খুব জানতে ইচ্ছে করে

উম্মে রায়হানাউম্মে রায়হানা
Published : 11 August 2014, 08:08 AM
Updated : 11 August 2014, 08:08 AM

৬ আগস্ট বাংলাদেশে তিনটি ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেল বন্ধ করে দেওয়ার জন্য হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করা হয়েছে। হাইকোর্টের আইনজীবী সৈয়দা শাহিন আরা লাইলী বাদী হয়ে এই রিট আবেদন করেন। তার পরের রবিবার অর্থাৎ ১০ আগস্ট এই রিট আবেদনের শুনানি হওয়ার কথা থাকলেও এর অগ্রগতির খবর পাইনি। রিট যেহেতু হয়েছে, এটি এখন আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে চলে যাবে, তাতে সন্দেহ নেই।

এই চ্যানেলগুলো হল জি বাংলা, স্টার জলসা ও স্টার প্লাস। হঠাৎ করে এই তিনটি চ্যানেল বন্ধ করার বিষয়ে তৎপরতার কারণ এখন আর কারও অজানা নেই।

এই পুরো ঘটনায় দুটো বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। এক, পাখি জামা ও দুই, ভারতীয় টেলিভিশন সিরিয়াল।

পত্রপত্রিকা ও ফেইসবুকের কল্যাণে পাখি জামা নামের একটি পোশাকের কথা এখন সবাই জানেন। গত ঈদ-উল-ফিতরে পাখি জামা নিয়ে আলোচনার ঝড় দেখা গেছে। ঈদ শেষ হয়ে যাওয়ায় এই নিয়ে আলোড়ন কমে গেলেও চ্যানেল বন্ধ করার প্রক্রিয়া থেমে নেই।

ঈদের আগে আগে খবরে জানা গেছে এক শিশু (স্ত্রীলিঙ্গ হওয়ায় তার সম্পর্কে পত্রপত্রিকাগুলো কিশোরী শব্দটি প্রয়োগ করতে বেশি আগ্রহী হলেও ১৬ বছর বয়সী একজন মানুষকে শিশু বলাই যথাযথ, মতান্তরে মেয়েটির বয়স ছিল ১০, সে ক্ষেত্রে এখানে বিতর্কের অবকাশই থাকে না) তার বাবার কাছে এই পোশাক চেয়েছিল। বাবার আর্থিক সঙ্গতি সম্পর্কে ধারণা না থাকায় অভিমানে আত্মহত্যা করেছে সেই মেয়ে।

এর আগে অথবা পরে (আমি নিশ্চিত নই) গণমাধ্যম মারফত জানা গেল এই একই জামার দাবি পূরণ না হওয়ায় কোনো এক নারী তার স্বামীকে তালাক দিয়েছেন। আলোচনার খাতিরে যদি ধরে নিই যে দুটি খবরই সত্যি, অর্থাৎ ঐ আত্মহত্যা আর তালাকের ঘটনার পেছনে নির্লজ্জ লোভ ছাড়া আর কোনো কারণই ছিল না, তাহলে বলতেই হবে প্রথম ঘটনাটি বেশ করুণ।

এই ঘটনায় ছোটবেলায় দেখা একটি সিনেমার দৃশ্যের কথা মনে পড়ে গেছে আমার। খুব সম্ভবত সিনেমার নাম 'এতটুকু আশা'। এই সিনেমায় নায়িকার ভুমিকায় অভিনয় করেছিলেন সুজাতা। নায়িকা ঢাকায় একটি কলেজে অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। তিনি জানতেন না তার বাবা (চাকরি হারিয়ে অথবা ব্যবসায় লস করে) সংসার চালানোর জন্য খেলনা-পুতুল ফেরি করে বিক্রি করেন এই শহরেরই পথে পথে। একদিন এক বান্ধবীসহ হাঁটতে হাঁটতে বাবার সঙ্গে দেখা হয়ে যায় মেয়ের। চোখাচোখি হতে দু'জন দু'জনকে এড়িয়ে চলে যান।

সেদিন ঢাকা থেকে নদী পার হয়ে বাড়ি ফেরার সময় বাবা তার খেলনা ফেরির বাঁশের কাঠামো খেয়াঘাটে পরিচিত দোকানির জিম্মায় রেখে আসেন না আর। বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে থাকা মেয়ের দিকে বাড়িয়ে ধরেন একটি প্লাস্টিকের পুতুল। তাঁর গলায় স্নেহ ঝরে পড়ে, যেন তাঁর মেয়েটি শাড়ি পরে কলেজে পড়তে যায় না, যেন তাঁর পাঁচ বছরের মেয়ে খেলতে গিয়ে ব্যথা পেয়ে কাঁদছে, এমনভাবে তিনি বলেন– "নিবি?"

কোনো মিল নেই, কিন্তু মনের উপর তো কারও হাত থাকে না। আর সিনেমার শক্তির কথাও আমরা জানি। তাই হয়তো বাস্তবের একটি অভিমানী মেয়ের আত্মহত্যার খবর শুনে আমার মনে পড়ে সিনেমার বাবার আর্থিক দৈন্য মেয়ের কাছে প্রকাশ হয়ে যাওয়ার লজ্জা আর গ্লানির দৃশ্য। মধ্যবিত্তের গরিব হয়ে যাওয়ার অসহায় করুণ রস।

দ্বিতীয় ঘটনাটি এতটা করুণ নয়, বরং খানিকটা আশঙ্কার, নিন্দার আর বেশ অনেকটা হাসির।

পাখি ড্রেস নিয়ে ব্যপক হাসাহাসির চর্চা সম্ভবত অনেকেরই চোখে পড়েছে। শুধু ফেসবুকে নয়, নিজের আশেপাশের অনেককেই দেখেছি খুব একটা মজার কথা বলা হচ্ছে, এহেন ভাব করে এই পোশাকের কথা উল্লেখ করতে। এমনকি ঈদের নতুন পোশাক পরা পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে বের হয়ে বন্ধুকে "এটা কি পাখি ড্রেস নাকি?" এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে দেখেছি মধুর ক্যান্টিনের সামনে। কিংবা ছবির হাটে চা সিগারেটের দোকানে কাজ করে, ঈদের পর পর ঈদের জরিচুমকিওয়ালা পোশাকটাই পরে মা বাবাকে চা বিক্রি করতে সাহায্য করছে, এমন একটা বাচ্চা মেয়েকে ডেকে এই প্রশ্ন করতে শুনেছি একজনকে।

ভারতীয় চ্যানেল বন্ধের পক্ষে বিপক্ষে অনেক রকম কথা শুনতে পাচ্ছি। চোখে পড়ছে অনেক রকম যুক্তি। বিভিন্ন জনের লেখালেখি ও মতামত মারফত এই ঘটনার সঙ্গে সম্পর্ক দেখতে পাচ্ছি ভোগবাদিতার,পণ্য-মোহাচ্ছন্নতার।

একটি খবরে বলা হয়–

"আবেদনকারীর আইনজীবী একলাছ উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, ভারতে বাংলাদেশের কোনো টিভি চ্যানেল প্রচার হয় না। অথচ বাংলাদেশে ভারতীয় টিভি চ্যানেলের অবাধ সম্প্রচারের ফলে যুব সমাজ ধংসের সম্মুখীন। সর্বশেষ তাদের একটি টিভি চ্যানেল স্টার জলসার 'বোঝে না সে বোঝে না' সিরিয়ালের পাখি চরিত্রের নামে পোশাক কিনতে না পেরে বাংলাদেশে অনেকে আত্মহত্যা করেছে। তাই যুব সমাজকে রক্ষার্থে এ রিট করা হয়েছে। এর আগে গত রোববার বিকালে রেজিস্ট্রি ডাকযোগে এ বিষয়ে আইনি নোটিশ পাঠান আইনজীবী এখলাস উদ্দিন ভূঁইয়া। নোটিশ পাওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বাংলাদেশে ভারতীয় টিভি চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধের ব্যবস্থা না নেওয়া হলে হাইকোর্টে জনস্বার্থে রিট করা হবে বলে নোটিশে জানানো হয়। নোটিশে বিবাদী করা হয় তথ্যমন্ত্রী, তথ্যসচিব ও বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনকে (বিটিআরসি)। এখলাস উদ্দিন জানান, ভারতে আমাদের দেশের চ্যানেল সম্প্রচারের অনুমতি দেয় না। কিন্তু আমাদের দেশে তাদের চ্যানেল চলছে। আর এতে সামাজিক অবক্ষয় ঘটেছে।"

সত্যাসত্য যাচাই সাপেক্ষ, একটি খবরে এ-ও বলা হয়–

"গৃহিণী ও ছাত্রছাত্রীদের পাশাপাশি কাজের বুয়ারাও এসব চ্যানেলে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন মন্তব্য করে নোটিসে বলা হয়, 'কাজের বুয়াদের এসব চ্যানেল দেখতে না দিলে তারা কাজ করতে চায় না।'"

হাস্যরস আর ঠেকা মারা ভঙ্গিটা দেখা যাচ্ছে কি? আমি কিন্তু দেখতে পাচ্ছি।

এছাড়াও সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট হ্যাক করে ভারতীয় চ্যানেল বন্ধ করার দাবি জানিয়েছে সাইবার-৭১ নামক একটি হ্যাকার সংগঠন।

দারুণ দারুণ প্রবন্ধ চোখে পড়ছে; যেমন, নারীর ডিজ্যায়ার বনাম নারীর আশা-আকাঙ্ক্ষা গলা চেপে দমন করার আগ্রাসী, পুরুষাধিপত্যবাদী মনোভাবের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে ব্লগার রেজাউল করিম তাই লিখেছেন–

" …ভারতীয় সিরিয়াল যদি মেয়েদের 'ডিজায়্যার' শিখায় বা 'ডিজায়্যার' প্রকাশের সংকোচ দূর করে দেয়— ভারতীয় সিরিয়াল তাইলে খারাপ? আর আপনি? যিনি 'ডিজায়্যার'কে মেয়েদের জন্য নিষিদ্ধ রাখতে চান, মেয়েদের 'ডিজায়্যার' প্রকাশ আমরণ স্থগিত রাখতে বলেন, বউয়ের ইচ্ছারে পাত্তা না দেওয়া স্বামীর সাথেই শুইতে বলেন— আপনিই তাইলে ভালো?…"

অথবা ভারতীয় চ্যানেল বনাম বাংলাদেশি চ্যানেলের অনুষ্ঠানের মান, নির্মাণ দক্ষতা ইত্যাদির তুলনামূলক আলোচনা এবং চ্যানেল বন্ধ করার পরবর্তী প্রভাব নিয়ে দূরদৃষ্টি দেখতে পাই সোহানা তুলির লেখায়–

"কিছুদিন আগে কার্টুন চ্যানেল ডিজনি বন্ধ করা হয়েছে। কারণ ওই চ্যানেলে প্রচারিত হিন্দি ভাষায় ডাব করা কার্টুন ডোরেমন দেখে শিশুরা নাকি হিন্দি ভাষা শিখে ফেলছে। এই অজুহাতে ওটা বন্ধ করা হলো। কিন্তু আসলে কি ওই চ্যানেল বন্ধ করে তা রোধ করা গেছে? আমার তো মনে হয় না। বরং বাচ্চার বাবা-মায়েদের ডোরেমনের সিডি কিনে দিতে হয়েছে। বা বিকল্প কোনো ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। আবার অন্য চ্যানেলে কাছাকাছি ধরনের নতুন কার্টুন চালু হয়েছে।

এখনও ঠিক একই রকম প্রশ্ন চলে আসছে। চ্যানেল বন্ধ করে দিলেই কি আর কেউ আর সিরিয়াল দেখতে পারবে না? সেই রাস্তা কি চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে? বা এই দুটি চ্যানেল বন্ধ করে দেওয়ার পর যারা এসব চ্যানেলের দর্শক ছিলেন তাদের জন্য কোনো বিকল্প ব্যবস্থা করা হয়েছে? জবাব আসবে না।"

আদর রহমান ফ্যাশনে দেশি তারকাদের জায়গায় ভারতীয় তারকাদের স্থান করে নেওয়ার দিকে চোখ ফেরাতে চেয়েছেন, লিখেছেন-

"ভারতীয় চ্যানেলের কারণে দেশ গোল্লায় যাচ্ছে, সমাজে অস্থিরতা দেখা দিচ্ছে, মানসিক অবক্ষয়, ঘরে ঘরে সংকট– এসব ক্লিশে সংলাপ আর আওড়াতে চাই না। তবে আমার 'কিউরিয়াস মাইন্ড' শুধু এতটুকু জানতে চায়, সেই 'মৌসুমীর লাছা' থেকে আমরা কী করে 'বেবি ডল' পোশাকের দিকে ধাবিত হলাম? কেন 'সালমান শাহ্ ব্লেজার'র জায়গা নিয়ে নিল 'রাওডি রাথোর টি-শার্ট'?"

বাংলাদেশের মেয়েদের প্রাণঘাতী চ্যানেল নিয়ে বাঁধন অধিকারী লিখছেন–

"তবে মুক্তবাজারের সন্ত্রাসী আক্রমণ যে গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে সেখানেও হত্যাকাণ্ড চালাতে শুরু করেছে, হালিমার মৃত্যু তার সাক্ষী হয়ে থাকবে। কেননা হালিমার বাড়িও একটা গ্রামে। তবে মার্কিন নিও লিবারাল দর্শনের অন্যতম হাতিয়ার নয়া যোগাযোগের প্রযুক্তি হালিমার গ্রামেও আজ পৌঁছে দিয়েছে স্যাটেলাইট আর ইন্টারনেট। পৌঁছে দিয়েছে লোভ। লোভকে উসকে দেওয়া হচ্ছে বিজ্ঞাপন নামের মারণাস্ত্র দিয়ে। হালিমা মরে যাচ্ছে। অথচ মিথ্যে করে আত্মহত্যার খবর লেখা হচ্ছে!"

সাংস্কৃতিক আগ্রাসন অথবা প্রভাব, ভারতের একচেটিয়া ব্যবসা করে যাওয়ার ফন্দি– এমন আরও বহু কিছুর উপর লেখা হচ্ছে এমন অনেক রকম ব্যখ্যা বিশ্লেষণ।

আমি এত কিছুর মধ্যে না গিয়ে এই হাসাহাসির অংশটুকুর কারণ এবং চ্যানেল বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা নিয়ে ভাবতে আগ্রহী।

অনেকেরই ধারণা, টিভি সিরিয়াল শুধু একটি "মেয়েদের জিনিস"-– সাবান শ্যাম্পুর মতো, যদিও সাবান শ্যাম্পু সবারই দরকার হয়, কিন্তু বিজ্ঞাপনের কল্যাণে এহেন ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়।

কেউ প্রশ্ন করতে পারে প্রতিষ্ঠিত হলে দোষ কোথায়? দোষ এখানেই যে যখনই কোনো পণ্যের ভোক্তা হিসেবে যে কোনো একদল মানুষকে চিহ্নিত করে ফেলা হবে, তখনই বিতর্ক উঠলে, পণ্য-মোহাচ্ছন্নতা বা ভোগবাদিতার দোষে দুষ্ট হবে সেই একদল মানুষ, যেমনটা এখন আঙুল তোলা হচ্ছে নারীর দিকে।

আঙ্গুল তুলছে সবাই। অনেকটা লিও তলস্তয়ের 'ক্রয়তযার সোনাটা' গল্পের সেই বুড়োর মতো, যে কিনা নিজের স্ত্রীকে হত্যা করার ঘটনা বর্ণনা করার সময় বলেছিলেন, ইহুদিরা আর নারীরা তাদের প্রতি নিপীড়নের অস্ত্রকেই ব্যবহার করছে নিপীড়নকারীর প্রতি। ইহুদিদের আছে টাকা বা পুঁজি আর নারীর আছে মাধুরী, তাই দোকান, বাজারভর্তি কেবল নারীর পোশাকে আর অলঙ্কারে। ঐ সব আদায় করার জন্য পুরুষকে দাবিয়ে রাখছে তারা, দাবিয়ে রাখছে নিজের মোহময়ী জাদু দিয়ে।

মজার ব্যাপার হচ্ছে টিভি সিরিয়ালের আদি দর্শক নারীই। সোপ সিরিয়ালের ইতিহাস লিখে গুগলে সার্চ দিলে উইকিপিডিয়া জানিয়ে দেবে সাবানের বিজ্ঞাপনের হাত ধরে রেডিও নাটকের যাত্রা শুরুর গল্প, সময়ে টিভি সিরিয়ালের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ। পশ্চিমের দেশগুলোতে পুঁজিবাদের প্রয়োজনে, নতুন নতুন ইলেকট্রনিক জিনিস বিক্রির জন্য সময়ে সময়ে নারীকে গৃহবধূ করে রেখে মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ভ্যাকুয়াম ক্লিনার থেকে শুরু করে সোপ সিরিয়ালের ভোক্তা বানিয়ে তোলার প্রয়োজন হয়েছে।

বেটি ফ্রিডেনের 'ফেমিনিন মিসটিক' গ্রন্থে যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যোগ্য স্বামী জোগাড় করা মেয়েদের কথা বলা হয়েছে, যারা কিনা ভুগতেন নামহীন এক সমস্যায়, তাদের জন্য শুরু হলেও সময়ে বিবর্তিত হয়েছে সোপ সিরিয়াল। নারী ঘরের বাইরে কাজ করতে গেলে, দিনের বেলা সিরিয়ালের দর্শক কমে গেলে বানানো হয়েছে অন্যন্য লিঙ্গ, পেশা ও বয়সের দর্শকের জন্য অন্যান্য বিষয়ের সিরিয়াল। নারী পুরুষ নির্বিশেষে আমার অনেক বন্ধু ইন্টারনেট থেকে নামিয়ে নিয়ে দেখেন এসব সিরিয়াল। আমি নিজে দেখেছি এমন কয়েকটা সিরিয়াল হচ্ছে, ফ্রেন্ডস, সেক্স অ্যান্ড দ্য সিটি, হাউজ ইত্যাদি। এখন সিরিয়াল আর মেলোড্রামাভিত্তিক রিলেশনশিপ স্টোরিতে আটকে নেই। সিরিয়াল হয় খুন, জখম নিয়ে, গোয়েন্দা গল্প নিয়ে। সাসপেন্স, থ্রিলার, হরর– সব রকমের।

কিন্তু এইসব সিরিয়ালের দর্শকদের নিয়ে কেউ হাসাহাসি করে না। কিন্তু 'কিউ কি সাস ভি কাভি বহু থি' অথবা 'কুসুম' কিম্বা 'কাসৌটি জিন্দেগি কি' ধরনের সিরিয়াল নিয়েই হয় হাসাহাসিগুলো, যার চরম রূপ দেখা গেল 'বোঝে না সে বোঝে না' সিরিয়ালের দর্শক, বলা ভালো নারী দর্শকদের নিয়ে।

এই হাসাহাসি দেখে আমার আবারও ছোটবেলার কথা মনে পড়ে। মনে করে দেখুন আশির দশকের জনপ্রিয় পত্রিকা 'বিচিত্রা' ঈদ সংখ্যায় পাতার পর পাতা র'নবীর আঁকা কার্টুনের কথা। পরিবারের রোজগেরে পুরুষের প্রতি ক্ষমাহীন শোষণ করে শপিং কিংবা কাঁচা বাজারের লিস্ট ধরিয়ে দেওয়া অসংবেদনশীল নারীর কথা। নারীর নির্লজ্জ লোভ আর ভোগী চরিত্রকে উপজীব্য করে আঁকা এ সব কার্টুন অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল সন্দেহ নেই। তা নইলে বছরের পর বছর একই সব কার্টুন দিয়ে ঈদ সংখ্যা ভরে থাকবে কেন?

কার্টুন সিরিয়াস কিছু নয়– এই বলে উড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে; আবার নারীর বোকামি, লোভ ও সংবেদনহীনতাকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টাকে চিহ্নিতও করা যেতে পারে এই কার্টুনের তুমুল জনপ্রিয়তা দেখে।

আমার প্রশ্ন হচ্ছে, ঐ সময় তো কলকাতার বাংলা বা মুম্বাইয়ের হিন্দি সিরিয়াল দেখানো হত না। তখনও কেন নারীকে লোভী ও ভোগী করে দেখানো হত?

নারী এই সমাজে নানাভাবে প্রান্তিক হয়। তার মধ্যে এই হাসির রাজনীতি একটা অন্যতম প্রধান অস্ত্র নারীকে দমিত করার। হাসির রাজনীতি শব্দবন্ধের জন্য নাসরিন সিরাজকে ধন্যবাদ জানাতে চাই, ২০০৬ সালে এই শিরোনামে লেখা একটি প্রবন্ধে তিনি নারীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করা এই অস্ত্র নিয়ে বিশদ লিখেছেন।

গোপাল ভাঁড়, মোল্লা নাসিরুদ্দিন, বীরবল, শিখ বা আরও অনেককে নিয়ে যত হাসির গল্প প্রচলিত আছে, নারীর বোকামি, লোভ, মূর্খতা, স্বার্থপরতা ইত্যাদি নিয়ে তার চেয়ে কোনো অংশে কম নেই। যার ফলশ্রুতিতে আত্মহত্যা বা তালাকের মতো বিষয়ও হাসির উৎস হয়ে ওঠে। নারীকে নিয়ে হাসাহাসি করার বহুদিনের প্রচলিত সংস্কৃতিরই একটা নতুন রূপ এই পাখি জামা বিতর্ক।

