ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধ ও আন্তর্জাতিক সমাজের দায়

রুহুল আমিন
Published : 19 July 2014, 05:16 AM
Updated : 19 July 2014, 05:16 AM

তিন ইসরাইলি কিশোর নিখোঁজ ও নিহত হওয়ার পর গাজার হামাস যোদ্ধাদের এ ঘটনার জন্য দায়ী করে ইসরাইল ফিলিস্তিনের উপর উপর্যুপরি বিমান হামলা শুরু করেছে যা এখন বিশ্বব্যাপী আলোচনার বিষয়। ওই ঘটনার প্রেক্ষিতে ইসরাইল প্রথমদিকে হাজার হাজার হামাস-কর্মীকে গ্রেফতার করে তাদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে। কিন্তু এরপর শুরু হয় ফিলিস্তিনের সর্বত্র বিমান হামলা। জুলাই মাসের শুরুতে ইসরাইলি আক্রমণ শুরু হলেও দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে তা সর্বাত্মক বিমান ও স্থল হামলায় পর্যবসিত হয়েছে।

এসব হামলায় ৮ জুলাই থেকে এ পর্যন্ত প্রায় দু'শ নিরপরাধ ফিলিস্তিনির জীবনপ্রদীপ নিভে গেছে। আহত হয়েছেন হাজার হাজার। বাস্তুচ্যূত হন অসংখ্য আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা। গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মাদ্রাসা ও অন্যান্য স্থাপনা। ভয়ার্ত মৃত্যুপুরীতে পরিণত এখন গোটা ফিলিস্তিন।

ফিলিস্তিনের উপর ইসরাইলের এ সর্বব্যাপী জুলুম-নির্যাতনের কারণে ইসরাইলকে যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার অপরাধে অভিযুক্ত করা যায় কিনা তার একটি নির্মোহ বিশ্লেষণ প্রয়োজন। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সংস্থাসমূহের উচিত অতিদ্রুত ইসরাইলকে আন্তর্জাতিক আদালতের কাঠগড়ায় হাজির করানো। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য বৃহৎ রাষ্ট্রসমূহের উপর ঐতিহাসিক দায়িত্ব বর্তায় যে, তারা ইসরাইলের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করে ফিলিস্তিনি জনগণের মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করাসহ ফিলিস্তিনের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার (right of self determination) অর্জনের পথের সকল বাধা দূর করবে।

বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইহুদিদের এনে ফিলিস্তিনের ভূমিতে জোর করে পুনর্বাসিত করে এবং স্বতন্ত্র ও শক্তিশালী একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ করে দিয়ে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ফিলিস্তিনের উপর ইসরাইলের অত্যাচার-নির্যাতন চালানোর যে পথ উন্মুক্ত করেছে, তা বন্ধ করতে এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ই নৈতিক ও বাস্তবিকভাবে দায়বদ্ধ।

এখন আমরা ফিলিস্তিনের উপর ইসরাইলের সম্পাদিত অপরাধের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার উপর আলোকপাত করব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পর ফিলিস্তিনের ভূমিতে বলপূর্বক ইসরাইল রাষ্ট্রটি গড়ে তোলার পর আরব জাহানসহ সমগ্র বিশ্বে নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় উঠলেও, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পাশ্চত্য বৃহৎ রাষ্ট্রসমূহের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ইহুদি মৌলবাদী এ রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করে দাঁড় করানো হয়।

আরব এলাকায় একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হওয়া সত্ত্বেও অতিদ্রুত সেটি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের পথে অগ্রসর হয়। পাশাপাশি অবৈধ সে রাষ্ট্র ফিলিস্তিনি জনগণের উপর জুলুম-নির্যাতনের স্টিম রোলার চালাতে থাকে। জাতিসংঘ, আরব লীগসহ আন্তর্জতিক সংস্থাসমূহ সে অত্যাচারমূলক কার্যাবলীর নিন্দা করলেও, ইসরাইরেল বর্বরতা এতটুকু হ্রাস পায়নি, বরং দিনে দিনে তা ভয়ংকর রূপ নিয়ে বর্তমান সময়ে ফিলিস্তিনিদের সমূলে ধ্বংস করে (ethnic cleansing) ফিলিস্তিনের অবশিষ্ট ভূমিতে ইসরাইলি রাষ্ট্রের সম্প্রসারণের পথ তৈরি করছে।

১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৭২-৭৩ সাল পর্যন্ত ইসরাইল সমস্যা কেন্দ্র করে আরবদের সঙ্গে ইসরাইলের বেশ কয়েকটা যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। ওইসব যুদ্ধে পাশ্চাত্য শক্তিসমূহ সরাসরি ইসরাইলকে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে সহযোগিতা করে ইসরাইলের পাশবিকতার মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। ফিলিস্তিনের উপর ইসরাইলের নানা নির্যাতনমূলক অপরাধ সংঘটন ও অনৈতিক যুদ্ধ চালানোর কারণে জাতিসংঘ নানা সময়ে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব গ্রহণ করলেও, তা বাস্তবায়িত হয়নি বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর ইসরাইলের প্রতি সমর্থনের কারণে।

ফিলিস্তিনকে দুর্বল করতে ইসরাইল বরাবরই মানবতা, সভ্যতা, ন্যায়-নীতি বিসর্জন দিয়ে নানাবিধ কৌশল অবলম্বন করেছে। প্রথমেই তারা ফিলিস্তিনিদের ঐক্য ও সংহতি বিনষ্ট করতে জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করার চেষ্টা করে। তাতে তারা সফলও হয়। আমরা অবাক বিস্ময়ে মজলুম ফিলিস্তিনিদের হামাস ও ফাতাহ্ এ দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত হতে দেখেছি।

ফাতাহ্ অনেকটা পাশ্চাত্য ধাঁচের, বেশভূষায়, আচরণে এবং নীতি-কৌশলে। কিন্তু হামাস প্রথম থেকেই প্রতিবাদী, পাশ্চাত্যবিরোধী ও জাতীয়তাবাদী। দেশমাতৃকার স্বাধীনতা, মুক্তি ও সার্বভৌমত্বের জন্য হামাস সশস্ত্র সংগ্রামে রত। আর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্য ফাতাহ্ পাশ্চাত্য-তোষণনীতিতে (policy of appeaxment) অভ্যস্ত।

ইসরাইলের এ জাতিবিভাজন কৌশল দীর্ঘ বছর ধরে সফলভাবে কার্যকর হলেও, হঠাৎ করে ২৩ এপ্রিল প্রতিদ্বন্দ্বী এ দুটি গ্রুপের মধ্যে নজিরবিহীন মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে ইসরাইলের কৌশল ব্যর্থ হতে শুরু করে। অব্যবহিত পর হামাস-ফাতাহ্ একতার সরকার (government of unity) গঠিত হয়। অনেক বিশ্লেষকের ধারণা, এ ঘটনার পর ইসরাইল ক্ষিপ্ত হয় এবং ফিলিস্তিনকে ধ্বংসের জন্য অজুহাত তৈরি করতে থাকে। পরবর্তীতে তিন কিশোরের নিখোঁজ ও নিহত হওয়ার পর ইসরাইলের ফিলিস্তিনি নির্যাতনের প্রেক্ষিত সূচিত হয়।

জাতিগত বিভাজনের পাশাপাশি ইসরাইল, ফিলিস্তিনসহ অন্যান্য আরব নেতৃবৃন্দের নৈতিক স্খলনের ফাঁদ তৈরি করে। সম্ভাব্য ও প্রতিশ্রুতিশীল আরব প্রতিভা ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে ধ্বংস করতে ইসরাইল এ ফাঁস সুকৌশলে ব্যবহার করে। ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মাসাদের নারী গোয়েন্দারা– যাদের মধ্যে ইসরাইলের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নারী নেত্রীরাও রয়েছেন– বিভিন্ন সময়ে আরব নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও শারীরিকভাবে অন্তরঙ্গতা স্থাপন করে তাদের নৈতিকভাবে ধ্বংস করতে ও ইসরাইলের বিরোধিতার পথ থেকে বিরত রাখতে সফল হয়েছে। ইসরাইলের রাষ্ট্রীয় স্বার্থে অন্যদের সঙ্গে যৌনসম্পর্ক স্থাপনের মতো চূড়ান্ত হৃদ্যতা তৈরির বিষয়কেও ইহুদিবাদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। এমন নীতি গ্রহণ করার পর বিশ্বমিডিয়ায় ইসরাইলের এ নৈতিকতাবিরোধী কৌশলের নানা কাহিনি প্রকাশিত হতে থাকে।

ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে ইসরাইলের সবচেয়ে ঘৃণ্য কৌশল হল আস্তে আস্তে ফিলিস্তিনি জনগণকে হত্যা করে বা তাদের অন্যত্র সরিয়ে দিয়ে তাদের ভূমি দখল করে ইসরাইলি রাষ্ট্রের সীমানা বৃদ্ধি করা। ইসরাইলের গৃহনির্মাণ ও বসতিস্থাপন সংক্রান্ত স্বতন্ত্র একটি মন্ত্রণালয়ও রয়েছে। ইসরাইলি সৈন্যরা প্রবল প্রতাপে ফিলিস্তিনিদের বিতাড়িত করে, আর গৃহনির্মাণ মন্ত্রণালয় সেখানে ইসরাইলের জন্য ঘরবাড়ি, স্থাপনা তৈরি করে ইসরাইলি রাষ্ট্রের পরিধি বৃদ্ধি করে। ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের মানচিত্রের দিকে তাকালে আমরা দেখব, দিন দিন ইসরাইল দীর্ঘ ও বৃহৎ হচ্ছে, আর ফিলিস্তিনিরা পশ্চিম তীরের রামাল্লা ও গাজায় সরু-চিকন ভূখণ্ডে সংকুচিত হচ্ছে।

এই কৌশলের বাস্তবায়ন নীতি হিসেবে ইসরাইল প্রথম থেকেই ফিলিস্তিনের উপর নানা অজুহাত তৈরি করে আক্রমণ করে থাকে। এ ধরনের একটি অজুহাত হল ফিলিস্তিনের সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা হামাসকে সন্ত্রাসী ও মৌলবাদী হিসেবে চিহ্নিত করা। দেশ ও মাটির জন্য অস্ত্র হাতে নেওয়াতে হামাস মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নন্দিত হওয়ার কথা, কিন্তু দুভার্গ্যবশত তাদের 'সন্ত্রাসী' হিসেবে আখ্যায়িত করার কৌশল নেওয়া হয়েছে।

ওদিকে ফিলিস্তিন-ইসরাইল সংঘাতকে ভুলভাবে উপস্থাপন করার জন্য সমস্যাটিকে একাডেমিক দিক থেকেও বিকৃত করা হয়েছে। বহুল প্রচারিত শব্দটি হল 'ফিলিস্তিন সমস্যা'। অথচ মূলত এটা আদৌ ফিলিস্তিন সমস্যা নয়। এটার নাম হওয়া উচিত 'ইসরাইল সমস্যা'। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদেরকে সহযোগিতা করার কারণে ইহুদিবাদীরা যুদ্ধশেষে ইহুদিদের স্বতন্ত্র আবাসভূমি গঠনের গোপন চুক্তি স্বাক্ষর করে। ইহুদিবাদীদের নেতা ডকটর থিওডোর হার্জল (Theodore Herzel) ইহুদি ধর্মের রাজনৈতিক রূপ থেকে উগ্ররূপ ইহুদিবাদের (Zionism) জন্ম দেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ফিলিস্তিন অটোম্যান সাম্রাজ্যের হস্তচ্যূত হয়ে ব্রিটেনের হাতে চলে গেলে ইহুদিরা এখানে তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের সুযোগ পায় এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সে অনুযায়ী ইহুদি ধর্মীয় রাষ্ট্র ইসরাইলের গোড়াপত্তন হয়। একাডেমিক শুদ্ধতার জন্য পুরো ইস্যুকে 'ইসরাইল সমস্যা' হিসেবে অভিহিত করা উচিত, এ মত যুদ্ধরাষ্ট্রের প্রখ্যাত ফিলিস্তিন পাশ্চাত্যবিদ এডওয়ার্ড সাঈদের।

