Published : 07 Sep 2014, 12:26 PM
ডেভোরা এলিস মূলত শিশুদের জন্য লিখেন। তাঁর লেখালেখির বিষয়আশয়ও শিশুদের জীবন ও মনন। কিন্তু তিনি শিশুসাহিত্যিক নন। বরং তিনি অত্যন্ত সিরিয়াস লেখক। তাঁর লেখালেখির পটভূমি যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগান, ইরান, ইরাক, সিরিয়া। যেখানে যুদ্ধ সেখানেই ছৃটে গিয়েছেন ডেভোরা। একটি দেশের সশস্ত্র যুদ্ধ ওই জনপদের শিশুদের জীবনের উপর কীভাবে প্রভাব ফেলে, কী ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে তা নিজে প্রত্যক্ষ করেছেন তিনি। কথা বলেছেন শিশুদের সঙ্গে। অনুধাবন করেছেন তাদের জীবনের অভিজ্ঞতা। তারপর সেগুলো ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর লেখনীতে।
না, ডেভোরা এলিস কোনো জবানবন্দি লিখেননি। তিনি লিখেছেন উপন্যাস। পাঠক মাত্রই জানেন, উপন্যাস সাধারণভাবেই রচিত হয় লেখকের কল্পনার অভিব্যক্তি দিয়ে। কিন্তু ডেভোরা কেবল কল্পনার উপর নির্ভরশীল হতে চাননি। সে জন্যে তিনি ছুটে গেছেন দেশ থেকে দেশে। তাঁর উপন্যাসের চরিত্রগুলোর ব্যক্তিগত জীবনযাপন, অভিজ্ঞতা নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করেছেন। তারপর সেগুলো চিত্রিত করেছেন তাঁর উপন্যাসে।
সম্ভবত সে কারণেই তাঁর উপন্যাস অনুদিত হয়েছে নানা ভাষায়। কানাডার সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার 'গভর্নর জেনারেল পুরস্কার' পেয়েছেন তিনি। একটি বইয়ের রয়্যালটি থেকেই তিনি এক মিলিয়ন ডলার অনুদান দিয়েছেন ইউনিসেফকে।
পশ্চিমের বোদ্ধা পাঠকের সামনে ডেভোরা এলিসকে তেমন বিশেষণ বা ভূমিকা দিয়ে পরিচয় করিয়ে দিতে হয় না। নিজের লেখালেখির মাধ্যমেই তিনি একটি পরিচিত নাম। সেই ডেভোরার সঙ্গে দেখা এবং কথা বলার সুযোগ হয়েছিল গত উইন্টারে। টরন্টো পাবলিক লাইব্রেরির একটি অনুষ্ঠানে তিনি এসেছিলেন বক্তৃতা করতে। সেই অনুষ্ঠানে এক খুদে পাঠক তাকে প্রশ্ন করেছিল, ''লেখালেখিটা তুমি কীভাবে কর? মানে, দেশে দেশে ঘুরে তথ্য যে সংগ্রহ কর সেটা তো বললেই। কিন্তু সেই তথ্যগুলো তোমার লেখায় কীভাবে প্রয়োগ কর? কীভাবে বুঝতে পার যে তোমার লেখাটা লেখা হয়ে উঠেছে?''
মনে পড়ে, প্রশ্নকর্তাটি ছিল ইলিমেন্টারি স্কুলের শিক্ষার্থী। কিন্তু ডেভোরা গুরুত্ব দিলেন তার প্রশ্নের 'কীভাবে বুঝতে পার, তোমার লেখাটা যে লেখা হয়ে উঠেছে' অংশটিকে। তিনি বললেন, ''আমি লিখতে থাকি, লিখতে থাকি। একটা চ্যাপ্টার লেখা শেষ হলে যখন এডিটরকে দিই, তিনি এমনভাবে কাটাকাটি করেন, চেঞ্জ করতে বলেন, আবার পুরোটা লিখতে হয়। কখনও কখনও একেকটা চ্যাপ্টার ৩/৪ বার করে লিখতে হয়। এডিটরের চূড়ান্ত অনুমোদন না পাওয়া পর্যন্ত লেখা চেঞ্জ করতে হয়।''
প্রশ্ন করা হয়, এডিটর কি শুধু ল্যাঙ্গুয়েজ দেখেন? নাকি তথ্যও? ডেভোরা জবাব দেন, দুটোই। তথ্যটা সঠিক কিনা সেটা তো এডিটর দেখেন-ই, সেই তথ্যটা আমি কীভাবে উপস্থাপন করব, ঠিক কোন শব্দটা ব্যবহার করব, বাক্যটা কীভাবে সাজাব– এগুলো নির্ভর করে এডিটরের অনুমোদনের উপর।
''তাহলে এডিটর লিখে দিলেই তো পারে। আর এডিটর যদি এত কাটাকাটি করে তাহলে তোমার লেখা থাকে কোথায়?''– প্রশ্ন করে আরেক খুদে প্রশ্নকর্তা।
ডেভোরা সহাস্যে জবাব দেন, ''এডিটর এই পরিশ্রমটুকু করেন বলেই একেকটি বই এত সুন্দর হয়ে উঠে। লেখক হিসেবে আমি যেটা তৈরি করি, সেটা নিতান্তই কাঁচামাল। একজন সম্পাদক তাঁর মেধাবুদ্ধি যোগ করেন বলেই সেগুলো হয়ে ওঠে এত আকর্ষণীয়।''
একে খন্দকারের '১৯৭১: ভেতরে বাইরে' বইটি নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্কের প্রেক্ষিতে ডেভোরা এলিসের সঙ্গে শিশু পাঠকদের এই সংলাপের কথা মনে পড়ে গেল। বাংলাদেশে কোনো প্রকাশনা সংস্থায় আলাদাভাবে সম্পাদক বলে কেউ আছেন বলে আমার জানা নেই। অনেকের লেখা সংগ্রহ করে বই প্রকাশকেই সাধারণভাবে সম্পাদনা হিসেবে দেখা হয় বাংলাদেশে। ধরে নেওয়া যায়, একে খন্দকারের বইটি কেউ সম্পাদনা করেননি। লেখক নিজেও বইটির তথ্যের ব্যাপারে যে সম্পূর্ণ নিশ্চিত ছিলেন তা-ও কিন্তু নয়।
রাজনৈতিক বিতর্ক না হলে হয়তো আরও অনেক বছর এই বইটি সম্পর্কে তেমন কিছু জানাই যেত না। কিন্তু বিতর্ক বইটির কাটতি বাড়িয়েছে, বইটির প্রকাশক 'প্রথমা'কে ব্যবসা দিয়েছে। একই সঙ্গে লেখক হিসেবে একে খন্দকারের চিত্তের অস্থিরতা সম্পর্কেও পাঠককে ধারণা দিয়েছে। বইটি প্রকাশের তিন দিনের মাথায় প্রকাশিত দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকায় লেখক বলছেন, ''বইয়ের ৩২ পৃষ্ঠার দ্বিতীয় স্তবকে আমি লিখেছিলাম– এই ভাষণের শেষ শব্দ ছিল 'জয় পাকিস্তান'। আসলে তা হবে 'এই ভাষণের শেষ শব্দ ছিল 'জয় বাংলা, জয় পাকিস্তান'।''
তার মানে কী? মানে হচ্ছে লেখক নিজেও নিশ্চিত ছিলেন না। একে খন্দকার যেহেতু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সরাসরি শোনার সুযোগ পাননি, তাঁকে অন্য কোনো সূত্রের উপর নির্ভর করতে হয়েছে তথ্যের জন্য। সেই তথ্যটি কী তা তিনি বইয়ে উল্লেখ করেননি।
সাধারণভাবে অন্যের কাছ থেকে নেওয়া তথ্যসূত্রের উল্লেখ করে ব্যবহার করা স্বাভাবিক সৌজন্য। ইতিহাস বয়ানের ক্ষেত্রে সেটি অপরিহার্যও। একে খন্দকার সৌজন্য ও অপরিহার্যতা, দুটোই উপেক্ষা করেছেন। কিন্তু তিনি আবার নিজের অবস্থানে স্থিরও থাকতে পারেননি। তিনদিনের মাথায় প্রকাশ হওয়া দ্বিতীয় সংস্করণে নিজেই স্বীকার করছেন যে, প্রথম সংস্করণে তিনি সঠিক তথ্য ব্যবহার করেননি।
তাহলে দ্বিতীয় সংস্করণে তিনি যে সঠিক তথ্য ব্যবহার করেছেন সেটা আমরা বিশ্বাস করি কীভাবে? কিংবা বইটা নিয়ে এত হৈচৈ না হলে, তিনদিনের মাথায় দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ না হলে তিনি কীভাবে এই তথ্য সংশোধন করতেন? সে ক্ষেত্রে তো 'বঙ্গবন্ধু জয় পাকিস্তান' বলে ৭ মার্চের ভাষণ শেষ করেছেন বলেই তথ্য থাকত। যেমন, এখন যারা প্রথম সংস্করণ পড়বেন তারা ওইটাই জানবেন।
যিনি জাতিকে ইতিহাসের বয়ান দেবেন তিনি ইতিহাসের ওই সময়টাতে 'এমএলএ' ছিল, নাকি এমপিএ ছিল সেটা জানবেন না, তা কী করে হয়? যদি না-ই জানেন, তাহলে তো স্পষ্টত বোঝা যায় তিনি রাজনীতির খবরাদি রাখতেন না, সেই সময়ের সরকারের অনুগত হিসেবে বিমানবাহিনীর চাকরিটিই ঠিকমতো করে গেছেন। তো, যিনি ইতিহাসের মাহেন্দ্রক্ষণের রাজনীতির গতিধারা সম্পর্কে খোঁজখবর রাখতেন না, তিনি জাতিকে ইতিহাসের বয়ান দিতে আসেন কীভাবে?
দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকা থেকে জানা যায়, একে খন্দকারের এমপিএ আর এমএলএর বিভ্রান্তি কেটেছে প্রফেসর আনিসুজ্জামানের সঙ্গে কথা বলে। সেটি তিনি তাঁর দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন। কিন্তু 'জয় পাকিস্তান' আর 'জয় বাংলা, জয় পাকিস্তান' নিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন কার সঙ্গে কথা বলে বা কোন দলিলের ভিত্তিতে? সেটি কিন্তু তিনি উল্লেখ করেননি।
দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকায় একে খন্দকার বলেছেন, ''সহৃদয় পাঠক এই বইয়ের অন্য কোনো ত্রুটি আমার নজরে আনলে বাধিত হব।''
অর্থাৎ একে খন্দকার নিজেও এই বইয়ের সমুদয় তথ্যের যথার্থতার ব্যাপারে নিশ্চিত নন। তিনি পাঠকদের দায়িত্ব দিচ্ছেন বইয়ের তথ্যের ভুল সত্য ধরিয়ে দেওয়ার। মুক্তিবাহিনীর উপপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী একে খন্দকার তথ্য সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়েই ইতিহাসের বয়ান নিয়ে জাতির সামনে হাজির হলেন কোন স্পর্ধায়?
৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের শেষে বঙ্গবন্ধু 'জয় বাংলা' বলার সঙ্গে 'জয় পাকিস্তান' বলেছিলেন কিনা, সেটি নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক। কেননা সেই সময়কার রাজনীতির বাস্তবতায় 'জয় বাংলার' সঙ্গে 'জয় পাকিস্তান' বললেও ইতিহাসের ধারাবাহিকতা পাল্টে যায় না, বাংলাদেশের স্থপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর নাম খারিজ হয়ে যায় না। কিন্তু যে দেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পাল্টে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে হেয় করার জন্য বড় বড় রাজনৈতিক গোষ্ঠী পর্যন্ত এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে, সেখানে মুক্তিযুদ্ধের উপপ্রধানের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বই প্রকাশের ক্ষেত্রে আরও একটু সতর্কতা দরকার ছিল।
সেই সতর্কতা লেখক হিসেবে একে খন্দকারের যেমন, প্রকাশক হিসেবে 'প্রথমা' দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। আমি বিশ্বাস করতে চাই, একে খন্দকার বা 'প্রথমা' কেউই কোনো অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এই বইটি লিখেননি বা প্রকাশ করেননি। তিনদিনের মাথায় নিজ বইয়ের তথ্য সম্পর্কে একে খন্দকারের দুদোল্যমানতা ঈঙ্গিত দেয়, তিনি পর্যাপ্ত হোমওয়ার্ক করে বইটি লিখেননি।
একে খন্দকারের বই নিয়ে বিতর্কই আমাকে ডেভোরা এলিসের কথা মনে করিয়ে দিল। কানাডার সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরষ্কার পাওয়া লেখককেও দফায় দফায় তাঁর লেখা বদলে ফেলতে হয় সম্পাদকের কাঁচির খোঁচায়। তথ্য, শব্দ, এমনকি বাক্য পর্যন্ত সম্পাদকের অনুমোদন পেতে হয়।
একে খন্দকারের বই নিয়ে বিতর্ক এবং তথ্য সম্পর্কে নিজের দোদুল্যমান অবস্থার কারণেই তার বইটি প্রকাশের আগে একজন পেশাদার সম্পাদকের হাত হয়ে আসা উচিত ছিল। সেই কাজটি একে খন্দকার নিজে যেমন করতে পারতেন, তেমনি প্রকাশক হিসেবে 'প্রথমা'ও করতে পারত।
এটা ঠিক যে, বাংলাদেশের লেখকরা এখনও নিজেদের লেখা আর কাউকে দিয়ে 'এডিট' করিয়ে বই প্রকাশ করার চিন্তা ধারণ করার জন্য প্রস্তুত নন। কিন্তু লেখকদের পেশাদারিত্বের জন্যই যে সেটি দরকার, তা লেখকরা অনুধাবন করতে পারলে ভালো। বিশেষ করে, অবসরপ্রাপ্ত আমলারা যখন লেখক হিসেবে নাজিল হতে চান, তাদের জন্য সম্পাদকের বিধানটি অপরিহার্য হওয়া দরকার।
একে খন্দকারের '১৯৭১: ভেতরে বাইরে' বইটির তথ্য নিয়ে খোদ লেখকেরই যেহেতু সংশয় আছে এবং তিনি এর ভুল ধরিয়ে দেবার জন্য পাঠকের শরণাপন্ন হন, তখন এটি বই হিসেবে বাজারে থাকার উপযোগিতা হারায়। 'প্রথমা' এবং লেখক একে খন্দকারের উচিত বইটি ঘোষণা দিয়ে প্রত্যাহার করে নিয়ে, এটি পেশাদার এবং যোগ্য কাউকে দিয়ে সম্পাদনা করিয়ে নতুনভাবে প্রকাশ করা।
আশা করি লেখক এবং প্রকাশক উভয়েই জাতির প্রতি এই দায়িত্বশীলতাটুকু দেখাবেন।
শওগাত আলী সাগর: দৈনিক প্রথম আলোর সাবেক বিজনেস এডিটর। টরন্টো থেকে প্রকাশিত নতুনদেশ ডটকম এর প্রধান সম্পাদক।