প্লিজ, সন্তানে বিনিয়োগ করুন

প্রভাষ আমিনপ্রভাষ আমিন
Published : 22 Sept 2014, 07:27 AM
Updated : 22 Sept 2014, 07:27 AM

সুমি সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে নিশ্চয়ই আমার কোনো শত্রুতা আছে। নইলে সব খারাপ খবর সুমি আমাকেই জানাবে কেন? মিশুক মুনীরের দুর্ঘটনার খবর আমি প্রথম পেয়েছিলাম সুমির কাছ থেকে। সেদিন সকালে সুমির ফোন পেয়ে আঁতকে উঠলাম। সুমি জানতে চাইল, আলিমুল ভাইয়ের বাচ্চাদের খবর জানেন?

আলিমুল আমার সাবেক সহকর্মী। ইত্তেফাক থেকে যোগ দিয়েছিলেন সিএসবি নিউজে। সেখানে কাজ করেছেন বার্তা সম্পাদক হিসেবে। সিএসবি বন্ধ হওয়ার পর যোগ দেন দিগন্ত টিভিতে। বর্তমানে রেডিও চায়নায় কাজ করছেন আলিমুল, বন্ধুরা যাকে টিপু নামে চেনেন, থাকেন বেইজিং। অনেকদিন যোগাযোগ নেই, মাঝে মধ্যে ফেসবুকে কথা হয়।

তার পারিবারিক নানা জটিলতার কথা শুনতাম। কিন্তু খুব বেশি জানা হয়নি। এমনিতে কেউ কিছু না জানালে আমি কখনও আগ বাড়িয়ে কারও ব্যক্তিগত ইস্যুতে নাক গলাই না। তাই একসঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করলেও তার পরিবার সম্পর্কে খুব বেশি জানতাম না।

তাই সুমির প্রশ্নের জবাবে বললাম, না তো। সুমি বলল, আলিমুল ভাইয়ের দুই সন্তান আত্মহত্যা করেছে। আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। না দেখা সেই দুই সন্তানের জন্য আমার হৃদয় দুমড়ে মুচড়ে গেল। দ্রুতই খোঁজ নিয়ে জানলাম, আলিমুল আর জয়শ্রী দম্পতির আঠার বছর বয়সী মেয়ে চিরশ্রী জামান মনমন এবং পনের বছর বয়সী ছেলে মুহাম্মাদ বিন আলম মরে গেছে। আহা রে, মাত্র আঠার আর পনের! শুরু হওয়ার আগেই ফুরিয়ে গেল দুই দেবশিশুর জীবন!

সব শিশুই আমার কাছে দেবশিশু। সব শিশুই আমার কাছে আমার সন্তানের মতো। কারণ সব শিশুই পৃথিবীতে আসে নিষ্পাপ, নিষ্কলুষ দেবশিশু হিসেবে। তারপর বড়দের মানে আমাদের ভণ্ডামি, কুপমন্ডূকতা, হিংসা, লোভ, লালসা বদলে দেয় তাদের পৃথিবী। আস্তে আস্তে সভ্যতার অন্ধকার দিকগুলো গ্রাস করে তাদেরও। তারা হতাশ হয়, কষ্ট পায়, বেদনায় নীল হয়, কেউ কেউ মরেও যায়।

জয়শ্রী জামানের সঙ্গে আমার পরিচয় নেই। কিন্তু তার কষ্টটা আমি হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে পারছি। সকালে অফিসে যাওয়ার সময় যে মা রেখে গেলেন তরতাজা দুই সন্তান, ফিরে দেখেন তাদের লাশ ঝুলছে। কীভাবে তিনি সহ্য করছেন জানি না। যতবার ভাবি, ততবার আমারই দম বন্ধ হয়ে আসে। আলিমুলের কষ্টটাও আমাকে ছুঁয়ে যায়। আমারও একটি ছেলে আছে। বাবার কাঁধে সন্তানের লাশের চেয়ে ভারি আর কিছু নেই পৃথিবীতে। কিন্তু আলিমুল এমনই দুর্ভাগা, সেই লাশ কাঁধে নেওয়ার সুযোগটাও পেলেন না।

হতভাগা এই বাবা মায়ের জন্য আমার হৃদয় কাদেঁ। সৃষ্টিকর্তা তাদের এই শোক সইবার শক্তি দিক।

আলিমুল আর জয়শ্রী আলাদা হয়ে গেছেন বছর সাতেক আগে। এই নিয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই। আমি সর্বোচ্চ ব্যক্তি স্বাধীনতা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে বিশ্বাস করি। ভালো না লাগলে দুটি মানুষ আলাদা হয়ে যেতেই পারেন। এটা যার যার স্বাধীনতা। তবে এখানেই আমার কিছু কথা আছে। সব স্বাধীনতা আমার ভালো লাগে না। সে কথা বলার আগে প্রাসঙ্গিক দুটি কথা বলে নিই।

দুটি সন্তানের আত্মহত্যার পরপর গণমাধ্যমের আচরণে একজন পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে লজ্জিত হয়েছি। বিভিন্ন পত্রিকায় ব্যক্তির চরিত্র হনন শুরু হয়ে গেছে তাৎক্ষণিকভাবে। আলিমুল আবার বিয়ে করে চীনে সুখে আছেন, বাচ্চাদের কোনো খোঁজ নেননি। জয়শ্রী পরকীয়া করছিলেন। বাচ্চা দুটো মাদকাসক্ত ছিল। এমন সব সত্য-মিথ্যা, আজগুবি তথ্যে ঠাসা ছিল বিভিন্ন পত্রিকার রিপোর্ট। আলিমুল এবং জয়শ্রী– দুজনেই সংবাদকর্মী হয়েও সাংবাদিকদের নোংরা কলমের আক্রমণ থেকে রেহাই পাননি।

জয়শ্রীর বন্ধুরা তার বিরুদ্ধে কুৎসা রটানোর প্রতিবাদ জানিয়ে, গণমাধ্যমকে দায়িত্বশীল হওয়ার আহবান জানিয়েছেন। নৈতিক প্রশ্নে সে আহবানে আমিও আছি। একই ঘটনা ঘটেছিল সাগর-রুনির ক্ষেত্রেও। গণমাধ্যম কর্মী হয়েও তারা ছাড় পাননি। আমি খালি অবাক হয়ে ভাবি, গণমাধ্যম কর্মীদের ব্যাপারেই আমরা একটা নিষ্ঠুর, আর সাধারণ মানুষ হলে আমরা কী করি? জয়শ্রীর পাশে দাঁড়ানোর পর অনেকেই ফেসবুকে এই প্রশ্ন করেছেও। তাদের জবাব দিতে পারিনি। লজ্জায় মাথা নুয়ে গেছে।

জয়শ্রী-আলিমুল-সাগর-রুনি, পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে সবাই আমাদের কাছে সমান। পত্রিকার কাটতি বাড়ানোর জন্য আমরা কারও ব্যাপারেই কুৎসা রটনা করব না, এটাই সাংবাদিকতার এথিকস। আমরা যেন বিনা কারণে কখনওই কারও চরিত্রহনন না করি, এটা তো সাংবাদিকতার প্রাথমিক পাঠ।

জয়শ্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পর আলিমুল আবার বিয়ে করেছেন। করতেই পারেন। কিন্তু জয়শ্রী করেননি। এটাই বাংলাদেশের সাধারণ চিত্র। পুরুষের তুলনায় মেয়েরা সন্তানের জন্য অনেক বেশি ত্যাগ স্বীকার করেন। স্ত্রীর মৃত্যুর তিন মাসের মাথায় স্বামী সন্তান পালনের দোহাই দিয়ে বিয়ে করে ফেলেন। আর স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রী সন্তানদের দিকে তাকিয়ে পার করে দেন গোটা জীবন। ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে, তবে এটাই সাধারণ প্রবণতা।

আর মায়ের শক্তি অনেক বেশি। একজন মা সন্তানের জন্য সবকিছু করতে পারেন। একাত্তরে স্বামী হারানো অনেক সাধারণ নারী অসাধারণ হয়ে তাদের সন্তান মানুষ করেছেন। কিন্তু এই সংগ্রামী নারীদের সমাজে পদে পদে প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করতে হয়। কিন্তু মুদ্রার উল্টা পিঠও আছে, এই যে আমরা সব দোষ আলিমুলের ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছি। সংগ্রামী নারী হিসেবে জয়শ্রীর পাশে দাঁড়াচ্ছি। কিন্তু আলিমুল যে দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন, সেও তো একজন নারীই। তাই নারী-পুরুষ, এভাবে বিষয়টি না দেখে, মানবিকভাবে দেখা উচিত। আমরা পাশে দাঁড়াব দুর্বলের, নির্যাতিতের– হোন তিনি নারী অথবা পুরুষ।

আলিমুল কেন বিয়ে করল, জয়শ্রী কেন করল না, এ নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। যার যার জীবনের সিদ্ধান্ত তার তার। আমার সকাল ভাবনা মনমন আর মুহাম্মাদকে নিয়ে। যার যার জীবন তার তার, বলছি বটে, তবে সব সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমাদের সন্তানদের কথা ভাবা উচিত। যদি না মিললেই আলাদা হয়ে যেতে হয়, তাহলে তো বিশ্বের কোনো সংসারই টিকবে না। সবচেয়ে সুখের সংসারেও তো কখনও না কখনও খিটিমিটি লাগে। তাই বলে কথায় কথায় আলাদা হয়ে যেতে হবে!

অন্তত সন্তান হওয়ার পর সকল ভাবনা, সকল ভালোলাগা সন্তানকেন্দ্রিকই হওয়া উচিত। কারণ যে সন্তান আপনি পৃথিবীতে আনলেন, সে কিন্তু তার ইচ্ছায় আসেনি। আপনারা তাকে এনেছেন। এখন তাদের ফেলে আপনারা চাইলেই নিজের ভালোলাগা, মন্দলাগা বিবেচনা করতে পারবেন না। সুখের খোঁজে নতুন বন্দরে নোঙর ফেলতে পারবেন না। ব্যক্তি স্বাধীনতার দোহাই দিয়েও নয়।

একজন মানুষ, একজীবনে সব সুখ পাবে না। আর নিরবচ্ছিন্ন সুখ তো আসলে কোনো সুখ নয়। সন্তান-সংসারের জন্য কখনও কখনও আপনাকে অনেক ত্যাগও স্বীকার করতে হবে, আপোষ করতে হবে, মেনে নিতে হবে। আপনার অনেক টাকা হল, অনেক ক্ষমতা হল, অনেক নাম হল; কিন্তু আপনার সন্তান বখে গেল। আপনার কিন্তু ষোলআনাই মিছে। সেই টাকা আপনার কাছে অর্থহীন হয়ে যাবে, ক্ষমতা পানসে মনে হবে, নাম ভুলে যেতে চাইবেন।

সন্তানকে মানুষ করতে হবে, শুধু আপনার জন্য নয়– দেশের জন্য, জাতির জন্য। এই শিশুরাই তো একদিন দেশের নেতৃত্ব দেবে। তাদের যত ভালোভাবে গড়ে তুলতে পারবেন, ততই লাভ। কেউ জমিতে বিনিয়োগ করে, কেউ শেয়ারবাজারে। কিন্তু সবচেয়ে ভালো বিনিয়োগ হল আপনার সন্তান।

আমাদের শক্তি আমাদের যৌথ পরিবার ব্যবস্থা, পারিবারিক মূল্যবোধ। শিশুরা বেড়ে ওঠবে মায়ের আদরে, বাবার শাসনে। চাচাতো, মামাতো, খালাতো, ফুপাতো ভাইবোনরা মিলে বেড়ে উঠবে। আনন্দে কানায় কানায় ভরে থাকবে তার শৈশব। আমরাও ছোটবেলায় মা মারতে আসলে খালার আঁচলের তলে আশ্রয় খুঁজতাম। কিন্তু সেই যৌথ পরিবারের ধারণাটা কি আলগা হয়ে যাচ্ছে? আমরা কি সব বিচ্ছিন্ন মানুষ হয়ে যাচ্ছি?

