ধর্ষকের শুক্লপক্ষ

Published : 10 August 2014, 07:10 AM
Updated : 10 August 2014, 07:10 AM

''মুসাম্মিন আঙুলে কর গোনে। বলে, পলটন আমাকে ঝোপরি থেকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। আর পহেলে পলটন, তারপর মহিন্দর, তারপর লছমন– আমি তো বেহোঁশ হয়ে যাই। পরদিন আমাকে থানায় আনে আর দারোগা, চর্তুবেদী দারোগা বলে, রেখে যান। আমাকে তো এর ইজাহার নিতে হবে। পলটন ও তার মস্তানরা খুব হাসল। বলল, হাঁ হাঁ নিন। ……

না, না, মিছা কথা।

ধরমনাশ করে বলাওতি করার নাম ইজাহার নেওয়া, সে কথা প্রথম শুনলাম। আগে জপ পূজা সারল, দেও-দেওতার ছবিতে নমস্কার করল, তারপর খানা খেল, দারু পিল, আর–

বল, মুসাম্মিন।

আধা রাত নিজে ইজাহার নিল…….. তারপর বাবু! আমাকে তুলে দেয় হেড কনস্টেবলের হাতে। বলে, আভি তু ইজাহার লে। তুই তো ব্রাহ্মণ। কাল অন্য সেপাইদের দিব।

মুসাম্মিন ভয়ংকর হয়ে উঠতে থাকে। চামড়ার নিচে বদলে যেতে থাকে ক্রমশ।''

মহাশ্বেতা দেবীর 'এজাহার' গল্পে পুলিশ ও তাদের সহযোগী মাস্তানদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার আদিবাসী রমনী মুসাম্মিন সাংবাদিক রোজিলাকে এভাবেই ইন্টারভিউ দেন। যার জীবন-যাপন ও সাহিত্য একই সূতোয় গাঁথা, সেই মহাশ্বেতা দেবী ভারতে সাম্প্রতিক ধর্ষণের সংক্রমণ ও ভয়াবহতা নিয়ে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে সক্রিয় হতে গণমাধ্যমকে অনেক কথা বলেছেন। আমাদের এই জনপদেও প্রতিদিনই নৃশংস ও ভয়াবহ এই যৌন বিকৃতি ছড়িয়ে পড়ছে। আইনি প্রশাসন ও আদালতের চরম অবহেলা, সর্বগ্রাসী দুর্নীতি, সামাজিক ও রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব ও দুবৃর্ত্তায়নের কারণেই বটে।

বিবিসি জানায়, জাতিসংঘের এক জরিপভিত্তিক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে যে, এশিয়ার কয়েকটি দেশে ২৩ শতাংশ পুরুষ জীবনে একবার হলেও ধর্ষণ করার কথা স্বীকার করেছে। চীন, ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, কম্বোডিয়া ও পাপুয়া নিউগিনির ১০ হাজার পুরুষ এই জরিপে অংশ নেয়। নারীদের ওপর সহিংসতার স্বরূপ উদ্ঘাটনে এবারই প্রথম একাধিক দেশের ওপর জরিপ চালায় জাতিসংঘ। ধর্ষণের কথা স্বীকার করা পুরুষদের প্রায় অর্ধেক বলেছে, তারা একাধিক নারীকে ধর্ষণ করেছে। পাপুয়া নিউগিনির পুরুষদের ৬০ শতাংশ ধর্ষক। বাংলাদেশে এই হার ১০ শতাংশের কম। কম্বোডিয়া, চীন ও ইন্দোনেশিয়ায় ২০ থেকে ৫০ শতাংশ।

দেখে-শুনে মনে হচ্ছে যেন ধর্ষণের অন্তহীন মৃগয়ায় নারীদের কৃষ্ণপক্ষ আর ধর্ষক পুরুষদের চলছে শুক্লপক্ষ! ধর্ষণের এ প্রাবল্য ও মোচ্ছবে আমাদের রাষ্ট্র, সরকারি-বেসরকারি সংস্থা আইন আদালত সবই কি অসহায়?

মানবসভ্যতা যখন মঙ্গলগ্রহে অক্সিজেন নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করে আর সে কাজে ভব্যিষত সময় নির্দিষ্ট করে তখন মানবতার এই চরম বিকলন কেন হয়? স্বামী ধর্ষণ করে স্ত্রীকে, শিক্ষক ধর্ষণ করে শিক্ষার্থীকে, চিকিৎসক ধর্ষণ করে তার রোগীকে, ধর্মগুরু ধর্ষণ করে তারই শিষ্যাকে, পুরোহিত, ইমাম বলাৎকার করে সেই বালককে যে তারই আশ্রিত, শ্বশুর ধর্ষণ করে পুত্রবধূকে। ধর্ষণ মৃগয়াক্ষেত্রের শিকারীরা কি শাস্তি পায় আদৌ? শাস্তি যদি পেতই তাহলে এ বিকৃতি আর অজাচারের এত প্রাবল্য কেন?