বিভিন্ন অজুহাতে ফিলিস্তিনের উপর এ পর্যন্ত অসংখ্য মানবতাবিরোধী অভিযান চালানো হয়েছে। ২০০৮ সালে গাজার উপর ইসরাইলি অবরোধের কারণে ১৫ লাখ নিরপরাধ ফিলিস্তিনি খাবারের জন্য মিসরে পাড়ি জমাতে বাধ্য হয়। ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে গাজা আক্রমণ করে শতাধিক ব্যক্তিকে হত্যা করে ইসরাইল। এরপর মিসরের মধ্যস্থতায় ৬ মাসের যুদ্ধবিরতির মেয়াদ শেষ হলে ইসরাইল পুনরায় গাজা আক্রমণ করে ১১০০ ফিলিস্তিনিকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। গাজায় বাড়িঘর ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হয়। ২০১২ সালে অপারেশন রিটার্নিং ইকো আর অপারেশনে পিলার অব ডিফেন্স চালিয়ে প্রায় ২০০ লোককে হত্যা করা হয়।

জুলাই, ২০১৪ এর অভিযানের নাম দেওয়া হয়েছে অপারেশন প্রটেকটিভ। এ জন্য যার লক্ষ্য হিসেবে ইসরাইল হামাসের রকেট হামলার প্রতিবাদে ইসরাইলের আত্মরক্ষার বিষয়টি উল্লেখ করে। সেদেশের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ফক্স টেলিভিশনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আক্রমণ চালিয়ে যাবার কথাও জানিয়েছেন।

ইসরাইলের ভাষ্যমতে, অভিযুক্ত হামাসের রকেট হামলার প্রতিবাদে তারা বিমান হামলা চালিয়ে আসছে। অর্থাৎ একজন বা এক গ্রুপের অপরাধে অন্যজন বা অন্যগ্রুপ বা সকলের উপর আক্রমণ চালানো হচ্ছে। আন্তর্জাতিক আইনে এমন অপরাধীকে 'সম্মিলিত শাস্তিদান' (collective punishment) হিসেবে অভিহিত করে একে সম্পূর্ণ আন্তর্জাতিক নীতিবিরোধী হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। প্রখ্যাত লেখক নাথান গুডম্যান (Nathan Goodman) ইসরাইলের এ অপরাধকে 'সম্মিলিত শাস্তি' হিসেবে উপস্থাপন করে দেশটিকে আর্ন্তজাতিক যুদ্ধনীতি ভঙ্গের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করেছেন। কেননা যুদ্ধসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইন জেনেভা কনভেনশনে ইসরাইলের এ জাতীয় কাণ্ডকে 'যুদ্ধাপরাধ' হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।

রয়টার্স, এপি, বিবিসি, সিএনএনসহ বিশ্বমিডিয়ায় ইসরাইলের বর্বরোচিত অপরাধের যে চিত্র তুলে ধরা হচ্ছে, তাতে ইসরাইলকে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধে দোষী সাব্যস্ত করাও যায়। নাথান গুডম্যান তো প্রথম থেকে ইসরাইনের যুদ্ধ, অত্যাচার ও অবরোধ আরোপের অপরাধকে ইসরাইলের 'সম্মিলিত অপরাধ' হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ দেশটির আচরণ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস (state terrorism) হিসেবে তুলে ধরেছেন।

আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের মধ্যে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে ইসরাইলকে অভিযুক্তির প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করেছে। জাতিসংঘও ইসরাইলের অবরোধ আরোপকে মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে ঘোষণা করেছে।

সংবাদমাধ্যমে ইসরাইলের সাম্প্রতিক বিমান হামলায় মারাত্মক ক্যান্সার-জীবাণুবাহী বোমা বর্ষণের খবর প্রকাশিত হয়েছে, যা জাতিসংঘের অস্ত্র আইনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী ও আন্তর্জাতিক যুদ্ধনীতির বিরোধী। ফিলিস্তিনসহ অন্যান্য আরব নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ইসরাইলি নারীদের বন্ধুত্ব ও শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে তাদেরকে ফাঁদে ফেলার বিষয়টিও আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী। কেননা এমন কার্যের মাধ্যমে একজনের প্রেম ও ভালোবাসার মতো পবিত্র অনুভূতি ব্যবহার করা ব্যক্তির মৌলিক মানবাধিকারবিরোধী জঘন্য একটি অপরাধ। ফিলিস্তিনের নারী, পুরুষ, শিশুসহ নিরপরাধ ব্যক্তিদের টার্গেট করা আন্তর্জাতিক যুদ্ধনীতির স্পষ্ট লঙ্ঘন, গণহত্যারও নির্দেশক।