এখন ঢাকায় চলছে ফ্ল্যাট সংস্কৃতি। সব পরিবার অণু-পরমাণুতে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। বাবা চাকরি করে, মা চাকরি করে। যার যার ক্যারিয়ার। কিন্তু সন্তান বেড়ে উঠছে অজান্তে, কখনও অনাদরে, অবহেলায়। বাবা-মা যার কাছে শিশুকে রেখে নিশ্চিন্তে অফিসে চলে যাচ্ছেন, সে কি আপনার সন্তানকে ঠিকমতো খাওয়াচ্ছে, মমতা দিচ্ছে? চাইলেও তার পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। শিশু বেশি কাঁদে বলে, তাকে ঘুমের সিরাপ খাইয়ে দেওয়া বা মেরে চুপ করিয়ে রাখার গল্প তো ঘরে ঘরে। অনেক কর্মজীবী দম্পতি ঘরে সিসিটিভি লাগান সন্তানের ওপর চোখ রাখতে। আহা রে সন্তানের জন্য কত দরদ!

সন্তানের জন্য মা যতটা দরকার, বাবাও ততটাই। মনমন আর মুহাম্মদের আত্মহননের জন্য কার দায় কতটা এ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় তোলপাড়। আলিমুল তার ফেসবুকে লিখেছে, চীনে বসেও সন্তানদের জন্য কতটা দায়িত্ব পালন করেছে, কত টাকা পাঠিয়েছে। কিন্তু মনমন আর মুহাম্মদের তো টাকা অতটা দরকার ছিল না, যতটা ছিল বাবা-মায়ের মমতা। অনেক কৃষকের সন্তানও তো অসাধারণ রেজাল্ট করে চমকে দেয় সমাজকে। অনেক অদম্য মেধাবীর গল্প তো আমরা জানি।

এর আগে পুলিশ দম্পতি খুন হওয়ার পর ঐশীর জন্য আমার হৃদয় কেঁদেছে। সেই ঘটনা এখন আদালতে বিচারাধীন। আমি যদি ধরেও নিই ঐশীই তার বাবা-মাকে খুন করেছে, তাহলে ওকে অমন পরিস্থিতিতে নেওয়ার দায়টা কার? ঐশীর বাবার অনেক টাকা ছিল। ঐশীর যা ইচ্ছা তাই করার স্বাধীনতা ছিল। সেই স্বাধীনতাই তাকে এত বড় পৃথিবীতে একলা করে দিয়েছে। দিনের পর দিন গণমাধ্যম ঐশীকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছে যে আমরা সবাই ঐশীকে ঘৃণা করি।

কিন্তু আমরা কি একবার নিজেকে ঐশীর জায়গায় কল্পনা করেছি? অতটুকুন মেয়ে, অমন কাজ কীভাবে করতে পারে! একবার ভাবুন তো, পৃথিবীতে ঐশীর চেয়ে অসহায় আর কে আছে? আমি তো ঐশীর পরিণতির জন্য তার বাবা-মাকেই দায়ী মনে করি।

আমরা সন্তানদের সময় দিতে পারি না বলে, তাদের অনেক অন্যায় আবদার মেনে নেই। নিজের অপরাধবোধ ঢাকতে নিজের অজান্তেই সন্তানকে বিপথে ঢেলে দিই। আর পরে সন্তানের কাছে কৈফিয়ত চাই, তোমার তো কোনো অভাব রাখিনি, তাহলে এমন হল কেন? আমরা বুঝতেই চাই না, সন্তানের চাহিদা তো টাকা নয়, মমতা।

আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, আলিমুল আর জয়শ্রী নিজেরা একটু স্যাক্রিফাইস করে একসঙ্গে থাকলে, অমন মেধাবী মুখ দুটোকে হারাতে হত না আমাদের। আমরা কি সবাই বুকে হাত দিয়ে বলতে পারব, সন্তানের প্রতি আমরা আমাদের সত্যিকারের দায়িত্ব পালন করেছি? প্রতিদিন কি আমরা সন্তানের সঙ্গে কথা বলেছি? সে কোথায় যায়, কার সঙ্গে মেশে, সে কীভাবে বেড়ে উঠছে, খোঁজ নিয়েছি? তার চাওয়া-পাওয়া নিয়ে ভেবেছি?

আমরা খালি আত্মতৃপ্তি খুঁজি, আমার সন্তানকে তো আমি ভালো স্কুলে ভর্তি করিয়েছি, ভালো টিচারের কাছে পড়িয়েছি, ভালো পোশাক কিনে দিয়েছি, ভালো খাইয়েছি। তাহলে সন্তান কেন খারাপ রেজাল্ট করে, কেন মাদকাসক্ত হয়, এই প্রশ্নের উত্তর আর মেলাতে পারি না। আপনার নিষ্পাপ দেবশিশু কীভাবে, কবে মাদকের অন্ধকার জগতে পা বাড়াল, আপনি জানতে পারলেন না কেন?

ভালো মন্দ বোঝার বয়স তো তার হয়নি। তাকে আগলে রাখার দায়িত্ব তো আপনার-আমার, আমাদের। মনমন আর মুহাম্মদের যে বয়স, সেটা সাংঘাতিক ঝুঁকিপূর্ণ। নিজের কৈশোরের কথা একবার মনে করে দেখুন। মায়ের বকুনি খেয়েই তো কতবার মরে যেতে ইচ্ছা করেছে। সেখানে বাবা চীনে, মা অফিসে– দিনের পর দিন অভিমানের পাহাড় জমেছে মনমন-মুহাম্মদের হৃদয়ে। আমরা হয়তো সেই পাহাড় দেখতেই পাই না।

আমাদের সময় বড্ড কম। একটু মমতা পেলেই সেই অভিমানের পাহাড় গলে যেতে পারত। কিন্তু আমার বোন জয়শ্রীকে তো তিন মুখের খাবার জোগাড় করতেই দিনমান খাটতে হয়েছে। দৌড়াতে হয়েছে।

ঐ যে শুরুতে বললাম, আলিমুলের সঙ্গে এতদিন কাজ করেও তার পরিবার সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানতাম না আমি। এটাই আমাদের সমস্যার মূলে। আমরা সবাই অনেক বেশি স্বার্থপর, অনেক বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছি। পাশের বাসার মানুষের সুখ-দুঃখের খোঁজ রাখি না, পাশের টেবিলের সহকর্মীর সংসার যে ভেঙে যাচ্ছে, টেরও পাই না। এখন যেমন সবাই তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছি– আলিমুল-জয়শ্রীর সমস্যার সময় যদি তার বন্ধুরা, মানে আমরা তাদের পাশে দাঁড়াতাম, তাহলে হয়তো সংসারটা ভাঙতই না। তাহলে হয়তো অমন চাঁদের কণা দুটিকে হারাতে হত না।

আমরা সুখ খুঁজি অর্থে, আমরা আনন্দ চাই শরীরে, আমরা বাঁচতে চাই আয়েশে। কিন্তু যদি আমরা সন্তানে সুখের সন্ধান পাই, সংসারই যদি আনন্দের উৎস হয়, তাহলে আর নানান বন্দরে যেতে হয় না। হয়তো তাতে ভালোলাগায় একটু কম পড়ে, আয়েশে হয়তো একটু ঘাটতি হয়, কিন্তু দিন শেষে সন্তান তো সব পুষিয়ে দিতে পারে। এই যে আমরা এত পরিশ্রম করি, এত অর্থ উপার্জন করি– কেন, কার জন্য?

আমি যতবার ঐশীর কথা, যতবার মনমনের কথা, যতবার মুহাম্মাদের কথা ভাবি– ততবার কষ্টে আমার বুক ফেটে যায়। মুহাম্মাদকে আমার সন্তানের স্থানে কল্পনা করে চমকে উঠি। আলিমুল আর জয়শ্রীর জন্য কষ্টে চোখ ভিজে যায়। ঐশীকে খুনী বানাই আমরা। মনমন-মুহাম্মাদকে পৃথিবীর রং-রূপ-আনন্দ বোঝার আগেই মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিই আমরা। প্লিজ বাবা-মায়েরা, আপনারা সন্তানের জন্য বাঁচুন, সন্তানে আনন্দ খুঁজুন, সন্তানে বিনিয়োগ করুন।

আপনারা হয়তো বলতে পারেন, অত বড় বড় কথা বলার আমি কে? সত্যি বাবা-মায়েদের অমন উপদেশ দেওয়ার মত বুড়োও আমি নই। কিন্তু আমার একটি ছেলে আছে। আমি তার অবস্থান থেকে পৃথিবীটা দেখার চেষ্টা করি। প্রসূনকে ভালোবাসি বলেই আমি মনমনকে ভালোবাসি, মুহাম্মদের জন্য আমার প্রাণ কাঁদে, ঐশীর কষ্টে পৃথিবীটা বিবর্ণ হয়ে যায়।

প্রভাষ আমিন: সাংবাদিক।