১৯৭১: এক বিদ্রোহী রাষ্ট্রদূতের পক্ষত্যাগের কাহিনী

আনাতুল ফাতেহ
Published : 29 Dec 2010, 01:30 PM
Updated : 29 Dec 2010, 01:30 PM

আমার বাবা এএফএম আবুল ফাতেহ ২০১০ সালের ৪ ডিসেম্বর মারা গেছেন। মুজিবনগর সরকারের গুরুত্বপূর্ণ যেসব ব্যক্তিত্ব বেঁচে ছিলেন তিনি তাদের মধ্যে অন্যতম । ওই সরকারে তিনি ছিলেন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের অবর্তমানে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনকারী সৈয়দ নজরুল ইসলামের উপদেষ্টা এবং রাষ্ট্রদূত হওয়ার সুবাদে সর্বোচ্চ সরকারি কর্মকর্তা। উল্লেখ করার মতো নানা ঘটনা রয়েছে তাঁর জীবনে। তবে তিনি বোধ হয় সবচেয়ে বেশি স্মরণীয় ১৯৭১ সালের অগাস্টে এক ব্যতিক্রমী পরিস্থিতিতে পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতের চাকুরি ছেড়ে বাংলাদেশ সরকারে আসার জন্য। কর্তব্যরত রাষ্ট্রদূত হিসেবে প্রথম তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দেন।

বহু বছর এটা কোনো আলোচনার বিষয় ছিলো না। তাই আমি লিখতে চাইলাম: অনেক বেশি বিস্তারিত আলোচনা করলে এখনো দুই এক জন ব্যক্তির অসহায় বোধ করার সম্ভাবনা রয়েছে। যে কোনোভাবেই হোক না কেন এগুলোর অনেক কিছুই ২০০৩ সালে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক-এর একটি প্রামাণ্যচিত্রে (রানিং ফর ফ্রিডম: রোক্সানার গল্প) উঠে এসেছিলো। এখন প্রায় চার দশক পরে সব স্মৃতি মুছে যাওয়ার আগে ঘটনাগুলোর পুরো বর্ণনা বোধ হয় বলা উচিত।

১৯৭০ সালের শেষের দিকে ইরাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হয়ে বাগদাদে যাওয়ার আগে আমার বাবা কলকাতায় পাকিস্তানের ডেপুটি হাই কমিশনার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ওই সময় ইরাকের প্রেসিডেন্ট ছিলেন সাদ্দাম হোসেনের খালু আহমেদ হাসান আল-বকর। কিন্তু মূল ক্ষমতা ছিলো রেভোল্যুশনারি কমান্ড কাউন্সিলের ভাইস-চেয়ারম্যান সাদ্দাম হোসেনের হাতে। তখনো আমার বয়স ১৪ হয়নি। কিন্তু আমি ছিলাম খবরের পাগল। অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও ইরাকি সমাজে ক্ষমতাসীন বাথ পার্টির বর্বরতা সম্পর্কে বেশ সচেতন ছিলাম আমি এবং আরসিসি-এর অনেক অপ্রীতিকর ঘটনাও ছিলো আমার জানা। কেবল বিষয়গুলোই আমাকে আগ্রহী করতো তা নয়, বরং পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতের ছেলে হিসেবে আমি যে কোনো সময় খবর জানার সুবিধা পেতাম।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বাবা আমাকে ও আমার ছোটো ভাই এনাসুলকে বাবা-মার শোবার ঘরে ডেকে নিয়ে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের বক্তব্য শোনালেন। বক্তব্যটি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে সম্প্রচারিত হয়েছিলো। অস্পষ্ট কণ্ঠে–হুইস্কি খেলে যেমন হয়, হুইস্কির প্রতি তার আসক্তি ছিলো–ইয়াহিয়া খান  শেখ মুজিবুর রহমান (জনগণের কাছে ইতোমধ্যেই বঙ্গবন্ধু নামে পরিচিত) ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে তার সরকারের রাজনৈতিক সমঝোতার সমাপ্তি ঘোষণা করলেন। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে পাকিস্তানের ন্যাশনাল অ্যাসেমব্লিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে এবং পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সব আসনেই জিতেছে। আমার সামনে বাবা কোনো মন্তব্য করলেন না এবং আমি রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। বাবার ইরাক ছেড়ে যাওয়ার আগের মাসগুলোতে আমি বিদেশি সংবাদ মাধ্যমে পড়তাম এবং বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে দেখতাম ভবিষ্যৎ বাংলাদেশে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও তাদের দেশীয় দোসরদের গণহত্যা ও নিষ্ঠুরতার চিত্র। যেসব ঘটছে সেগুলো নিয়ে আমি কী ভাবছি বাবা সব সময় আমার কাছে তা জানতে চাইতেন। কিন্তু তার নিজের মানুষের ওপর ঘটা ওই গণহত্যা নিয়ে তিনি মা ছাড়া কারো কাছে কোনো সময়ই নিজের ভাবনার ইঙ্গিত দিতেন না।

১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার শপথ নিয়েছিলো। ওই সরকারের উপ রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছিলেন বাবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু। কারারুদ্ধ বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তিনি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। বাবার উত্তরসূরি হুসেন আলি ছিলেন কলকাতার ডেপুটি হাই কমিশনার এবং কলকাতা অচিরেই মুজিবনগর সরকারের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে। মুজিবনগর সরকার গঠনের আগেই নয়া দিল্লিতে নিয়োজিত দুই কূটনীতিক (দ্বিতীয় সচিব কেএম শেহাবুদ্দিন এবং দূতাবাসের সহকারি প্রেস সচিব আমজাদুল হক) ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানায় এবং বিশ্বব্যাপী বাঙালি কূটনীতিকরা ওই পথ অনুসরণ করা শুরু করে। তখনো কোনো বাঙালি রাষ্ট্রদূত তা করেনি। আর এ বিষয়টিই ছিলো পরিবর্তনের।

মালেক আমান নামের এক পাঠানের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়। বাবা দিল্লিতে পাকিস্তানি হাই কমিশনের কাউন্সিলর (কলকাতায় পোস্টিং হওয়ার অল্প কয়েক দিন আগে) থাকার সময় তিনি আমাদের বাবুর্চির কাজ করতেন।  পাঠান খুব দুঃখ করে বললেন, কেবল বাবা কলকাতায় দায়িত্ব পালন করলে কলকাতা মিশন কখনো পাকিস্তান সরকারের বশ্যতা অস্বীকার করতো না। এ কারণে তার  দুঃখ ছিলো।

তখন ইরাকে ভারতের রাষ্ট্রদূত ছিলেন কেআরপি সিংহ। বাগদাদের কারাদাত মরিয়ম এলাকায় পাকিস্তানি দূতাবাসে তিনি বাবার সঙ্গে এক সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাৎটি ছিলো অপ্রত্যাশিত–ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বৈরী সম্পর্ক থাকলেও কূটনৈতিক শিষ্টাচার মেনে চলা হতো। তারপর ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের এক সন্ধ্যায় তার স্ত্রী আগে থেকে না জানিয়ে আল মনসুর শহরের উপকণ্ঠে আমাদের সরকারি বাসভবনে আসেন। সন্ধ্যার পরপর হওয়ার অর্থ হচ্ছে তখন ইরাকি নিরাপত্তা বাহিনীর নিয়োজিত কোনো সদস্য বাবাকে পর্যবেক্ষণ করছিলো না। ধারণা করা হয়, কূটনীতিকরা সব সময় নজরদারির মধ্যে থাকেন। কিন্তু কোনো পর্যবেক্ষণকারী দেখলে মনে করবে এটা এক রাষ্ট্রদূতের স্ত্রীর ডাকে অন্যজন এসেছেন সামাজিক সাক্ষাতের জন্য এবং আমার মা ও মিসেস সিং ছিলেন পরস্পরের পরিচিত এবং তাদের মধ্যে বেশ ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিলো। তবে সাক্ষাৎ নিছক  সামাজিকতা ছিলো না। মা বিস্মিত হয়েছিলেন যখন গৃহপরিচারিকার কাছে জানতে পারলেন, মিসেস সিং শুধু মার সঙ্গে নয় বাবার সঙ্গেও দেখা করতে এসেছেন। মিসেস সিং তখন একটি চিঠির খাম বাবার হাতে ধরিয়ে দিলেন। সেটি ছিলো দায়িত্ব পালনকারী রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বাধীন মুজিবনগর মন্ত্রিসভার সদস্যদের স্বাক্ষরিত একটি চিঠি। তারা বাবাকে জানান, বাবা স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দিলে তারা খুশি হবেন এবং ইরাক থেকে আমাদের পরিবার নিরাপদে বাইরে নেওয়ার আয়োজন করবে ভারতীয়রা। চিঠিটি পড়ে এমনকি পাশে বসে থাকা মায়ের সঙ্গেও কোনো কথা না বলেই বাবা 'হ্যা' বলে চিঠিতে সই করলেন। সাধারণত বাবা সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে মায়ের সঙ্গে পরামর্শ করতেন। ১০ মিনিটেরও কম সময়ের সাক্ষাৎ শেষে মিসেস সিং উঠে গেলেন।

আমার বাবা-মা তখন খুব কঠিন পরিস্থিতিতে ছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানের বেলুচ বিদ্রোহীদের ইরাক সহায়তা করছে বলে অভিযোগ ্ওঠে। দু'দেশের সম্পর্কের মৃদু অবনতি ঘটার পর পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে ইরাক ছিলো খুব উৎসাহী। তাই বাংলাদেশকে বাবা সমর্থন দিচ্ছে বিষয়টির সামান্যতম ইঙ্গিত পেলেই বাবাকে ইরাক সরকার পাকিস্তানের কাছে হস্তান্তরে একটুও দ্বিধা করবে না-এ ব্যাপারটি ছিলো সন্দেহাতীত। এ পরিস্থিতিতে পুরো পরিবার নিয়ে অন্যদের চোখ এড়িয়ে কীভাবে ইরাক ছাড়বে?

আমার বাবা-মা ঘোষণা করলেন, আমার ভাইকে ও আমাকে ইংল্যান্ডে আবাসিক স্কুলে পাঠাতে চান। এটা ছিলো পুরোপুরি যৌক্তিক সিদ্ধান্ত। কারণ কূটনীতিক হওয়ার আগে প্যারেন্টস ন্যাশনাল এডুকেশনাল ইউনিয়ন নামের একটি ইংলিশ টিউটোরিয়াল ইনস্টিটিউশনের সঙ্গে সম্পর্কিত থেকে সব সময় ব্রিটিশ স্কুলগুলোতে যেতেন বাবা। তখন বাবা আমাদের পড়াতেন। আমাদের বাড়িতে তখন অন্য রকম পরিস্থিতি, যাওয়ার জন্য আমরা প্রস্তুত। লেখাপড়ার জন্য আমি ও আমার ভাই ইংল্যান্ডে যাচ্ছি। তবে সেটি কেবল ভাই ও আমার জন্য ঘটলো না। ইংল্যান্ডে ছোটো ভাই ও আমার লেখাপড়া শুরু করতে সঙ্গে বাবা-মারও ব্রিটেনের ভিসা পাওয়া গেলো। বাবার সঠিক কর্তব্য পালনের জন্য এটা ছিলো জরুরি।

পাকিস্তানের সামরিক সরকারের বক্তব্য নিয়ে বাগদাদে নিয়োজিত অন্য দেশের রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিকদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যেতে লাগলেন বাবা। ইসলামাবাদ সরকারের প্রতি সমর্থন প্রকাশের জন্য যে ধরনের আগ্রহ থাকতে হয় তা বোধ হয় বাবা সব সময় দেখাতে পারতেন না। তার এক ব্যক্তিগত সচিব ছিলেন বাঙালি। তিনি মনে হয় কিছু সন্দেহ করতেন কারণ তিনি বাবাকে একটি দামি কলমের সেট দেওয়ার জন্য জোরাজুরি করেছিলেন।

সেসময় বাবা আমার পদার্থ ও রসায়ন বিজ্ঞান প্রাইভেট পড়ার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ইরাকের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন–ইরাকে উর্ধ্বতন অবস্থানে থাকা গুটিকয়েক নারীর মধ্যে তিনি ছিলেন একজন। এ দুটি বিষয় দীর্ঘ দিন আমি পড়িনি। স্বাস্থ্যমন্ত্রী আয়োজন করলেন, বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই ইনস্টিটিউশনের ডিন নিজেই আমাকে পড়াবেন। ১৪ বছর বয়সে আমি নিয়মিত বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া শুরু করলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক অনুষ্ঠানে বাবা প্রধান অতিথি ও পুরস্কার প্রদানকারী ছিলেন। আমাকে না জানিয়ে বাবা বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয় সফর করেন যাতে বোঝা যায়, তিনি বাগদাদে স্বাচ্ছন্দ বোধ করছেন। এটা ছিলো তার আসল উদ্দেশ্যকে ঢেকে রাখার কৌশল।

বাবার বাংলাদেশের স্বাধীনতযুদ্ধে যোগ দেওয়ার ব্যাপারটি খুব অল্প কয়েক জন জানতো: আমার মা, ভারতের ও বাংলাদেশের মন্ত্রিসভার সদস্যরা, গুটিকয়েক ভারতীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তা এবং অবশ্যই কেআরপি সিংহ ও তার স্ত্রী এবং বাগদাদে ভারতীয় দূতাবাসের আর দু'একজন কর্মকর্তা। বাবা সব সময় ভারতীয় দূতাবাসের গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে গোপনে দেখা করতেন। একজনের উপস্থিতির ইঙ্গিত পেয়ে তিনি আমাদের আল মনসুরের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পাশের একটি ক্ষুদ্র পার্কে গেলেন এবং আমদের যাওয়ার আয়োজনের ব্যাপারে আলোচনা করে ফিরে আসলেন। আমার মনে আছে নিচতলায় আমার শোবার ঘরে হঠাৎ জেগে উঠে আমি একটা কণ্ঠস্বর শুনতে পাই। আমি সিড়ি দিয়ে সবচেয়ে উঁচুতে উঠে নিচে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করলাম কোথা থেকে শব্দ আসছে। তখন এতো ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলাম যে, এ বিষয়ে বেশি চিন্তা করতে পারছিলাম না। আবার ঘুমোতে চলে যাই।

তার পরপরই খারাপ খবর আসে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তেহরানে আঞ্চলিক রাষ্ট্রদূতদের তলব করেন। তেহরানে তখন তুরস্ক, ইরান ও পাকিস্তানের ত্রিপক্ষীয় জোট সেন্ট্রাল ট্রিটি অর্গানাইজেশনের একটি বৈঠক হবে। আমার বাবাকে তলব করা হয়। ভারতীয়দের তখন আশংকা হলো, বাবা বোধ হয় পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের সন্দেহের মধ্যে রয়েছেন। তারা ভয় পেয়েছিলো যে, তিনি  তেহরান থেকে বাগদাদে ফিরে আসতে পারবেন না। কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রীর তলব প্রত্যাখান করা যাচ্ছিলো না। তাই পরিকল্পনায় হঠাৎ বড় ধরনের পরিবর্তন আনার প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

বাবা তার কর্মকর্তাদের বলেন, তিনি তার অফিসের গাড়ি নেবেন এবং সড়ক পথে বাগদাদ থেকে তেহরানে যাবেন। সেটি ছিলো প্রায় ৭০০ কিলোমিটারের দূরত্ব। ১৯৭১ সালের ১৫ অগাস্ট ছিলো তার যাত্রা করার তারিখ। নির্ধারিত দিন এলো। দূতাবাসের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ছিলো রাফিদায়িন ব্যাংকের কারাদাৎ মরিয়ম শাখার সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং বাবা রাষ্ট্রদূত হওয়ায় নিজের সই দিয়ে অ্যাকাউন্টের লেনদেন করতে পারতেন। বাবা ব্যাংক ম্যানেজারকে জানালেন যে, দূতাবাসের তহবিল থেকে তার টাকা তোলা দরকার এবং ব্যাংক বন্ধ হওয়ার অল্প কিছুক্ষণ আগে তিনি আসবেন। ব্যাংক বন্ধ হওয়ার পৌনে এক ঘণ্টা পরে বাবা গেলেন। তিনি জানতেন, ব্যাংক ম্যানেজার পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতের জন্য অপেক্ষা করবেন এবং পৌনে এক ঘণ্টা দেরিতে সেখানে কোনো প্রত্যক্ষদর্শী না থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হবে। দূতাবাস তহবিলের পুরো টাকাটাই বাবা তুললেন। মোট অর্থের পরিমাণ ছিলো ২৮ হাজার পাউন্ড। সেকালে এটা বেশ বড় অংকের টাকা ছিলো। সৌভাগ্যবশত, ব্যাংক ম্যানেজার তাৎক্ষণিকভাবে এ ধরনের অস্বাভাবিক লেনদেনের বিষয়টি ইরাকি কর্তৃপক্ষের নজরে আনেননি। মুজিবনগর সরকারের ব্যবহারের জন্য টাকাটা বরাদ্দ হয়েছিলো। টাকাটা পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব ছিলো ভারতীয় দূতাবাসের।

চালক নিয়ে তেহরানের পথে বাবা যাত্রা করেন। ইরান সীমান্তের কাছাকাছি পৌঁছে বাবা চালককে বলেন তিনি বুকে ব্যাথ্যা অনুভব করছেন। নির্দেশ মতো চালক বাসায় ফিরে এলো। সন্ধ্যার দিকে গাড়ি আল মনসুর শহরে পৌঁছালো। বাবা তখন বললেন, তিনি বেশ ভালো বোধ করছেন। আগামীকাল বিমানে তেহরান যাত্রা করার কথা জানিয়ে বললেন, চালককে আর দরকার নেই এবং সে তার নিজের বাড়িতে যেতে পারে।

বাবার ফিরে আসা দেখে আমি চমৎকৃত হয়েছিলাম। কিন্তু তিনি আমার সঙ্গে একটি কথাও না বলে তাদের শোবার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লেন। মা আমাকে ও আমার ভাইকে বললেন, বাবার ভালো লাগছে না। কিছুক্ষণ পর তিনি নেমে এলেন। আমাদের বাসার দু'জন কাজের লোককে সেদিন সন্ধ্যায় কিছু টাকা দিয়ে স্থানীয় সিনেমায় একটি সিনেমা দেখার জন্য ছুটি দেওয়া হয়েছিলো। তারা দু'জনই ছিলো বাঙালি। তারা মূল ঘর ছেড়ে তাদের কোয়ার্টারে চলে গেলে মা পিছন দরজা লাগিয়ে দেন। বাবা-মা তখন আমাদের দুই ভাইকে তাদের শোবার ঘরে ডাকলেন। বাবা শান্তভাবে আমাদের জানালেন যে, ওই সন্ধ্যায় আমরা লন্ডনের উদ্দেশ্যে ইরাক ছাড়ছি। কারণ তিনি বাংলদেশের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিচ্ছেন। আমাদের যাওয়ার জন্য সব কিছু প্রস্তুত। কিন্তু তার মধ্যে আমরা কোনো ফোনের উত্তর দিতে পারবো না বলে জানিয়ে দেওয়া হয়। সে রাতে আমাদের বাসায় অনেক ফোন এসেছিলো। গভীর উৎকণ্ঠা নিয়ে আমি ফোন বাজার শব্দ শুনেছিলাম। আমি সে সময় জানতাম না। কিন্তু আমার বাবার গাড়ি চালক দূতাবাসের প্রথম সচিবের সঙ্গে যোগাযোগ করে  রাষ্ট্রদূতের ফিরে আসার কথা এবং বাবার পরের দিন বিমানে তেহরান যাওয়া দরকার বলে জানায়। বাবার স্বাস্থ্যের খবর নিতে ও তেহরানের ফ্লাইট বিষয়ে নির্দেশ পেতে বাবার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছিলেন তিনি। সৌভাগ্যবশত টেলিফোনে না পেয়ে তিনি আমাদের বাসায় আসেননি।


ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগের পর ফিরে বাবা বাড়ি থেকে বের হয়ে তার সাধারণ সঙ্কেতস্থলে যান। তার পরপরই একটি ভ্যান আমাদের বাড়িতে আসে এবং আমাদের নেওয়ার মতো মালামাল তাতে তোলা হয়। মালামাল নিয়ে ভ্যানটি চলে যায়। লন্ডনে আমরা যেসব জিনিসপত্র নিতে পারি সেগুলো দিয়ে মা স্যুটকেস গোছাতে থাকেন। বড় একটি কালো গাড়িও আমাদের বাড়িতে আসে। বাড়ির সামনের দরজা ছিলো বন্ধ এবং ওই কালো গাড়িতে করে আমাদের ভারতীয় দূতাবাসে নেওয়া হয়

আমাদের রাতের খাবারের জন্য বিভিন্ন ধরনের ও প্রচুর খাবার রাখা হয়েছিলো। ভারতীয় রাষ্ট্রদূত, তার স্ত্রী ও উপস্থিত অন্যান্য ভারতীয় আমাদের দিকে গভীর মনোযোগ দিচ্ছিলেন এবং আমাদের উপস্থিতিতে আমাদের প্রতি তাদের যে শ্রদ্ধা হয়েছিলো এবং যে আনন্দ তারা পেয়েছিলো তা তারা প্রকাশ করতে পারেনি। দুর্ভাগ্য, আমার কোনো ক্ষুধা ছিলো না।

ওই রাতের খাবারের আয়োজন আমার কাছে মনে হয়েছিলো সাময়িক বিরতি। আমরা আবার গাড়িতে উঠে বসলাম। আমাদের নিয়ে যাওয়া গাড়ির সঙ্গে এক ভারতীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তার গাড়ি গিয়েছিলো। আমরা কুয়েত সীমান্তের দিকে যাত্রা করলাম।

রাতের অন্ধকারে বশরার জলাভূমি দিয়ে কুয়েত সীমান্তে যাওয়ার পথে আমরা ব্যাঙ ও কীট পতঙ্গের শব্দ শুনতে পেলাম। সব সময় সামনে ও পিছন দিক থেকে অন্য গাড়ির আলো আমাদের গাড়ির ওপর এসে পড়ে এবং প্রতিবার আমি এই ভেবে চমকে উঠি যে, ইরাকি নিরাপত্তা বাহিনী কি আমাদের ফ্লাইট সম্পর্কে জানতে পেরে আমাদের আটকাতে আসছে নাতো! ১৯৭১ সালের ১৬ অগাস্ট ভোরে আমরা ইরাকের কুয়েত সীমান্তে পৌঁছালাম।

আমাদের সময়টি শুভই ছিলো । কারণ আমরা দিনের প্রথম ভ্রমণকারীদের দলে ছিলাম। আমাদের গোয়েন্দা কর্মকর্তা গাড়ি থেকে বের হয়ে এসে আমাদের পরিবারের পাকিস্তানি কূটনৈতিক পাসপোর্ট নিয়ে নেন। আমি আতঙ্কগ্রস্ত ছিলাম। পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতের পাসপোর্ট ভারতীয় কূটনৈতিক পাসপোর্টের পাশে রাখলে সীমান্ত বাহিনীর কর্মকর্তারা কি ভাববেন?  গাড়িতে নিস্ক্রিয়ভাবে বসে না থেকে ডেস্কে গিয়ে আমাদের নিয়তিতে কী ঘটে তার মুখোমুখি হওয়াই ভালো মনে হলো আমার। তাই আমি ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তার সঙ্গে নিরাপত্তা চৌকিতে ঢুকে পড়লাম।

সীমান্তে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা আমার সঙ্গীকে আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়ে এবং তাদের তিনি সব পাসপোর্ট দিয়ে দিলে আমার আতঙ্ক আরো বেড়ে যায়। তারপর তিনি হাসতে হাসতে আমাকে বললেন, ওই কর্মকর্তা একজন পাকিস্তানি। কর্মকর্তাও তার সঙ্গে হাসলেন। তারপর আমি বুঝলাম কী ঘটছে। ওই পাকিস্তানি একজন ভারতীয় গুপ্তচর হিসেবে কাজ করছে এবং আমরা নিরাপদে সীমান্ত অতিক্রম করা পর্যন্ত তিনি উপস্থিত ছিলেন। ওই সীমান্ত তল্লাশি চৌকি দিয়ে আমাদের পরিবারের ইরাক ছাড়ার কোনো প্রমাণ না থাকার বিষয়েও তিনি নিশ্চিত হন।

ভাগ্য আমাদের সহায় ছিলো। খুব ভোরে দুটি কূটনৈতিক গাড়ি ওই সীমান্ত তল্লাশি চৌকিতে কেন তা জানার আগ্রহ থেকেও কোনো ইরাকি কর্মকর্তা কোনো পদক্ষেপ নিলেন না। আমরা কুয়েত সিটিতে পৌঁছে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের স্থানীয় কার্যালয়ে গেলাম।  ম্যানেজারকে আগেই নির্দেশ দেওয়া হয়েছিলো কিছু বিশেষ যাত্রী এখান থেকে ভ্রমণ করবে এবং তাদেরকে সাধারণ মানুষের নজরের বাইরে রাখতে হবে এবং ওই কার্যালয়ের পেছনের কক্ষে ছিলাম আমরা। সেখান থেকে আমরা কুয়েত বিমান বন্দরে যাই। লন্ডনগামী একটি বিওএসি ফ্লাইটে আমাদের জন্য সিট রাখা হয়েছিলো।

সে সকালে বাগদাদে বেশ কিছু  চমকপ্রদ ঘটনা ঘটে। আমাদের নম্বরে একের পর এক ফোন করে কোনো উত্তর না পেয়ে প্রথম সচিব এবং দূতাবাসে সংযুক্ত সামরিক কর্মকর্তা সকালে আমাদের বাসায় এসে কাজের লোকদের বাইরে অপেক্ষা করতে দেখে এবং দেখে দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। তখন দুই কর্মকর্তা দরজা ভেঙে বাসায় ঢুকে দেখে আমরা ও আমাদের জিনিসপত্র কিছুই নেই। আমাদের নিখোঁজ হওয়া নিয়ে তারা দ্রুত ইরাকি ও পাকিস্তানি সরকারকে জানাতে যায়। দূতাবাসের তহবিল খালির বিষয়টিও তারা তাড়াতাড়িই জানতে পারে।

পরবর্তীতে প্যারিসে ইরাকের রাষ্ট্রদূত (তখন তিনি ইরাকের পররাষ্ট্র সচিব ছিলেন) বাবাকে বলেন, আমাদের কি ভয়ঙ্কর পরিণতি হতো সে বিষয়ে কোনো ধারণাই বাবার ছিলো না। তারা ও পাকিস্তান সরকার জোরালোভাবেই  সন্দেহ করতো, বাবা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতি সমর্থন দিয়েছেন। কিন্তু আমরা কোথায় গেছি সে বিষয়ে তাদের কাছে কোনো তথ্য ছিলো না। ইরাকের উত্তরাঞ্চলের কুর্দি বিদ্রোহীরা আমাদের অপহরণ করেছে বলেও ধারণা করেছিলো ইরাকি কর্তৃপক্ষ। সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে দেশের মধ্য থেকে আমাদের খুঁজে বের করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিলো ইরাকের পুরো গোয়েন্দা নেটওয়ার্ককে। সেসময় বাগদাদ বিমান বন্দর থেকে ছাড়ার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া বিমানগুলোতে তল্লাশি চালানো হয় এবং যেসব বিমান অল্প সময় আগে ছেড়ে গিয়েছিলো সেগুলোও ফিরিয়ে এনে তাতে তল্লাশি চালানো হয়।

কুয়েত বিমান বন্দরে আমরা বিওএসি কাউন্টারে যাই। বিওএসি-এর এক প্রতিনিধি যাত্রীদের নামের তালিকার সঙ্গে আমাদের পাসপোর্ট মিলিয়ে দেখছিলেন। যাত্রীদের নামের তালিকায় আমাদের নাম ছিলো না। তখন একজন ভারতীয় দৌঁড়ে ডেস্কে গিয়ে ওই প্রতিনিধির দিকে হাত নাড়েন। তিনি কুয়েতে বিওএসি'র সহকারি ব্যবস্থাপক। যাত্রীদের তালিকায় আমাদের নামের বদলে চারটি ভুয়া নাম দেওয়া হয়েছিলো। কুয়েতে বহু ইরাকি এজেন্ট ছিলো এবং কুয়েত বিমান বন্দর থেকে যাত্রার বিষয়টি গোপন করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলো ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা।

১৯৭১ সালের ১৬ অগাস্ট বিকালে আমরা হিথ্রো বিমান বন্দরে পৌঁছালাম। তখন  বিমান বন্দরে নেমে আমি এতো বেশি স্বস্তি বোধ করেছিলাম যে জীবনে আর কখনো তা হয়নি এবং আমি অনুভব করলাম আমার বাবা-মায়ের স্বস্তিও ছিলো আমারই মতো।

স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দেওয়া অন্যরা আমাদের চেয়ে বিপদের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু দেশের জন্য আমার বাবার মতো অল্প কিছু মানুষ স্বেচ্ছায় নিজেদের ও তাদের সন্তানদের জীবন চরম ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেন। আমাদের পরিবার  সুখী অবস্থা ছিলো। আমরা ছিলাম সুবিধা প্রাপ্তদের মধ্যে এবং তা সেভাবেই চলতে পারতো। ১৯৭১ সালের ১৫-১৬ অগাস্ট যে ঘটনাগুলো ঘটেছিলো সে সময় যদি আমরা ধরা পড়তাম তাহলে আমাদের প্রত্যেকের জীবনে আলাদা আলাদাভাবে বিভীষিকাময় পরিণতি নেমে আসতো। অন্তত আমার বাবার জীবন সীমিত হয়ে আসতো কোনো এক দুর্ভাগ্যজনক দুর্ঘটনায় যা ইরাকি কর্তৃপক্ষ যথাযথভাবে আয়োজন করতো। ভাগ্য সাহসীদের পক্ষে থাকে-এ বিষয়টি সত্য হয়েছিলো তখন।

বাবার ইরাক ছেড়ে যাওয়ার বিষয়টি প্রকাশ্যে এলে পাকিস্তান সরকার চরম ক্ষুব্ধ হয়। প্রথম রাষ্ট্রদূত হিসেবে অনেক বেশি নাটকীয় ঘটনার মধ্য দিয়ে পাকিস্তান সরকারের আনুগত্য ত্যাগ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দেওয়ায় বাবার পক্ষ ত্যাগের ঘটনাটি ছিলো পাকিস্তানের জন্য খুব খারাপ ঘটনা। কিন্তু দূতাবাসের তহবিল খালি করার জন্য বাবার নামে অপবাদ দেওয়া হয়। পাকিস্তান চায় এ অপরাধের জন্য ব্রিটিশ সরকার বাবাকে তাদের কাছে হস্তান্তর করুক। তবে ব্রিটেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বাবাকে নিশ্চিত করেন যে, পাকিস্তানের এ দাবি প্রত্যাখান করবে ব্রিটিশ সরকার। তারপরেও বেশ কিছু সময় বাবার মধ্যে সে আশঙ্কা থেকে যায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আবারো ব্ল্রাক ডিসেম্বর সৃষ্টির হুমকি দেয় এবং ১৯৭৩ সালে ফ্রান্সে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত থাকাকালে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে ফ্রান্সের পুলিশ বাবাকে ঘিরে রাখে। এর আগে সন্ত্রাসীরা বাবাকে লক্ষ্য করেই আরেকটি ব্ল্যাক ডিসেম্বর সৃষ্টির তৎপরতা চালাচ্ছে বলে তাদের সন্দেহের কথা জানায় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের গোয়েন্দারা।

এটা সম্ভবত সৌভাগ্যের বিষয় ছিলো যে, ১৯৭১ এর পর স্বাধীনতা যুদ্ধে তার ভূমিকা এবং পরবর্তীতে দেশের স্বার্থে তার কাজের কোনো স্বীকৃতি আমার বাবা কখনো চাননি। কারণ কখনোই সেগুলোর কিছু দেওয়া হয়নি। বরং আমার বাবা সব কিছু এড়িয়ে নিজেকে গুটিয়ে রাখতেন। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু বাবাকে তার উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন অব্যাহত রাখার এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দেন। প্যারিসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হওয়ার জন্য তিনি সে প্রস্তাব নাকচ করেন। তখন বঙ্গবন্ধু বলেন, রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন শেষে বাবা চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হতে পারবেন। পদটিতে তাকে সব সময় স্বাগত জানানো হবে বলে জানান তিনি। কিন্তু সরকারে এ ধরনের দায়িত্ব পালনের জন্য বাবাকে বিবেচনা করার সেটাই ছিলো শেষ ঘটনা। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যসহ বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ায় গভীরভাবে আহত হন আমার বাবা। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা প্যারিসে আমাদের বাসায় বেড়াতে আসার জন্য ব্রাসেলস থেকে যাত্রা করার ঠিক আগ মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর নিহত হওয়ার এ খবরটি প্রচারিত হয়। ১৯৫৬ সালের জানুয়ারিতে আমার মা বাবার বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু এবং তার সঙ্গে আমার বাবার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিলো। ১৯৭৫ এর ৩ নভেম্বর মুজিব নগর সরকারের সদস্যদের মধ্যে যাদের হত্যা করা হয় তারা ছিলেন বাবার বন্ধু। বাংলাদেশের সরকার ব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটে, কিন্তু তা ভালোর জন্য নয়। তবে ১৯৭১ সালে পরিবারকে চরম ঝুঁকির মধ্যে ফেলার পিছনে যে চেতনা ছিলো  তাতে অটল থাকেন আমার বাবা। ১৯৮২ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এরশাদের অমত সত্ত্বেও বাবা চাকরি থেকে অবসর নিয়ে বাস করার জন্য ঢাকা চলে আসেন। বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গায় বাবার বিশেষ দখল থাকায় তাকে সেক্ষেত্রে মূল্যায়ন করা হয় এবং ঢাকায় মায়ের সঙ্গে চুপচাপ ১০ বছর বাস করেন বাবা।

১৯৭১ সালে যে স্বপ্নের কারণে বাবা কাজ করেন সেটার সঙ্গে ঢাকায় বাবা-মার বাস করার সময় সমাজের প্রকৃত চিত্রের মধ্যে বৈপরীত্য বাড়তে থাকায় একাত্তরের অগাস্টের তার পদক্ষেপের স্মৃতিগুলো ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসতে থাকে। এতে তিনি অসহায় বোধ করতে থাকেন এবং ১৯৯২ সালে ব্রিটেনের অভিবাসী হয়ে আমাদের দুই ভাইয়ের সঙ্গে বাস করার জন্য বাবা-মা ব্রিটেনে চলে আসেন। যে বাংলাদেশের জন্য তিনি বিশাল ঝুঁকি নিয়েছিলেন সেখানে নয় এই লন্ডনেই জীবনের বাকি সময় কাটিয়ে বাবা মারা যান।

আবুল ফজল মুহাম্মদ আবুল ফাতেহ ১৯২৪ সালের ১৬ মে বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন এবং ২০১০ সালের ৪ ডিসেম্বর ব্রিটেনের লন্ডনে মারা যান। তিনি ১৯৭০-১৯৭১ মেয়াদে ইরাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত ছিলেন, ১৯৭১-১৯৭২ মেয়াদে বাংলাদেশের মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা ছিলেন, ১৯৭১-১৯৭২ মেয়াদে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব ছিলেন, ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ মেয়াদে ফ্রান্সে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন এবং ১৯৭৪-১৯৭৬ মেয়াদে ইউনেস্কোয় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন, ১৯৭৬-১৯৭৭ মেয়াদে ব্রিটেনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন এবং ১৯৭৭-১৯৮২ মেয়াদে আলজেরিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেন।

অনুবাদ : আজিজ হাসান সহ-সম্পাদক, আন্তর্জাতিক বিভাগ, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।