি ধর্মীয় লেবাসধারী 'ধর্মপ্রচারক' হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে তার।

শুদ্ধ উচ্চারণ, শব্দচয়নে সতর্ক, মার্জিত ভঙ্গি, মাঝে মাঝে ইংরেজি শব্দের ব্যবহার, সর্বোপরি আকর্ষণীয় উপস্থাপনার কৌশলের কারণে তার ওয়াজ মাহফিলে প্রচুর লোকসমাগম হয়। তথাকথিত ধর্মপ্রচারের নামে সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ আর উগ্র জঙ্গিবাদী মতবাদ প্রচারই তার মূল লক্ষ্য। ইসলামরক্ষার নামে প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী, লেখক-সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা, নারীদের সম্পর্কে অশালীন বক্তব্য উপস্থাপন তার তফসিরের প্রধান বিষয়।

বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৪০ সালে জন্মগ্রহণকারী 'দেলোয়ার শিকদার' বর্তমানে দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী নামে পরিচিত। এমন কী জিয়ানগরের 'সাউদখালি' গ্রামকে এখন 'সাঈদখালি' বলা হচ্ছে, সাঈদীর নামের সঙ্গে মিলিয়ে। স্থানীয় সাংবাদিক নাসিরউদ্দীন বিবিসিকে জানিয়েছেন, "উনি (সাঈদী) মূলত এর আগে পারের হাটে ব্যবসা করতেন ভায়রা ভাইয়ের সঙ্গে মিলে। মুদি দোকানের ব্যবসা ছিল।"

কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় সাঈদী ছিলেন ত্রিশ বছরের যুবক। তেমন পরিচিত ব্যক্তি নন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জামায়াতের প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছিলেন তিনি। তখন যুক্ত ছিলেন ইসলামী ছাত্র সংঘের সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সাঈদী পিরোজপুরে শান্তি কমিটি, রাজাকার বাহিনীর নেতৃত্ব দেন। বিশেষ করে হিন্দু-অধ্যুষিত, আওয়ামী লীগ-সমর্থক ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী পরিবারগুলো সাঈদীর নৃশংস অত্যাচারের শিকার হয়েছে। তার বিরুদ্ধে পিরোজপুরের মাছিমপুর, পারেরহাট, চিথোলিয়া, নলবুনিয়া, উমেদপুর, টেংরাখালী ও হোগলাবুনিয়া গ্রামের নিরীহ সাধারণ মানুষ খুন, নারীধর্ষণ, গণহত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও ধর্মান্তরকরণের অভিযোগ উত্থাপন করা হয়।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ সাঈদীর বিরুদ্ধে ২০ টি অভিযোগ গ্রহণ করে। ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনালের রায়ে সুস্পষ্টভাবে ৮ টি অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সাঈদীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। যে দু'টি অভিযোগে তাকে ফাঁসির দণ্ড দেওয়া হয় তার একটি হল, ৮ মে, ১৯৭১ সাঈদীর উপস্থিতিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও রাজাকাররা চিথোলিয়া গ্রামের মানিক পসারির বাড়িতে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে মানিক পসারির ভাই মফিজুদ্দিন ও ইব্রাহিমকে পাকবাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে যায়। মফিজ সেনা ক্যাম্পে নির্যাতনের শিকার হন। কিন্তু সাঈদীর প্ররোচনায় ইব্রাহিমকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

দ্বিতীয় ঘটনা, উমেদপুর গ্রামে ২ জুন, ১৯৭১ সকাল ১০ টার দিকে সাঈদীর নেতৃত্বে একদল সশস্ত্র ব্যক্তি হিন্দুপাড়ায় ২৫ টি ঘরে অগ্নিসংযোগ করে। এরপর তার ইন্ধনে বিসাবালীকে গাছের সঙ্গে বেঁধে গুলি করে হত্যা করা হয়। এছাড়া বহু সংখ্যালঘু নারী ধর্ষণ ও হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেককে বলপূর্বক ধর্মান্তর করেন তিনি ও তার দল।

২৮ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর পর জামায়াত-শিবির সারা দেশে জঙ্গি মিছিল করে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েমের চেষ্টা করে। রাতে সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে এমন আজগুবি কাহিনি প্রচার করে আবারও তাণ্ডব চালায়। হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি, মন্দিরসহ বহু গাড়ি, দোকান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে জামায়াত আক্রমণ চালায়। নজিরবিহীন সহিংসতায় গাইবান্ধার তিন পুলিশসহ সারা দেশে প্রথম তিন দিনেই নিহত হন ৭০ জন।

ব্যাপক সন্ত্রাসের পরও আসামিপক্ষ উচ্চ আদালতে আপিল করে; রাষ্ট্রপক্ষও করে। দীর্ঘ সময়ব্যাপী বিচারকার্য চলার পর ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৪ দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে সাঈদীর ফাঁসির দণ্ড হ্রাস করে তাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিত পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ এই রায় প্রদান করেন। সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে এই রায় দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধান বিচারপতি।

