ঈদ উৎসব: বিকাশ থেকে বর্তমান

মুনতাসীর মামুন
Published : 28 July 2014, 02:24 PM
Updated : 28 July 2014, 02:24 PM

দেড়শ দু'শো বছর আগে ঢাকা ছিল নিতান্ত অস্বাস্থ্যকর, অসুন্দর নোংরা এক শহর; নিরানন্দ তো বটেই। তবুও প্রতিবছর বিশেষ বিশেষ সময়ে হঠাৎ দু-একদিনের জন্য বদলে যেত ঢাকা শহরের চেহারা। মেলা, রঙিন নিশান, লোকজনের ব্যস্ত চলাফেরায় ঢাকা পড়ে যেত শহরের নোংরা চেহারাটা। নিরানন্দ শহর দু-একদিনের জন্য হলেও ঝলমল করে উঠত, জমকালো সব মিছিল দেখতে সাড়া পড়ে যেত। এর মূলে ছিল কয়েকটি উৎসব– ঈদ, মুহররম ও জন্মাষ্টমী।

ঊনিশ শতক পর্যন্ত বর্তমান বাংলাদেশে, বিশেষ করে ঢাকা শহরে এ তিনটি উৎসবই ছিল প্রধান উৎসব। এ কথা ঠিক, মূলত তিনটি উৎসবই ধর্মীয়, কিন্তু মুহররম ও জন্মাষ্টমী ধর্মীয় গণ্ডি ছাড়িয়ে অনেকাংশে পরিণত হয়েছিল সর্বজনীন উৎসবে। ঈদ বা ঝুলন সে অর্থে ধর্মের গণ্ডি ছাড়াতে পারেনি। মুহররম বা ঈদ বাংলাদেশের বাইরে থেকে আমদানি করা হলেও অজস্র লোকায়ত উপাদান এদের আমদানিকৃত কঠোর শুদ্ধ চরিত্র বদলে দিয়েছিল। ফলে, এক সম্প্রদায়ের লোকের পক্ষে সম্ভব হয়েছিল আরেক সম্প্রদায়ের উৎসবে যোগ দেওয়া। এখানে একটি কথা উল্লেখ্য, ঈদ, মুহররম এবং জন্মাষ্টমী, এই তিনটি উৎসবেরই প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল মিছিল। জমকালো, উল্লাসমুখর সে মিছিল এখন স্মৃতি।

এখানে ঢাকার উৎসব ও ঝুলন-এর কথাই প্রধানত আলোচনা করব; আলোচনা সীমিত থাকবে ঢাকা শহরের মধ্যেই। আলোচনার শুরুতে ঈদ উৎসবের উৎস, তারপর ঢাকায় এর বিকাশ এবং স্থানীয়, সামাজিক ও লোকায়ত উপাদান কীভাবে সৃষ্টি করেছিল আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যের, তা তুলে ধরার চেষ্টাি করব।

মুসলমানদের গুরুত্বপূর্ণ দুটি উৎসব হচ্ছে ঈদ-উল-ফিতর ও ঈদ-উল-আজহা। আমাদের দেশে এ দুটি ধর্মীয় উৎসব পালিত হয় যথেষ্ট ধুমধামের সঙ্গে। ঈদ-উল-ফিতর আবার যুক্ত মুসলমানদের সবচেয়ে পবিত্র মাস রমজানের সঙ্গে। আর ঈদ-উল-আজহা যুক্ত পবিত্র হজব্রতের সঙ্গে। এখানে, এখন যেভাবে ঈদ পালিত হচ্ছে, একশ বা দেড়শ বছর আগেও কীভাবে পালিত হত ঈদ? এ দুই উৎসবের ওপর কী প্রভাব ফেলেছিল কৃষিজীবী মানুষের লোকায়ত বিশ্বাস?

প্রথমেই বলে রাখা ভালো, বিশ্বাসের সঙ্গে জিজ্ঞাসা মেলে না; জ্ঞানের উৎস জিজ্ঞাসা। আর রসূল (দ:) নিজেও বলেছেন, জ্ঞানার্জনের জন্যে প্রয়োজন হলে সুদূর চীনেও যেতে। সুতরাং বর্তমান আলোচনা সে পরিপ্রেক্ষিতেই, কারও ধর্মবিশ্বাসে আঘাত দেওয়ার জন্য নয়।

সম্প্রতি 'ইসলামি পার্বণের সামাজিক নৃতত্ত্ব' নামক এক প্রবন্ধে বাহারউদ্দিন সামগ্রিকভাবে ঈদ-উল-ফিতর ও ঈদ-উল-আজহা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। আলোচনা করেছেন তিনি রমজান, হজ সম্পর্কেও, মূলত প্রাচীন লোকবিশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে।

প্রবন্ধকার জানিয়েছেন, ''ঈদ, সওম এবং রমজানের মূল অর্থ তাদের উৎসভূমির ভিত্তিতেই। অনুমান হয় রোজার উপবাস জন্ম দিয়েছে কৃষিনির্ভর সমাজে, হয়তো-বা প্রাচীন সিরিয়ায়। রমজান মাস মুসলমানদের সবচেয়ে পবিত্র মাস এবং কোরানে একমাত্র এ মাসের কথাই উল্লেখ করা হয়েছে। এ মাসেই নাজেল হয়েছিল কোরান, প্রথম অহী পেয়েছিলেন মুহম্মদ (দ:), গিয়েছিলেন তিনি মেরাজে। বাহারউদ্দিনের মতে, মক্কা থেকে মদিনায় যাওয়ার আগে রমজানের সঙ্গে পরিচয় ছিল না মুসলমানদের। এর সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল হিজরতের পরেই। এ অনুমানের ভিত্তি– 'রমজান' শব্দটি আরবি 'রমজ' ধাতু থেকে আগত। রমজ মানে দাহ, তাপ। পুরনো আরবি শব্দতাত্ত্বিকদের ধারণা, চান্দ্রমাস চালু হওয়ার [চন্দ্রবর্ষই নিয়ন্ত্রিত করে মুসলমানদের উৎসব] অনেক আগে, প্রাচীনকালে গরমের মওসুমে এই মাস পড়ত বলে এর নাম হয় 'রমজান'।''

''রমজানের সঙ্গে উপবাসের আরবি প্রতিশব্দের ধ্বনিগত কোনো মিল নেই। উপবাসের আরবি প্রতিশব্দ হচ্ছে 'সওম'। এর অর্থের সঙ্গেও উপবাসব্রতের কোনো মিল নেই। এর অর্থ হল আরাম বা বিশ্রামে থাকা। হিজরতের পরেই সম্ভবত ইহুদি সিরিয়াক সূত্র থেকে উপবাসের প্রতিশব্দ হিসেবে 'সওম' শব্দটি গ্রহণ করেন মুহম্মদ (দ:)। কোরানের ১৯ নং সূরা মরিয়মের ২৭ নং আয়াতে 'সওম' শব্দটি আছে।''

''দ্বিতীয় হিজরিতে নির্দেশ এসেছিল অবশ্য কর্তব্য হিসেবে রজমান পালনের এবং এ উপবাসের সঙ্গে মিল আছে আবার পূর্বাঞ্চলীয় খ্রিস্টানদের, যারা নির্দিষ্ট সময়ে চল্লিশ দিন পালন করেন উপবাস। রমজান শেষে ঈদ-উল-ফিতর। ঈদের অর্থ উৎসব। তবে আভিধানিক অর্থ 'পুনরাগমন' বা বারবার ফিরে আসা। ধর্মীয় অনুষ্ঠানজ্ঞাপক অধিকাংশ শব্দের মতো ঈদ শব্দটি মূলত সিরিয়াক।''

আরও লিখেছেন তিনি, ''ঈদ শব্দটির অর্থের সঙ্গে আজকের অর্থের কোনো যোগাযোগ নেই, কিন্তু সামাজিক উৎসবের প্রকৃতিকে অর্থবহ করে তোলে তার আদি অর্থ। সামাজিক উৎসব বারবার ফিরে আসে আর ঈদ শব্দের আদি অর্থেও আছে তার ইঙ্গিত।

ঈদ শব্দটির আদি অর্থ ও তার আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকর্ম খতিয়ে দেখে মনে হয়, হয়তো এককালে এই ধরনের এক সামাজিক উৎসবের সঙ্গে পরিচিত ছিল সিরিয়াক জনগোষ্ঠী। হয়তো তার কৃষিজ আচারে অন্তর্ভুক্ত ছিল এই উৎসব এবং তাদের কাছ থেকেই আচার-অনুষ্ঠানজ্ঞাপকক শব্দের মতোই আরবরা আমদানি করেছেন এই উৎসসব ও তার প্রকৃতিকে।''

একই কথা প্রযোজ্য ঈদ-উল-আজহা ও হজ সম্পর্কে, যার সঙ্গে যোগ আছে 'আরব কিংবা অন্য কোনো সেমেটিক জনগোষ্ঠীর নবান্ন' উৎসবের। বাংলাদেশে যেভাবে এ উৎসব দুটি পালিত হত, তাতে আমরা দেখব সেখানে প্রভাব ফেলছিল কৃষিজীবী মানুষের লোকায়ত বিশ্বাস এবং সে লোকায়ত বিশ্বাস বিশ্লেষণ করলে সহজেই প্রমাণিত হয় সে মিথের যে এ দেশের মুসলমানরা বহিরাগত। কারণ, যেভাবে পালিত হত উৎসব দুটি, তাতে লোকায়ত বিশ্বাস, বা আরও নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে হিন্দু ধর্মের রীতিনীতির প্রভাব ছিল বেশি।

উৎসব হিসেবে বাংলাদেশের মানুষ ঈদের দিনটি কীভাবে পালন করতেন, সে সম্পর্কে অবশ্য খুব বেশি কিছু জানা যায় না। এ ধরনের উৎসব সম্পর্কে তথ্য পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল আত্মজীবনী, সাহিত্য বা সমসাময়িক সংবাদ-সাময়িকপত্রে। সাহিত্যে, সংবাদ-সাময়িকপত্রে ঈদের তেমন কোনো বিবরণ পাই না। আর হিন্দু বা মুসলমান যিনিই আত্মজীবনী লিখে গেছেন, তিনিই দুর্গাপুজো, জন্মাষ্টমী, মুহররম, এমনকি রথযাত্রা বা বিভিন্ন পুজোর কথা উল্লেখ করেছেন; করেননি উল্লেখ শুধু ঈদ সম্পর্কে। অবশ্য এ শতাব্দীর প্রথম দু-তিন দশকে যারা জন্মেছিলেন তাদের আত্মজীবনীতে ঈদ-উল-আজহা বা কোরবানি বা রমজান সম্পর্কে খানিকটা তথ্য আছে।

এ থেকে যদি সিদ্ধান্তে পৌঁছি যে, ঈদ-উল-ফিতর বাংলাদেশে তেমন বড় কোনো উৎসব হিসেবে পালিত হয়নি, তাহলে কি ভুল হবে? মনে হয় না। আজ আমরা যে ঈদের জন্য সাগ্রহে অপেক্ষা করি বা যে ঈদকে দেখি আমাদের একটি বড় উৎসব হিসেবে, তা চল্লিশ-পঞ্চাশ বছরের ঐতিহ্য মাত্র।

এর কয়েকটি কারণ থাকতে পারে। ঔপনিবেশিক আমলে যে উৎসব সবচেয়ে ধুমধামের সঙ্গে পালিত হত এবং যে ধর্মীয় উপলক্ষে সবচেয়ে বেশি ছুটি বরাদ্দ ছিল, তা হল ক্রিসমাস। এর কারণ স্বাভাবিক। ইংরেজরা ছিল শাসক। সুতরাং তাদের উৎসব যে শুধু জাঁকালো হত তা নয়, এ নিয়ে মাতামাতিও কম হত না। স্থানীয় ভদ্রলোকেরাও যোগ দিতেন ক্রিসমাসে। তৎকালীন বাংলার কলকাতা ছিল ক্রিসমাস উৎসব পালনের প্রধান কেন্দ্র। কারণ, কলকাতা ছিল রাজধানী এবং শাসকগোষ্ঠী ও শহরের সম্পন্ন ভদ্রলোকদের বেশিরভাগ সেখানেই থাকতেন। তবে গ্রামাঞ্চলের কথা দূরে থাক, শহর বা মফস্বলের সাধারণ মানুষের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক ছিল না।

ওই সময় বিত্ত-বিদ্যার দিক দিয়ে তুলনামূলকভাবে মুসলমানদের থেকে হিন্দুরা সম্প্রদায় হিসেবে এগিয়ে ছিলেন অনেক। ফলে ক্রিসমাসের পর সরকারিভাবে তো বটেই, সম্প্রদায়গত আধিপত্য এবং ঐতিহ্যের কারণেও এ অঞ্চলের দুর্গাপুজা হয়ে উঠল সবচেয়ে জাঁকালো এবং গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসব। সরকারি ছুটির পরিমাণ ঈদের থেকেও পুজোর জন্য ছিল বেশি। পুজোর ছুটিতে সম্পন্ন ভদ্রলোকরা বেরিয়ে পড়তেন ভ্রমণে। চাকরিজীবীরা ফিরতেন গ্রামের বাড়িতে; আসতেন জমিদাররা শহর থেকে প্রজাদের খোঁজখবর নিতে। বিত্ত ছিল তাদের। সুতরাং ধুমধামের সঙ্গে উৎসব পালনে বাধা ছিল না।

পুজো চলতো বেশ কয়েকদিন এবং সে উপলক্ষে হত যাত্রা, কবিগান, নাচ। গ্রামের সাধারণ মানুষের তো বিনোদন বলতে কিছু ছিল না [এখনও নেই], তাই ছেলে বুড়ো সবাই সাগ্রহে যোগ দিতেন উৎসবে। এসব কিছুর একটা ঝলমলে, রঙিন দিক ছিল, তাই পুজোর বর্ণনা আমরা প্রায় সব আত্মীজীবনীতেই পাই। অন্যান্য নথিপত্রেও পুজো সম্পর্কে আছে পর্যাপ্ত তথ্য।

ইংরেজ আমলের মুসলমান চাকুরেদের আবেদনপত্রে দেখা যায়, তাঁরা আবেদন জানাচ্ছেন ঈদে ছুটি বৃদ্ধির জন্য। কিন্তু কর্ণপাত করা হয়নি তাতে। আর ছুটি বৃদ্ধি করলেই-বা কী হত? বড়জোর গ্রামের বাড়িতে ফিরে পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে কয়েকদিন কাটিয়ে যেতে পারতেন। ঈদকে উৎসবে পরিণত করা সম্ভব ছিল না তাঁদের পক্ষে। কারণ গ্রামাঞ্চলে অধিকাংশ মুসলমান ছিলেন বিত্তহীন।

ঈদ মুসলমানদের প্রধান উৎসব হিসেবে পালিত না হওয়ার আকেটি কারণ, বিশুদ্ধ ইসলাম সম্পর্কে সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা। ফারায়েযী আন্দোলনের আগে গ্রামাঞ্চলে মুসলমানদের কোনো ধারণা ছিল না বিশুদ্ধ ইসলাম সম্পর্কে। ইসলাম ধর্মে লোকজ উপাদানের আধিপত্য ছিল বেশি [প্রায় ক্ষেত্রে হিন্দু রীতিনীতির]।

১৮৮৫-এর দিকে জেমস ওয়াইজ লিখেছিলেন, বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সরল অজ্ঞ কৃষক। ইসলাম ধর্মে যেসব বিজাতীয় রীতিনীতি প্রবেশ করেছিল তারা এখন তা উৎপাটন করতে চাইছে। কিন্তু এরপর ওয়াইজ যে উদাহরণ দিয়েছেন, তাতে মনে হচ্ছে, কৃষকরা এর পথ খুঁজে পাচ্ছেন না। লাক্ষ্য নদীর তীরে, কোরবানির ঈদের সময় গ্রামবাসীরা জমায়েত হয়েছেন ঈদের নামাজ পড়বেন বলে। কিন্তু জামায়েতের একজনও জানতেন না কীভাবে ঈদের নামাজ পড়তে হয়। তখন নৌকায় ঢাকার এক যুবক যাচ্ছিলেন। তাকে ধরে এনে পড়ানো হয়েছিল নামাজ।

অন্যদিকে, মুকুন্দরাম আবার চণ্ডীকাব্যে লিখেছিলেন, মুসলমানরা বড়ই ধার্মিক এবং প্রাণ গেলেও 'রোজা নাহি' ছাড়ে–

'ফজর সময়ে উঠি, বিছানা লোহিত পাটি

পাঁচ বেরি করয়ে নামাজ।

সোলেমানি মালা ধরে জপে পীর পয়গম্বরে

পীরের মোকামে সেই সাজ।

দশবিশ বেরাদরে বসিয়া বিচার করে,

অনুদিন কিতাব কোরান।

বড়ই দানিসমন্দ, কাহাকে না করে ছন্দ

প্রাণ গেলে রোজা নাহি ছাড়ে।'

মনে হয়, মুকুন্দরাম এ বর্ণনা লিখেছিলেন বহিরাগত মুসলমানদের দেখে।

মির্জা নাথানও বহিরাগত মুসলমানরা কীভাবে রমজান এবং ঈদ পালন করতেন তার বর্ণনা রেখে গেছেন। সম্রাট জাহাঙ্গীরের প্রতিনিধি সুবেদার ইসলাম খাঁ ঢাকায় রাজধানী স্থাপন করেছিলেন ১৬১০ সালে। নাথান ছিলেন তাঁর একজন সেনাপতি। বাংলাদেশের মুঘল অভিধানের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেছেন নাথান তাঁর গ্রন্থ 'বাহারিস্তান ই-গায়বী'তে। রমজান সম্পর্কে তিনি লিখেছেন–

''রমজান মাসের শুরু থেকে ঈদ পর্যন্ত প্রতিদিন বন্ধুবান্ধবরা পরস্পর মিলিত হত পরস্পরের তাঁবুতে। এটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল সাধারণ এক রীতি।''

ভারতের উত্তরাঞ্চল থেকে আগত মুঘলরা বাংলার সাধারণ মানুষের তুলনায় ইসলাম সম্পর্কে জানতেন বেশি। কিন্তু বিশুদ্ধ ধর্ম পালনে তাঁরা বেশি উৎসাহী ছিলেন না। ধর্ম আছে ঈদ মানে খুশি। সুতরাং, রমজান থেকেই মোটামুটি তারা সচেষ্ট থাকতেন যতটা পারা যায় আনন্দ নিংড়ে নিতে। সুরা পানেও এ সময় তাদের অনাগ্রহ ছিল না।

ঢাকার ঈদ প্রতিপালন সম্পর্কে সবচেয়ে পুরোনো তথ্যটি পাই আজাদ হোসেন বিলগ্রামীর 'নওবাহারই মুর্শীদ খান' গ্রন্থে। ঐতিহাসিক আবদুর রহিম সে গ্রন্থ অবলম্বন করে লিখেছেন–

''মুসলমানরা সুন্দর পোশাক পরিচ্ছদে সজ্জিত হয়ে শোভাযাত্রা করে ঈদগায় যেত। অবস্থাপন্ন ব্যক্তিরা উৎসবের সময় মুক্ত হস্তে অর্থ ও উপহারাদি পথে ছড়িয়ে দিতেন।''

এ বর্ণনা থেকে মনে হতে পারে, দু-তিনশ বছর আগে ঢাকায় বোধহয় খুব ধুমধামের সঙ্গে ঈদ পালিত হত। আসলে তা ঠিক নয়। এ বর্ণনাটির পরিপ্রেক্ষিত সঠিক নয়। আর এত ধুমধামের সঙ্গে ঈদ পালিত হলে অন্যান্য উৎসবের মতো ঈদের বর্ণনা থাকত বিভিন্ন গ্রন্থে। মূল ব্যাপারটি ছিল এ রকম [যদুনাথ সরকারের ইংরেজি অনুবাদ অবলম্বনে]–

''দ্বিতীয় মুর্শীদ কুলি খাঁর সময় (১৭২৯) জয় করা হয়েছিল ত্রিপুরা। ২৯ রমজান নবাব এ খবর পেয়ে এত উল্লসিত হলেন যে, তিনি যেন দুটি ঈদ পালন করছেন। ঈদের দিন, এ কারণে তিনি মীর সৈয়দ আলী ও মীর মোহম্মদ জামানকে আদেশ দিলেন গরিবদের মধ্যে এক হাজার টাকা বিতরণ করতে। ঢাকা কিল্লা থেকে এক ক্রোশ দূরে ঈদগা যাবার পথে রাস্তায় ছাড়ানো হয়েছিল মুদ্রা।''

তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে, ঈদের দিন যে হইচইটুকু হত তা বহিরাগত উচ্চপদধারী বা ধনাঢ্য মুসলমানদের মধ্যেই ছিল সীমাবদ্ধ। এ সবের সঙ্গে সাধারণ মানুষের ছিল যোজনব্যাপী ব্যবধান। আর রইসরাও ঈদের দিন 'পথে প্রচুর পরিমাণ টাকাকড়ি ছড়িয়ে দিতেন' না [একবার দেওয়া হয়েছিল বিশেষ কারণে]। তবে, কিছু দান-খায়রাত হয়তো করতেন।

এরপর এ শতকের আগের ঈদের বর্ণনা তেমন আর পাই না। তবে, মুঘলরা ঈদের গুরুত্ব দিতেন। তা বোঝা যায় বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গা [যেমন, ঢাকা, সিলেট] শাহী ঈদগাহের ধ্বংসাবশেষ দেখে। এ রকম একটি ঈদগা আছে ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকায়, যার কথা একটু আগেই উল্লেখ করেছি।

ধানমণ্ডির ঈদগাহটি মাটি থেকে চার ফুট উঁচু একটি সমতলভূমি। দৈর্ঘ্য এর ২৪৫ ফুট, প্রস্থ ১৩৭ ফুট। বিস্তৃত তিনদিকে। পশ্চিমে ১৫ ফুট উঁচু প্রাচীর, যেখানে রয়েছে মেহরাব বা মিম্বর। পাশ দিয়ে তখন এর বয়ে যেত পাণ্ডু নদীর একটি শাখা। এই শাখা নদী জাফরাবাদের সাতগম্বুজ মসজিদের কাছে মিলিত হত বুড়িগঙ্গার সঙ্গে।

শাহ সুজা যখন বাংলার সুবাদার তখন তাঁর আমাত্য মীর আবুল কাসেম ১৬৪০ সালে নির্মাণ করেছিলেন ঈদগাহটি। সুবাদার, নাজিম ও অন্যান্য মুগল কর্মকর্তারা নামাজ পড়তেন এখানে। ইংরেজ আমলে জরাজীর্ণ ও জঙ্গলাকীর্ণ অবস্থায় ছিল ঈদগাহটি।

ঐতিহাসিক তায়েশের বিবরণ থেকে জানা যায়, তবুও উনিশ শতকে [খুব সম্ভব শেষের দিকে] শহরের মুসলমানেরা ঈদের নামাজ পড়তেন এই ঈদগাহে এবং এখানে আয়োজন করা হত একটি মেলার। অনুমান করে নেওয়া যেতে পারে, ঈদ উপলক্ষে এখানে হত মেলা, যেখানে যোগ দিতেন শহর ও আশেপাশের এলাকার লোকজন।

এখানে বলে রাখা ভালো, যে, মুঘল আমলে ঈদের দিন ঈদগাহে যেতেন মুঘলরাই, সাধারণ মানুষের স্থান সেখানে ছিল কিনা সন্দেহ। তবে, তায়েশ উল্লিখিত মেলার বর্ণনা থেকে অনুমান করে নিতে পারি, উনিশ শতকের শেষে এবং এ শতকের গোড়ায় ঈদের দিন আনুষঙ্গিক আনন্দ হিসেবে সাধারণ মানুষ যোগ করেছিলেন একটি লোকায়ত উপাদান– মেলা। তায়েশের বর্ণনা ছাড়া [তা-ও সম্পূর্ণ নয়] মেলার কথা আত্মজীবনীতে অবশ্য তেমন পাওয়া যায় না। বয়োবৃদ্ধদের কাছে শুনেছি, ছেলেবেলায় ঈদ উপলক্ষে তাঁদের কোথাও কোথাও মেলা বসার কথা মনে পড়ে।

সম্প্রতি, আশরাফউজ্জামান তাঁর আত্মজীবনীমূলক এক নিবন্ধে এই মেলার কথা উল্লেখ করেছেন–

''ঈদের মেলা হত চকবাজারে এবং রমনা ময়দানে। বাঁশের তৈরি খঞ্চা ডালা আসত নানা রকমের। কাঠের খেলনা, ময়দা এবং ছানার খাবারের দোকান বসত সুন্দর করে সাজিয়ে। কাবলীর নাচ হত বিকেল বেলা।''

আবদুস সাত্তারও প্রায় একই কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁরা যে সময়ের কথা লিখেছেন তা সম্ভবত ত্রিশ-চল্লিশের দশক। চকবাজার, কমলাপুরে এখনও হয়তো সেই মেলার রেশ ধরে মেলা বসে।

ঈদ সম্পর্কে যে স্বল্প বিবরণ পাওয়া যায়, তা থেকে ধরে নেওয়া যায়, রমজান মাস থেকেই শুরু হত ঈদের প্রস্তুতি। এ উৎসবের শুরু হত রমজানের ঈদের চাঁদ দেখা থেকে। মনে হয়, এটি মুঘল প্রভাবের কারণ এবং তা সীমাবদ্ধ ছিল শহরে বিশেষ করে ঢাকার এবং মফস্বল বা গ্রামের সম্পন্ন বা মধ্যবিত্ত পরিবারের মধ্যে।

১৯৪৭-এর আগে, বাংলাদেশে একমাত্র ঢাকাতেই ঈদ যা একটু ধুমধামের সঙ্গে পালিত হত। ঢাকা ছিল পূর্ববঙ্গের প্রধান ও মুঘল শহর। তাই মুঘল ঈদের প্রভাব ছিল বেশি। তাছাড়া, এখানে থাকতেন নওয়াব ও অন্যান্য মুসলমান ধনাঢ্য ও শরীফ ব্যক্তিরা। ফলে ঈদ পেত পৃষ্ঠপোষকতা।

ঢাকার উপরের স্তরে যে রীতিনীতি চালু ছিল, তা হল খোসবাস বা সুখবাস সমাজ প্রভাবিত। হাকিম হাবিবুর রহমান লিখেছেন–

''ঢাকার সমাজ ব্যবস্থা ও তাহযীব তমুদ্দন মূলত আগ্রারই সমাজব্যবস্থা ও তখনকার তাহযীব-তমুদ্দন। কিন্তু এই সমাজ কাঠামোতে ইরানিদের আধুনিক তমুদ্দন যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছে। এদের মাধ্যমে শিয়া মত-সংশ্লিষ্ট লোকদের মধ্যেও প্রবেশ লাভ করেছে। এই ধর্মীয় মতবাদটি অজ্ঞাতসারে উর্দুভাষী সুন্নীদেরকেও প্রভাবিত করেছে।''

উনিশ শতকের শেষার্ধে ও এ শতকের প্রথম দু-তিন দশকের পরিপ্রেক্ষিতে এ মন্তব্য করেছিলেন হাকিম হাবিবুর রহমান। এর রেশ ঢাকা শহর থেকে এখনও মিলিয়ে যায়নি।

খোসবাস সংস্কৃতির একটি উদাহরণ ছিল ঢাকার ঈদের মিছিল। এ ধরনের মিছিল বাংলাদেশের কোথাও বেরোত না। এ সম্পর্কে জানা যায় আলম মুসাওয়ারের এক চিত্রমালা থেকে।

আলম মুসাওয়ার নামে এক শিল্পী, খুব সম্ভব উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ঢাকার ঈদ ও মুহররম মিছিলের ৩৯ টি ছবি এঁকেছিলেন, যা রক্ষিত আছে জাতীয় জাদুঘরে। এ চিত্রমালা দেখলে বোঝা যায়, নবাবি আমলের ঢাকার মুহররম ও ঈদ মিছিলের বর্ণাঢ্য রূপ ও ব্যাপকতা। ছবিগুলো দেখে অনুমান করে নিতে পারি, নায়েব নাযিমদের বাসস্থান নিমতলি প্রাসাদের ফটক থেকে [বর্তমান এশিয়াটিক সোসাইটির পেছনে] বিভিন্ন পথ ঘুরে, চকবাজার, হুসেনি দালান হয়ে সম্ভবত মিছিল আবার শেষ হত মূল জায়গায় এসে।

মিছিলে থাকত জমকালো হাওদায় সজ্জিত হাতি, উট, পালকি। সামনের হাতিতে থাকতেন নায়েব নাযিম। কিংখাবের ছাতি হাতে ছাতি বরদার, বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ছিল কাড়া-নাকড়া শিঙা। রঙবেরঙের নিশান মিছিলের রূপ দিত আরও খুলে। দর্শকরা সারি বেঁধে থাকতেন রাস্তার দু'পাশে, ছাদে। এঁদের মধ্যে ছিলেন দেশীয়, মুঘল। [বহিরাগত], ইংরেজ সাহেব, মেম। রাস্তায় রাস্তায় ফকির যেমন ছিল, তেমনি ছিল খেলা-দেখানেওয়ালা।

এ মিছিল কবে শুরু হয়েছিল, তা জানা যায়নি। খুব সম্ভব নায়েব নাযিমরা যখন থেকে নিমতলি প্রাসাদে এসে বসবাস শুরু করেছিলেন [অষ্টাদশ শতকে], তখন থেকেই এই মিছিলের শুরু। নওয়াবরা খুব সম্ভব এ মিছিলের অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন ঢাকার বিখ্যাত জন্মাষ্টমী মিছিল থেকে এবং নিজেদের আধিপত্য ও ঈদে জাঁকজমক দেখাবার জন্য শুরু করেছিলেন তাঁরা এ মিছিল।

ঈদের মিছিল আবার কবে ঢাকা থেকে মিলিয়ে গিয়েছিল, তাও জানা যায়নি। খুব সম্ভব উনিশ শতকের মাঝামাঝি ঢাকার নায়েব নাযিমদের বংশ লুপ্ত হয়ে গেলে, সমাপ্তি ঘটেছিল এ মিছিলের। কারণ, ধনাঢ্যের পৃষ্ঠপোষকতা ব্যতীত এ ধরনের মিছিল সংগঠিত করা দুরুহ।

এ শতকের বিশ-ত্রিশের দশকে ঢাকায় রমজানের শুরুতে ঘরবাড়ি মসজিদ সব সাফ সুতরো করে রাখা হত। রমজানের চাঁদ দেখার জন্য বিকেল থেকেই বড় কাটরা, আহসান মঞ্জিল, হুসেনি দালানের ছাদে ভিড় জমে যেত। ''চাঁদ দেখা মাত্রই চারিদিক হইতে মোবারকবাদ, পরস্পর সালাম বিনিময় এবং গোলাবাজি ও তোপের আওয়াজ হইতে থাকিত।''

ঢাকার রমজান ও ঈদের বড় আকর্ষণ ছিল খাবার। রোজায় ঘরে অনেক রকম ইফতারি থাকলেও সবাই একবার চকে ছুটে যেত। চক সেই মুঘল আমল থেকেই ব্যবসা-বাণিজ্য, খাবার-দাবার, আড্ডার কেন্দ্র। চকের ইফতারির কিছু বিবরণ রেখে গেছেন আবু যোহা নূর আহমেদ। খাবারগুলো ছিল– শিরমাল, বাকেরখানি, চাপাতি, নানরুটি, কাকচা কুলিচা, নানখাতাই, শিক কাবাব, হাড্ডি কাবাব, মাছ ও মাংসের কোফতা, শামি ও টিকা কাবাব, পরোটা, বোগদাদি রুটি, শবরাতি রুটি, মোরগ কাবাব, ফালুদার শরবত ও নানারকম ফল। চক এখনও প্রায় সে ঐতিহ্য বজায় রেখেছে।

ঢাকার তোরাবন্দি খাবার ছিল বিখ্যাত। বিশেষ বিশেষ উৎসবে এর ব্যবস্থা করা হত। তার মানে ঈদের দিন রইস আদমিরা তোরাবন্দি খাবারের আয়োজন করতেন। এ ধরনের খাবারের একটি বর্ণনা উদ্ধৃত করছি আবু যোহা নূর আহমদের লেখা থেকে–

''… রইসদের বাড়িতে এইসব খাবার প্রস্তুত হইত। নৌকা বানাইয়া লাল বানাতের নিচে সারি সারি বরতন ও পেয়ালা সাজাইয়া মেহমানদের সামনে এইসব খাবার রাখা হইত। এই খাবারের সারিতে থাকিত চারি প্রকারের রুটি; চারি রকমের পোলা ও চারি রকমের নানরুটি, চারি প্রকারের কাবাব; পানির বোরানি চাটনি অর্থাৎ প্রত্যেক পদের খাবার; চারি পদের থাকিত। মোট চব্বিশ পদের নিচে থাকিত না।''

ঈদ-উল ফিতর যেমন বাংলাদেশের বড় কোনো ধর্মীয় উৎসব হিসেবে পালিত হয়নি, তেমনি পালিত হয়নি ঈদ-উল আজহাও। না-হওয়ার একটি কারণ উনিশ শতকে সম্প্রদায়গত বিরোধ। আজকে আমরা যে ধুমধামে ঈদ-উল-আজহা পালন করি, তা চল্লিশ-পঞ্চাশ বছরের ইতিহাস মাত্র। সারা বাংলাদেশে সম্প্রদায়গত বিরোধ যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল, সে সম্পর্কে পর্যন্ত তথ্য আছে, নেই শুধু ঢাকা শহর সম্পর্কে। তবে, উনিশ শতকের শেষার্ধে গোটা বাংলাদেশ জুড়ে যখন গরু কোরবানি নিয়ে প্রবল বিতর্ক ও উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল, তখন ঢাকা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক 'সারস্বতপত্র' [গোড়া হিন্দুদের মুখপত্র] লিখেছিল [১৮৮৩]–

''এটা সত্যি যে ঢাকার সমাজের অনেক ক্রুটি ও দুর্নাম আছে। কিন্তু এখন যখন দেখি গরু কোরবানি নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলন চলছে সে সময় ঢাকা এসব থেকে মুক্ত। ঢাকার হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে নিখুঁত ভালো সম্পর্কই বিদ্যমান। উভয়ে উভয়ের ধর্মীয় উৎসবাদিতে যোগ দেয় এবং কেউ কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিতে চায় না। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের উচিত ঢাকাকে অনুসরণ করা।''