জুলাই মাসের ভাবনা, আলোকিত প্রজন্ম ও তাজউদ্দীন আহমদ স্মরণে

শারমিন আহমদ
Published : 22 July 2014, 06:40 PM
Updated : 22 July 2014, 06:40 PM

সম্প্রতি এই জুলাই মাসেই, পবিত্র রমজানের প্রারম্ভে এবং ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবল কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপী আনন্দ-উত্তেজনার মধ্যেই ঘটে গেল হৃদয়বিদারক কিছু ঘটনা। আমার নিকট দুই আত্মীয় পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। তাঁদের হারানোর ব্যথা সামলে উঠতে না উঠতেই যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সজ্জন-অমায়িক নাজমুল ইসলামের নৃশংস হত্যার খবরটি পেলাম। মনে হল অবিশ্বাস্য!

মাত্র গত ডিসেম্বর মাসেই তিনি নিজ উদ্যোগে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের পক্ষ হতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের কাণ্ডারি, প্রেসিডিয়াম সদস্য আম্মা সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের শোকসভার আয়োজন করেছিলেন। নিউ ইয়র্ক থেকে ঢাকায় ফোন করে আমাকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন। তার মাত্র সাত মাস পরে তিনি নিজেই হয়ে গেলেন শোক সংবাদ।

মৃত্যুটি স্বাভাবিক হলেও কিছুটা সান্ত্বনা পাওয়া যেত। তাঁর নির্মম মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত নিউ ইয়র্কের দুই তরুণের গ্রেফতার হওয়ার সংবাদে মনে হল পৃথিবীটা ক্রমশই কেমন নিষ্ঠুর হয়ে উঠছে। যে তারুণ্যের শক্তি জোগাবে স্বস্তি ও শান্তি, সেই শক্তিই সঠিক নীতি, মূল্যবোধ, পরিবেশ ও দিকনির্দেশনার অভাবে পরিণত হয়েছে হত্যা, বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতায়।

এই হৃদয়বিদারক হত্যাকাণ্ডের মাত্র দুদিন আগেই ৭ জুলাই থেকে গাজায় ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর ইসরায়েলের বর্বর হামলা শুরু হয়েছে যা থেকে দুধের শিশু পর্যন্ত রেহাই পায়নি। বিশ্ব বিবেক কেমন নির্বাক হয়ে রয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার আর্চ বিশপ ডেসমণ্ড টুটু, গুয়াতেমালার রিগোবারতা মেঞ্চু, উত্তর আয়ারল্যান্ডের বেটি উইলিয়ামস, আয়ারল্যান্ডের মেইরেড মেগির, আর্জেন্টিনার অ্যাডলফ এস্কুইভেল, যুক্তরাষ্ট্রের জোডি উইলিয়ামস, এই নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ীরাসহ ইসরায়েলি হামলা বন্ধ এবং ইসরায়েল সামরিক বাহিনীর ওপর এম্বারগো কার্যকর করার জন্য গুটিকতক প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ছাড়া বাকি প্রতাপশালীরা এবং বরাবরের মতোই আরব রাষ্ট্রপ্রধানরা নিদারুণ লজ্জাজনকভাবেই নিরব ও নিষ্ক্রিয়।

ষাট-সত্তর দশকে ভিয়েতনাম আক্রমণ কেন্দ্র করে তরুণদের যে বলিষ্ঠ প্রতিবাদ শোনা যেত বর্তমানে তেমন শোনা যায় না। নির্দয় হামলা, অন্যায় ও অবিচারের শিকার ফিলিস্তিনিদের আর্তনাদের সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে উক্রাইনে গুলিতে ভূপাতিত মালয়েশিয়ান বিমানের নিহত যাত্রীদের আত্মীয়-স্বজনদের আহাজারি, কান্না। মাত্র এই গত মার্চ মাসেই নিখোঁজ মালয়েশিয়ান বিমানে চিরতরে হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনদের হারানোর ব্যথা সামলাতে না সামলাতেই আবারও দুর্যোগ নেমে এল।

এই জুলাই মাসেই, ঈদুল ফিতর উদযাপনের কয়েক দিন আগের একটি বিশেষ দিনও স্মরণ করছি। ২৩ জুলাই আব্বুর জন্মদিন। শুধু ব্যতিক্রম হবে যে, এই প্রথমবারের মতো আম্মাকে আর এই দিনটি উপলক্ষে ফোন করা হবে না। ঈদের দিনটিতে তিনিও আর কোনোদিন ফোন তুলে শুভেচ্ছা জানাবেন না; জিজ্ঞেস করবেন না ঈদ কেমন হল। ২৩ জুলাই স্মরণে আব্বুকে কেন্দ্র করে যে কথা লিখব তাঁরা হয়তো পড়বেন– সেই অমর্ত্যলোকেই।

শাল, মহুয়া গজারি বনে ঘেরা, শীতলক্ষ্যা নদীর কূলঘেঁষা, গাজীপুর জেলার এক নিটোল সুন্দর গ্রাম দরদরিয়ায় আজ থেকে ঊনআশি বছর আগে যে শিশুটি জন্মগ্রহণ করে, সে-ই একদিন বড় হয়ে একটি জাতির, আমাদের এই প্রিয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সফল নেতৃত্ব দেন। পুকুরপাড়ে, আমবাগানের ধারে, টিনের চাল দেওয়া লাল এঁটেল মাটির দেয়াল এবং কাঠের সিঁড়ি ও কাঠের বারান্দায় ঘেরা বাংলো স্টাইলের দোতলা বাড়ি। তারই এক ঘরে ৭ শ্রাবণের দিবাগত রাত বৃহস্পতিবার, ইংরেজি ২৩ জুলাই, ১৯২৫ সালে বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ জন্মগ্রহণ করেন।

বাল্যকাল থেকেই লেখাপড়ায় প্রথম স্থান পাওয়া মিতভাষী এই মেধাবী শিশুটি ছিল ভিন্ন ধরনের। চিন্তাধারাও ব্যতিক্রমধর্মী। খেলাধূলার মধ্যে যখন ঝগড়া-বিবাদ হয় তখন তাতে অংশগ্রহণ না করে তিনি সম্প্রীতি রক্ষার জন্য মধ্যস্থতা করেন। নিজ হাতে পশু-পাখি ও গাছপালার পরিচর্যা করেন পরম মমত্বের সঙ্গে। পরিবেশ ও প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের নিবিড় যে সংযোগ রয়েছে এবং আমরা যে পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল যা আজকের পরিবেশ বিজ্ঞানে স্বীকৃত তা যেন তিনি সহজাতভাবেই আত্মস্থ করেন। অংশ নেন বয়েজ স্কাউটের পরিবেশ সংরক্ষণ ও সমাজসেবার নানাবিধ কর্মকাণ্ডে।

ধূমপানের অপকারিতা সম্বন্ধে যে যুগে মানুষ তখনও সচেতন নয়, সে সময় কিশোর তাজউদ্দীন গড়ে তোলেন ধূমপানবিরোধী সংগঠন। আকালের সময় অভাবী-দরিদ্রদের যাতে উপকার হয় সেজন্য এলাকার তরুণদের নিয়ে গঠন করেন পল্লী মঙ্গল সমিতি। সেই সমিতি ফসলের মৌসুমে ধনী কৃষকদের কাছ থেকে ফসল সঞ্চয় করে ধর্মগোলায় জমা দেয়, যা থেকে দুর্ভিক্ষের সময় অনাহারি, অভাবি ও দুঃস্থ মানুষেরা খাদ্য সংগ্রহ করতে পারে।

মহামারীর সময় মায়ের হাতের রান্না করা খাবার নিয়ে আক্রান্ত এলাকার অসহায়-রোগাক্রান্তদের যে কিশোর নিজ হাতে খাওয়ান, এতিমখানার বালকদের অধিকার রক্ষায়, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা রোধে এবং রেল স্টেশনে পড়ে থাকা এক অচেনা মৃতপ্রায় যাত্রীকে রক্ষার জন্য যে উদ্যমী তরুণটি এগিয়ে আসেন, তাঁর কাছেই যখন ন্যস্ত হয় একটি জাতির মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব এবং রাষ্ট্রপরিচালনার ভার– তখন তিনি যে একই আদর্শ ও আন্তরিকতা নিয়ে তাঁর দায়িত্ব পালন করবেন সেটা তো বিস্ময়ের ব্যাপার নয়।

বিস্ময়ের বিষয়টি হল যে, জাতীয় পর্যায়ে এমন এক বিশাল চিন্তা ও কর্মে দীক্ষিত নেতার উদাহরণ তুলে না ধরা। বিশেষত কিশোর ও তরুণদের জন্য তাঁর জীবন-কর্ম বাতিঘরের মতোই সঠিক পথে চলার দিকনির্দেশক হতে পারে এখনও এবং আজীবন। হাতেগোনা দু একটি ব্যতিক্রম ছাড়া বাংলাদেশের ঐতিহাসিক, রাষ্ট্র ও সমাজবিজ্ঞানীরাও তাজউদ্দীন আহমদকে নিয়ে যে মৌলিক কোনো গবেষণা করেননি, এটাও জাতির দুর্ভাগ্য।

নব্বই দশকে জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে 'পলিটিকাল সাইকোলজি' নামে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি কোর্স পড়ানো হত। একজন রাজনীতিবিদের শৈশব-কৈশোরের অভিজ্ঞতা এবং যে প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে তার মানসিকতার বিবর্তন ঘটেছে এবং সেগুলি তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কীভাবে প্রভাবিত করে থাকে তারই ওপরে কোর্সটিতে আলোকপাত করা হত।

তাজউদ্দীন আহমদের বাল্যকাল হতে যৌবনে পা দেওয়া ছাত্রজীবনটি পর্যালোচনা করলেও দেখা যায় যে, তিনি কী নিষ্ঠার সঙ্গেই না তিল তিল করে নিজেকে গড়ে তুলেছেন। তাঁর ছাত্রজীবনের লেখা ডায়েরিগুলি পড়লে বোঝা যায় যে, তিনি কী কঠোরভাবেই না নিজের সাধারণ ভুলত্রুটিরও সমালোচনা করতে দ্বিধাবোধ করছেন না। নিজের মনের আয়নায় নিজেকে মেলে ধরছেন আত্মশুদ্ধির একান্ত প্রচেষ্টায়। তরুণ বয়স থেকেই তিনি নিজেকে একাত্ম করেছেন জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সারা বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের মুক্তির সংগ্রামে। এভাবেই তিনি নিজেকে গড়ে তুলছেন একজন খাঁটি মানুষ, জনগণের সেবক রাজনীতিবিদ ও দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক রূপে।

আজকের রাজনৈতিক অঙ্গনে তেমন মানুষ কোথায়? যে তরুণরা ভবিষ্যতে বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেবে তাদের জন্য কি সুযোগ্য উদাহরণ ও পরিবেশ তৈরি হচ্ছে? প্রায়ই দেখা যাচ্ছে যে, তরুণরা নানাবিধ অপরাধ ও সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। তাদেরকে ব্যবহার করা হচ্ছে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য চরিত্র গঠনের বিকল্প নেই। সেই লক্ষ্যে মহৎ নেতা ও ব্যক্তিত্বদের নীতি ও আদর্শ তাদের সামনে তুলে ধরা আবশ্যক। তাঁদের আত্মত্যাগের উদাহরণ যেদিন তরুণপ্রাণ উজ্জীবিত করবে এবং তাঁদের চিন্তা ও কর্ম হবে প্রেরণার প্রজ্জলিত শিখা সেদিনই বাংলাদেশ খুঁজে পাবে তার আলোকিত ভবিষ্যৎ।

মুক্তিযুদ্ধের কাণ্ডারি তাজউদ্দীন আহমদের জন্মদিনে প্রার্থনা রইল তাঁর মতো এক নতুন শিশুর– এক আলোকিত প্রজন্মের জন্যে।

ম্যারিল্যান্ড

২১ জুলাই, ২০১৪

শারমিন আহমদ: শিক্ষাবিদ ও বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের জ্যেষ্ঠ কন্যা।