যুদ্ধাপরাধ সংঘটনের কারণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এখনই ইসরাইলকে আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। অতিদ্রুত তাদের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের পরিচালিত সম্মিলিত বাহিনী গঠন করে মানবিক হস্তক্ষেপ (humanitarian intervention) করতে হবে। ইরাকের বিরুদ্ধে মারাত্মক জীবাণুযুক্ত মারণাস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগে যেমন অভিযান পরিচালনা করা হয়েছিল, তার চেয়েও ভয়াবহ অভিযান চালাতে হবে আন্তর্জাতিক যুদ্ধনীতি ভঙ্গকারী ইসরাইলের বিরুদ্ধে।

আন্তর্জাতিক পরমাণু অস্ত্র সংঘ (IAEA) সহ জাতিসংঘের অন্যান্য অঙ্গ সংস্থার উচিত ইসরাইলের অস্ত্র গুদাম তদন্ত করা। ক্যান্সার জীবাণু ছাড়াও অন্যান্য মারাত্মক জীবাণু থাকতে পারে ইসরাইলের অস্ত্রভাণ্ডারে। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ইসরাইলের অঘোষিত পারমাণবিক অস্ত্রশস্ত্রের ধ্বংস সাধনে তদন্ত ও অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণ। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সেকেলে অস্ত্রশস্ত্রের বিপরীতে ইসরাইলের অত্যাধুনিক মারণাস্ত্রের সমাহার আঞ্চলিক শক্তিসাম্য (Regional balance of power) বিঘ্নিত করছে।

আর তাই ইরানের বিরুদ্ধে যেমনভাবে বিশ্বশক্তিসমূহ নানা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করছে, ইসরাইলের বিরুদ্ধেও তেমন কঠোরতর ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। আঞ্চলিক শক্তিসাম্য প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হলে আঞ্চলিক অস্ত্রায়ন (armament) সম্প্রসারণের পথ খুলে দেওয়া হবে, যা আঞ্চলিক শাস্তি বিনষ্ট করে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তায় নানারূপ হুমকি সৃষ্টি করবে।

আরেকটি বিকল্প হতে পারে পারমাণবিক শক্তিসাম্য অবস্থা গড়ে তোলা, যাতে ইসরাইলের পাশাপাশি অন্য কোনো আরব রাষ্ট্র বা একাধিক আরব রাষ্ট্র মারাত্মক অস্ত্রের অধিকারী হতে পারে। এমনকি পারমাণবিক শক্তিসাম্যের জন্য পারমাণবিক নিবারক তত্ত্বের (Nuclear Deterrence) প্রযোজ্যতাও বিশ্লেষণ করা যেতে পারে, যাতে করে দক্ষিণ এশিয়ার মতো আফ্রো-এশিয়া ও উপসাগরীয় এলাকার শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষা করা যায়।

এ লক্ষ্যে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আন্তর্জাতিক সমাজের দায়বদ্ধতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার চেতনা স্থাপন। একটি সমন্বিত, একত্রিত আন্তর্জাতিক উদ্যোগই কেবল ইসরাইলের ঔদ্ধত্য দমন করে মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি, নিরাপত্তা ও প্রগতি আনতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিভাজন একটি অবশ্যম্ভাবী আঞ্চলিক স্নায়ুযুদ্ধের (regional cold war) পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। ইতোমধ্যে রাশিয়া ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে ইসরাইলকে প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে। হামাসও জানিয়েছে, আক্রমণকারী ইসরাইল তার হামলা বন্ধ না করলে তারা নিরন্তর সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যাবে।

মধ্যপ্রাচ্যে শ্বাসরুদ্ধকর আঞ্চলিক যুদ্ধসমূহ, যথা ইরাক যুদ্ধ, সিরিয়া যুদ্ধ, মিসরীয় যুদ্ধ যখন আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করেছে, সেই মুহূর্তে ইসরাইল-ফিলিস্তন যুদ্ধ সর্বব্যাপী আঞ্চলিক যুদ্ধ তথা বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষিতও রচনা করতে পারে। সে ভয়ংকর পরিণতি থেকে বিশ্বকে রক্ষা করতে আন্তর্জাতিক সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে এখন, এবং এখনই।

মুহাম্মদ রুহুল আমীন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক।