বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানি: আর কত কাল

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 22 Sept 2014, 07:10 PM
Updated : 22 Sept 2014, 07:10 PM

দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবারও যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেছে। ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরমেন্স স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সাইফুল ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। অধ্যাপক সাইফুল সম্প্রতি (১৩ সেপ্টেম্বর) তার বিভাগের চতুর্থ বর্ষের এক ছাত্রীকে বাসায় ডেকে নিয়ে যৌন হয়রানি করেন বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের।

দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে শিক্ষকের দ্বারা ছাত্রীকে যৌন হয়রানির ঘটনা আমাদের দেশে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। বেশিরভাগ ঘটনাই ধামাচাপা পড়ে যায়। অনালোচিত থাকে। মাঝেমধ্যে কোনো কোনো ঘটনা ফাঁস হয়ে যায়। তাই নিয়ে আমরা কিছুদিন হৈচৈ করি। তারপর আবার সবকিছু আগের মতো চলতে থাকে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটিয়ে থাকেন– এ কথা সুবিদিত। কিন্তু এসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত, অপরাধ প্রমাণ, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি– এসব আর বড় বেশি হয়ে উঠে না। অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার সংস্কৃতির কারণে যৌন হয়রানির ঘটনা চলতেই থাকে।

হাজারো প্রতিকূলতার মধ্যেও যারা সাহস করে যৌন হয়রানির ঘটনা ফাঁস করেন, তাদের অভিনন্দন জানাতে হয়। তবে এখন অভিযোগ আর প্রতিবাদের মধ্যে থেমে থাকলে চলবে না, প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। প্রয়োজনে কষে থাপ্পর লাগাতে হবে। এতে নৈরাজ্য হয়তো কিছুটা বাড়বে। কিন্তু মুখোশধারী নরপশুদের শায়েস্তা করতে এমন নৈরাজ্যের বিকল্প কী?

আমাদের প্রচলিত ব্যবস্থায় অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান বেশ কঠিন। আর কঠিন কাজটা খুব একটা এগোয়ও না। এ পরিস্থিতিতে কর্তৃপক্ষকে কঠোর ও আন্তরিক হতে হবে। না হলে নৈরাজ্যকেই আমন্ত্রণ জানাতে হবে। কেননা নিজের মর্যাদা রক্ষার অধিকার সবারই আছে।

যৌন হয়রানি প্রতিরোধে সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব শিক্ষকদের। এমন কলঙ্কের দায় নিয়ে শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে যুক্ত থাকাটা মোটেও সম্মানের নয়। মনে রাখতে হবে, অল্প কয়েকজন অপরাধ করলেও কলঙ্কের দায় কিন্তু সবার উপরই বর্তায়।

অনেক শিক্ষককে বলতে শুনেছি, বিশ্ববিদ্যালয় সমাজের থেকে আলাদা নয়। সমাজের সামগ্রিক অধঃপতনের ঢেউ বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়েছে। এটা একটা চাতুর্যপূর্ণ উক্তি। এর মধ্যে একটা দায় এড়ানোর মনোভাব রয়েছে। সমাজের ঘাড়ে সব দোষ চাপিয়ে দিয়ে নিজে মহানন্দে থাকব– এটা মূঢ়তা। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষকের কাছ থেকে এমন মূঢ়তা আশা করা যায় না।

যখন রাস্তাঘাটে কোনো যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটে তখন আমরা বলি, ওর মধ্যে প্রকৃত শিক্ষার আলো নেই, তাই এমন অপকর্ম করেছে; যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এমন কাজ করেন তখন আমরা কী বলব? সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তির মধ্যে যদি শিক্ষার আলো না থাকে, তাহলে আমরা উন্নত সমাজ গড়ব কাদের নিয়ে? যৌন নির্যাতনকারী-লোলুপ-লম্পটদের নিয়ে?

যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে আমাদের সামগ্রিক সচেতনতা আজ বড় বেশি প্রয়োজন। এ জন্য সবার আগে বদলাতে হবে নারী সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি। অনেক পুরুষের কাছে, নারীরা কেবলই ভোগ্য হিসেবে বিবেচিত। নারীকে মনে করা হয় কেবলই 'কামনার বস্তু'। তাদের মনে এ বিষয়টি কাজ করে যে, কোনো এক নারীকে পাওয়াটা তার এক ধরনের অধিকার। তাই তো তারা সুযোগ পেলেই নারীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

নারী নির্যাতনকারীরা কোনো অদ্ভুত বা অচেনা ব্যক্তি নয়। তারা হতে পারে কারও বাগদত্তা, সহপাঠী, শিক্ষক বা কাছে থাকা আর অন্য কেউ। ঘরদোর পরিষ্কারকারী বা অফিসের কোনো দারোয়ান। এমনকি তিনি হতে পারেন শ্রদ্ধেয় কোনো ঘনিষ্ঠজন। এসবের বাইরে যে কোনো পুরুষই হতে পারে হয়রানিকারী, এমনকি ধর্ষক। সব হয়রানিকারীই নির্যাতিত ব্যক্তিটিকে মনে করে 'কামনার বস্তু'।

