মিডিয়াকে বলছি, দায়িত্বশীল হোন, প্লিজ

বৃন্দলেখক
Published : 8 June 2011, 06:39 AM
Updated : 18 Sept 2014, 05:52 PM

দু' দিন ধরে দুঃসহ সময় পার করছি আমরা। সাংবাদিক জয়শ্রী জামান ও আলিমুল হকের দুই সন্তান চিরশ্রী জামান মনমন (১৭) ও মোহাম্মদ বিন আলীম (১৫) গত সোমবার আত্মহত্যা করলে শুধু সাংবাদিক সমাজই নয়, গোটা দেশ শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়ে। জয়শ্রী ও আলিমুলের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটেছে বেশ ক'বছর আগে। তাদের দুই সন্তানের একসঙ্গে আত্মহত্যার ঘটনাটি বাবা-মায়ের বন্ধন অটুট না থাকলে যে ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে, সেই নির্মম সত্যটাই প্রমাণ করে দিয়েছে।

অথচ এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়ার বদলে আমরা মেতে উঠেছি কুৎসিত সাংবাদিকতায়। নারীর চরিত্র হননে মত্ত হয়েছে আমাদের গণমাধ্যমের একটি অংশ। কয়েকটি পত্রিকায় এই ঘটনায় আঙুল তোলা হয়েছে জয়শ্রী জামানের দিকে, যা আমাদের ভীষণভাবে মর্মাহত করেছে। একই রকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে দেখতে আমরা ক্লান্ত। সাংবাদিকতার নীতির বাইরে গিয়ে কল্পিত গল্পগাথা যে সমাজকে বিভ্রান্ত করতে পারে সে কথাটাও আমরা ভুলে গেছি।

২০১১ সালে স্বামীর নির্যাতনের শিকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রোমানা মঞ্জুরের কথা আমরা এখনও ভুলে যাইনি। রোমানার স্বামী হাসান সাইদ মারা যাবার পর পুরো পরিস্থিতিই বদলে গেল। রোমানার ওপর হওয়া অত্যাচারের কথা সমাজ, গণমাধ্যম ভুলে গেল। তখন প্রকাশিত হতে থাকলে কথিত 'ইরানি' বন্ধুর সঙ্গে রোমানা মঞ্জুরের ছবি আর সূত্রবিহীন মেইল। অথচ রুমানা দেশের বাইরে পড়াশুনা করছিলেন। তখন যে কারও সঙ্গে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠতেই পারে। এটা খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। এজন্য তো তার ওপরে করা অত্যাচার জায়েজ হয়ে যায় না।

আমরা ভুলে যাইনি ২০১০ সালে জুরাইনে দুই সন্তান নিয়ে মায়ের আত্মহত্যার কথা। সেখানেও একজন নারী সাংবাদিককে নিয়ে বিস্তর লিখেছে গণমাধ্যম। কয়েকটা দিন যাওয়ার পর দেখলাম, মূল ঘটনা পাশ কাটিয়ে দেদারসে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে লেখা হচ্ছে সেই নারী সাংবাদিককে নিয়ে। আত্মহত্যার মূল ঘটনাটি লিখতে মজা না পেয়ে নারী সহকর্মীকে নিয়ে হলুদ সাংবাদিকতাতেই বিকৃত আনন্দ ছিল অনেকের। সমুদ্র সৈকতে কিংবা ঘরের ভেতরে তোলা টি-শার্ট পরা ছবি দিয়ে সেই ঘটনার আপডেট জানানো হয়েছে বহুদিন।

ঐশীর ঘটনাটিও আমাদের সমাজকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াটাই যেন একমাত্র কারণ ছিল কিংবা জিন্স-টি-শার্ট। ঘটনার মূলে যাওয়ার চেয়ে ঐশীকে নিয়ে লেখালেখিই আনন্দের বিষয় ছিল অনেকের। লক্ষ্য ছিল জিন্স-টি-শার্ট পরা টিনএজ একটি মেয়ের ছবি দিয়ে নিউজ করে পত্রিকার পাঠক আর অনলাইনগুলোর হিট বাড়ানো।

সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি নিহত হওয়ার পরও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। আমাদের প্রিয় বন্ধু-সহকর্মী রুনির মৃত্যুর পর কতে কথা শুনেছি। হ্যাঁ, সব কথাই হয়েছে রুনিকে নিয়ে (প্রিয় বন্ধু সাগরকে নিয়ে বললেও সেটা সুখকর হতে না আমাদের কাছে)। রিপোর্টের লাইনে লাইনে রুনির চরিত্রহনন করা হয়েছে নানাভাবে। যার কারণে এখনও আমরা সাগর-রুনি হত্যারহস্য জানতে পারিনি। তবে রুনির বেলায় আমরা, রুনির বন্ধু-সহকর্মী ও স্বজনেরা প্রতিবাদ করেছিলাম।

