ফেব্রুয়ারির বইমেলা শুরুর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। এর সঙ্গে প্রতিধ্বনির মতো বারবার আছড়ে পড়ছে বেদনাদায়ক কিছু প্রসঙ্গ। যেমন লেখক-প্রকাশক সম্পর্ক, বাংলা একাডেমীর দায়িত্বশীলতা, মেলার পরিবেশ, প্রতিদিনের গৎবাঁধা, হাস্যকর ও অর্থহীন আলোচনার অনুষ্ঠান ইত্যাদি। এত কিছুর পরও এই মেলা বাংলাদেশের লেখকসমাজের জন্য অনেকটা তীর্থের মতোই: পুকুরের চতুর্দিকে লেখকরা ঘুরে বেড়ান, তবে শয়তানের উদ্দেশে পাথর ছোঁড়ার কাজটি হয় না। আগতরা সম্ভবত নতুন-নতুন বই আর বন্ধুদের পেয়ে শয়তানের কথা ভুলে যান। তাছাড়া কে শয়তান? কারা? শয়তান তো পুরো মেলা ঘিরে থাকে। অনুভব করলেও, তাতে যন্ত্রণা বোধ করলেও লেখকরা অসহায়; তবে প্রকাশের আনন্দে সারা মাস তারা এই অসহায়ত্ব টের পান না। ফলে, শয়তানকে ঢিল মারাও হয়ে ওঠে না সম্ভব।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক কালে 'চক্র' শব্দটির বেশ ব্যবহার ঘটছে; এক সময় শব্দটি ছিল খুব সদর্থক, গঠন ও শৃঙখলাবাচক; যেমন 'জীবনচক্র', 'ক্রীড়াচক্র', 'পাঠচক্র' ইত্যাদি। কিন্তু যেদিন থেকে এটি পাকস্থলির সঙ্গে জড়াতে লাগল 'চা-চক্র'র মধ্য দিয়ে, সেদিন থেকে এর পতনশীল অর্থের পরিসর উন্মুক্ত হতে থাকল। আজ 'প্রকাশক' শব্দটিও জড়িয়ে গেছে 'চক্র' শব্দটির সঙ্গে; এটি উচ্চারণমাত্র ওই নিন্দাসূচক ও গভীর নঞর্থক শব্দটি জেগে ওঠে এবং লেগে থাকে। বেশ আগে থেকেই লেখকরা চক্রটির কাছে অসহায়। মানসম্পন্ন লেখকরাও এদেশে প্রকাশকদের টাকা দেন বই বের করার জন্যে। বিনিময়ে তাকে কিছু বই অবশ্য দেয়া হয়; আর যা রয়ে যায় প্রকাশকের কাছে, তার হিসাবটা কী, ক'টাই বা বিক্রি হলো, জানার অধিকার ও উপায় কোনোটাই লেখকের নেই। কারণ লেখকের সাথে নেই কোন চুক্তিপত্র। বেশ আগে থেকেই প্রকাশনা ব্যবসা এক রকম পাটোয়ারি কারবারের মতোই; এখন এটা রূপ নিয়েছে ধাপ্পাবাজিতে। এবং ধাপ্পাটা চলে সমাজের সবচেয়ে অগ্রসর অংশের সঙ্গে।
রয়্যালটি চাইতে গেলে প্রকাশকের কাছ থেকে যে-বাক্যটি শুনতে লেখকরা মোটামুটি অভ্যস্ত, তা এই, 'বই বিক্রি হয় নাই।' তা হলে বইগুলো কোথায় গেল? কোন নক্ষত্রমণ্ডলে হারিয়ে গেল? বিক্রি যদি না-ই হলো, প্রতিষ্ঠানটি কেন প্রতি বছর বাংলা একাডেমীকে টাকা দিয়ে স্টল নেয়? কেন বই বের করে যাচ্ছে বছরের পর বছর? প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো কি স্বেচ্ছাসেবায় মুহ্যমান?
টাকা দিয়ে ছাপানো বইয়ের একটি সাধারণ ছবি হচ্ছে প্রকাশক এগুলোর বিপণনে তেমন আগ্রহী নয়। ফলে এগুলোর বিক্রির ব্যাপারটিও মহাজাগতিক। একটা চোরাগোপ্তা কিছু নিশ্চয়ই আছে। আর যারা টাকা ছাড়া বই ছাপার সুযোগ পান, তাদের যন্ত্রণা অন্যরকম। তাদের তো জানার অধিকারই নেই, কতো কপি বই ছাপা হয়েছে, বিক্রি হয়েছে কতো। কোনো কোনো প্রকাশক অবশ্য সেই হিসাব জানিয়ে লেখকদের বেশ ধন্য করে থাকেন। কিন্তু এই জানা কেমন জানা, তা তো ভুক্তভোগীরা জানেনই। এক প্রকাশক আমার কবিতার বই ছেপে আমাকে ধন্য করেছিলেন। রয়্যালটি নয়, ক'টি বই বিক্রি হয়েছে, জানতে গিয়ে যে-পরিস্থিতির মধ্যে পড়লাম, মনে হলো লেখক হওয়া এদেশে যতোটা অপরাধ, তার চেয়ে বেশি অপরাধ বই প্রকাশের সূত্রে কোনো প্রকাশকের সঙ্গে কথা বলা বা বলতে যাওয়া।
'অমর একুশে গ্রন্থমেলা'য় স্টল বরাদ্দ থেকে বাংলা একাডেমী টাকা পেয়ে থাকে। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে এই মেলায় স্টল দেয়ার ক্ষেত্রে সম্প্রতি কিছু নিয়মকানুন হয়েছে। এগুলোতে রয়েছে প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা, রেজিস্ট্রেশন, ট্রেড লাইসেন্স এইসব বিষয়আশয়। কিন্তু বই প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রকাশকরা লেখকের সঙ্গে লিখিত কোনো চুক্তি করে কি-না, লেখকের রয়্যালটি তারা দেয় কি-না, টাকার বিনিময়ে বই বের করার ক্ষেত্রে কী নিয়ম থাকবে, প্রকাশিত বইগুলো মানসম্মত কি-না–এই বিষয়গুলোয় বাংলা একাডেমী মহা উৎসাহের সঙ্গে নীরবতা পালন করে যাচ্ছে। অভ্যাসটি প্রমাণ করে যে, মেলা উপলক্ষে অর্থ সংগ্রহ এবং এই কাজকে কিছু নিয়মের মধ্য দিয়ে বৈধ করে নেয়াই প্রতিষ্ঠানটির প্রধান একটি কর্তব্য। লেখকের টাকা যায় প্রকাশকের পকেটে; এই প্রক্রিয়ায় বাংলা একাডেমীও সেই টাকার ভাগ পায়। তাহলে কথাটা দাঁড়ায় এরকম: বাংলা একাডেমী ও প্রকাশকচক্র মিলিতভাবে লেখকদের ঠকিয়ে চলেছে! এই হলো আমাদের মহান একুশের চেতনার খুব সুন্দর উদাহরণ। এইসব অপকর্ম দেখার ও বছরের পর বছর সহ্য করে যাওয়ার জন্যে ভাষাভিত্তিক এই জাতিরাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে বাঙালির রক্ত ও অশ্রুর বিনিময়ে।
রয়্যালটি নিয়ে কিন্তু কিছু প্রীতিকর গল্পও আছে, যা আমরা শুনেছি দু'চারজন লেখকের কাছ থেকে। দু'চারটি প্রতিষ্ঠানের কথাও শুনেছি, যেগুলো থেকে বই বিক্রির টাকার একটা অংশ দেয়ার জন্যে লেখকদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হতো। পতনশীলতা এদেশের ধর্ম, পিছিয়ে পড়া আমাদের একটা অনিবার্যতা। আগে লেখকদের সম্মান ছিল, যদিও লেখকরা সম্মানের জন্যে লিখতেন না। সব লেখক লিখতেন না টাকার জন্যে; কিন্তু প্রাপ্যটুকু লেখকের হাতে তুলে দেয়ার দায়িত্ববোধ কোনো কোনো প্রকাশকের মধ্যে তো ছিল!
আজ লেখকদের রয়্যালটির কথা ভাবতে নেই। ভাবলেও বলতে নেই। লেখকরা খালি লিখবেন। আর অপেক্ষা করবেন (কারো-কারো না করলেও চলবে) থলেভরা টাকা নিয়ে কখন প্রকাশকরা আসবেন, দুঃখিত, কখন লেখকরা সেই প্রকাশককে খুঁজে পাবেন, যার প্রডাকশন ভালো। কাগজ-ব্যবসায়ী কাগজের বিনিময়ে টাকা পাবেন; ছাপাখানার মালিক ছাপার কাজ করে পাবেন; বাঁধাইকারী বই বাঁধিয়ে; কিন্তু পাণ্ডুলিপি দিয়ে লেখকদের কিছু পেতে নেই, তিক্ত অভিজ্ঞতা ছাড়া!