যৌন নির্যাতনের সঙ্গে ক্ষমতার সম্পর্ক আছে। নারীর ওপর বলপ্রয়োগের বহিঃপ্রকাশ হিসেবেও যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটতে পারে। কখনও দেখা যায়, সামাজিকভাবে কোনঠাসা কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তির সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ার আশায় অলীক কল্পনা করতে থাকে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সমাধান না পেয়ে, বলপ্রয়োগের পথ বেছে নেয়।

ঘরে-বাইরে নারীর উপর আগ্রাসী যৌন আচরণ, যৌন হয়রানি, যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণ সবই পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা কাঠামোতে নারীর অধস্তনতাই প্রকাশ করে নানারূপে। তাই ধর্ষণ, যৌন হয়রানি বা নিপীড়ন, নারীর সম্মতি ব্যতিরেকে তার উপর যে কোনো ধরনের আগ্রাসী যৌন আচরণ ক্ষমতা প্রদর্শনের, দমন-পীড়নের, কর্তৃত্ব করার কুৎসিত বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছু নয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে যার জন্ম, সচেতন চেষ্টা ছাড়া নারীবান্ধব, নারীবাদী, সে কোনোভাবেই হয়ে উঠতে পারে না। দৃষ্টিভঙ্গিটা পুরুষতান্ত্রিক বলেই নারীকে তারা গণ্য করে অধস্তন লৈঙ্গিক পরিচয়ের বস্তু হিসেবে যা পীড়নযোগ্য।

এটা খুবই আশঙ্কার কথা যে, একজন মেয়ের জন্য সমাজের কেউ নিরাপদ নয়। শিক্ষক, সহপাঠী, বন্ধু, এলাকার ছেলে, আত্মীয়-পুরুষ, চাচা-মামা-খালু, দুলাভাই। কর্মক্ষেত্রে সহকর্মী, অফিসের বস– সুযোগ পেলেই মিষ্টি হাসি হেসে হয়রানিকারী বা ধর্ষকের রূপ ধরতে মুহূর্ত দেরি করেন না। বাসের হেলপার, ক্যান্টিন বয়, হাসপাতালের ঝাড়ুদার, বাসার দারোয়ান কিংবা অফিসের পিয়ন– নিজেদের তথাকথিত পৌরুষ দেখাতে কেউ কারও চেয়ে পিছিয়ে নেই।

প্রথমত, নারীনিপীড়করা মনে করে, এভাবে তারা 'পৌরুষ' প্রদর্শন করতে পারছে। দ্বিতীয়ত, তাদের ধারণা, নারীর প্রতি এ ধরনের আচরণ সহজেই করে ফেলা যায়। নারী খুব সহজ 'শিকার' বলে তাদের ক্ষতি হওয়ার ভয় কম। কারণ অনেক সময় পুলিশ প্রশাসনও নিপীড়কদের পক্ষে থাকে। ভুক্তভোগী এমনকি ধর্ষিত নারীর প্রতি সহানুভূতির পরিবর্তে পুলিশ নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে। সে ক্ষেত্রে নারীর জন্য ন্যায়বিচার পাওয়া কঠিন হয়ে যায়।

নারী নির্যাতন কেন হয়, যৌন হয়রানি কেন ঘটে? এসব প্রশ্নের উত্তরে আমাদের চারপাশে অনেক কথা শোনা যায়। যেমন– নারীর প্রোভোকেটিভ পোশাক পরিধান (পাঁচ বছরের শিশুর শরীর কীভাবে কাউকে প্রভোক করে!), ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয় (ধর্মতান্ত্রিক মধ্যপ্রাচের দেশগুলোতে ধর্ষণের হার তবে এত বেশি কেন? এত কম কেন ধর্মনিরপেক্ষ স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে?), পুরুষের যৌন কামনা (তবে স্বমেহনের বদলে ধর্ষণ কেন?) ইত্যাদি ইত্যাদি। এসবই আসলে পুরুষতান্ত্রিক যুক্তি।

নারীবাদীরা এসব যুক্তি গ্রাহ্য করেন না। তাদের মতে, বর্তমান বিশ্বে ধর্ষণের আদি কারণ সুপ্রাচীনকাল থেকে মানবসমাজে বহমান পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাচেতনা। অনেক পুরুষ বলেন, নারীরাই নারী নির্যাতনের জন্য বেশি দায়ী। নারীরাই নারীদের পরাধীন করে রাখার পক্ষে বেশি ভূমিকা পালন করে থাকেন। মেয়েরাই মেয়েদের বড় শত্রু।

এসব কথা আমরা প্রতিনিয়ত শুনি। এ প্রসঙ্গে আশাপূর্ণা দেবীর লেখা 'সুবর্ণলতা' উপন্যাসটির কথা মনে পরে। সুবর্ণলতায় শাশুড়ি প্রতি পদে পুত্রবধূর পায়ে বেড়ি পরাতে চায়। এর কারণটাও আশাপূর্ণা দেবী অত্যন্ত চমৎকারভাবে বর্ণনা করেছেন, 'যে মহিলা চিরকাল পুরুষের সৃষ্টি করা সংস্কারের অধীন সে কী করে বুঝবে যে স্বাধীনতা কী? তাই সুবর্ণলতা শাশুড়ির এহেন আচরণে তার উপর রাগ করতে পারে না বরং করুণা হয়, যে মানুষটা এতটাই মিথ্যা কুসংস্কারের নাগপাশে বন্দি যে এর বাইরে অন্য কিছু ভাবতেও সে ভুলে গেছে।' গল্পের শেষে লেখিকা দেখিয়েছেন, মনের কালো কুঠুরির দরজায় ঘা মেরে মেরে সুবর্ণলতা অবশেষে তা ভাঙতে সক্ষম হন।

আদতে মেয়েরা মেয়েদের শত্রু নয় মোটেই। এটা পুরুষতন্ত্রের খোঁড়া যুক্তি। মেয়েদের হীন করে করে রাখার, মেয়েদের ঘাড়ে দোষ চাপানোর এবং পুরুষকে সব রকম অপকর্মের দায় থেকে রেহাই দেওয়ার একটা অপকৌশল। ছোটকাল থেকেই মেয়েদের মাথায় হাতুড়ি মেরে মেরে (মগজ ধোলাই) যা ঢুকিয়ে দেওয়া হয় তারা তার বাইরে সহজে বের হতে চায় না বা পারে না। যা চলে আসছে তাই ঠিক বলে মনে হয়। সংস্কার জাল বিস্তার করে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে। অবশ্য শুধু সংস্কারই-বা কেন? সব নিয়ম, সব ধর্ম, সব রীতিনীতির তো একটাই লক্ষ্য– যেন-তেনভাবে মেয়েদের স্বাধীনতা খর্ব করা।

ভিড়ের সুযোগে ধাক্কা মারা বা শরীরে হাত দেওয়ার কারণে কোনো নারী যদি প্রতিবাদী হয়, সংশ্লিষ্ট পুরুষকে কিছু বলে, তবে অন্য সবাই কোনো তদন্ত ছাড়াই মেয়েটির বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যায়। পুরুষতন্ত্র তো মেয়ের খুঁত ধরার জন্য মুখিয়ে বসে আছে।

যৌন হয়রানির ঘটনাগুলো যত কম লুকিয়ে রাখা যায় তত ভালো হয়; ঘটনাটার সত্যিকারের রূপের সামনাসামনি হবার হিম্মত অর্জন করতে হবে। লিঙ্গভিত্তিক ক্ষমতায়নের নিয়ম যতদিন না পালটায়, পুরুষরা যতদিন মেয়েদের নিজস্ব সম্পত্তি হিসেবে ভাবা বন্ধ না করে, আমাদের ততদিন এই ভয়ংকর অত্যাচারের হাত থেকে মুক্তি পাবার কোনো উপায় আছে বলে মনে হয় না।

পুরুষতান্ত্রিকে এই সমাজে অধিকাংশ পুরুষের ভেতরে যেন একটা করে হয়রানিকারী বা ধর্ষক লুকিয়ে আছে। সময় এবং সুযোগে কারওটা বেরিয়ে আসে। অনেকের সে সুযোগ মেলে না। আরেক দল আছে, যৌন হয়রানির প্রতিবাদ না করে পরোক্ষে সেও হয়রানিকারী সেজে সমাজে জায়গা করে দেয়।

মনে রাখা দরকার, নারী-পুরুষে আদিতম বিনিময় সম্পর্ক হল যৌনসম্পর্ক। সেই বিনিময়ে শোষণ-নির্যাতনও গোড়া থেকেই আছে। আবার একই সঙ্গে আধিপত্যহীন যৌনসম্পর্ক জীবনেরই উপহার। কিন্তু যৌন নিপীড়নের সংস্কৃতি থেকে বেরোতে না পারলে এই উপহার থেকে আমরা বঞ্চিত থেকে যাব।

যৌন হয়রানি, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ ইত্যাদি আসলে একটি পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতায়নের প্রক্রিয়া। যার উচ্ছেদ চাইতে হলে পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। নারীর ব্যক্তিত্বের মর্যাদা দিতে হবে। মানুষ হিসেবে নারী-পুরুষের মধ্যে সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তার ইচ্ছে-অনিচ্ছে ভালোলাগা-মন্দলাগায় সর্বোচ্চ মূল্য দিতে হবে।

আর আমাদের বিশ্বাস, প্রতিবাদ করতে করতে, নিজেদের মানসিকতা পালটাতে পালটাতে আসবে সেই সম্মানের সাম্য।


চিররঞ্জন সরকার:
কলামিস্ট।