জয়শ্রী জামানকে নিয়ে লেখা সংবাদগুলোর বেলায়ও আমরা একযোগে প্রতিবাদ জানাচ্ছি। জয়শ্রীর দুই সন্তানের আত্মহত্যার ঘটনা তো প্রত্যেক অভিভাবকের বিবেক জাগিয়ে তোলার কথা। নিজের সন্তানের নিরাপদ জীবনের জন্য সচেতন হয়ে উঠার কথা। আমাদের মনে রাখতে হবে, বাচ্চা দুটি ছিল জয়শ্রী জামানের প্রাণ। এই দুই সন্তানের জন্যই জয়শ্রীকে ছুটে বেড়াতে হত রাজধানীর এই প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। মনমন আর আলীমকে আঁকড়ে ধরেই বাঁচতে চেয়েছিলেন জয়শ্রী। আজ যখন ওরাও চলে গেল তখন তার আর তো হারাবার কিছু নেই।

তবুও সব হারানো নিঃস্ব জয়শ্রীকে আমরা বাঁচতে দিচ্ছি না। একজন সন্তানহারা মায়ের আর্তচিৎকার আমাদের কর্ণকুহরে পৌঁছে না। আমরা মানবিকতার হাত প্রসারিত করে তার পাশে দাঁড়াইনি। বরং কীভাবে তার বেঁচে থাকার শেষ সম্বল 'সম্মানটুকু' ধুলিসাৎ করা যায় সে জন্য যেন কেউ কেউ আদাজল খেয়ে লেগেছে। যার সব হারিয়েছে তাকেই দায়ী করা হচ্ছে কারণ হিসেবে। হায় রে সাংবাদিকতা!

অত্যন্ত মেধাবী মনমন ও আলীমকে নিয়েই দু'চোখে রঙিন স্বপ্ন ছিল জয়শ্রীর। মনমন চারটি স্টার মাকর্সসহ 'এ' পেয়েছিল 'ও' লেভেলে। গিটার বাজাত। জাপানি ভাষা জানত। মনমনও মায়ের মতোই বিনয়ী ও ভদ্র ছিল। অথচ ওই দুটি বাচ্চাকেও মাদকাসক্ত বানানোর অপচেষ্টা হয়েছে। গতকাল কয়েকটি পত্রিকা লিখেছে, "বাবা তাদের জীবন থেকে আগেই চলে গেছেন। মাও সে পথেই হাঁটছেন।" মা যে সে পথে হাটঁছেন এটা কীসের ভিত্তিতে বলছে পত্রিকাগুলো?

অথচ কম্যুনিটির প্রতি দায়িত্বশীল হয়ে এবং ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে দূরে সরে না থেকে আমরা যদি জয়শ্রী-আলিমুলের সাজানো সংসারটি ধরে রাখার চেষ্টা করতে পারতাম তাহলে হয়তো আজ দুটি মেধাবী শিশুকে অকালে ঝড়ে যেতে হত না। আমরা যদি মেধাবী মেয়েটির জন্য একটা চাকরির ব্যবস্থা করতে পারতাম তাহলে হয়তো সন্তান দুটিকে নিয়ে আরেকটু ভালোভাবে থাকতে পারত জয়শ্রী। আমাদের মধ্যে অনুতাপ তো নেই-ই, কেউ কেউ দুঃখজনক বিষয়টিকেও মিথ্যার প্রলেপ দিয়ে 'সংবাদ-পণ্য' করার চেষ্টা করছেন।

সমাজের বিবেক, সমাজের দর্পণ হিসেবে যারা কাজ করছেন, তারা কি দয়া করে একবার ভেবে দেখবেন বিষয়গুলো?

আমরা, জয়শ্রী জামানের বন্ধু ও সহকর্মীরা

দিল মনোয়ারা মনু, ইখতিয়ারউদ্দিন, তানবীর সিদ্দিকী, পারভীন সুলতানা ঝুমা, ফজলুল বারী, মাহমুদ হাফিজ, ফরিদা ইয়াসমিন, সুপ্রীতি ধর, জাহিদ নেওয়াজ খান, প্রভাষ আমিন, সুমি খান, ইলিয়াস খান, মানস ঘোষ, রানা হাসান, অঞ্জন রায়, মেনন মাহমুদ, কাওসার রহমান, রোজিনা ইসলাম, আঙ্গুর নাহার মন্টি, জাহানারা পারভীন, নাদিরা কিরণ, ফারহানা মিলি, শারমীন রিনভী, সুলতানা রহমান, জুলহাস আলম, শাহমিকা আগুন, আলফা আরজু, জাকিয়া আহমেদ, শাহনাজ গাজী, লীনা পারভীন, সাজু রহমান, ফাতেমা জোহরা হক কাকলী, গোধূলী খান, ইশরাত জাহান ঊর্মি, শরীফা বুলবুল, সাবরিনা সুলতানা চৌধুরী, শাহেদা ফেরদৌসী, ফারহানা লাকি, মুনমুন শারমীন শামস্, সেবিকা দেবনাথ, জেসমিন পাপড়ি, মোরসালিন মিজান, তাসকিনা ইয়াসমিন, লাবনী গুহ রায়, দৌলত আক্তার মালা, শামীম আরা শিউলি, রুখসানা ইয়াসমিন, সাবরিনা করিম মোর্শেদ ও ঝর্ণামনি।