যাই হোক, এসব একতরফা নেয়া আর পাওয়ার অশ্লীল ও অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে লেখকসমাজকে মুক্ত করতে কিছু ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। প্রথমত, রয়্যালটি পাওয়ার নিশ্চয়তাদানকারি একটি অবকাঠামো তৈরির পাশাপাশি, মেলায় প্রতিদিনের বিক্রিত বই থেকে উপার্জিত টাকার অন্তত দশ শতাংশ প্রকাশক/স্টলগুলো লেখকদের জন্য রেখে দেবে। কারণ এই মেলা উপলক্ষে প্রচুর বই বিক্রি হয়। এই টাকা কোনওভাবেই মেলাস্থলের বাইরে নেয়া যাবে না। এটা তারা বাংলা একাডেমী বা মেলা কর্তৃপক্ষের কাছে গচ্ছিত রাখতে পারেন। পরে প্রকাশক সেই টাকা লেখকদেরকে বাংলা একাডেমী থেকে তুলে নিতে বলতে পারেন মেলা শেষে। যদি কোনও লেখক টাকা না নেন, তবে তা দুস্থ বা আর্থিক অনটনে-পড়া লেখকদের মধ্যে বিতরণ করা যেতে পারে। অথবা সেই টাকায় গঠিত হতে পারে একটা তহবিল, যা গুরুতর অসুস্থ লেখকের চিকিৎসায় কিংবা লেখকের মৃত্যুর পর তার পরিবারের কল্যাণে কাজে আসবে।
দ্বিতীয়ত, একটা নীতিমালা খুব দরকার। মেলায় তো বটেই, সারা বছরই নিচুমানের অসংখ্য বই বের হয়। অন্য অনেক বিষয়ের সঙ্গে নিচুমানের বইয়ের মুদ্রণ ঠেকানোর বিষয়টিও নীতিমালায় থাকা জরুরি। প্রকাশকরা লেখকদের রয়্যালটি দেয় কি-না, এ-ব্যাপারে মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। রয়্যালটির পরিমাণও স্থির হওয়া জরুরি। প্রচ্ছদশিল্পীকে সম্মানী দেয়া হয় কি-না, দিলে তা গ্রহণযোগ্য কি-না এইসব ব্যাপারেও নজরদারি চাই।
তৃতীয়ত, ছাপানো বইয়ের সংখ্যা ও বিক্রির পরিমাণ সম্পর্কে স্বচ্ছতার জন্যে একটি পর্যবেক্ষক কমিটি গঠন করতে হবে। যাদের লেখা বইয়ের বিক্রি ভালো হয়, তারা প্রকাশকের কাছ থেকে একটা থোক টাকা পান। কিন্তু ছাপানোর কাজে ব্যবহৃত প্লেটগুলো প্রকাশকদের কাছেই থেকে যায়, যেগুলোর ব্যবহার বারবার হতে পারে। দেখা যায়, লেখককে বলা হচ্ছে এক হাজার কপি ছাপিয়ে পাঁচ শ' বিক্রির কথা; কার্যত সত্যটি এই যে, তার চেয়ে বেশি বিক্রির ধান্দায় বেশি বই ছাপা হয়েছে; মেলায় ধান্দাটি সফল না-হলেও ক্ষতি নেই; বই তো কলা নয় যে, বাজারে বেশি দিন থাকলে পচে যাবে। আসল কথা, সারা বছর কী-পরিমাণ আয় হলো, তার হিসাব নেয়ার জন্যে এই খাতে অডিট হওয়া জরুরি। প্রকাশকদের রোজগার, জীবনযাপন ইত্যাদিও দেখা দরকার। লেখকদের বঞ্চিত করে প্রকাশকদের আরাম-আয়েশ গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। হলে, ধরে নিতে হবে–রাষ্ট্রের মধ্যে, সরকারের মধ্যে গোলমাল আছে।
চঞ্চল আশরাফ : কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক ও সমালোচক।
—–
ফেসবুক লিংক । মতামত-বিশ্লেষণ