গণতন্ত্র বনাম সম্প্রচার নীতিমালা ও বিচারপতিদের অভিশংসন

আমানুল্লাহ কবীর
Published : 1 Sept 2014, 07:03 AM
Updated : 1 Sept 2014, 07:03 AM

দেশে দুটি নতুন আইন হতে যাচ্ছে। একটি সম্প্রচার নীতিমালা, অপরটি বিচারপতিদের অভিশংসনের জন্য জাতীয় সংসদের ক্ষমতায়ন। দুটি প্রস্তাবিত আইনই সমাজের সর্বস্তরে বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। মন্ত্রিসভা ইতোমধ্যেই আইন দুটির প্রস্তাব অনুমোদন করেছে। এরপর আইন দুটি সংসদে পাস করার জন্য বাকি প্রক্রিয়া শুরু হবে।

বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের অন্যতম স্তম্ভ। আর প্রেস বা সংবাদমাধ্যমকে বলা হয় রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ (ইংরেজিতে fourth estate)– অর্থাৎ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা যে চারটি স্তম্ভের উপর স্থাপিত, তার দুটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হচ্ছে বিচার বিভাগ ও সংবাদমাধ্যম। গণতান্ত্রিক অধিকার সমুন্নত রাখার জন্য এ দুটি অঙ্গ কতটুকু কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে, তা নির্ভর করে তাদের স্বাধীনতার উপর। যে দুটি নতুন আইন হতে যাচ্ছে, তা অপরিবর্তিত অবস্থায় বাস্তবয়িত হলে বিচার বিভাগ ও সম্প্রচার মাধ্যমগুলো স্বাধীনভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারবে কিনা, এ বিবেচনা থেকেই বিতর্কের শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ গণতন্ত্র চর্চার যে স্তরে রয়েছে তাতে উদ্বেগ ও শংকার কারণ অযৌক্তিক বলে পরিস্থিতি হালকা করে দেওয়া যৌক্তিক হবে না।

প্রথম পর্ব: সম্প্রচার নীতিমালা

প্রথমেই প্রস্তাবিত সম্প্রচার নীতিমালার কথা বলা যাক। সংবাদপত্র ও সম্প্রচার মাধ্যমগুলোর জন্য নীতিমালা থাকবে না, বিষয়টা তা নয়। সংবাদমাধ্যমের সার্বিক বিকাশের জন্য নীতিমালা প্রণয়নের কথা সাংবাদিকরা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছিল। সাংবাদিকরা সংবাদপত্রের জন্যও নীতিমালা দাবি করেছিল, কিন্তু তা আর কখনও হয়নি। প্রেস কাউন্সিল নিজ উদ্যাগে পেশাদার সাংবাদিকদের জন্য নীতিমালা তৈরি করেছিল, কিন্তু তা সমন্বিত উদ্যোগের অভাবে কার্যকর হয়নি। এটা এখন নিশ্চয়ই আলমারির তাকে ধূলার নিচে চাপা পড়ে গেছে।

আমাদের সংবাদপত্রের ইতিহাস দীর্ঘদিনের হলেও বেসরকারি খাতে সম্প্রচার মাধ্যমের ইতিহাস দু'দশকের বেশি নয়। কিন্তু এর প্রসার ঘটেছে অতিদ্রুত। দেশে পোশাক শিল্পের পর সম্প্রচার মাধ্যমই কেবল এত দ্রুত প্রসার লাভ করেছে। ফলে সংশ্লিষ্ট সব মহলে নীতিমালার প্রয়োজন অনুভূত হয়। তবে সাংবাদিকসহ মিডিয়াকর্মী, বিনিয়োগকারী ও সরকার একই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তা অনুভব করেছিল, তা নয়। প্রস্তাবিত নীতিমালা আলোচনা করলে তা পরিস্কারভাবে বোঝা যায়।