এ সব কথার আগে আমরা ধর্ষণের অভিধান, তার নামাবলী ও নৃতত্ত্ব, ইতিহাসে যাই।
'রেইপ' শব্দটি এসেছে ল্যাটিন "র‌্যাপারে (rapare) থেকে। যার অর্থ চুরি করা (to steal), জব্দ করা (seize) বা তুলে নিয়ে আসা (carry away)। সমাজবিজ্ঞান থেকে পাওয়া যায়, আদিম সাম্যবাদী সমাজ ও তার পরে দাস সমাজে কাঙ্ক্ষিত নারীকে বলপূর্বক গ্রহণ করে তার শরীর ও সত্তার অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে তাকে নিজ গোষ্ঠীতে অন্তর্ভুক্ত করা হত। প্রকৃতপক্ষে এ সমাজটাই বলপ্রয়োগের, বলাৎকারের।

নারীর প্রতি যৌন সহিংসতা মাত্রই বলাৎকার। 'বলাৎকার' কথাটার একটি অর্থ যেমন 'ধর্ষণ', তেমনই এর অপর অর্থ হল 'বলপ্রয়োগ', 'শক্তিপ্রয়োগ', 'জোরকরণ', 'অত্যাচার', 'জুলুম', 'জবরদস্তিমূলক আচরণ' (বাংলা একাডেমী সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধান)। 'বলাৎকার' হচ্ছে একদিকে 'বল দ্বারা করণ', 'বলপ্রয়োগ', 'অন্যায়', 'অত্যাচার' এবং অন্যদিকে 'বলপূর্বক সতীত্বনাশ' (রেপ)। শুধু তাই নয়, 'ঋণীকে স্বগৃহে আনিয়া তাড়নাদি দ্বারা ঋণ দেওয়ানো'ও 'বলাৎকার' বটে (হরিচরণ বন্দোপাধ্যায়, 'বঙ্গীয় শব্দকোষ')।

পুরাণ কাহিনীতে রয়েছে অজস্র ধর্ষণ উপাখ্যান। ভারতীয় মিথের স্বর্গের রাজা ঈন্দ্র ও গ্রিক মিথের প্রধান দেবতা জিউসের ধর্ষকামের কাহিনি কারও অজানা নয়। মধ্যযুগের পুঁথি সাহিত্যেও রয়েছে রাজা ও সামন্তদের ধর্ষণ কাহিনি। ইতিহাসে যবনদের (ভিনদেশি অনুপ্রবেশকারী ও আক্রমণকারী) অপহরণ ও ধর্ষণের হাত থেকে রক্ষার জন্য ভারতীয় নারীরা অঙ্গুরীয়তে জহর অর্থাৎ বিষ রাখতেন।

কাশ্মীরের ইতিহাসের ঘটনা। সনাতন হিন্দু ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী কাশ্মিরি ব্রাহ্মণদের মধ্যে সূর্য সাক্ষী রেখে দিনের বেলায় বিয়ে হত। আরব দেশের অনুপ্রবেশকারীরা কাশ্মিরি সুন্দরীদের বিয়ের অনুষ্ঠানে হামলা করে অপহরণ করে ধর্ষণ করত। গত্যন্তরহীন ব্রাহ্মণরা নিজেদের হাতে কন্যাদের মুখে কালি ঝুলি মাখিয়ে বিয়ের আসনে বসিয়ে দিতেন। কিন্তু তাতেও নিস্তার নেই। সে কারণে রাতে বিয়ের চল শুরু হয়, যা মিতক্ষরা বা দায়ভাগ সব অঞ্চলে আছে আজও।

নারীর উপর পুরুষের বলপ্রয়োগের চরম রূপ ধর্ষণ। নারীর উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে ধর্ষণ। ধর্ষিতার লজ্জা ও বিহবলতা, ধর্ষিতার পরিবারের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আমাদের সমাজে বিশেষত নারীর জন্য একটি দুর্বিসহ আতঙ্ক ও মেন্টাল ট্রমায় নিয়ে যায়। বিচারহীন ক্লীব সংস্কৃতি ধর্ষকদের পুনরায় জোর করে নারীগমনকে উসকে দেয়। নতুন নতুন ধর্ষক সৃষ্টি করে।

আইনি কাঠামোর দুর্বলতা, রাষ্ট্রপক্ষের অধিকাংশ আইনজীবীদের অনৈতিকতা, আদালতের সকল স্তরের অধিকাংশ কর্মচারির নীতিহীনতা আর বিচারের দীর্ঘসূত্রতা ধর্ষণ মামলার বিচারকাজকে ফলবলহীন এক প্রহসনে পরিণত করে। বিশেষত দরিদ্র নারীদেরকে আদালতে যেভাবে এ ধরনের মামলার বিচার চাইতে গিয়ে হেনস্তার শিকার হতে হয়, তার দৃশ্যায়ন যে কারও মনেই বিবমিষার উদ্রেক করবে।

ধর্ষণের অভিযোগের তালিকা থেকে কেউ বাদ পড়েন না। সেনাসদস্য, পুলিশ, বিচারক, আইনজীবী, সাংবাদিক, কবি, কেরানি, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, ভিক্ষুক, মোল্লা, পুরোহিত, বস্ত্রকর্মী কেউ নন। এ সব ঘটনার মামলায় কোনোটি প্রমাণিত হয়। কোনো কোনো মামলার বিচার মুখ থুবড়ে পড়ে। আবার কোনোটির প্রমাণ পাওয়া যায় না। অভিযুক্ত পেয়ে যায় খালাস। বহুল আলোচিত ভারতের দিল্লিতে চলন্ত বাসে ধর্ষণের রায়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি অথবা আমাদের দেশে মানিকগঞ্জে চলন্ত বাসে গার্মেন্টস কর্মীকে ধর্ষণের রায় দৃষ্টান্তমূলক হলেও, ধর্ষণ বাড়ছে মারী আর মহামারীর মতো।

তবে ধর্ষণ সম্পর্কে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মনোভাবও একটি সমস্যা। ভারতের উ্ত্তর প্রদেশের বার ও চৌদ্দ বছর বয়সী দুই কিশোরীকে ধর্ষণ ও হত্যা নিয়ে রাজ্য যখন উত্তপ্ত, তখন প্রদেশের আইন ও বিচার বিভাগীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিজেপি নেতা বাবুলাল গৌড় সাংবাদিকদের জেরার মুখে বেসামাল হয়ে বলে ফেলেন, ''ধর্ষণ একটি সামাজিক অপরাধ। তবে কখনও কখনও এটি ঠিক আছে! আবার কখনও কখনও ভুল! …. ধর্ষণ সম্পর্কে যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো অভিযোগ করা না হয়, ততক্ষণ কিছুই হয় না। পুলিশের কাছে অভিযোগ দিলেই ধর্ষণ বলে মনে করা হয়।''

আমাদের দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধিত, ২০০৩) আইনের অধীনে ধর্ষণ মামলার বিচার চলে। এ আইনের ৯ ধারায় ধর্ষণ, ধর্ষণজনিত কারণে মৃত্যু ইত্যাদির শাস্তির কথা বলা হয়েছে। ধর্ষণের অবস্থা ভেদে মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন ইত্যাদি শাস্তি রয়েছে। ষোল বছরের কমবয়সী কোনো শিশুর সঙ্গে তার সম্মতিতেও যৌনসঙ্গম করাকেও ধর্ষণ বলে এ আইনে চিহ্নিত করা হয়েছে।

এ আইনের ৯ (ক) ধারায় কোনো নারীর সম্মতি ছাড়া বা ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো ব্যক্তির ইচ্ছাকৃত কোনো কার্য দ্বারা সম্ভ্রমহানি হওয়ার প্রত্যক্ষ কারণে কোনো নারীর আত্মহত্যার শাস্তি অনধিক দশ, অন্যূন পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ড। ১০ ধারায় যৌনপীড়ন ও শ্লীলতাহানির শাস্তি অনধিক ১০ বছর, অন্যূন তিন বছর সশ্রম কারাদণ্ডের কথা বলা হয়েছে।

এ আইনের অধীনে দায়ের করা মামলা (ধর্ষণ মামলাও) ১৮০ দিনের মধ্যে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে শেষ করার বিধান রয়েছে। কিন্তু কোনো বিচারকই সেটা মানেন না। মানেন না ধর্ষণ মামলার বিচার রুদ্ধদ্বার কক্ষে অনুষ্ঠান বা ক্যামেরা ট্রায়ালের বিধানও। ঢাকার নিম্ন আদালতে নারী নির্যাতনের মামলার বিচার হয় খুব কম, নেই বললেই চলে। রুদ্ধদ্বার কক্ষে বিচারের কোনো উদাহরণ তো আমি গত একুশ বছরের পেশাজীবনে প্রত্যক্ষ করিনি।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণের মামলায় ক্যামেরা ট্রায়ালের বিধান থাকলেও আইনজীবী ও বিচারকগণের মধ্যে চর্চাটি নেই। অথচ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩) এর ২০ (৬) ধারায় উল্লেখ রয়েছে–

"কোনো ব্যক্তির আবেদনের প্রেক্ষিতে কিংবা ট্রাইব্যুনাল স্বীয় বিবেচনায় উপযুক্ত মনে করলে এই আইনের ধারা ৯ এর অধীন অপরাধের (ধর্ষণ মামলার বিচার) বিচার কার্যক্রম রুদ্ধদ্বার কক্ষে করতে পারবে।"

এই চর্চাহীনতা বিচারক ও আইনজীবীদের পুরুষতান্ত্রিকতার প্রকাশ। যদিও সকল বিচারক আর সকল আইনজীবী পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা ধারণ করেন না, তাই ব্যতিক্রমও দু-একটি মামলার ক্ষেত্রে রয়েছে। গত বছরের আগস্ট মাসে ভিকারুন নিসা নুন স্কুলের শিক্ষক পরিমল জয়ধরের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলায় বিচারক রুদ্ধদ্বার এজলাস কক্ষে ধর্ষিতা ছাত্রীর সাক্ষ্য নেন (ক্যামেরা ট্রায়াল)। ঢাকার ৪ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক আরিফুর রহমান ছিলেন এই বিচারক। তাঁর খাসকামরায় অর্থাৎ চেম্বারে স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় রুদ্ধদ্বার এজলাস কক্ষে এ সাক্ষ্য নেওয়া হয়।

কিন্তু পরিমলের মামলার দুই পক্ষই উচ্চ বা উচ্চ মধ্যবিত্তের। আর ঘটনাটিও বেশ আলোচিত ছিল। তাই গণমাধ্যমকে প্রতিদিনই এ নিয়ে খবর প্রকাশিত বা প্রচারিত হচ্ছে বলে এ মামলায় রুদ্ধদ্বারের বিধানটি মানা হয়েছে, সেটাও বলা যায়। সে হিসেবে এটি ব্যতিক্রমী ঘটনা।

মানবাধিকার সংগঠনগুলো কিন্তু সক্রিয় রয়েছে এ ব্যাপারে। তবে এখানে আমার একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ হল, এসব সংগঠনের নিযুক্ত আইনজীবীদের অধিকাংশই অদক্ষ, অনভিজ্ঞ ও অপরপিক্ক। এই আইনজীবীদের দিয়ে ভুল ও আত্মঘাতী মামলা পরিচালনা করার ইতিহাস রয়েছে। প্রকৃত ধর্ষক হয়েও খালাসের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হয়ে যায় ওই আসামি। তাছাড়া এদের অনেকে জেন্ডার সংবেদনশীলও নন। বেশ নামডাকওয়ালা কোনো কোনো মানবাধিকার সংগঠনের নারী আইনজীবীদের মুখে এমন অনেক কথা শুনেছি যা মোটেও ধর্ষিতার পক্ষে যায় না। এদের সাংস্কৃতিক মান ও কর্ম এদের সংগঠনের স্লোগানের সঙ্গে মেলে না।

আমাদের আদালতগুলো জেলা জজের তত্ত্বাবধানে রয়েছে সরকারি আইন সহায়তা লিগ্যাল এইড কমিটি এখানকার আইনজীবীদের একই দশা। এখানকার সদস্য তালিকার কৌঁসুলিদেরও ধর্ষণ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের পাবলিক প্রসিকিউটরদের সাহায্য করার জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়। তদুপরি রাষ্ট্র নিয়োজিত আইনজীবীরা নূন্যতম মাত্রায় দক্ষ হলেও তাদের মধ্যে বেশিরভাগ পাবলিক প্রসিকিউটরই দুর্নীতিগ্রস্ত।

২০০৯ সালের ১৩ অক্টোবর শরীয়তপুরে জেলার পালং থানার তুলাসার গ্রামের কাশেমের বাড়ির বেত বাগানে কিশোরী ডালিয়ার লাশ পাওয়া যায়। তদন্তে তাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। মামলাটি তদন্ত করেন পালং থানা পুলিশের উপপরিদর্শক সুনীল কুমার কর্মকার। অভিযোগপত্রের ১৭ জন সাক্ষীর মধ্যে ১৪ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়।

২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সে মামলায় প্রমাণের অভাবে একমাত্র আসামি সিরাজ সরদার ওরফে আওরঙ্গকে খালাস দিতে বাধ্য হন ঢাকার ৪ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের তৎকালীন বিচারক মোহাম্মদ রেজাউল ইসলাম। রায়ের পর্যালোচনায় বিচারক বলেন, "ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। তবে এ আসামিই যে তা করেছে তা বাদীপক্ষ আদালতে প্রমাণ করতে পারেনি। একটি শিশুকন্যাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হল, অথচ বিচার পেল না পরিবারটি। এদেশে গরিব মানুষের বিচার নেই।"

মামলাটির সঠিক তদন্ত হয়নি বলেও বিচারক মন্তব্য করেন। রায় ঘোষণার পর আদালতে বিলাপ করতে থাকেন ভিকটিম ডালিয়ার পিতা স্বপন লাখড়িয়া। আসামি খুব ধনী ও প্রভাবশালী। তিনি বলতে থাকেন, ''এবার আমাকেও সে মেরে ফেলবে।''

অসহায় বিচারবঞ্চিত পিতার বিলাপে আদালতের পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে।

এটি শত উদাহরণের একটি মাত্র। ধর্ষণ মামলার তদন্তে থাকে ইচ্ছাকৃত ত্রুটি, থাকে অবহেলা। চিকিৎসকের পরীক্ষা ধর্ষিতার মনে ধরিয়ে দেয় আরও আতঙ্ক। আর ধর্ষক যদি হয় বিত্তশালী, তাহলে পুলিশি তদন্ত যায় ধর্ষকদের পক্ষে। ধর্ষক ও ধর্ষিতা উভয়েই যদি হয় দরিদ্র তবে তদন্ত হয় দায়সারা গোছের, অন্তসারশূন্য– তদন্ত প্রতিবেদন হয় ধারাবাহিকতাহীন একটি কাগজ মাত্র।

ধর্ষণের শাস্তি সর্বোচ্চ হওয়ায় (capital punishment) সাধারণত আসামিপক্ষ ওজনদার ফিস নেওয়া আইনজীবীদের এসব মামলায় নিয়োগ দেন। চিকিৎসা প্রতিবেদন বা মেডিকেল রিপোর্টে অধিকাংশ চিকিৎসক মন্তব্যের ঘরে বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে ফিজিক্যাল অ্যাসল্ট বা ভায়োলেশনের সুনিদির্ষ্ট কোনো মন্তব্য করেন না। এত মামলা হয়ে পড়ে দুর্বল। ধর্ষিতার পক্ষে ন্যায়বিচার পাওয়া দুরূহ হয়ে ওঠে।

বিচারপতি ইমান আলী ও বিচারপতি শেখ হাসান আরিফের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এক রায়ে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে দেশের প্রতিটি থানায় আলাদা সেল গঠন করার কথা বলেছিলেন। তাঁরা নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, একমাস পর পর যেন যৌন হয়রানির মামলার প্রতিবেদন দাখিল করে থানা সেলগুলো। কিন্তু সে নিদের্শনা কতটুকু বাস্তবায়ন করেছে পুলিশ কর্তৃপক্ষ?

মামলা প্রমাণের জন্য তদন্তে রয়েছে আলামত সংগ্রহের বিষয়। কিন্তু জটিলতা রয়েছে সেখানেও। পরিবার, প্রতিবেশ, লোকলজ্জা ও সংস্কারের কারণে ধর্ষিতা নিজেই অনেক সময় ধর্ষণের চিহ্ন ও দাগ মুছে ফেলেন। অনেক সময় আদালতের উন্মুক্ত আড়ালহীন পরিবেশে আতঙ্কে-সংকোচে-উৎকণ্ঠায় ধর্ষণকারীকে শনাক্ত করতেও পারেন না ধর্ষিতা।

আইনজীবী ও আইন আদালত বিষয়ক সাংবাদিকতায় গিয়ে দেখেছি, মামলায় আসামিপক্ষে অধিকাংশ আইনজীবীরাই জেরা করেন বল্গাহীন, অকথ্য ভাষা ও মুদ্রায়। যদিও এর ব্যতিক্রমও রয়েছে, কিন্তু ব্যতিক্রম তো ব্যতিক্রমই। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার আইনজীবীদের ধর্ষিতাকে জেরার বিষয়ে একটি নোংরা ও গ্রাম্যতার সমন্বয়ে মাখানো একটি বহুল প্রচলিত আদালতি গল্প বলি। প্রাসঙ্গিক পরিবেশনায় পাঠকের এখানে একে অশ্লীল ও পুরুষতান্ত্রিক পরিবেশনা মনে না হওয়ারই কথা।

কাঠগড়ায় দাঁড়ানো একজন ধর্ষণ মামলার ভিকটিম সাধারণ গেরস্ত ঘরের এক নারীকে জেরা করতে আসেন আসামিপক্ষের উকিল। জেরার এক পর্যায়ে তিনি তার কালো পকেট থেকে সুঁই আর সুতা বের করেন। বিচারকের অনুমতি নিয়ে তিনি ভিকটিমকে বলেন, ''দেখ মা, তুমি স্বামী-শ্বশুরের ঘর-সংসার কি ঠিকমতো কর? স্বামী-শ্বশুরের সেবা কর?''

স্বাভাবিকভাবেই উত্তর আসে সদর্থক। এরপর বলেন, ''তুমি তো তাদের জামা পাঞ্জাবির বোতাম লাগিয়ে দাও? সুঁই-সুতার কাজ করতে পার?''

এবারও উত্তর, ''হ্যাঁ, লাগিয়ে দিই।''

''সুঁই-সুতা দিয়ে কাঁথা সেলাই করতে পার?''

''হ্যাঁ, পারি।''

''তোমার তো বয়স কম, চোখেও ভালো দেখতে পারার কথা। তাহলে সুঁইয়ের মাথার ঘরে তো সুতাও লাগাতে পার?''

''পারি।''

''আসলে তুমি তা পার কিনা আমি এ আদালতে দাঁড়িয়ে দেখতে চাই।''

ওই নারীকে সুতো ধরিয়ে দেন আইনজীবী। তার হাতে থাকে সুঁই। সুতো লাগাতে উদ্যোগ নেন নারীটি। কিন্তু সুতো এগিয়ে আনার সঙ্গে সঙ্গে উকিল মহোদয় সুঁইটি নাড়াতে থাকেন। সুঁইয়ে সুতো পড়ানো হয় না ওই নারীর পক্ষে।

ঘটনাটিকে উপজীব্য করে আইনজীবী বিচারকের সামনে নারীটিকে সাজেশন আকারে বলেন, ''আমি এভাবে সুঁই নাড়াতে থাকলে তুমি কখনও-ই তাতে সুতো প্রবেশ করাতে পারবে না। সেভাবে তুমি যদি রাজি না হও তবে তোমাকে ধর্ষণ করাও সম্ভব নয়।''

সমাজে ধর্ষণের এই প্রাবল্য কেন? রাষ্ট্রচরিত্র, সমাজ-চরিত্র সবকিছু মিলিয়ে খুব সচেতনভাবে দেখলে কী দৃশ্যমান হবে?

শোষণ আর বৈষম্যমূলক সমাজে ধর্ষণ থাকবেই। শোষণের তীব্রতর মাত্রা যেখানে রয়েছে আর সে রকম পীড়িত ও রুগ্ন সমাজে যত বড় বড় কার্যকর মোক্ষম আইন তৈরি করা হোক না কেন, ধর্ষণ তো বন্ধ হবেই না, থামবেও না। ব্যক্তিসর্বস্বতা থেকে মানুষের চরম নিঃসঙ্গতা আসে আর এই নিঃসঙ্গতা একজন মানুষকে মানব সমাজের প্রতি নেগেটিভ অ্যাপ্রোচ তৈরি করে। তখন ভোগসর্বস্বতা ছাড়া আর কিছু এ সমাজের মানুষের থাকে না।

বৈষম্যমূলক সমাজে তৈরি হয় যৌন অবদমনও, থাকে না যৌন স্বাধীনতা। তা থেকেও তৈরি হয় ধর্ষণের মতো অসুস্থতা। মানুষের মধ্যে তৈরি হয় মনোবিকলন। ধর্ষণের চরম অভীপ্সা তৈরি হয় এখানে।

অতীতেও ধর্ষণ ছিল। প্রাগৈতিহাসিক যুগে ধর্ষণের রূপ ও সম্পর্ক ছিল ভিন্ন। উৎপাদন সম্পর্ক আর উৎপাদন মালিকানার দ্বন্দ্ব সম্পর্কে পরিষ্কার হওয়া গেলে দেখা যাবে দাস যুগে, সামন্ত যুগে গোত্রযুদ্ধে উদ্বৃত্ত সম্পদের লড়াইয়ে নারীও একটি সম্পদ ছিল। বিজিত নারীরা ছিল ধর্ষণের মহার্ঘ বস্তু। ইউরোপ, ভারতবর্ষ, আরব কোথাও ব্যতিক্রম ছিল না।

মনুসংহিতার আমল আর ফতোয়া-ই-আলমগীরীর আমলে নারীর অধিকার পুরুষের তুষ্টি আর মর্জির উপর নির্ভর করত। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ফ্যাসিবাদী বিদ্বেষ নিয়ে বাঙালি নারীদের গণিমতের মাল ভেবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ধর্ষণ চালানোর পর আমাদের দেশেই আমাদের নিজস্ব আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হাতে গ্যাং রেপ হয়েছে দিনাজপুরের ইয়াসমিনসহ আরও অনেক কিশোরী ও নারী।

'বাঙালি জীবনে রমণী' গ্রন্থে কাম ও প্রেম পরিচ্ছেদে নীরদ চন্দ্র চৌধুরী বলেন–

"কাম সম্বন্ধে ধীরভাবে চিন্তা করিলে দেখা যায়, উহার উচ্চ-নিচ, ইতর- ভদ্র, শ্রদ্ধেয় ও ঘৃণ্য, লোকোত্তর ও লৌকিক– নানা রূপ আছে। নিম্নস্তরের কামও আবার বিভিন্ন হইতে পারে, যেমন, সাধারণ লোকের কাম স্বাভাবিক কিন্তু একেবারে ছ্যাঁচড়া; কিন্তু কাহারও মধ্যে উহা অস্বাভাবিক ও জুগুপ্সাজনক হয়।….. বহুবিবাহ যতদিন প্রচলিত ছিল, ততদিন স্ত্রী-পুরুষের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে কাম ছাড়া প্রেম দেখা দেখা দিবার উপায় ছিল না। সত্যিকার ভালোবাসা থাকিলে কেহ এক রাত্রির পর আর এক রাত্রিতে বিভিন্ন পত্নীতে উপগত হইতে পারে না।''

এ গ্রন্থে তিনি কাম ও প্রেমে বাঙালি, ইংরেজ, ফরাসিদের তুলনা ও দর্শন সাহিত্যে তার প্রভাব সর্বোপরি যৌন সংস্কৃতিতে প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেছেন। এ আলোচনায় প্রাসঙ্গিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষ্য, "প্রেমহীন দাম্পত্যজীবন ব্যাভিচারের নামান্তর"। আর ব্যাভিচার থাকলে ধর্ষণ থাকবেই।

শাহাদুজ্জামান প্রয়াত কথাসাহিত্যক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। লিটল ম্যাগাজিন 'লিরিক' ১৩৯২ বাংলা সালের ৮ নম্বর সংখ্যায় তার ডকুমেন্টশন রয়েছে। সেখানে প্রাসঙ্গিকভাবে যৌনতা, নর-নারীর সম্পর্ক, স্বাধীনতা বিষয়ে আলোচনা করেন ইলিয়াস। তিনি সে আলোচনায় যৌনতায় শ্রেণিচেতনার আধিপত্যকে গুরুত্ব দিয়েছেন। ইলিয়াস তার 'উৎসব', 'তারা বিবির মরদ পোলা' গল্পে আর 'চিলেকোঠার সেপাই' উপন্যাসে ওসমান গণি রঞ্জুর মধ্য দিয়ে রুগ্ন সমাজে যৌনতার অভিব্যক্তি কেমন হতে পারে তা দেখিয়েছেন। এ সম্পর্কিত আলোচনায় ইলিয়াস সমাজে অবাধ যৌনতা, অপ্রেশন অব সেক্স এবং যৌনস্বাধীনতার কথা বলতেন। চাইতেন শেষের প্রপঞ্চটি সমাজে দেখতে। তিনি বলতেন, তাহলে ধর্ষণের প্রাবল্য ক্ষীণ হয়ে মাত্রার মধ্যেই চলে আসবে।

আবার আমরা সরাসরি ধর্ষণ প্রসঙ্গে গণমাধ্যমের সাম্প্রতিক পরিবেশনায় ফিরে যাই। সম্প্রতি আমাদের দেশের একটি দৈনিকের বরাতে জানা যায়, জনপ্রিয় গণমাধ্যম গালফ নিউজের 'ডিকোডিং দ্য মাইন্ড অব আ রেপিস্ট' শিরোনামের একটি প্রতিবেদনে ধর্ষকদের প্রবণতা নিয়ে একটি আলোচনার কথা। দুবাই লাইফ ওয়ার্কস কাউন্সিলিং অ্যান্ড ডেভলপমেন্টের মনোচিকিৎসক লাবিনা আহুজা গালফ নিউজের ওই প্রতিবেদককে বলেন, "কোনো কোনো ধর্ষক মনে করে, নারীর ওপর এটা তার অধিকার। আবার অনেক ধর্ষক মনে করে, ঘটনার জন্য ধর্ষিতারাই দায়ী। ধর্ষকেরা এটা ভাবতে ভালোবাসে যে, নিপীড়িত নারীটি ধর্ষিত হতে চাইছিল বা সে তা উপভোগ করেছে। অথচ বাস্তব হচ্ছে যে কোনো নারীই এ জিনিসটি চায় না।''

সেখানে উল্লেখ করা হয় আরেকটি বিষয়ের। তা হল, ধর্ষক কোনো অদ্ভুত বা অচেনা ব্যক্তি নয়। তারা হতে পারে কারও বাগদত্তা, সহপাঠী বা কাছে থাকা অন্য কেউ। রেস্তোরাঁর কোনো পরিচারক, ঘরদোর পরিষ্কারকারী বা অফিসের কোনো দারোয়ান। এমনকি তিনি হতে পারেন শ্রদ্ধেয় কোনো ঘনিষ্ঠজন। এসবের বাইরে যে কোনো পুরুষও হতে পারে ধর্ষক।

দুবাইয়ের আমেরিকান সেন্টার ফর সাইকিয়াট্রির মনোচিকিৎসক মুহাম্মদ তাহির বলেন, তবে সব ক্ষেত্রে ধর্ষকদের বিষয়ে একটি কথা সত্য। সব ধর্ষক নির্যাতিত ব্যক্তিটিকে মনে করে 'কামনার বস্তু'। এরা সাধারণত শারীরিকভাবে বা আত্মরক্ষায় দুর্বল নারীর ওপরে আক্রমণ চালায়।

কোন ঘটনাগুলো ব্যক্তিকে 'ধর্ষক' করে তোলে? এর জবাবে মনোবিজ্ঞানীরা চারটি বিষয়ের কথা উল্লেখ করেছেন। এগুলো হল– অতীত অভিজ্ঞতা, একাকিত্ব, ক্ষোভ ও তাড়না।
হুমায়ুন আজাদ তাঁর 'নারী' গ্রন্থে ধর্ষণ অধ্যায়ে বলেন–

''কামের জৈবিক বৃত্তি অবশ্যই রয়েছে, তবে বিভিন্ন সংস্কৃতিতে ধর্ষণের ঘটনার যে ভিন্নতা দেখা যায়, তাতে এটা স্পষ্ট যে সংস্কৃতি মানুষের কামপ্রবৃত্তিকে প্রবলভাবেই পরিচলিত করে। ধর্ষণ পুরাষাধিপত্যের সামাজিক ভাবদর্শরই প্রকাশ। ধর্ষণপ্রবণ সমাজে নারীর ক্ষমতা আর অধিপত্য নেই। নারী সেখানে কোনো সামাজিক সিদ্ধান্তে অংশ নিতে পারে না, যদিও কোনো নারী হঠাৎ সরকারপ্রধান হয়ে যেতে পারে; সেখানকার পুরুষেরা ঘৃণা করে নারীর সিদ্ধান্ত। ধর্ষণপ্রবণ সমাজে পৌরুষ বলতে বোঝানো হয় হিংস্রতা আর কঠোরতা। বাংলাদেশ এমনই এক সমাজ।''

ধর্ষকদের তিনটি ব্যাপার লক্ষণীয়। ক্ষমতা, ক্রোধ ও যৌনতা। মনোবিজ্ঞানীদের একটি বড় অংশ মনে করেন ধর্ষণও (শিশু নির্যাতন থেকে শুরু করে নারী নির্যাতন) শুধুমাত্র নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্যই করা হয়।

আজকাল নারীর স্বনির্ভরতা পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে বিপন্ন করে তুলছে। নারী হয়ে উঠেছে 'শত্রু-লিঙ্গ'। নারীর নিরাপত্তা, আত্মসম্মান, স্বাধীন চিন্তার সুযোগ কেড়ে নিলেই কেবলমাত্র পুরুষ হতে পারে এবং তার সবচেয়ে সহজ উপায় হল যৌন-হিংসা। একজন নারী কেবলমাত্র পুরুষকে সুখ দেবার একটা শরীর, তার বেশি কিছু নয়। পুঁজিবাদী সমাজে নারীর প্রধান পরিচয় সে যৌনবস্তু। পণ্য বিক্রি থেকে শুরু করে সকল ক্ষেত্রে নারীর শরীর ও যৌনতাকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সমাজের সর্বত্র পুঁজিবাদী এই আদর্শের বিকাশ আমাদের এক ধরনের বিকৃত যৌনচর্চায় অনুপ্রাণিত করে।

সুজান ব্রাউন মিলার তাঁর সাড়াজাগানো বই 'আমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে'-তে ধর্ষণকে ব্যাখ্যা করেছেন পুরুষাধিপত্য প্রতিষ্ঠার কেন্দ্রীয় উপাদান রূপে।

আজকের কিশোর আর তরুণেরাও এই পুরুষতন্ত্রের ফসল। তাদের ধর্ষকামী মনোবৃত্তির পিছনে তাই তাদের অবিকশিত মানস দায়ী, তার চেয়ে বেশি দায়ী এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা যা তাকে অবিকশিত, লৈঙ্গিক চেতনায় পঙ্গু করে রেখেছে। ধর্ষণে তাই বয়স মূখ্য নয়, কামেচ্ছাও নয়। নারীর পোশাকটি যৌনউত্তেজক কিনা সেটিও তত নয়। এখানে চার বছরের শিশু থেকে ষাট বছরের বৃদ্ধাও ধর্ষিত হয়। বোরকাপরা মেয়েও ধর্ষণের হাত থেকে নিস্তার পায় না।

বাংলাদেশেরই বহু আদিবাসী সমাজের মেয়েদের ঊর্ধ্বাংশ উন্মুক্ত থাকে। তাদের আমরা অসভ্য বলে গালি দিই। কই তাদের সমাজে তো ধর্ষণের মচ্ছব নেই? নগ্নতা সত্ত্বেও নারীর শরীরে আদিবাসী পুরুষ হামলে পড়ে না! তবে কি তারা অমানবিক? তবে কি তাদের কামবোধ নেই? আদিবাসীদের সমাজে ঘুরতে গিয়ে বরং এই 'সভ্য' আমরাই তাদের নগ্নতায় কামার্ত হই; অসুস্থ বিনোদন খুঁজে পাই। যে সভ্যতা আড়াল করতে শেখায়, যে সভ্যতা পোশাক আমদানি করে সেই সভ্যতা একই সঙ্গে অবগুণ্ঠনমুক্তদের দেখে কামার্ত হতে শেখায়।

যদিও এ রকম বৈষম্যমূলক ও স্ববিরোধী সমাজে ধর্ষণের উৎপাটন কখনও-ই সম্ভব নয়। তারপরও মাত্রার প্রশমন করা সম্ভব হতে পারে। আর সে ক্ষেত্রে আকাশ সংস্কৃতির মন্দ দিক, বাজারি সিনেমার অশ্লীলতা, যৌনতার অপ্রাসঙ্গিক খোলাখুলি পরিবেশনা, মুঠোফোনের পর্নোগ্রাফি, অভব্য ও অশালীন বিজ্ঞাপন চিত্রের সদর্থক রাশ টানা অতি জরুরি। তা না হলে শিশু থেকে কিশোর, যুবক থেকে প্রবীণকে নারীর উপর উসকে দেবেই ভয়াল যৌনআক্রমণের জন্য।

আমাদের সমাজের মননে-মানসে, রক্তে-মাংসে রয়েছে সামন্ত পশ্চাৎপদ চিন্তা। আর প্রযুক্তির অপপ্রয়োগে চলে এসেছে চরম ভোগবাদী পুঁজিবাদী সংস্কৃতি। যা কোনোভাবেই একসঙ্গে সাঁতার কাটতে পারছে না। নারীকে কোথাও পর্দায় মুড়িয়ে বন্দি করে মুর্দা বানানো হচ্ছে। আবার কোথাও বানানো হচ্ছে নগ্ন চুম্বকে। অসঙ্গত নাজুক সমাজের অস্থির হাওয়ায় তাই বেসামাল সবকিছু। রুগ্নতার ভয়ংকর প্রকাশ সর্বত্র।

সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকাঠামোর বিভিন্ন অঙ্গ, বিচার বিভাগকে কঠোর হতে হবে। নিয়ে আসতে হবে নারী ও পুরুষকে নূন্যতম একই মাত্রার একই সমান্তারালের ব্যক্তি হয়ে ওঠার দীক্ষায়। নিরাপদ বারান্দায় দাঁড়িয়ে নারীরা তখনই দেখতে পারবে বিস্তৃত না হলেও এক টুকরো সুনীল আকাশ। আর ধর্ষকদের শুক্লপক্ষকে আমরা পারব হঠাতে।

অবশ্য মাতৃতান্ত্রিক সমাজে নারী গোষ্ঠীপতি কিন্তু পশু শিকারে, খাদ্য আহরণে সবচেয়ে বলশালী তরুণকে দখল করে যৌন অধিকারে নিয়ে আসত। 'ভোলগা থেকে গঙ্গা'য় রাহুল সাংস্কৃত্যায়ন উল্লেখ তা করেছেন গোষ্ঠীনেত্রী দিবা, উষা, নিশাদের মধ্য দিয়ে।

আমেরিকার আমাজন অঞ্চলে মাতৃতান্ত্রিক সমাজে হত নির্দিষ্ট দিনে ধর্ষণ উৎসব। দেবতার নামে নারী গোষ্ঠীপতি সুগঠিত বীর্যবান পুরুষকে তাদের জবরদস্তি করে হলেও সম্ভোগ করে পরে।

প্রাচীন ভারতে পৈশাচ বিবাহে একজন কুমারী কন্যাকে ঘুমন্ত অবস্থায় অথবা আসব, সোমরস (মদ) পানে মাতাল করে, অচেতন অবস্থায় তাকে ধর্ষণের পর অথবা হরণের পর বিয়ের বিধান ও প্রথা ছিল। রাক্ষস বিবাহে কন্যাকে বলপূর্বক কেড়ে এনে বিয়ে করা হত। এ রকম বিবাহের অনেক উদাহরণ মহাভারতে উল্লেখ রয়েছে। দুর্যোধনের সঙ্গে বিবাহ দেবার জন্য কলিঙ্গরাজার সভা থেকে চিত্রাঙ্গদাকে কর্ণ বলপূর্বক অধিকার করে এনেছিলেন। অর্জুন সুভদ্রাকে বলপূর্বক অপহরণ করে বিবাহ করেছিলেন।

সিগমুন্ড ফ্রয়েড, পাভলভ সবাই যৌন স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী এ স্বাধীনতা ব্যাহত করলে অবচেতনে সচেতনে ধর্ষকামের জুগুপ্সা থেকে মানুষের মুক্তি মিলবে না।

প্রকাশ বিশ্বাস: আইনজীবী ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের আদালত প্রতিবেদক।