আইএসআইএস: মধ্যপ্রাচ্যে জঙ্গিগোষ্ঠীর ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ

রায়হান আবীর
Published : 14 July 2014, 01:05 PM
Updated : 14 July 2014, 01:05 PM

মধ্যপ্রাচ্যের সুন্নী ওয়াহাবি জঙ্গিগোষ্ঠী 'আইএস' বা 'দ্য ইসলামিক স্টেট'-এর (যেটি মাত্র ক'দিন আগেই ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া বা আইএসআইএস নামে পরিচিত ছিল, মূলধারার মিডিয়ায় এখনও এই গোষ্ঠী এভাবেই অভিহিত হচ্ছে) আত্মগোপনে থাকা প্রতিষ্ঠাতা আবু বকর আল-বাগদাদী তাদের দখলকৃত ইরাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মসুলের আল-নুরি মসজিদে গত শুক্রবার মুসল্লিদের উদ্দেশে বক্তৃতা করেন। জুমার নামাজের খুতবায় তিনি নিজেকে স্বঘোষিত ইসলামি রাষ্ট্রের খলিফা এবং ইসলাম ধর্মের শেষ নবীর বংশধর দাবি করে তাকে অনুসরণ করতে সকল মুসলমানকে আহবান জানান।

খুতবার ভিডিও চিত্র প্রকাশের আগ পর্যন্ত বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বেশি অর্থসম্পদের মালিক এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা সম্পর্কে তথ্য ছিল খুব সামান্য। আল-কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ইসলামের ইতিহাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী আবু বকর ২০০৫-২০০৯ সাল পর্যন্ত ইরাকে মার্কিন নিয়ন্ত্রণাধীন একটি কারাগারে বন্দি ছিলেন [১]। ২০০৯ সালে মুক্তি পাবার সময় বিচারকদের তিনি হুমকি দিয়েছিলেন 'নিউইয়র্কে আবার দেখা হবে' বলে।

গত পাঁচ বছরে আবু বকরের দেখা না মিললেও তার প্রতিষ্ঠিত জঙ্গিগোষ্ঠী তাদের অকল্পনীয় সন্ত্রাস, আত্মঘাতী হামলা, সাধারণ জনগণকে হত্যা, নারী-শিশু হত্যা, নির্যাতন, অগুণতি গাড়ি বোমা হামলার জন্য শিরোনাম হয়েছে বারবার। ২০১০ সালের অক্টোবরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আবু বকরকে 'আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী' ঘোষণা করে এবং তার সন্ধান বা তথ্যদাতার জন্য ১০ মিলিয়ন ডলার পুরষ্কার ঘোষণা করে [২]।

দীর্ঘদিন আইএসআইএস নেতার দেখা না মেলায় এবং জঙ্গি দমনে নিয়োজিত সরকারি বাহিনী ও স্বেচ্ছাসেবকদের মনোবল চাঙ্গা করতে, অল্প কিছুদিন আগেই ইরাক সরকার ঘোষণা করে, আনবার প্রদেশে সরকারি বাহিনীর হামলায় আবু বকর মারাত্মক আহত হয়ে সিরিয়ায় পালিয়ে গেছেন।

ইরাকি নেতাদের আত্মবিশ্বাসে ছাই ঢেলে সশরীরে ইরাকের অন্যতম প্রাণকেন্দ্রে হাজির হয়ে আবু বকর বললেন, ''দীর্ঘদিনের ধর্মযুদ্ধ এবং প্রতীক্ষার পর আল্লাহ মুজাহিদিনদের জয়ী করেছেন… যোদ্ধারা ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠা করেছে এবং খলিফার হাতে রাষ্ট্র সমর্পণ করেছে।''

আইএসআইএস কর্তৃক রমজানের প্রথম দিন মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামি রাষ্ট্র ঘোষণার ঠিক পাঁচ দিন পর নিজেকে সেই প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের খলিফা দাবি করে আবু বকর বিশ্বব্যাপী জিহাদের আহবান জানিয়ে বলেন [৩]-–

''এই মহান রমজান মাসের ডাক শোন, এ আল্লাহর বান্দারা! যুদ্ধ শুরু কর। এই সেই মাস যে মাসে রাসুল (স:) তাঁর সেনাবাহিনীকে আল্লাহর শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করতে বলেছিলেন, যে মাসে তিনি যুদ্ধ শুরু করেছিলেন বহুশ্বেরবাদীদের বিরুদ্ধে। আল্লাহকে ভয় কর, হে আল্লাহর বান্দারা।''

যেভাবে উঠে এল আইএসআইএস

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসি ও নিউইয়র্কে আত্মঘাতী বিমান হামলা চালায় ওসামা বিন লাদেনের আল-কায়েদা জঙ্গিগোষ্ঠী। স্মরণকালের অন্যতম ভয়াবহ সেই হামলায় নিহত হন তিন হাজারের বেশি সাধারণ মানুষ। ক্ষয়ক্ষতি হয় প্রায় দশ বিলিয়ন ডলার সম্পদের।

ওই হামলার প্রেক্ষিতে, সবাইকে অবাক করে দিয়ে ২০০৩ সালে, তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ইরাকের তখনকার প্রেসিডেন্ট (পরে বিচারে ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত) সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদে মদদ দেওয়া ও তাঁর দেশের ভেতরে গণবিধ্বংসী অস্ত্র মজুদ রাখার অভিযোগ আনেন। এরপর বিশ্ব জনমত উপেক্ষা করেই জর্জ বুশ তাঁর মিত্রদের নিয়ে তেলসমৃদ্ধ ইরাক আক্রমণ করে বসেন।

শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ ইরাকের জনসংখ্যার বিশ শতাংশ সুন্নী মুসলমান। সাদ্দাম হোসেন ছিলেন এই সুন্নী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি এবং তাঁর উপর ভর করেই ইরাকের ক্ষমতার কাছাকাছি ছিল সুন্নীরা। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রবাহিনী কর্তৃক সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর শিয়া জনগোষ্ঠী দীর্ঘদিন পর ইরাকের রাষ্ট্রক্ষমতায় নিজেদের অধিকার লাভ করে।

আমেরিকা এবং এর মিত্রবাহিনী ইরাক আক্রমণের সময় বলেছিল, তারা ইরাকের জনগণকে তাদের দেশ ফিরিয়ে দিতে এসেছে। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, ইরাকিদের হাতে ইরাক ফিরিয়ে দেওয়া শেষে মার্কিন ও তার মিত্ররা যখন ইরাক ছাড়ল, তখন সেটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় 'জঙ্গি প্রজননক্ষেত্র'।

২০০৩ সালে আমেরিকা ও এর মিত্রবাহিনী যখন ইরাক আক্রমণ করে, সেই সময় বাগদাদের দক্ষিণে এক মসজিদের ইমাম ছিলেন আবু বকর। তখন থেকেই সুন্নী মতাবলম্বী বিভিন্ন ইসলামি জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত আবু বকর তৎকালীন 'ইসলামিক স্টেট অব ইরাক'-এর মজলিসে সুরার সদস্য মনোনীত হন। এরপর প্রায় পাঁচ বছর বন্দিত্ব শেষে ২০১০ সালে আবার আত্মপ্রকাশ করেন আবু-বকর, এবার আল-কায়েদার ইরাকের প্রধান হিসেবে [৪]।

২০১০ সালের ১৬ মে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরাকের সরকারি বাহিনীর সম্মিলিত হামলায় তৎকালীন ইরাকের আল-কায়েদা প্রধান আবু ওমর আল বাগবাদী নিহত হলে তার স্থলাভিষিক্ত হন আবু বকর। এই ভয়ংকর মানুষটির যোগদানে ইরাকে আল-কায়েদা স্মরণকালের ভয়াবহ সব হামলা চালানো শুরু করে। আবু বকরের নেতৃত্বে ২০১১ সালের মার্চ-এপ্রিল এই দুই মাসেই ২৩ বার হামলা চালানো হয় ইরাকের বিভিন্ন স্থানে।

একই বছরের মে মাসে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে মার্কিন কমান্ডোদের হামলায় ওসামা বিন লাদেন নিহত হলে আবু বকর আল-বাগদাদীর এই জঙ্গি আইএসআইএস প্রতিবাদস্বরূপ ইরাকের হিলা সিটিতে হামলা চালিয়ে ২৪ জন পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে। পরের মাসে তারা ইরাকে কমপক্ষে একশটি হামলা চালানোর জন্য তাদের ওয়েবসাইটে ডাক দেয় [৫]।

১৫ আগস্ট আইএসআইএস জঙ্গিদের আত্মঘাতী বোমা হামলায় মসুলে নিহত হন সত্তর জন সাধারণ মানুষ। ডিসেম্বরে মার্কিন বাহিনী ইরাক ত্যাগ করলে আইএসআইএস গাড়ি বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ইরাকের বিভিন্ন অঞ্চলে তেষট্টি জনকে হত্যা করে।

সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে আইএসআইএস

আরব বসন্তের পর থেকে সিরিয়ায় বাশার আল আসাদের নেতৃত্বে যে গৃহযুদ্ধ চলছে সে যুদ্ধে সংগঠন নিয়ে জড়িয়ে পড়েন আবু বকর আল-বাগদাদী। ২০১৩ সালের এপ্রিলে আবু বকর ঘোষণা করেন, সিরিয়ায় আল-কায়েদার শাখা জাবাত-আল-নুসরা তার সংগঠন আইএসআইএসের সঙ্গে একীভূত হয়েছে এবং এখন থেকে তারাই এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দিবে। যদিও আল-নুসরার সংশ্লিষ্টরা এই দাবি উড়িয়ে দেয়।

কিন্তু থেমে থাকেননি আবু বকর। সিরিয়ায় আইএসআইস দখল করে নিতে থাকে একের পর এক উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহর। এমনই এক শহর রাক্কা। প্রায় এক বছরের বেশি সময় ধরে ইসলামি রাষ্ট্রের জঙ্গিদের দখলে থাকা রাক্কার সংখ্যালঘু শিয়া ও খ্রিস্টান বাসিন্দাদের নবগঠিত ইসলামি রাষ্ট্রের জিহাদিরা তিনটি সুযোগ দেয়। এক. তাদের জঙ্গিদের মতো ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হবে। দুই. যদি তা না হয় তাহলে জিজিয়া কর প্রদান করতে হবে। নগদ অর্থে এই কর দেওয়া যাবে না, দেওয়া যাবে কেবলমাত্র সোনায়। ৩. উপরের দুটির কোনোটি পছন্দ না হলে তাদের সবাইকে হত্যা করা হবে।

যে কোনো শহর দখল করেই ইসলামি রাষ্ট্রের জঙ্গিরা সেখানে কালবিলম্ব না করে শরিয়া আইন চালু করে। একই সঙ্গে শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা দখল করে নিজেদের দপ্তর ও শরিয়া আদালত স্থাপন করে। অন্ধকারের সেপাইরা সবখানেই উড়িয়ে দেয় তাদের কালো পতাকা। সিরিয়ার সরকারবিরোধী যুদ্ধে জড়িত আল-কায়েদা থেকে শুরু করে সবাই খুব দ্রুত বুঝতে পারে, আইএসআইএস-এর সিরিয়ায় আগমন প্রেসিডেন্ট আসাদকে উৎখাতের জন্য বিরোধী শিবিরকে সহায়তা করার উদ্দেশ্যে নয়, তারা সিরিয়ায় এসেছে সিরিয়া দখল করার জন্য।

দখলকৃত শহরগুলোর বাসিন্দাদের জনসমক্ষে হত্যা, ক্রুসিফাই করে ঝুলিয়ে রাখা থেকে শুরু করে হেন কোনো মানবতাবিরোধী অপরাধ নেই যা দখলদাররা করছে না। শহরগুলোতে আইএসআইএসের চালানো নৃশংসতা দেখে আল-কায়েদা এ সংগঠনকে 'অতিরিক্ত সন্ত্রাসবাদী' ঘোষণা করে এবং ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাদের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে।

জিহাদের ঝাণ্ডা উড়িয়ে

সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বেশ কিছু শহর নিজেদের দখলে নিয়ে সেসব শহর কেন্দ্র করে আবার সুসংগঠিত হয় আইএসআইএস। জুন নাগাদ অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত তিন থেকে চার হাজার জিহাদি সিরিয়া থেকে ইরাকে আক্রমণ চালানো শুরু করে তাদের ভৌগলিক সীমা আরও বিস্তৃত করার উদ্দেশ্য। প্রধান লক্ষ্য রাজধানী বাগদাদ হলেও জঙ্গিরা প্রথমে সিরিয়া এবং বাগদাদের মধ্যবর্তী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর মসুল নিজেদের দখলে নেবার জন্য ধীরে ধীরে এগুতে থাকে।

তারা ৫ জুন সামারা এবং ৬ জুন পূর্ণ শক্তি নিয়ে মসুল আক্রমণ করে। ইরাকের সরকারি বাহিনীকে 'দাজ্জালের সেনাবাহিনী' আখ্যা দিয়ে ইসলামিক রাষ্ট্রের জিহাদিরা ঘোষণা করে, যারা তাদের বিরুদ্ধে যাবে তাদের সবাইকে হত্যা করা হবে। ৭ তারিখ তারা রামাদির আনবার বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা চালিয়ে ১৩০০ শিক্ষার্থীকে বন্দি করে। ইরাকি সেনাবাহিনীর তৎপরতায় যাদের পরবর্তীতে উদ্ধার করা সম্ভব হয়। আইএসআইএস-এর ভয়ে ভীত হয়ে ইরাকি বাহিনী মসুল রক্ষা করতে ব্যর্থ হয় এবং শহর ছেড়ে পালিয়ে যায়।

দু'দিন পরে অর্থাৎ ৯ জুন, মসুল জিহাদিদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে [৬]। শহরের সকল সরকারি প্রতিষ্ঠান, বিমানবন্দর থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ সকল স্থাপনায় টানিয়ে দেওয়া হয় আইএসআইএস-এর কালো পতাকা। শুধু তাই নয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে হামলা চালিয়ে প্রায় ৪২৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সম্পদ লুট করে নেয় ওরা [৭]।

অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে সেখানেও শরিয়া আইন জারি করে বাসিন্দাদের হত্যা, নির্যাতন শুরু করে দেওয়া হয়। যার প্রেক্ষিতে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে ভিন্ন জায়গায় আশ্রয় খুঁজতে বাধ্য হয়। তেলসমৃদ্ধ মসুল দখলের ফলে রাতারাতি বিপুল সম্পদের মালিক বনে যাওয়া জঙ্গি দল খুব দ্রুতই ইরাকের বাকি তেল খনিগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিবে, এমনটাই আশঙ্কা। মূল লক্ষ্য বাগদাদের কথা ভুলে না গিয়ে জঙ্গিরা তাদের আক্রমণ অব্যাহত রাখছে।

১৫ তারিখ জঙ্গিরা নিনেভা প্রদেশের তাল আফার শহরে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। সেখানে আটক হয় ১৭০০ জন ইরাকি সেনা যাদের প্রত্যেককে জিহাদিরা হত্যা করে, তার ভিডিও বিভিন্ন ওয়েবসাইটে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। সিরিয়া ও ইরাক মিলিয়ে দখল নেওয়া বিশাল অঞ্চল নিয়ে নতুন ইসলামি রাষ্ট্র ঘোষণা করা হয় একই মাসের ২৯ তারিখ। অর্থাৎ এক মাসেরও কম সময়ে, তেমন কোনো বাধা-বিপত্তি ছাড়াই আইএসআইএস ইরাকের আটত্রিশ হাজার বর্গ কিলোমিটার দখল করে নিতে সমর্থ হয়।

রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য আইএসআইএসকে লড়তে হচ্ছে ইরাকি সেনাবাহিনী, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী, শহর-গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীসহ অনেক ধরনের ফ্রন্টের বিরুদ্ধে। আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত এই বাহিনী প্রথম থেকেই ইসলাম রক্ষার জন্য জিহাদের প্রোপাগাণ্ডা চালিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, এমনকি ইউরোপ, আমেরিকা থেকে জিহাদি মানসিকতার মানুষদের আকৃষ্ট করতে শুরু করে। তাই দেখা গেছে, কয়েক দিন আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক নাগরিক আইএসআইএসের হয়ে আত্মঘাতী বোমা হামলায় অংশ নিয়েছিল।

জঙ্গিদের অর্থায়ন ও রাজনীতির নানা খেলা

আপাত সুসজ্জিত এই ভয়ংকর সেনাবাহিনীর অর্থায়ন কোথা থেকে হচ্ছে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ২০১৪ সালে তাদের অর্থের উৎস খোঁজার নিমিত্তে প্রায় দু'শর অধিক দলিল-দস্তাবেজের উপর গবেষণা চালায় একটি বেসরকারি সংস্থা (RAND Corporation)। তাদের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০০৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত জঙ্গি সংস্থার বাজেটের পাঁচ ভাগ অর্থ এসেছে আশেপাশের দেশগুলোয় অবস্থিত বিভিন্ন ধনী ব্যক্তির ব্যক্তিগত সহায়তা থেকে। বাকি সব অর্থ জোগানো হয়েছে ইরাক থেকেই।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, ইরাকের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ধরনের অপহরণ, লুটতরাজ, চাঁদাবাজি, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে হামলার মাধ্যমে যে অর্থ সংগ্রহ করা হত, তার ২০ ভাগ দিয়ে দেওয়া হত জিহাদি বাহিনীর মূল সমন্বয় সেলে। সেখান থেকে এই অর্থ আবার বিভিন্ন স্থানে জঙ্গিদের দেওয়া হত যাতে করে হামলা, অপরহণ আরও বৃদ্ধি করে আয় বাড়ানো যায়।

২০১৪ সালের মধ্যভাগে ইরাকি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইএসের বিভিন্ন উচ্চপর্যায়ের জিহাদিদের তথ্য পর্যালোচনা করে ঘোষণা করে যে, জঙ্গিদের হাতে প্রায় দুই বিলিয়ন ডলারের সম্পদ রয়েছে [৮]। পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত কোনো জঙ্গি গোষ্ঠী রাতারাতি এত বিপুল সম্পদ অর্জন করতে পারেনি। ব্যাংক লুট, সোনার দোকান লুট, অপহরণ, চাঁদাবাজি ছাড়াও গালফ অঞ্চলের বিভিন্ন নাগরিকের কাছ থেকে জঙ্গিরা আর্থিক অনুদান গ্রহণ করে তাদের সম্পদ ক্রমান্বয়ে আরও বৃদ্ধি করছে।

ইরাকের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মালিকি কাতার ও সৌদি আরবের বিরুদ্ধে জিহাদিদের অর্থ জোগানোর অভিযোগ করেছেন। এছাড়াও সিরিয়ার পূর্বাঞ্চলে নিজেদের দখলে রাখা শহরগুলো থেকেও তারা বিভিন্ন উপায়ে অর্থ সংগ্রহ করেছে। দখলে থাকা তেল পরিশোধন কেন্দ্রগুলোর তেল সিরিয়া সরকারকেও বিক্রি করেছে আইএসআইএস। ২০১২ সাল থেকেই এই জঙ্গি গোষ্ঠী বিভিন্ন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের মতো বিভিন্ন হামলা, হত্যায় তাদের বার্ষিক খরচের প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে অর্থদাতাদের আকৃষ্ট করার জন্য [৯]।

আইএসআইএস এখানেই থেমে থাকবে না সেটা তাদের খুব অল্প সময়ের কর্মকাণ্ড বিবেচনা করলেই বোঝা যায়। মধ্যপ্রাচ্য ছাড়িয়ে তারা রোম পর্যন্ত তাদের খেলাফত বিস্তৃত করার ঘোষণা দিয়েছে। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করতে তারা পারঙ্গম। উচ্চমানের ভিডিও এবং অডিওর মাধ্যমে তারা বিশ্বব্যাপী জিহাদের জন্য আহবান জানিয়ে যাচ্ছে, আহবান জানাচ্ছে তাদের ইসলামি রাষ্ট্রকে পৃথিবীর একমাত্র রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার।

গণমাধ্যমের খবর অনুসরণ করলে অনেকেরই মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, ইরাক এবং সিরিয়ায় আইএসআইএসকে কেন্দ্র করে যা হচ্ছে তা কেবলমাত্র জাতিগত সংঘাত। মোটেও তা নয়। যদিও ইসলামি রাষ্ট্রের জঙ্গিরা ইসলামকে ব্যবহার করছে তাদের ভয়াবহ সকল অপকর্ম হালাল করতে, কিন্তু তাদের হাতে কেবল খ্রিস্টান নয়, মারা যাচ্ছে অসংখ্য মুসলমানও। ইরাকের সুন্নী আলেমরাও সমগ্র দেশকে এই অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে অনুরোধ জানাচ্ছেন, অনুরোধ জানাচ্ছেন বৈদেশিক ভাইরাস থেকে দেশরক্ষার।

এই সংঘাতে পশ্চিমা বিশ্বের অবদানও কম নয়। সিরিয়ায় বাশার-বিরোধী বিদ্রোহীদের মধ্যে সবচেয়ে সুসঙ্গত শক্তি আল-কায়েদা। সারা পৃথিবীতে আল-কায়েদা নিষিদ্ধ হলেও সিরিয়ায় নিষিদ্ধ নয়, কারণ সেখানে তারা প্রেসিডেন্ট আসাদের বিরুদ্ধে লড়ছে। পশ্চিমা বিশ্ব আসাদকে তাড়াতে আল-কায়েদাকেই অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছে। আইএসআইএস-এর দখলে থাকা সিরিয়া ও ইরাকের সীমান্ত দিয়ে সেসব অস্ত্র চলে আসছে আইএসএসএর হাতে। এই অস্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে ইরাকি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে, যাদের সহায়তা করছে আবার সেই পশ্চিমা বাহিনী।

সিরিয়ার বিদ্রোহীদের যেমন মার্কিনীরা সহায়তা দিচ্ছে, ঠিক তেমনি বাশারের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য তাকে সহায়তা করছে ইরান ও রাশিয়া। অন্যদিকে ইরাকে এসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কাজ করার কথা বলছে ইরান। আইএসআইএস তাই ধর্মযুদ্ধের কথা বললেও এখানে ধর্মকে পুঁজি করে বিশ্বের বিভিন্ন শক্তি তাদের খেলা খেলছে, প্রাণ হারাচ্ছে সাধারণ মানুষ।

আর এভাবে পৃথিবী তলিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারের দিকে। এমন একটা কঠিন সময়ে হঠাৎ মনে পড়ে যায় মেঘদলের গানের কথা– বল হরি হরি বল, যুদ্ধে যাব, বিভেদের মন্ত্র স্বর্গ পাব….। বিভেদের মন্ত্রে স্বর্গ লাভ হয় না। সুন্নীরা যদি শিয়াদের হত্যা করে, শিয়ারা যদি হত্যা করে আলায়াইটসদের, মুসলমানরা খ্রিস্টানদের– তাহলে কখনও-ই পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে না। তখন হয়তো শুধু পৃথিবীর পরিচালকদের ব্যাংক-ব্যালেন্সে 'শান্তি' প্রতিষ্ঠিত হবে।

ইরাকে কিংবা সিরিয়ায়, আইএসআইএস অথবা আল-কায়েদার সন্ত্রাসীরা এভাবেই তাদের মানুষ মারার খেলনা দিয়ে শেষ করে দিবে সবকিছু?

রায়হান আবীর: ব্লগার ও পিএইচ-ডি গবেষক।

তথ্যসূত্র:

[১]

PolitiFact.com, Tampa Bay Times

14 June, 2014 (Retrieved 20 June 2014)

[২]

United States Department of State

4 October, 2011 (Retrieved 8 October, 2011)

[৩]

BBC News

11 June, 2014

[৪]

Los Angeles Times

16 May, 2010

[৫]

United States Department of State

4 October, 2011

[৬]

The New York Times

10 June, 2014

[৭]

IBT

13 June, 2014

[৮]

The Guardian

15 June, 2014

[৯]

McClatchy News Service

23 June, 2014