আমাদের চিন্তাশীল চলচ্চিত্রের দুর্বলতা

নাদির জুনাইদ
Published : 12 August 2014, 06:27 AM
Updated : 12 August 2014, 06:27 AM

সত্যজিৎ রায়ের প্রথম ছবি পথের পাঁচালী'র অসাধারণ সাফল্যের মধ্য দিয়ে ১৯৫০-এর দশকেই চিন্তাসমৃদ্ধ চলচ্চিত্রের বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে বাংলা ছবির পরিচিতি ঘটেছে। সত্যজিতের সমসাময়িক বাংলা চলচ্চিত্রের অন্য দুই গুরুত্বপূর্ণ পরিচালক ঋত্বিক ঘটক ও মৃণাল সেনের বিভিন্ন ছবি নিয়েও খ্যাতিমান চলচ্চিত্র সমালোচকরা বিস্তর আলোচনা করেছেন। নান্দনিক দিক দিয়ে আকর্ষণীয় সমাজ-সচেতন চলচ্চিত্র নির্মাণের মাধ্যমে খ্যাতি অর্জন করেছেন সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল পরবর্তী প্রজন্মের বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, গৌতম ঘোষ, অপর্ণা সেন প্রমুখ চলচ্চিত্রকার।

পশ্চিম বাংলার এই পরিচালকদের কাজের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিকভাবেই একটি প্রশ্ন উঠে আসে। গত তেতাল্লিশ বছরে বাংলাদেশে বাণিজ্যিক ধারার বিনোদন-নির্ভর চলচ্চিত্রের বাইরে যেসব ছবি নির্মিত হয়েছে, বক্তব্যের গভীরতা ও নির্মাণশৈলীর উৎকর্ষের দিক থেকে সেইসব বাংলা ছবিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রশংসিত করে তুলতে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকাররা কতটা সফল হয়েছেন?

তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ছবি (যেমন ইরান, সেনেগাল, ভারত, ব্রাজিল, কিউবা) নিয়ে এমনকি পাশ্চাত্যেও বহু আলোচনা হলেও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র কতটা পরিচিত চলচ্চিত্রের আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে? আর পরিচিত না হলে তার জন্য দায়ী কারণগুলো কী কী? বাংলাদেশের চিন্তাশীল চলচ্চিত্রের মান এবং সাফল্য বোঝার জন্যই এই প্রশ্নগুলো বিশ্লেষণ করা জরুরি।

কাহিনি এবং নির্মাণপদ্ধতি– দুই দিক দিয়েই যদি একটি চলচ্চিত্র মূলধারার বাণিজ্যিক ছবি থেকে ভিন্ন হয়ে ওঠে, কেবল সে ক্ষেত্রেই সেই ছবিটিকে শৈল্পিক, চিন্তাশীল বা বক্তব্যধর্মী চলচ্চিত্র হিসেবে গণ্য করা সম্ভব। ফর্মুলাভিত্তিক বাণিজ্যিক ছবির নির্মাতারা জটিল ও উদ্ভাবনী চলচ্চিত্রভাষা ব্যবহার করে দর্শককে চিন্তা করার সুযোগ দিতে আগ্রহী হন না; কারণ তাদের মূখ্য উদ্দেশ্য থাকে সহজে দর্শকের চিত্তবিনোদনের সুযোগ তৈরি করে চলচ্চিত্রের ব্যবসায়িক সাফল্য নিশ্চিত করা। ফলে ক্যামেরাকে সৃষ্টিশীলভাবে ব্যবহার করে দৃশ্যের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ অর্থ নিমার্ণের চেষ্টা বিনোদনমূলক ছবিতে গুরুত্ব পায় না।

বাণিজ্যিক ছবিতে দর্শকের মনোরঞ্জনের জন্য প্রযুক্তির সাহায্যে বিভিন্ন অবাস্তব এবং জৌলুসপূর্ণ দৃশ্য ব্যবহার করা হয়। কিন্তু শৈল্পিক ছবিতে দৃশ্যকে আকর্ষণীয় করার জন্য স্পেশাল এফেক্টের দরকার পড়ে না। একজন সুলেখক যেভাবে কলম ব্যবহার করে নিজের ভাবনা তুলে ধরেন (১৯৪৮ সালে ফরাসি চলচ্চিত্র বিশ্লেষক এবং নির্মাতা আলেক্সান্দার আসত্রুক এই ক্যামেরা-কলম ধারণাটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন), তেমনি শৈল্পিক ছবির পরিচালক চিন্তাশীলভাবে ক্যামেরা, আলো, শব্দ ব্যবহার করে নির্মাণ করেন তাঁর ছবির বিভিন্ন দৃশ্য যেখানে প্রাধান্য পায় নান্দনিকতা ও গভীর ভাবনা, চটক ও চাকচিক্য নয়।

বিভিন্ন দেশের সমাজ-সচেতন এবং শৈল্পিক ছবিতে খ্যাতিমান পরিচালকরা চলচ্চিত্রের ফর্ম (নির্মাণশৈলী) অগতানুগতিক এবং নান্দনিকভাবে আকর্ষণীয় করে তোলার বিষয়টিতে গভীর গুরুত্ব দিয়েছেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ফরাসি নতুন ধারার পরিচালকরা (জঁ-ল্যুক গদার, ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো, ক্লদ শ্যাব্রল, এরিক রোমা, জ্যাঁক রিভেৎ প্রমুখ), ইটালির ফেলিনি, অ্যান্তোনিওনি, বের্তোলুচ্চি, কিউবার টমাস গ্যেতিরেজ আলিয়া, ব্রাজিলের গ্লবার রোচা, সেনেগালের ওসমান সেমবেন, মৌরিতানিয়ার মেড হন্ডো, জার্মান নতুন সিনেমার ফাসবিন্ডার, হার্জগ, ক্লুজে, সিবারবার্গ, ভিম ভেন্ডার্স এবং আরও বিভিন্ন দেশের বিকল্প ধারার পরিচালকরা।

এই পরিচালকরা বিনোদন-প্রত্যাশী নিষ্ক্রিয় দর্শক চাননি, নিজেদের ছবির মাধ্যমে তাঁরা নিশ্চিত করতে চেয়েছেন দর্শকের সক্রিয়তা এবং সচেতনতা। দর্শক যেন ছবিতে উপস্থাপিত দৃশ্যসমূহ নিয়ে চিন্তা করতে বাধ্য হন, এজন্যই ছবির ফর্মকে তাঁরা জটিল ও উদ্ভাবনী করে তুলতে চেয়েছেন। জঁ-ল্যুক গদারের প্রথম ছবি 'ব্রেথলেস' (১৯৬০) ছিল মার্কিন গ্যাংস্টার ছবির আদলে নির্মিত। ছবির কাহিনিতে নতুনত্ব ছিল না, কিন্তু পরিচালক পুরো ছবিতে বিভিন্ন শট ব্যবহার করেছিলেন সম্পূর্ণ নতুন ও প্রথাবিরোধী পদ্ধতিতে। আর কেবল অভিনব নির্মাণশৈলীর জন্যই 'ব্রেথলেস' হয়ে উঠেছে চলচ্চিত্রের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ছবি।

বিখ্যাত মার্কিন চলচ্চিত্রকার কুয়েনটিন টারানটিনোর সাড়াজাগানো ছবি 'রেসারভোয়ার ডগস' (১৯৯২) কয়েকজন অপরাধীর ডাকাতি করার একটি সাধারণ কাহিনি তুলে ধরেছিল ভিন্ন এক উপস্থাপন পদ্ধতির মাধ্যমে, যেখানে ছবির গতানুগতিক ধারাবাহিকতা বার বার ব্যাহত করা হয়েছে।

নির্মাণশৈলী বৈপ্লবিক করে তোলার লক্ষ্যে মৃণাল সেন তাঁর রাজনৈতিক ছবি 'ইন্টারভিউ' (১৯৭০) আর 'কলকাতা ৭১' (১৯৭২)-এ ব্যবহার করেছিলেন জার্মান নাট্যকার বের্টোল্ট ব্রেখ্ট্ প্রবর্তিত 'ডিসট্যানসিয়েশন' কৌশল। এই ছবিগুলোর কয়েকটি দৃশ্যে ছবির মূল চরিত্ররা সরাসরি ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে দর্শকের উদ্দেশ্যে কথা বলে। চলচ্চিত্রের কাল্পনিক জগৎ গতানুগতিকভাবে যে বিভ্রম তৈরি করে, তা ভেঙে দিয়ে দর্শকের মনে তীব্র অভিঘাত তৈরি তাদের বাস্তব জীবনের বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে সচেতন করার এই বিশেষ কৌশলটি মৃণাল সেনই প্রথম ভারতীয় ছবিতে ব্যবহার করেন।

সত্তরের দশকের শুরুতে সত্যজিৎ রায় তাঁর রাজনৈতিক ছবিসমূহে ('প্রতিদ্বন্দ্বী', 'সীমাবদ্ধ', 'জনঅরণ্য') ব্যবহার করেন ইউরোপীয় আর্ট সিনেমায় সচরাচর ব্যবহৃত বিভিন্ন জটিল চলচ্চিত্র কৌশল– জাম্প কাট, ভয়েস-ওভার ন্যারেশন, সময় আর স্থানের ধারাবাহিকতা নিয়ে বিভ্রান্তি, ফ্ল্যাশ ব্যাক আর ফ্ল্যাশ ফরোয়ার্ড, নেগেটিভ ফিল্মের মাধ্যমে দেখানো দৃশ্য, ফ্রিজ ফ্রেম, ছবির ভেতর অন্য চলচ্চিত্রের দৃশ্য প্রভৃতি।

অন্যদিকে ঋত্বিক ঘটকের ছবির সামগ্রিক বিন্যাসে পাশ্চাত্যের চলচ্চিত্রে প্রচলিত বিভিন্ন কৌশলের পরিবর্তে সবসময়ই প্রাধান্য পেয়েছে দেশজ ছাপ। কিন্তু ঋত্বিকের ছবির ফর্ম ছিল গতানুগতিক বাংলা ছবির চেয়ে আলাদা। যে আবেগপ্রধান বৈশিষ্ট্য (মেলোড্রামা) বাংলা বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে প্রায়ই ব্যবহার করা হয়, সেই মেলোড্রামাসহ নিজ ছবিতে সংলাপ ও বিভিন্ন প্রতীক ঋত্বিক ব্যবহার করেছেন চিন্তাশীলভাবে এবং তার মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন নিজের রাজনৈতিক বক্তব্য।

কিন্তু বিভিন্ন দেশে বক্তব্যধর্মী চলচ্চিত্রের ফর্মকে নান্দনিকভাবে আকর্ষণীয় করে তোলার প্রচেষ্টা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকারদের গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছে এ কথা দাবি করা যায় না। বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে মূলধারার বাণিজ্যিক ছবির বাইরে নির্মিত চলচ্চিত্রসমূহে ফর্মকে গতানুগতিকতামুক্ত, অভিনব ও নান্দনিকভাবে উদ্ভাবনী করে তোলার চেষ্টা নিয়মিতভাবে আমাদের চোখে পড়েনি।

সত্তরের দশকে নির্মিত আলমগীর কবিরের কয়েকটি ছবি ('ধীরে বহে মেঘনা', 'সূর্যকন্যা', 'রূপালী সৈকতে') এবং ইটালিয়ান নয়া-বাস্তববাদী চলচ্চিত্রের আদলে নির্মিত মসিহউদ্দিন শাকের ও শেখ নিয়ামত আলির 'সূর্যদীঘল বাড়ি' (১৯৭৯) ছবিতে নির্মাণশৈলী ব্যতিক্রমী করে তোলার আগ্রহ আমরা লক্ষ্য করেছি। কিন্তু বাংলাদেশের বিকল্প ধারার বেশিরভাগ চলচ্চিত্রেই দেখা যায় ক্যামেরা-ভাষা ও উপস্থাপন পদ্ধতি সাদামাটা ও বৈচিত্র্যহীন।

অনেক ছবিতে বিনোদনধর্মী চলচ্চিত্রের গতানুগতিক কাহিনি পরিহার করে ছবির বিষয়বস্তু বাস্তব সমস্যাভিত্তিক করে তোলা হয়েছে। কিন্তু ক্যামেরার বিভিন্ন শট ও সম্পাদনার নানা কৌশল সৃষ্টিশীলভাবে ব্যবহার করে বা ছবির ধারাবাহিকতা অগতানুগতিকভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে সেই সব ছবির নির্মাণশৈলী নান্দনিক দিক দিয়ে ভিন্নধর্মী করার বিষয়টি পরিচালকদের কাছে গুরুত্ব পায়নি। কখনও কোনো ছবিকে বক্তব্যধর্মী হিসেবে বর্ণনা করা হলেও, সেখানে বিনোদনমূলক চলচ্চিত্রের আদলে জাঁকজমকপূর্ণ ও সুখকর উপাদানের মাধ্যমে কাহিনি উপস্থাপন করা হয়েছে।

এ কথা মনে রাখা প্রয়োজন, বক্তব্যধর্মী ছবির কাহিনি মামুলি, নতুনত্বহীন নির্মাণপদ্ধতির মাধ্যমে অথবা শুধুই বিনোদন-যোগানো উপাদানের সাহায্যে উপস্থাপন করলে কখনওই সেই ছবি শক্তিশালী হবে না; কারণ চিন্তাশীল চলচ্চিত্রে কাহিনি এবং গতানুগতিকতামুক্ত নির্মাণশৈলী সমান গুরুত্বপূর্ণ।

বিশ্বমানের শৈল্পিক ছবি নির্মাণের ক্ষেত্রে আমাদের সাফল্য না থাকার অন্যতম কারণ আমাদের চলচ্চিত্রের ফর্ম নান্দনিকভাবে যথেষ্ট উদ্ভাবনী নয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমরা দেখেছি নতুন সিনেমার প্রসার, যখন একদল চলচ্চিত্রকার বাণিজ্যিক ছবির চিন্তারীতির বিরোধিতা করে নতুন নির্মাণপদ্ধতির মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে ছবি তৈরি করেছেন।

উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় ব্রাজিলের সিনেমা নোভো এবং নতুন ভারতীয় চলচ্চিত্র ধারার ছবিসমূহের কথা। কিন্তু বাংলাদেশে একসঙ্গে অনেক পরিচালকের এই ধরনের প্রতিবাদী চলচ্চিত্র নিয়মিত নির্মাণের মাধ্যমে নতুন একটি চলচ্চিত্র আন্দোলন যেমন বিকশিত হয়নি, তেমনি এই ধরনের শৈল্পিক ও জীবনঘনিষ্ঠ ছবির নির্মাণ, বিতরণ ও প্রদর্শনীতেও পর্যাপ্ত সহায়তা করার জন্য দেখা যায়নি যথেষ্ট সরকারি আগ্রহ।

বাস্তব জীবনের বিভিন্ন জটিল ও গুরুতর সমস্যা সম্পর্কে দর্শকের মনে সচেতনতা তৈরি করা চিন্তাশীল ছবির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। কিন্তু বর্তমান সময়ে সমাজকে পীড়িত করছে এমন রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যাসমূহের বিশ্লেষণ ও সমালোচনা আমাদের বক্তব্যধর্মী চলচ্চিত্রে দুর্লভ। কঠোর রাজনৈতিক সমালোচনার এই অনুপস্থিতি আমাদের সমাজ-সচেতন চলচ্চিত্রের আরেকটি দুর্বল দিক।

নির্মাণশৈলীর দিক দিয়ে যথেষ্ট উদ্ভাবনী না হলেও তারেক মাসুদের 'মাটির ময়না' (২০০২) দীর্ঘস্থায়ী একটি সামাজিক সমস্যার সমালোচনা তুলে ধরেছিল সাহসিকতার সঙ্গে। জহির রায়হানের 'জীবন থেকে নেওয়া' (১৯৭০) ছবিতে জনপ্রিয় নায়ক-নায়িকা, চরিত্রদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক, হাস্যরস, অতিঅভিনয়, সঙ্গীত প্রভৃতি বাণিজ্যিক ছবির উপাদান অন্তর্ভুক্ত করা হলেও সেগুলো দর্শককে বিনোদন দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়নি। পরিচালক দক্ষতার সঙ্গে এই উপাদানগুলির মাধ্যমে প্রকাশ করেছিলেন পাকিস্তানি শাসনবিরোধী বক্তব্য, দর্শককে রাজনৈতিক চেতনায় অনুপ্রাণিত করা ছিল ছবির মূল উদ্দেশ্য।

ভিন্ন সময়ে তৈরি এই দুটি ছবিই সরকারি বাধার সম্মুখীন হয়েছিল। আমরা দেখেছি চলচ্চিত্রে জোরালো রাজনৈতিক সমালোচনা তুলে ধরা আমাদের দেশে কখনওই সহজ হয়নি।

এ ক্ষেত্রেও পশ্চিম বাংলার বিকল্প ধারার চলচ্চিত্রের সঙ্গে আমাদের ছবির পার্থক্য চোখে পড়ে। নকশালবাদী আন্দোলন চলাকালীন সময়েই মৃণাল সেন, সত্যজিৎ রায় তাঁদের বিভিন্ন ছবিতে রাজনৈতিক সিস্টেমের তীব্র সমালোচনা তুলে ধরেছেন। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের সরাসরি সমালোচনা করে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের 'দূরত্ব' (১৯৭৮) ছবিতে বলা হয়–

"কলকাতাকে চমকদার আর পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য একদিকে রাস্তার ধারে ফুলগাছ পোঁতা হল। অন্যদিকে সমস্ত বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের জঞ্জাল হিসেবে সাফ করে দেওয়া হল।"

পশ্চিম বাংলার সাম্প্রতিক ছবি শ্রীজিত মুখার্জির 'বাইশে শ্রাবণ' (২০১১) ছবিতে একজন চরিত্রের মুখে শোনা যায় রাজনৈতিক ব্যবস্থার সমালোচনা–

"ড. বিনায়ক সেনের মতো লোককে যারা যাবজ্জীবন দেয়, তাদের কাছ থেকে আর কী আশা করতে পারি? একটা পচে-যাওয়া সিস্টেম।"

সেই চরিত্র আবার বলে ওঠে–

"আমাদের দেশের আশি ভাগ মানুষের কাছে গণতন্ত্র মানে শুধুই ভোটাধিকার। বাকী অধিকারগুলো আপনাদের পকেটে।"

বাংলাদেশের সমাজ-সচেতন চলচ্চিত্রে এই ধরনের তীক্ষ্ণ রাজনৈতিক বক্তব্য হয়তো সরাসরিভাবে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব নয়। এই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক স্যাটায়ার (যেমন, সত্যজিৎ রায়ের 'হীরক রাজার দেশে') অথবা রূপকধর্মী রাজনৈতিক ছবি ('জীবন থেকে নেওয়া') নির্মাণের মাধ্যমে সেন্সরের বাধা এড়িয়ে সমসাময়িক রাজনৈতিক সমস্যার সমালোচনা করা সম্ভব। কিন্তু আমাদের দেশে এমন ছবি তৈরির প্রচেষ্টাও চোখে পড়ছে না।

নান্দনিকভাবে উদ্ভাবনী নির্মাণশৈলী এবং সমসাময়িক বিভিন্ন সমস্যার তীক্ষ্ণ সমালোচনা– প্রয়োজনীয় এই দুইটি দিকের ঘাটতি টিকিয়ে রেখে চিন্তাশীল চলচ্চিত্র নির্মাণ করা সম্ভব নয়। বাণিজ্যিক ছবির মূলনীতি প্রত্যাখ্যান করে প্রথাবিরোধী ছবি তৈরি করতে হলে সেই চলচ্চিত্রকে কখনওই গতানুগতিকতার গণ্ডিতে আটকে রাখা যায় না।

এই জরুরি দিকগুলোতে গুরুত্ব দেওয়া না হলে উঁচুমানের সমাজ-সচেতন, শৈল্পিক চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে আমাদের সাফল্যহীনতা দীর্ঘস্থায়ী হবে।

ড. নাদির জুনাইদ: সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।