তিনটি অভিযোগে সর্বোচ্চ আদালত সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদণ্ড প্রদান করে। এর মধ্যে উমেদপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম খানকে পাকবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া, গৌরাঙ্গ সাহার তিন বোনকে ধর্ষণ ও যৌনদাসী হিসেবে পাকবাহিনীর কাছে সমর্পণ করা। রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী হিসেবে গৌরাঙ্গ সাহা ট্রাইব্যুনালে সাঈদীকে শনাক্ত করেন যিনি পাকবাহিনীর হাতে তার বোনদের তুলে দিয়েছিল। এছাড়া একশ থেকে দেড়শ হিন্দুকে ইসলামে দীক্ষা দেন। আরও দু'টি অভিযোগে ১০ বছর ও ১২ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আপিল বিভাগ।

এই রায়ে ক্ষোভ, অসন্তোষ জানিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবারের সদস্যগণ, বুদ্ধিজীবী, লেখক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীসহ অনেকে। সাঈদীর মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীরা ভয়ানক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। গত বছরের ৯ ডিসেম্বর সাঈদীর মামলার সাক্ষী মোস্তফা হাওলাদারকে তাঁর বাড়িতে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। অন্য সাক্ষীদের জন্য পুলিশ প্রহরার ব্যবস্থা করলেও সাক্ষী বা তাঁদের পরিবারের সদস্যরা কেউ নিরাপদ বোধ করছেন না। এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের ১ নম্বর সাক্ষী মাহবুব আলম হাওলাদার রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, "সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল না রাখায় আমি হতাশ।"

কেন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকল না, মামলার তদন্ত ঠিকমতো হয়েছে কি না, সে প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে। প্রসিকিউশনের দুর্বলতা, ট্রাইব্যুনালের নিরাপত্তাসহ ভৌত অবকাঠামোগত সুবিধা বৃদ্ধি ইত্যাদি বিষয়ে ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন, সাংবাদিক-লেখক শাহরিয়ার কবিরসহ অনেকেই দীর্ঘদিন যাবত লিখছেন। বিভিন্ন সময়ে প্রসিকিউশনের মধ্যকার বিরোধ নিয়ে পত্রিকায় প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। কিন্তু কার্যকর পদক্ষেপ নজরে আসেনি। সরকারের সঙ্গে জামায়াতের আতাঁতের কথা বলছেন কেউ কেউ। এটা প্রমাণ-সাপেক্ষ বিষয়; অন্যদিকে এমন ধারণা আদালত অবমাননার শামিল।

মূলত মুক্তিযুদ্ধের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করছে যুদ্ধাপরাধ মামলার রায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যুদ্ধাপরাধ বিচারের ক্ষেত্রে, কোথাও সাধারণ ফৌজদারি মামলার ধারণা গ্রহণ করা হয়নি। কারণ যুদ্ধাপরাধ বা মানবতাবিরোধী অপরাধ সাধারণ অপরাধের পর্যায়ে পড়ে না। তাই বিশেষ আইনি প্রক্রিয়ায় এই অপরাধের বিচার ও দণ্ড নির্ধারণ করতে হয়। সুতরাং এই মামলায় প্রচলিত সাক্ষ্য আইন প্রাধান্য পেতে পারে না।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান বিষয় হল গণহত্যা ও নারীনির্যাতন। এর ফলে সৃষ্টি হয়েছে লাখ লাখ শরণার্থী। ৩০ লাখ শহীদ, ৬ লাখ নারীর সম্ভ্রম আর অগণিত মানুষের সীমাহীন দুঃখ-কষ্ট, অপমান– এই সবকিছুই ইতিহাসের অংশ। ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন সাঈদীর রায় প্রসঙ্গে প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, "ইতিহাসের সত্য আদালত উপেক্ষা করেছেন। বিচারকেরা হয়তো উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কিছু করেননি, কিন্তু এগুলো সরকারের জন্য, সমাজ, রাষ্ট্র সবকিছুর জন্য খুব ক্ষতিকর হবে।"

ইতিহাসের সত্য উপেক্ষা করার মতো অনুকুল পরিবেশ তৈরি হয়েছে বলেই কি সাঈদীর মানবতাবিরোধী অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পরও ট্রাইব্যুনালের দেওয়া শাস্তি হ্রাস পেয়েছে? গত বছর যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গড়ে উঠেছিল গণজাগরণ মঞ্চ। হতাশায় নিমজ্জিত জাতি জেগে উঠেছিল গণজাগরণ মঞ্চের আহ্বানে। ইতিহাস সৃষ্টিকারী সেই মঞ্চ আজ নিজেই বিভক্তি, অনৈক্য আর বিভ্রান্তিতে নিমজ্জিত।

মঞ্চের বিভাজন জামায়াতের মুখে হাসি ফুটিয়েছে– এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। বিভক্ত মঞ্চ তেমন কিছু অর্জন করতে পারবে বলে মনে হয় না। জামায়াতের ন্যায় বিরাট শক্তিশালী শত্রুর বিরুদ্ধে যে কোনো মূল্যে গণজাগরণ মঞ্চের ঐক্যের বিকল্প নেই। কারণ সাঈদীর চূড়ান্ত রায়ের পর পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশনে হতাশা ব্যক্ত করা ছাড়া তেমন বড় প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়নি।

মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির আত্মঘাতী বিভক্তি ধ্বংসের শেষ প্রান্তে যাবার আগেই আমাদের চেতনা জাগ্রত হবে, এই আশাবাদ সত্য হোক।

মোহাম্মদ সেলিম: অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।