এবার আসি চ্যানেল বন্ধ করা প্রসঙ্গে। ভারতের একশ একটা চ্যানেল এ দেশে দেখানো হয়, ভারতে আমাদের কোনো চ্যানেল দেখানো হয় না। এই অসম বাণিজ্য নীতির বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে বলা যেতেই পারে ভারতীয় চ্যানেল বন্ধ করা হোক।

কিন্তু ভারতীয় চ্যানেল মানে কেবল স্টার প্লাস, স্টার জলসা ও জি বাংলা তো নয়। বন্ধ যদি করতেই হয় নারীকে ক্রমাগত বস্তু ও পণ্য করে তোলা, অবিরাম বেবি ডল নাচ প্রদর্শন করা চ্যানেলগুলো কেন বন্ধ করা হবে না? এই চ্যানেলগুলো দেখে 'ইভ টিজিং' (পড়ুন যৌন নিপীড়ন) কি বাড়ছে না দেশে?

এই প্রশ্ন তুলে সেদিন বোকা বনে গেলাম। আমার এক পুরুষ সহকর্মী আমাকে বোঝালেন যে, এসব চ্যানেল রেপ বা টিজিং বাড়াচ্ছে না, বরং পুরুষের অবদমিত কামনা বশে রাখছে। বাঁচিয়ে দিচ্ছে নারীকে। ভারতীয় চ্যানেলবিরোধীদের প্রকৃত চেহারা ধরতে পারলাম আমি। বেবি ডলের দর্শক পুরুষ বলে তাতে দোষ নেই। নারীকে উল্টেপাল্টে, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, ভিজিয়ে শুকিয়ে– যত রকমভাবে ইচ্ছা দেখানো যেতে পারে।

সিরিয়ালের দর্শক নারী বলে এ নানান দোষে দুষ্ট। এই সমস্ত চ্যানেলের উপর নির্ভরশীল হয়ে যাওয়ার আগে নারীর জন্য কী ধরনের বিনোদনের জোগাড় সমাজ করে রেখেছিল সেই আলোচনা না হয় অন্য কোনোদিন করা যাবে। আপাতত এতদিন ধরে ঘরবন্দি নারীর বিনোদনের বিকল্প নিয়ে ভাবা যাক। তার অনুভূতি নিয়ে ভাবা যাক। তার অনুভূতির উপর, অভ্যাসের উপর, রুচির উপর তীব্র শ্লেষাত্মক আক্রমণ নিয়ে ভাবা যাক।

আমাকে মনে হয় বলে দিতে হবে না যে আমি কোন নারীর কথা বলছি, সমাজের কোন অংশের মানুষের কথা বলছি।

আমি আমার পাশের বাড়িতে থাকা, সন্তানকে স্কুলে নেওয়া আর বাজারে যাওয়া গৃহিণীর কথা বলছি, যার পক্ষে সপ্তাহে তো দূরের কথা মাসে একটা সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে দেখার সুযোগ নেই। আমি পুরো জীবন সন্তান মানুষ করে বড় করে ফেলা আমার মা, বড়খালামণি আর মাসিমার কথা বলছি, যারা এখন নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছেন। আমি মফঃস্বলের ঘরবন্দি কিশোরীর কথা বলছি, ছুটির দিনে যার ছাদ ছাড়া কোথাও যাওয়ার অনুমতি নেই।

তাদের অলস (?) সময় কাজে লাগিয়ে প্রসার করা ব্যবসায় কোন পক্ষের গায়ে আঘাত লাগল আর নতুন করে নারীকে হাস্যকর বোকা জীব হিসেবে প্রমাণ ও প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজন পড়ল খুব জানতে ইচ্ছে করছে।

শেষকালে এইটুকু বলা যেতে পারে, ভারতের সঙ্গে ব্যবসায়িক লেনদেন নিয়ে, চ্যানেল দেখানো নিয়ে যে সিদ্ধান্তই নেওয়া হোক, তা হতে হবে যৌক্তিক। বাংলাদেশের নারীর নির্বুদ্ধিতাকে যুক্তি হিসেবে নিয়ে, তার চয়েসকে আদৌ গোনায় না ধরে কোনো সিদ্ধান্ত নিলে সমাজে নারীর দ্বিতীয় মাত্রার অবস্থান পাকাপোক্ত করার পথে এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই হবে না।

উম্মে রায়হানা: স্নাতকোত্তর, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ।