বীরমাতাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ

শাহমিকা আগুন
Published : 3 August 2014, 06:48 AM
Updated : 3 August 2014, 06:48 AM

ঈদ শেষ। ঈদের আমেজ এখনও রয়ে গেছে ঘরে ঘরে। তবে এবারের ঈদটি এমনিতেই কেমন যেন! ফিলিস্তিনে ইসরাইলি বোমা নিক্ষেপ, নাইজেরিয়ায় বোকো হারাম নামে উগ্র ইসলামি জঙ্গিবাদীদের রক্তপাত ঘটানো, ইরাকে ও সিরিয়ায় কট্টরপন্থী আইসিদের দখলদারী ও ফতোয়াবাজি– বুক হিম করা মৃত্যু, রক্ত আর ব্যবচ্ছেদের পুনরাবৃত্তি। সে সঙ্গে দেখছি যুদ্ধের নামে চলছে নারীশরীরে চরম হিংস্রতা খোদাই করার ঘৃণ্য চেষ্টা।

মাথা হেঁট হয়ে যায় যখন দেখি ইসরাইলি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মরদেছি কেদার ঘোষণা দেন যে, ''ফিলিস্তিনের আরব নারীদের ধর্ষণ করাই যুদ্ধে জেতার একমাত্র কৌশল।'' বুকটা খান খান হয়ে যায় যখন দেখি নাইজেরিয়ার তিনশ শিশু-কিশোরীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়। এমনকি ধর্মের নামে যে যুদ্ধ চলছে ইরাকে, সিরিয়ায়– সেখানেও ঘর থেকে মেয়েদের টেনে বের করে ধর্ষণ করা হচ্ছে নিয়মিত।

তেমনিভাবে একাত্তরে বাংলাদেশেও যুদ্ধের কৌশল হিসেবে ধর্ষণ বেছে নেওয়া হয়েছিল। ভাবা যায়, একটি দেশের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, সেনাবাহিনী প্রধান থেকে শুরু করে প্রতিটি বিভাগের প্রধান মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সেই দেশেরই একটি অংশের নারীদের ধর্ষণের মাধ্যমে জাতিগত শোধন চালানো হবে! ওদের সেনাবাহিনী তাই এই জনপদে হত্যা, রাহাজানি, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ, ধংস করেই ক্ষান্ত হয়নি– নয় মাসের যুদ্ধে চার লাখেরও বেশি নারী ও শিশুকে ধর্ষণ করেছে পরিকল্পিতভাবে।

সেই থেকে আমাদের বীরাঙ্গনাদের ছায়াজীবনের শুরু। ত্রিশ লাখ শহীদের করোটির মতোই এই বীরাঙ্গনারা এখন বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছেন। হারিয়ে যাওয়া সেই করোটিদের খোঁজ করার জন্য গত জুনে গিয়েছিলাম বাংলাদেশে। কিছু ভয়াবহ অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে এসেছি। তার কিছুটা পাঠকদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে কষ্ট একটু হালকা করার চেষ্টা করছি।

বাংলাদেশে এক আলাপচারিতায় যখন শুনলাম ইংরেজি স্কুলের পাঠ শেষ করে বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমাতে প্রতীক্ষারত কজন তরুণ-তরুণী 'বীরাঙ্গনা' শব্দটির সঙ্গেই পরিচিত নয়, তখন খুব অবাক হইনি। বীরাঙ্গনারা 'অস্পৃশ্য', 'অচ্ছুৎ' এই ভেবে ওঁদের কথা পাঠ্যপুস্তকে ছাপানো হয়নি, দেখানো হয়নি টেলিভিশনে। আমাদের মতো একটি গোটা প্রজন্ম তাই বড় হয়েছি শুধু এই জেনে যে, স্বাধীনতা যুদ্ধে নারী নির্যাতন হয়েছিল। কিন্তু সেই নির্যাতনের ধরন যে কী বিভীষিকাময় ছিল সে সত্যটি জানা এবং পরের প্রজন্মকে জানানোর প্রয়োজনীয়তা কেউ উপলব্ধি করেননি।

ইংল্যান্ডে গত বছর জুন থেকে আমরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কিছু তরুণ (ডা. ফয়সাল, রাশেদ, জুয়েল, লিপি, হাসনাত, সুহানা) মিলে বীরাঙ্গনাদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ফান্ড রাইজিংসহ সামাজিক সচেতনতা বাড়ানোর জন্য কাজ করে যাচ্ছি। বীরাঙ্গনাদের একসঙ্গে করে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উদযাপন করেছি বাংলাদেশে। এ জন্য গঠন করা হয়েছে 'অরগ্যানাইজেশন ফর ওয়্যার হিরোইনস' নামের একটি সংগঠন। বীরাঙ্গনাদের 'মুক্তিযোদ্ধা' বা সমমানের স্বীকৃতি আদায়ের জন্য বাংলাদেশের নারী আইনজীবীরা যে রিট হাইকোর্টে জমা দিয়েছেন, তার সমর্থনে দেড়শ' মানুষের মানব বন্ধন করে তাদের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি স্মারকলিপি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।

তাছাড়া আমরা স্কাইপের মাধ্যমে বীরাঙ্গনাদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলার ব্যবস্থা করে দিয়েছি সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী, হাউজ অব লর্ডসের সদস্য ব্যারনেস পলাউদ্দীনসহ উপস্থিত সকলের। বীরাঙ্গনাদের দুর্বিষহ জীবনের বৃত্তান্ত তাঁদের নিজেদের মুখে শুনে সেদিন কেউ অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি। সুখবর হল, রিটের পক্ষে রায় পাওয়া গেছে।

এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে গিয়ে বীরাঙ্গনাদের চিকিৎসা এবং তাঁদের ও তাঁদের সন্তানদের পুনর্বাসনের জন্য দেখা করলাম মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের সঙ্গে। সরকার বীরাঙ্গনাদের বিষয়ে সহমর্মী। বাংলাদেশে থাকার সময় প্রায আঠারশ কিলোমিটার এলাকা ঘুরে কুড়িগ্রাম, ঠাকুরগাঁও, কুমিল্লা ও সিরাজগঞ্জ জেলার বেশ ক'জন বীরাঙ্গনার সঙ্গে দেখা করার সৌভাগ্য হয়েছিল।

বীরাঙ্গনা রমা চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করে আসতে পারিনি বলে খুব খারাপ লেগেছে । চট্টগ্রামে বন্যা হচ্ছিল, তাই যেতে পারিনি। কিন্তু আলাউদ্দীন খোকনের কাছ থেকে শুনেছি তিনি ভালো নেই। রমা'দি নিজের লেখা বই ফেরি করেন, খালি পায়ে হেঁটে বেড়ান। শরীর খারাপ বলে ফেরি করা বন্ধ।

গিয়েছিলাম শ্রীপুরে বীরাঙ্গনা মমতাজকে দেখতে। মমতাজ হলেন সেই বীরমাতা যাকে ন'মাসের গর্ভাবস্থায় আট পাকিস্তানি সৈন্য ধর্ষণ করেছে। তাঁর সন্তানটির পৃথিবীর আলো দেখার ভাগ্য আর হয়নি। পেটের ভেতরে মায়ের জরায়ু ও পায়ুপথের সঙ্গে জড়িয়ে-প্যাঁচিয়ে পচে গলে গেছে শিশুটি, বাংলার স্বাধীনতার ইতিহাসের সঙ্গে মিশে গেছে। তিন মাস পর মৃত্যুপথযাত্রী মমতাজকে নদীপথে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে সেই মৃত শিশুর হাড়গোড় বের করে আনা হয়।

কিন্তু চিরদিনের জন্য অকেজো হয়ে যায় মমতাজের পায়ুপথ ও যোনিপথ। ডাক্তাররা তাঁর তলপেট কেটে তাঁর কোলনটি (পায়খানার রাস্তা) বের করে দিয়েছিলেন। বিয়াল্লিশ বছর ধরে এভাবেই মলত্যাগ করছেন তিনি। সারাজীবনে ষোলটি অপারেশন করতে হয়েছে তাঁর। কোলনটি ঢেকে রাখার জন্য কোলন ব্যাগ কেনার ক্ষমতাও তাঁর নেই। তাই পরনের ছেঁড়া ময়লা শাড়ি দিয়ে তিনি কোলন ঢেকে রাখেন।

আমি নিজে হাসপাতালে ক্যান্সার রোগীদের সঙ্গে দীর্ঘ দিন কাজ করেছি, অনেক বীভৎস দৃশ্য দেখেছি, সহজে বিচলিত হই না। কিন্তু বীরাঙ্গনা মমতাজের ঘা হয়ে যাওয়া কোলন দেখে আমি শিউরে উঠেছি। ময়লা শাড়ি আর বাতাস থেকে জীবাণু মিলেমিশে তাঁর কোলনটির কী বেহাল দশা। এক কথায় অবিশ্বাস্য! সবসময় কোলন দিয়ে রক্ত পড়ে। শুধু তাই নয়, মমতাজের মলত্যাগ স্বাভাবিক উপায়ে হয় না। তাঁর জন্য প্রয়োজন একটি ভালো টয়লেট। কিন্তু কোথায় সেটি? নেই। কোলন দিয়ে বের হয়ে আসা তাঁর মল পরিষ্কার করতে হয় নদীর পানিতে!

তখন দুপুরবেলা। বীরাঙ্গনা মমতাজ সামনে এনে দিলেন শসা। মজা করে জিজ্ঞেস করলাম, ভাত রান্না করেননি? খুব লজ্জা পেলেন। বললেন, স্বামী কামলা খেটে দু দিনে চার দিনে যা আয় করত তা দিয়ে ভাত জুটত। স্বামী মারা গেছেন ঊনচল্লিশ দিন হল। অনেক ধার করেছেন। এখন আর কোনো উপায় নেই। ঘরে চাল নেই, চুলোয় নেই আগুন।

আমার গালে যেন একটি শক্ত চড় পড়ল। থমকে গেলাম। নিজের ও বন্ধুদের কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে খুব বড় মুখ করে গেছিলাম যে, বীরাঙ্গনাদের আর্থিক সাহায্য করব। বুঝে গেলাম কত বড় দুরাশা নিয়ে এসেছি। তবু দায়িত্ব নিলাম তাঁর ও তাঁর নাতনির চিকিৎসা ও টয়লেটের সুব্যবস্থার। সে সঙ্গে তাঁর ঋণ পরিশোধের।

কুড়িগ্রামের নীলকণ্ঠ গ্রামের বীরমাতাদের আবদার ছিল, এক বেলা মাংস দিয়ে ভাত খাবেন, কেউ তাঁদের ভালো খেতে দেয় না। তা আর হল না। কারণ আমরা পৌঁছুলাম সন্ধ্যায়। সারা দিনের ক্ষুধার্ত পরিশ্রান্ত আমরা পৌঁছুনোর পর বীরাঙ্গনা মায়েরা এসে জড়িয়ে ধরলেন। তাঁদের দেখে সব ক্ষুধা-তৃষ্ণা উবে গেল। অনেক না-বলা কথা, অনেক বছরের গুমোট যন্ত্রণা আর বঞ্চনার সত্য কাহিনি।

তরুবালা, রহিমা, আবিরুন, দুলু, ময়না, সুরুজ জান, খোদেজা, গেন্দি, মেহেরজান, খুকি, আসমা, বসিরুন, আয়শা– কত কত নাম। একাত্তরে তাঁদের বয়স ছিল বার থেকে বিশের মধ্যে। সবাই বিবাহিতা ছিলেন। সবাই পাকিস্তানি সৈন্য দ্বারা গণধর্ষণের শিকার। সুরুজ জান ছিলেন ছয় মাসের গর্ভবতী। চার পাকিস্তানি সেনা তাঁকে ধর্ষণ করার পর তাঁর গর্ভস্থ শিশুটি মারা যায়। স্বামী সেই থেকে নিখোঁজ।

তরুবালা ছিলেন এক মাসের গর্ভবতী, যখন তিনি পাঁচ মিলিটারি দ্বারা ধর্ষিতা হন। তাঁর সামনেই তাঁর স্বামীকে মেরে ফেলা হয়। গেন্দি ছিলেন তিন মাসের গর্ভবতী। দশ মিলিটারি তাদের বাড়িতে হামলা চালিয়ে তাঁর স্বামীকে মেরে ফেলে তাঁকে ধর্ষণ করে।

আমি স্তব্ধ হয়ে ভাবছিলাম গর্ভবতী নারীদের গণধর্ষণ কীভাবে করতে পারে এরা! প্রত্যেকেই হানাদারদের হাত-পা ধরে বলেছিলেন যে, তাঁরা 'পোয়াতি'। তাহলে! উত্তরটা পেলাম কিছু পরে, যখন কথা বললাম আবীরুনের সঙ্গে। তাঁর কোল থেকে তাঁর ছেলেটিকে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল ওরা। নাকে মুখে রক্ত উঠে মারা যায় শিশুটি। সে অবস্থায় একজন মাকে ধর্ষণ করেছে চার নরপশু!

একই ঘটনা ঘটেছে ময়না, মেহেরজান, খুকি, আসমাদের ক্ষেত্রে। কারও কোলে ছিল আড়াই মাসের বাচ্চা, কারও সন্তান চার মাসের, কারও-বা ছয় মাসের। মায়ের কোল থেকে শিশুদের টেনে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে পাষণ্ডরা। কয়েকজন শিশু তারপরও ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছে। কিন্তু মিলিটারিদের উদ্দেশ্যই ছিল ওই শিশুদের হত্যা করা, বাঙালির বংশ নিপাত করা, যা এখন আমরা ফিলিস্তিনি শিশুদের ক্ষেত্রে দেখতে পাচ্ছি। দুঃখজনক হল, এই বাংলায় শিশুহত্যার বিরুদ্ধে বিশ্ববিবেক তখনও জেগে উঠেনি।

এখানে আরেকটি বিষয় তাৎপর্যপূর্ণ। পাকিস্তানি সেনারা খুব ভালোভাবেই জানত যে, একজন গর্ভবতী নারীকে গণধর্ষণ করা হলে তাঁর গর্ভস্থ শিশুটির মৃত্যুর আশঙ্কা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অসহায় নারীটিরও মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ে। তারা আসলে নারী ও শিশুদের হত্যা করতে মূল্যবান 'গুলি' খরচ করতে চায়নি, পাশবিকতার দ্বারাই হত্যা করতে চেয়েছে তাঁদের।

অসহায় নারীদের হানাদারের হাতে তুলে দেওয়ার পেছনে রাজাকার-আলবদরদের ছিল প্রত্যক্ষ ভূমিকা। রহিমা, দুলু, ময়নাকে ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বসিরন লুকিয়েছিলেন কাঁচা পায়খানার নিচে কোনো এক জায়গায়। সেখান থেকে রাজাকাররা তাঁকে তুলে নিয়ে তিন মিলিটারির হাতে তুলে দেয়। মিলিটারিরা কয়েক দিন তাদের উপর যে তাণ্ডব চালিয়েছিল তার দায় বয়ে যাচ্ছেন এই নারীরা– জীবনের প্রতিটি ক্ষণে, প্রতিটি পলে।

এই নারীদের সবাই ছিলেন বিবাহিতা, স্বামীরা তাঁদের সঙ্গে আর সংসার করেননি। নিজ বাসভূমে পরবাসী জীবন কাটিয়েছেন তাঁরা। নিজের ঘরে ঠাঁই যেমন হয়নি, তেমন ঠাঁই হয়নি সমাজ নামের শৃঙ্খলিত প্রাচীরে। সেখানে সারা জীবন মাথা ঠুকেও এক বিন্দু স্বীকৃতি মেলেনি তাঁদের। মিলেছে শুধু লাঞ্ছনা, গঞ্জনা আর বীরাঙ্গনা জীবনের জন্য তিরস্কার। দিনের পর দিন অভুক্ত ছিলেন তাঁরা, পড়ে ছিলেন স্টেশনে, নদীর পাড়ে। পরনে হয়তো কোনো কাপড় থাকত না। তাঁদের জন্য এক তিল মায়া হয়নি কারও।

কেউ কেউ অনেক দূরে নিজেদের পরিচয় লুকিয়ে কাজ করতে যেতেন। তাতেও বিপত্তি। কোনো না কোনোভাবে জেনে যেত বাড়ির কর্তা। তখন মাছের বিষ্ঠা আর আঁশের মতো তাঁদের ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হত, যেন বাড়ির পাশে থাকলেই দুর্গন্ধ ছড়াবে!

বীরমাতাদের প্রত্যেকেই নিজের নিজের হাত দেখালেন। কাঁটাছেড়া, চড়াই-উৎরাই মাখানো হাত, তাঁদের জীবনের মতোই। বললেন, তাঁরা এখনও খড়ি ফাটান। এক মণ খড়ি ফাটালে দশ টাকা পান। তাই দিয়ে কোনো রকমে টেনে নিচ্ছেন জীবন।

ঝড়ে ভাঙা বটের ঝুড়ির মতো এই মায়েরা আমার পায়ে পড়লেন যেন তাঁদের কোনো ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। এই বুড়ো বয়সে আর পারছেন না। কারও ছেলেমেয়েই মায়ের পরিচয় দিতে চায় না। যে যুদ্ধশিশুকে এত সাইক্লোন-তুফান পার করে বুকে আগলে বড় করেছেন, সেই ছেলেই মাকে 'খারাপ মেয়েছেলে' বলে গালি দেয়। বললেন, শুধু দিনে দুবার নয়, শুধু একবার একমুঠো ভাত আর মাথা গোঁজার একটা ব্যবস্থা যদি করে দিতে পারি!

বুক ফেটে কান্না আসছিল। যে দেশে রাজাকাররা বাংলাদেশের পতাকা তুলে সংসদ চষে বেড়ায়, সে দেশে বীরাঙ্গনা মায়েদের এই করুণ পরিণতি দেখে নিজের সত্তার ওপর লজ্জা হল। তাঁদের কাছ থেকে তাই সে রাতের মতো বিদায় নিলাম, যেন পালিয়ে বাঁচলাম।

আমার জন্য কত বড় দগদগে সত্য অপেক্ষা করছিল তা বুঝতে পারিনি ঠাকুরগাঁওয়ে পৌঁছানোর আগে পর্যন্ত। উঁচু নিচু রাস্তা পার হয়ে গেলাম বীরাঙ্গনা তমিনা খাতুনের বাড়িতে। গ্রামের অন্য সব বাড়ি থেকে দূরে এই ঘরটি। ওখানে পৌঁছে তমিনাকে খুঁজছি আমরা, অনেক ডাকাডাকি করা হল। না, কেউ নেই ঘরে। মনটা খারাপ হল, এতদূর এসেও তাঁর দেখা পেলাম না!

ফিরে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ কানটা একটু খাড়া হল। মৃদু একটা শব্দ ভেসে আসছে দূর থেকে। খুব মৃদু। শব্দ ধরে এগুতে লাগলাম। এ কী! ভাঙা ঘরের দাওয়ায় শুয়ে আছেন এক বৃদ্ধা। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে অস্তিত্ব জানান দেওয়ার চেষ্টা করছেন। কাছে গিয়ে জানতে পারলাম তিনি খুব অসুস্থ। তার ডান পা-টি ভেঙে গেছে এক মাসের উপর হল। কোনো চিকিৎসা তো দূরে থাক, একটি ট্যাবলেটও কপালে জুটেনি। কী বলব ভাষা খুঁজে পেলাম না।

মেয়ে অনেক দূরে থাকেন। তবু দুদিনে একবার মায়ের জন্য খাবার নিয়ে আসেন। আর তখনই মায়ের মলমূত্র পরিষ্কারও করে দিয়ে যান। আমরা যাবার কিছু আগেই মেয়ে এসেছিলেন। তাই আমরা পরিষ্কার জায়গায় বসতে পেরেছি। নয়তো তিনি খুব বিব্রত হতেন। ভাবলাম, এই ঠা ঠা রোদে মানুষের কতবার তৃষ্ণা পায়! হায় এই বীরাঙ্গনার কপালে এক গ্লাস পানিও জোটে না প্রচণ্ড তৃষ্ণায়। আর বৃষ্টি যদি আসে? বললেন, দু' ছেলে পাশেই থাকে, কিন্তু বীরাঙ্গনা বলে মায়ের পরিচয় দেয় না।

বারবার এই অশীতিপর বৃদ্ধা হাতে ধরলেন তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য। চিকিৎসা করার জন্য তাঁকে ঢাকায় নেওয়া দরকার। কিছু টাকা তাঁর হাতে দিয়ে বললাম, আপনার ছেলেদেরকে বলবেন আপনাকে ঢাকায় নেওয়ার ব্যবস্থা করতে, বাকি দায়িত্ব আমরা নিলাম।

বীরাঙ্গনা তমিনা বললেন, যুদ্ধের সময় একজন রাজাকার তাঁদের বাড়িতে মিলিটারি নিয়ে আসে। তাঁকে গণধর্ষণের পর ফেলে চলে যায়। স্বামী তাঁকে ত্যাগ করেননি। তিন সন্তানের কথা চিন্তা করে সংসার করেছেন। কিন্তু তাঁরা ঠাকুরগাঁওয়ে আর থাকেননি। তিনি বৃদ্ধ হবার পর তাঁরা আবার এখানে ফিরে এসেছেন।

কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল এই অসহায় মায়ের। আমরা তাই ফেরার জন্য তৈরি হলাম। ভাগ্যক্রমে পথে তমিনার এক ছেলের সঙ্গে দেখা হল। তাকে বললাম তার মাকে ঢাকায় নিয়ে যেতে, চিকিৎসার ব্যবস্থা আমরা করে দেব। কিন্তু ঢাকায় যতদিন ছিলাম, ওরা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি।

রানীশংকৈলে একটি দিঘি আছে যেটি একাত্তরে মানুষের রক্তে লাল রঙ ধারণ করেছিল। কত মানুষকে যে হত্যা করা হয়েছে! এই গ্রামে পেয়ে গেলাম মোখলেছা, মালেকা, আমিনাকে। তারা তিন বোন। ছিলেন চার জন, একজন মারা গেছেন, যার নাম ছিল বুদি। এই চার বোনই বীরাঙ্গনা। দীর্ঘ তিন মাস তাঁদের ক্যাম্পে আটকে রেখেছিল পাকসেনারা। প্রত্যেককেই প্রতিদিন দশ থেকে বিশ সেনা ধর্ষণ করত। ওঁদের পরনে কাপড় রাখতে দিত না। চুল ছোট করে ছেঁটে দিত।

যুদ্ধের শেষের দিকে মিলিটারি ক্যাম্প থেকে পালাতে সক্ষম হয়েছিলেন ওরা। কিন্তু পালাতে পারেননি জীবনের নির্মম সত্য থেকে। স্বাধীন বাংলার মানুষ রাজাকার, আল বদর, আল শামসদের দুধ-ভাত পেতে দিলেও, বীরাঙ্গনাদের জন্য মিলেনি আশ্রয়!

আমিনা বিবাহিতা ছিলেন। স্বামী এক বছরের সন্তানসহ তাঁকে ত্যাগ করেছে। তখন চার বোন আমিনার ছেলেসহ জমিদার বাড়ির পেছনের জঙ্গলে সারাদিন লুকিয়ে থাকতেন। গ্রামের মানুষ তাঁদের দেখলেই তাড়া করত, মেরে ফেলতে চাইত। দিনের পর দিন এভাবে এক শিশুসহ অভুক্ত থেকেছেন তারা।

লোকালয়ে যেমন হিংস্র মানুষের থাবা, জঙ্গলেও তেমন রাতের বেলা বাঘসহ নানা হিংস্র পশুর গর্জন শুনে ভয় পেতেন। আমিনার শিশুটিকে বাঘে খেয়ে ফেলবে এই ভয়ে লোকালয়ে ছুটে আসতেন, মানুষের উঠোনে আশ্রয় নিতেন– লোকে তখন ঝাঁটা ও লাঠি নিয়ে তেড়ে আসত। যেন ওঁরা অচ্ছুৎ কোনো প্রাণী, দূর দূর করে খেদিয়ে দিত!

একেকটি কাহিনি শুনছি, আর গা শিউরে উঠছে। কত কিছু যে সইতে হয়েছে এই চার বোনকে। সবার পরনে কাপড়ও ছিল না। একটা কাপড় পরে এক বোন লোকালয়ে বা দূরে, যেখানে তাদের কেউ চিনে না, সেখানে খাবার আনতে যেতেন। বাকি তিনজন নগ্ন লুকিয়ে থাকতেন সেই জঙ্গলে। তিনি খাবার বা টাকা নিয়ে ফিরে এলে আরেকজন সেই কাপড় পরে বের হতেন।

আমিনা দ্বিতীয় বার পরিচয় লুকিয়ে বিয়ে করেছিলেন। পাঁচ বছর পর স্বামী যখন তাঁর বীরাঙ্গনা পরিচয় জানতে পারল, তখন সেই অপরাধের 'উপযুক্ত' শাস্তি আমিনাকে দিয়েছিল সে। ইট দিয়ে মেরে এই বীরমাতার হাত, পা, দাঁত সব ভেঙে দিল তাঁর পাষণ্ড স্বামী। তারপর যথারীতি সন্তানদের তাঁর ঘাড়ে ফেলে রেখে চলে গেল। এরপর দীর্ঘ এক বছর পঙ্গু ছিলেন আমিনা।

এই বীরমাতা বোনদের কথা শুনতে শুনতে আমার দুহাত শক্ত হয়ে মুষ্ঠিবদ্ধ হচ্ছিল বারবার, কী এক প্রতিবাদের আক্রোশে। কেন এ জীবন পেলেন এই বীর নারীরা! ক্যাম্পের নরকযন্ত্রণা থেকে জীবন ফিরে পাওয়ার পর তো সমাজের কাছে তাঁদের অনেক আদর হওয়ার কথা ছিল। উচিত ছিল এই দেশের জন্য তাঁদের যৌবনের মূল্যবান সময়ে নিগৃহীত হয়ে কাটানোর উপযুক্ত মুল্য তাঁদের দেওয়া। উল্টে তাঁরা পেলেন তাঁদের ওপর চালানো নির্যাতনের বিনিময়ে স্বাধীনতা পাওয়া স্বজাতির কাছ থেকে অসীম গঞ্জনা আর নিগ্রহ!

কুমিল্লার আম্বিয়ার কথা বলে লেখা শেষ করব। আম্বিয়াকে পাক সৈন্যরা ধর্ষণ করলে তিনি গর্ভবতী হয়ে পড়েন। স্বাধীনতার পর তাঁর সন্তান জন্ম নেয়। কিন্তু 'শিশুটি বৈধ নয়' এই ফতোয়া দিয়ে মসজিদের ইমাম শিশুটির মুখে লবণ দিয়ে তাকে মেরে ফেলে। শিশুটির জন্ম অবৈধ কিন্তু শিশুহত্যার কাজটি তার কাছে অবৈধ বলে মনে হল না!

সেখানেই যদি শেষ হত, তবু হয়তো কথা ছিল। বীরাঙ্গনা আম্বিয়া অবিবাহিত অবস্থায় সন্তান প্রসব করেছেন, তাই তিনি অসতী– এই মর্মে ফতোয়া জারি করা হয়। পরের চল্লিশ দিন আম্বিয়ার দু' হাতে চল্লিশটি করে বেত্রাঘাত করা হল। এর ফলে থেতলে যায় তাঁর হাতের পাতা দুটো। এরপর যতদিন বেঁচে ছিলেন, ভাইয়ের সংসারে দাসী হয়ে পড়ে ছিলেন। আম্বিয়া মারা গেছেন সম্প্রতি।

এই হচ্ছে আমাদের বীরাঙ্গনাদের জীবনের সুঁচে খোদাই করা নকশি কাঁথা।

আমি যখন বাংলাদেশে বীরাঙ্গনাদের মুখে তাঁদের উপেক্ষার জীবনের কথা শুনে যন্ত্রণায় নীল আর বিবর্ণ হচ্ছি, লন্ডনে তখন যুদ্ধে নারী ধর্ষণ বন্ধের জন্য ওয়্যার সামিট হচ্ছে। সামিটের জন্য বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, আর বাংলাদেশ এই সামিটের পক্ষে স্বাক্ষর করেছে ২০১৪ সালের মে মাসে।

শুধু তাই নয়, সামিটে পৃথিবীর সমস্ত যুদ্ধাক্রান্ত দেশ তাদের তথ্য-প্রমাণ-পোস্টার নিয়ে হাজির। অথচ যে দেশের মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে বেশি নারীধর্ষণ হয়েছে, যে দেশে ন' মাসে চার লাখের ওপর নারী-শিশুর জীবন বিপর্যস্ত হয়েছে, যে দেশ মায়ের সামনে সন্তানকে মেরে তারপর মাকে ধর্ষণ করার মতো পাশবিকতার সাক্ষী, যে দেশে মমতাজরা শরীরের স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারিয়ে ঝুলন্ত কোলন নিয়ে ঘুরে বেড়ান বিয়াল্লিশ বছর ধরে– সেই দেশের এই বীভৎসতার চিত্র দেখানোর জন্য আন্তর্জাতিক সম্মেলনে মিলল না একটি দেয়াল!

বুক ভেঙে যায়, দম বন্ধ হয়ে আসে। তবু থেমে যাওয়া চলবে না। এক কঠিন লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হচ্ছি আমরা। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন বীরমাতারা। মুক্তিযোদ্ধা ভাতা যাতে পৌছায় তাঁদের কাছে, সেই সংগ্রাম চালাতে হবে এখন। বীরাঙ্গনাদের নামের তালিকা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ছিল ৩১ জুলাই। কতজন প্রকৃত বীরাঙ্গনার নাম জমা পড়েছে কে জানে! তাদের প্রতি সহযোগিতার হাত আপনাকে আমাকেই বাড়াতে হবে।

আমাদের বীর জননীদের প্রাপ্য সম্মান দিয়ে তাঁদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার সময় এখনই। নয়তো জাতি হিসেবে আমাদের মুক্তি মিলবে না।


শাহমিকা আগুন:
লেখক, অ্যাকটিভিস্ট।