খসড়া নীতিমালা তৈরির জন্য সরকার যে কমিটি গঠন করেছিল তাদের অনেকরই অভিযোগ, খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে একতরফাভাবে এবং তাদের অনেক প্রস্তাব কাটছাঁট করা হয়েছে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রাধান্য দেওয়ার জন্য। কথা ছিল, সরকার একটি স্বাধীন সম্প্রচার কমিশন গঠন করবে, যে কমিশন নীতিমালা তৈরি করবে। কিন্তু ঘোড়ার আগে গাড়ি জোড়ার মতো সরকার কমিশন গঠনের আগেই নীতিমালা করে তা পরে গেজেট আকারে প্রকাশ করেছে। সরকার আগেই নীতিমালা তৈরি করে দিলে কমিশনের নীতিমালা তৈরির স্বাধীনতা কোথায় থাকল? ফলে অবিশ্বাসের শুরু হয়েছে গোড়াতেই।

কমিশন কবে নাগাদ গঠিত হবে, খোদ তথ্যমন্ত্রীও তা সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারছেন না। তবে নীতিমালার শেষে একটি ধারা যোগ করে দেওয়া হয়েছে, ''সম্প্রচার ও সম্প্রচার কমিশন সম্পর্কিত আইন, বিধিমালা এবং নীতিমালা প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত তথ্য মন্ত্রণালয় সম্প্রচারসংশ্লিষ্ট সকল বিষয়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।''

এ কথা বলে সম্প্রচার মাধ্যমগুলোর উপর খড়গ ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। কত দিন নাঙ্গা অবস্থায় এই খড়গ ঝুলবে তার নির্দিষ্ট দিন-তারিখ নেই।

নীতিমালার 'উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য' সম্পর্কে যেসব কথা বলা হয়েছে, 'সংবাদ ও তথ্যমূলক অনুষ্ঠান' সম্প্রচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেক ধারাই সাংঘর্ষিক। এসব ধারা তথ্য অধিকার আইনের সঙ্গেও অসামঞ্জস্যপূর্ণ। সংবিধানে মতপ্রকাশের ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার যে নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে, নীতিমালা তৈরির বেলায় তা-ও যথাযথ অনুসরণ করা হয়নি। সরকার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নির্ধারণ করে দিয়ে কমিশন গঠন করে তার উপর নীতিমালা তৈরির দায়িত্ব অর্পণ করলে আজ যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে, তা হওয়ার সুযোগ থাকত না। উদাহরণস্বরূপ, এসব ধারার কয়েকটি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা যেতে পারে।

'সংবাদ ও অনুষ্ঠান সম্প্রচার' অধ্যায়ে বলা হয়েছে, ''আলোচনামূলক অনুষ্ঠানে কোনো প্রকার বিভ্রান্তিকর ও অসত্য তথ্য বা উপাত্ত দেওয়া পরিহার করতে হবে। এ ধরনের অনুষ্ঠানে সকল পক্ষের যুক্তিসমূহ যথাযথভাবে উপস্থাপনের সুযোগ থাকতে হবে।''

আলোচনামূলক অনুষ্ঠান বলতে টক শো-ও বোঝায়, যে অনুষ্ঠানকে আমাদের প্রধানমন্ত্রী 'টক (তিতা) শো' বলেছেন। 'বিভ্রান্তিকর ও অসত্য তথ্য বা উপাত্ত' কথাগুলো বলে একজন আলোচকের বক্তব্যের মনমতো ব্যাখ্যা বা অপব্যাখ্যা করার সুযোগ রাখা হয়েছে। যেমন, পদ্মা সেতু দুর্নীতি নিয়ে বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে সরকারের যে বিরোধ সৃষ্টি হয়েছিল, সরকার বিশ্ব ব্যাংকের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করলেও তা সরকারের জন্য ছিল অত্যন্ত বিব্রতকর। যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসনকে মন্ত্রিত্ব হারাতে হয়েছিল।

তখনকার সেসব খবর সরকার 'বিভ্রান্তিকর ও অসত্য' বলেই দাবি করে আসছিল। সরকারের দৃষ্টিতে ও ব্যাখ্যায় সেসব 'বিভ্রান্তিকর ও অসত্য তথ্য' ছিল পরিহার্য। অর্থাৎ এ ধরনের 'বিভ্রান্তিকর ও অসত্য' তথ্য নিয়ে আলোচনা করা যাবে না।

পঞ্চম অধ্যায়ের আরেকটি ধারায় বলা হয়েছে, ''কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত বা গোপনীয় বা মর্যাদাহানিকর তথ্য প্রচার করা যাবে না।''

আবারও একজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের কথা বলতে হয়। ছয় মাস রেলমন্ত্রী থাকার সময় সুরঞ্জিত সেনের বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগটি বহুল প্রচারিত। ঘুষ লেনদেন রাষ্ট্রীয় ব্যাপার নয়, সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ও গোপনীয় এবং তা প্রকাশিত হলে মর্যাদাহানিকর। একজন পাবলিক লিডার বা জননেতার সব বিষয়ে জানার অধিকার জনগণের রয়েছে, তা যতই ব্যক্তিগত বা গোপনীয় হোক না কেন এবং ঘটনা হিসেবে তা প্রকাশ করার দায়িত্ব মিডিয়ার। দুর্নীতিটা করেছেন মন্ত্রী, তা প্রকাশ করার জন্য অপরাধী হবে মিডিয়া?

তাহলে সরকারি কর্মকর্তাসহ কেউ দুর্নীতি, ধর্ষণ, ক্ষমতার অপব্যবহার বা অন্য কোনো ধরনের অপরাধ করলে তা প্রকাশ করা যাবে না? আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদান রাখার জন্য বিদেশি বন্ধুদের সম্মাননার সঙ্গে ক্রেস্ট উপহার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ক্রেস্টে স্বর্ণের পরিবর্তে নিম্নমানের ধাতব পদার্থ ব্যবহার করা হয়েছে। এর সঙ্গে জড়িত মন্ত্রী, আমলা ও ব্যবসায়ী। এতে বিদেশি বন্ধুদের অবমাননা এবং জাতির অমর্যাদা করা হয়েছে। জনস্বার্থে এ ঘটনা প্রকাশ করাই তো মিডিয়ার দায়িত্ব।

সম্প্রতি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তিন নেতার বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তারা হলেন সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খান, বর্তমান সাংসদ ও সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান এবং সাংসদ আবদুর রহমান ওরফে বদি। ব্যাংকের অর্থ আত্মসাৎ এবং অর্থ কেলেংকারির জন্য হল-মার্ক ও ডেসটিনির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে এবং তারা এখন জেলে। হল-মার্ক কেলেংকারির সঙ্গে সোনালী ব্যাংকের কতিপয় কর্মকর্তাও জড়িত। তাদের দুর্নীতির ব্যাপারে যেসব খবর মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে, নিঃসন্দেহে তা তাদের মর্যাদার জন্য হানিকর।

ব্যক্তির মর্যাদার জন্য হানিকর বলে দুর্নীতির খবর প্রকাশ করা না গেলে তাতে কি প্রত্যক্ষভাবে দুর্নীতি উৎসাহিত করাই হবে না? এ ধারা সংযোজন করে কি সরকার দুর্নীতির খবর ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে? দুর্নীতির এমন হাজার হাজার উদাহরণ রয়েছে যেসব মিডিয়ায় প্রকাশিত হওয়ার পরই কেবল দুদক বা সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের টনক নড়েছে।

পঞ্চম অধ্যায়ে আরও এমন সব ধারা সংযোজন করা হয়েছে, যেসব সম্প্রচার মাধ্যমগুলোর গলায় ফাঁসির রজ্জুর মতো পেঁচিয়ে থাকবে। অপর একটি ধারায় বলা হয়েছে, ''রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে এমন ধরনের সামরিক, বেসামরিক বা সরকারি তথ্য প্রচার করা যাবে না।''

আমার দীর্ঘদিনের সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, নীতিমালা না থাকলেও রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে এ ধরনের খবর প্রচারে সাংবাদিকরা স্ব-আরোপিত বিধিনিষেধই (self-censorship) মেনে চলছে, তবে তা সরকারের দৃষ্টি বা ব্যাখ্যা অনুসরণ করে নয়।

ধরা যাক, পিলখানার আধা-সামরিক বাহিনী বিডিআরের (বিজিবি) বিদ্রোহের ঘটনা। সংবাদপত্র ও সম্প্রচার মাধ্যমগুলো এ ঘটনার ব্যাপক প্রচার করে। মিডিয়ার বস্তুনিষ্ঠ প্রচারের ফলেই রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন জনগণ সে সময় বিডিআর বিদ্রোহের বিপক্ষেই অবস্থান গ্রহণ করেছিল। সরকার ক্ষমতা প্রয়োগ করে সে সময় বিডিআর বিদ্রোহের খবর প্রচারে বিধিনিষেধ আরোপ করলে যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হত তাতে বরং রাষ্ট্রের নিরাপত্তা হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়া হত।

এই ধারায় একটি মজার কথা বলা হয়েছে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে এমন 'সরকারি তথ্য'ও প্রচার করা যাবে না। অর্থাৎ যে সরকার তথ্য সরবরাহ করেছে, তার কোনো দায় নেই, দায় হল সম্প্রচার মাধ্যমের!

প্রায় একই ধরনের আরেকটি ধারায় বলা হয়েছে, ''কোনো অনুষ্ঠান বা বিজ্ঞাপনে সশস্ত্র বাহিনী, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত কোনো সংস্থা এবং অপরাধ রোধ, অনুসন্ধান ও তদন্ত এবং অপরাধীকে দণ্ড প্রদানের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের প্রতি কটাক্ষ বা বিদ্রুপ কিংবা তাদের পেশাগত ভাবমূর্তি বিনষ্ট করতে পারে এমন কোনো দৃশ্য প্রদর্শন কিংবা বক্তব্য প্রচার করা যাবে না।''

এ ক্ষেত্রে নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। মিডিয়া নিজ থেকে কোনো ঘটনা ঘটায় না, যা ঘটে তার বস্তুনিষ্ঠ রিপোর্ট করাই মিডিয়ার দায়িত্ব।

নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের বেলায়ও মিডিয়া সে দায়িত্বই পালন করেছে, সশস্ত্র বাহিনী বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী কোনো সংস্থার পেশাগত ভাবমূর্তি বিনষ্ট করার অসৎ উদ্দেশ্যে তা করেনি। সাত খুনের ঘটনায় র‌্যাবের কতিপয় সদস্য জড়িত ছিল, যাদের কয়েকজন ছিল সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য; সুতরাং সশস্ত্র বাহিনী বা র‌্যাবের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়ে থাকলে তার জন্য দায়ী খুনের সঙ্গে জড়িত এসব ব্যক্তি।

এই ধারা আলোচনায় প্রাসঙ্গিক আরেকটি ঘটনার উল্লেখ করা যায়। সম্প্রতি অবসরে যাওয়ার আগে একজন বিচারক অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে অনেকগুলো মামলার নিষ্পত্তি করেন। এ খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বর্তমানে ওই বিচারকের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। নীতিমালার এই ধারা আইন হিসেবে বলবৎ হলে মিডিয়া এ ধরনের রিপোর্ট করলে দণ্ডনীয় অপরাধ হবে। অর্থাৎ কেউ অপরাধ করলে তার শাস্তি হবে না, যে তা প্রকাশ করবে তার শাস্তি হবে।

আরেকটু ব্যাখ্যা করে বলা যায়, ক্রসফায়ারিং, এনকাউন্টার বা পুলিশ হেফাজতে বিচারবর্হিভূত হত্যাকাণ্ড ঘটলেও তা জনসমক্ষে প্রকাশ করা যাবে না কিংবা মিছিল বা সমাবেশে পুলিশ বা র‌্যাবের গুলিতে কেউ নিহত-আহত হলেও তা প্রকাশ বা প্রচার করা হবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ ও র‌্যাবের কোনো সদস্য দুর্নীতি করলে, যেহেতু তা প্রকাশ বা প্রচার করলে তাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে, সেহেতু তা প্রকাশ বা প্রচার করা যাবে না।

সরকারের এ ধরনের নীতি কি পরিণামে উল্লিখিত পেশার সদস্যদের মধ্যে দুর্নীতি, উচ্ছৃঙ্খলতা ও মানবধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা আরও উৎসাহিত করবে না? সরকার কাদের স্বার্থে, বিশেষত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এই সুরক্ষা দিতে চাচ্ছে? এটা কি তাদের এক ধরনের ((indemnity) দেওয়ার সামিল নয়?

একই অধ্যায়ের অপর একটি ধারায় বলা হয়েছে, ''জনস্বার্থ বিঘ্নিত হতে পারে এমন কোনো বিদ্রোহ. নৈরাজ্য এবং হিংসাত্মক ঘটনা প্রদর্শন পরিহার করতে হবে।''

এখানে 'জনস্বার্থ বিঘ্নিত হতে পারে' এ বিষয়টি অস্পষ্ট রাখা হয়েছে। সরকার সুবিধামতো তার ব্যাখ্যা দিতে পারে, সে সুযোগ রাখা হয়েছে। এই ধারার আওতায় বিডিআর বিদ্রোহের মতো কোনো ঘটনা, হরতাল-অবরোধের কারণে সৃষ্ট নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি কিংবা পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত বাঙালি-অবাঙালির মধ্যে সংঘর্ষের খবর প্রচার বা প্রদর্শন করা যাবে না।

পঞ্চম অধ্যায়ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা হচ্ছে, ''কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের অনুকূলে এমন ধরনের প্রচারণা যা বাংলাদেশ ও সংশ্লিষ্ট দেশের মধ্যে বিরোধের কোনো একটি বিষয়কে প্রভাবিত করতে পারে অথবা একটি বন্ধুভাবাপন্ন বিদেশি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এমন ধরনের প্রচারণা যার ফলে সে রাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে সুসম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশংকা সৃষ্টি হতে পারে এমন দৃশ্য বা বক্তব্য প্রচার করা যাবে না।''

এই ধারার প্রয়োগ হলে কোনো বিদেশি রাষ্ট্র সম্পর্কে সরকারের ভাষ্য ছাড়া অন্য কিছু প্রকাশ বা প্রচার করা যাবে না। অন্যায়ভাবে যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি সুবিধা স্থগিত করেছে, এ কথা বলা যাবে না। তেমনি বিএসএফ প্রায় প্রতিদিনই সীমান্তে গুলি করে বাংলাদেশের নাগরিকদের হত্যা করছে, তা প্রদর্শন বা প্রচার করা যাবে না। এমনকি ফেলানি হত্যার বিচারও দাবি করা যাবে না বা তা নিয়ে প্রতিবেশি রাষ্ট্রের সমালোচনা করা যাবে না। নিঃশর্তভাবে ভারতকে যে ট্রানজিট সুবিধা দেওয়া হচ্ছে তার বিরুদ্ধে বা তার সমালোচনা করা হলে তা প্রচার করা যাবে না। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলা হলে তা-ও প্রচার করা যাবে না।

সর্বশেষ সম্প্রচার মাধ্যমের সম্পাদকীয় কর্তৃত্বও হরণ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ''এ সম্প্রচার নীতিমালার আলোকে প্রতিটি সম্প্রচার প্রতিষ্ঠানকে সুনির্দিষ্ট পযধৎঃবৎ ড়ভ ফঁঃরবং ও সম্পাদকীয় নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে, যা কোনোমতেই সম্প্রচার নীতিমালার পরিপন্থী হতে পারবে না এবং কমিশন কর্তৃক অনুমোদিত হবে।''

সম্পাদকীয় নীতিমালা একটি সংবাদপত্র বা সম্প্রচার প্রতিষ্ঠানের প্রাণকোষ, যা সংবাদপত্র বা সম্প্রচার প্রতিষ্ঠানকে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও পরিচিতি দান করে এবং যা দ্বারা অনুষ্ঠানাদি পরিচালিত ও প্রচারিত হয়। নিজস্ব সম্পাদকীয় নীতিমালার কারণেই বিবিসি, সিএনএন, আল জাজিরা বা অন্যান্য আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত সম্প্রচার প্রতিষ্ঠান সংবাদ ও অনুষ্ঠান প্রচারে দর্শকদের কাছে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও পরিচিতি প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং বৈচিত্র্যের জন্য নতুন নতুন আকর্ষণ সৃষ্টি করেছে। এ ধরনের খবর-প্রধান মাধ্যম ছাড়াও রয়েছে নিছক বিনোদনমূলক মাধ্যম।

অভিযোগ নিষ্পত্তির দায়িত্ব সম্প্রচার কমিশনকে দেওয়া হলেও 'অভিযোগ প্রমাণিত হলে সরকার আইন/বিধি দ্বারা নির্ধারিত শাস্তি নিশ্চিত করবে'– অর্থাৎ শাস্তি প্রদানের ক্ষমতা সরকার নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছে। সাংবাদিকতা পেশা এমনই এক পেশা যে, একজন সাংবাদিককে পতিতার দালাল থেকে রাষ্ট্রদ্রোহী সাব্যস্ত করে তার শাস্তি নির্ধারণ করা যেতে পারে।

সরকারের হাতে ইতোমধ্যে সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিক বা মিডিয়াকর্মীকে শাসন করার জন্য স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট, প্রিন্টিং প্রেস এবং পাবলিকেশন অর্ডিন্যান্স, আইসিটি অ্যাক্ট ও ফৌজদারি আইন রয়েছে। শাস্তি প্রদানের ক্ষমতা সরকারের হাতে ন্যস্ত থাকলে আইনের মারপ্যাঁচে সরকারই ইচ্ছামতো নির্ধারণ করতে পারবে কাকে কী ধরনের শাস্তি প্রদান করা হবে। ফলে লঘু চাপে গুরু দণ্ডের আশংকা থেকেই যাবে।

মানহানিকর সংবাদ প্রকাশের বিচারের জন্য দেশে দু'ধরনের আইন প্রচালিত রয়েছে। সংবাদপত্রের মুদ্রণ সংস্করণে প্রকাশিত কোনো খবর বা রিপোর্টের জন্য যে আইন প্রযোজ্য, অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত একই খবর বা রিপোর্টের জন্য ভিন্ন আইন প্রযোজ্য। শাস্তিও ভিন্ন। মুদ্রণ সংস্করণের জন্য বিচার করা হয় ফৌজদারি আইনে, আর অনলাইন সংস্করণের বিচার হয় আইসিটি অ্যাক্ট বা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের আওতায় বিশেষ ট্রাইব্যুনালে।

একই অপরাধে মুদ্রণ সংস্করণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ দুই বছরের বিনাশ্রম করাদণ্ড এবং অনলাইন সংস্করণের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি ১৪ বছরের জেল। মুদ্রণ সংস্করণের বেলায় অপরাধের জামিন আছে, কিন্তু অনলাইন সংস্করণের বেলায় তা জামিন-অযোগ্য। মুদ্রণ সংস্করণের জন্য আদালতের জারি করা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়া পুলিশ সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক, সম্পাদক বা প্রকাশককে গ্রেপ্তার করতে পারবে না। অন্যদিকে অনলাইন সংস্করণের অপরাধ আমলে নিয়ে পুলিশ বিনা পরোয়ানায় সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিকে গ্রেপ্তার করতে পারবে এবং জামিনযোগ্য নয় বলে মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তাকে কারাবন্দি থাকতে হবে।

বর্তমানে প্রায় সব দৈনিক পত্রিকার মুদ্রণ সংস্করণের পাশাপাশি অনলাইন সংস্করণও রয়েছে। সুতরাং সরকার কার বিরুদ্ধে কোন আইন প্রয়োগ করবে এবং কাকে কী শাস্তি দেবে সেই সুযোগ রয়েছে, যা সংবিধান পরিপন্থী। সংবাদপত্রে কারও বিরুদ্ধে কোনো মানহানিকর খবর প্রকাশিত হলে অভিযোগ সাপেক্ষে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫০০, ৫০১ ও ৫০২ ধারায় মামলা হয়ে থাকে। এই তিনটি ধারার অপরাধ জামিন ও মীমাংসাযোগ্য। সর্বোচ্চ শাস্তি দুই বছরের বিনাশ্রম করাদণ্ড। এছাড়া সংবাদপত্রের জন্য রয়েছে প্রেস কাউন্সিল।

কাজেই সরকার যে সম্প্রচার নীতিমালা তৈরি করেছে তা প্রকৃত অর্থে নিয়ন্ত্রণমালা। সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে সকল নাগরিকের চিন্তা ও বিবেক, বাক এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার যে নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে, এই নীতিমালা আইনে পরিণত হলে তা তাদের অধিকার নিশ্চিতভাবেই খর্ব করবে। তথ্য অধিকার আইনে সরকার এক হাতে যা দিয়েছে, এই নীতিমালার মাধ্যমে অন্য হাতে তা কেড়ে নিয়েছে।

নীতিমালাটি আগাগোড়া পাঠ করলে ধারণা হবে, সরকার সংবাদ মাধ্যমকে প্রতিপক্ষ বিবেচনায় নিয়ে তা তৈরি করেছে। না-বোধক ধারা ও বাক্যের সমাহারে যে কোনো সচেতন নাগরিকের মনে ভীতির সঞ্চার করবে। সম্পাদক পরিষদ, সাংবাদিকদের দুটি ইউনিয়ন, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ও নাগরিক সমাজসহ সংশ্লিষ্ট সব মহলই এই নীতিমালার সমালোচনা করে বলেছে, এর ফলে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব হবে। সম্প্রচার প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক সমিতি ও বিজ্ঞাপনদাতারাও এই নীতিমালা সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করেনি। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠেছে। নীতিমালার খসড়া তৈরির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের অনেকেই এর উপর বিভিন্ন আলোচনায় ও টক শো'তে বলেছেন, চূড়ান্ত খসড়া প্রণয়নের সময় তাদের ডাকা হয়নি এবং তাদের মতামত উপেক্ষা করা হয়েছে।

সম্প্রচার নীতিমালা নিয়ে মানুষের উদ্বেগের আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে, অতীতে বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংবাদপত্র বন্ধ করার ঘটনা তাদের স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি। বাকশাল আমলের কথা বাদ দিলেও ১৯৯৬-এর আওয়ামী লীগ সরকারও দৈনিক বাংলা, বাংলাদেশ টাইমস ও সাপ্তাহিক বিচিত্রা বন্ধ করে দিয়েছিল। গত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বন্ধ করা হয়েছে সম্প্রচার মাধ্যম দিগন্ত টেলিভিশন ও ইসলামিক টেলিভিশন ও দৈনিক 'আমার দেশ'।

এর আগে বিএনপি সরকারের সময় বন্ধ করা হয়েছিল একুশে টেলিভিশন। আমাদের রজনৈতিক দলগুলো বিরোধী দলে থাকার সময় মিডিয়াবান্ধব হলেও ক্ষমতাসীন হওয়ার পর তারা চেহারা পাল্টে ফেলে। এ সত্যটাই সাংবাদিক ও মিডিয়াকর্মীদের মনে রাখতে হবে। যে সম্প্রচার নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে তাতে তাদের ঝুঁকিপূর্ণ পেশার মূল্যায়ন করা হয়নি এবং তাদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য একটি শব্দও উচ্চারিত হয়নি।

সরকার এই প্রস্তাবিত সম্প্রচার নীতিমালা আইনে পরিণত করতে সফল হলে, একই ধরনের নীতিমালা সংবাপত্রের জন্যও হবে, একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।

[আগামী পর্বে সমাপ্য]

আমানুল্লাহ কবীর: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। বিডিনিউজটোয়েন্টিফোর ডটকমের সিনিয়র এডিটর।