নারীর পোশাক নির্বাচনের স্বাধীনতা বনাম মানবাধিকার

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 10 July 2014, 11:08 AM
Updated : 10 July 2014, 11:08 AM

চার বছর আগে ফ্রান্সে আইন পাশ হয়েছিল, বোরখা কিংবা অন্য কোনো সর্বাঙ্গ-আবরণী পোশাক পরে পাবলিক প্লেসে যাওয়া যাবে না। ইউরোপের সর্বাধিক মুসলিম অধিবাসী সম্বলিত দেশটিতে জনসমাজের এক বিরাট অংশের মধ্যে এই আইন বিশেষ সন্তোষ সৃষ্টি করে। এই নিষেধমূলক আইনটির বিরুদ্ধে চার বছর ধরে ক্রমাগত বিক্ষোভ-প্রতিবাদ-সমালোচনাও দেখা গেছে। বহুসংস্কৃতিবাদ ও মানবাধিকারের যুক্তিতে এর বিরোধিতা চলেছে।

অবশেষে সেই প্রতিবাদ একটি মামলায় এসে ঠেকেছিল। ইউরোপিয়ান কোর্ট অব হিউম্যান রাইটসে মামলা দায়ের করেছিলেন পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত এক ফরাসি মুসলিম তরুণী। দাবি করেছিলেন যে, তিনি স্বেচ্ছায় বোরখা পরে থাকেন, রাষ্ট্র তা নিষিদ্ধ করবে কেন? ২ জুলাই, ২০১৪ ইউরোপীয় আদালত এই মামলার রায় প্রকাশ করে, রায়ে তরুণী পরাজিত, নিষেধাজ্ঞাটিই সমর্থিত হয়।

স্বভাবতই প্রতিবাদ আবারও উত্তাল। আবারও প্রশ্ন, কোন মানবাধিকার-বলে একটি আধুনিক দেশে পোশাকের উপর নিষেধাজ্ঞা চাপানো যায়। এই সমালোচনার উত্তরে পাল্টা যুক্তিও শোনা যাচ্ছে। সব মিলিয়ে এই গ্রীষ্মে বহুসংস্কৃতি বনাম জাতীয় সংস্কৃতি বিতর্কে পশ্চিম ইউরোপের আবহাওয়া উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।

বোরখা-নিষেধ আইনের বিরোধী মতগুলি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা চলছে। উদারপন্থী রাষ্ট্রদর্শনের প্রেক্ষিতে মানবাধিকারের সাধারণ নীতিতেই ধর্মাচরণে বা ব্যক্তিগত আচার-ব্যবহারে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ অগ্রহণযোগ্য, বিশেষত যখন এক জনের আচরণে অন্য কারও ক্ষতির আশঙ্কা নেই। যদি কোনো মুসলিম নারী সর্বাঙ্গ, এমনকি মুখও, ঢেকে রাস্তায় বের হন, তাতে কারও মনে অস্বস্তি নিতে হতে পারে, কিন্তু 'ক্ষতি' হবে কেন?

এটাও প্রমাণ করা কঠিন যে বোরখা-পরা নারী নিশ্চিতভাবে পরিবারের পুরুষদের দ্বারা আদিষ্ট হয়েই পোশাক বেছে নিয়েছেন। ধর্মীয় বিভেদের মতোই ধর্মভিত্তিক সংস্কৃতির বিভেদও গুরুতর বিষয়, তাকে রক্ষা করা আধুনিক রাষ্ট্রের প্রাথমিক কর্তব্যগুলির মধ্যে পড়ে। আর পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চোখরাঙানির কথাই যদি ওঠে, তবে তর্ক উঠবে, আইন প্রণয়ন করে তা করা যায় কি না।

অত্যন্ত মৌলিক এই সব প্রশ্নের উত্তরে ইউরোপীয় আদালত এ বার যে যুক্তির আশ্রয় নিয়েছে, তা অভিনব। আদালত তুলে ধরেছে সামাজিক সংযোগের যুক্তি। আধুনিক উদার সমাজের লক্ষ্য, বিভিন্ন ব্যক্তির নিজস্ব পরিচয়ে ব্যক্তিকে অপর ব্যক্তিবর্গ ও সমাজের সঙ্গে যুক্ত করা। এদিকে যদি কোনো ব্যক্তি সর্বক্ষণ তার মুখের অধিকাংশ ঢেকে থাকেন, তবে তাকে দেখা যায় না, তাই চেনা যায় না। তিনি অন্যদের চেনেন, অন্যরা তাকে চেনে না, এই অসম সংযোগ একটি বিশেষ 'অসুবিধা', আধুনিক সমাজের অনুপযুক্ত। ফরাসি রাষ্ট্র যে সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তাতে এই অসম সংযোগের স্থান নেই। বোরখার বদলে মুখোশ-পরিহিত মানুষ যদি স্কুলে কলেজে স্টেশনে পার্কে ঘুরে বেড়াত, ও মুখোশ খুলতে অসম্মত হতে, তবে একই সমস্যা দাঁড়াত।

শেষ যুক্তিটি অবশ্যই এই রায়কে ধর্মীয় প্রেক্ষিত থেকে বের করে আনবার প্রয়াস। যুক্তিটি অবশ্যই প্রণিধানযোগ্য, তবে তর্কাতীত নয়। সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে ব্যক্তির মৌলিক অধিকার অস্বীকার করা যায় কি না, এটাই মূল প্রশ্ন। ইউরোপীয় আদালতের বিচার সেই মৌলিক প্রশ্নটি উড়িয়ে দিতে পেরেছে বলে মনে হয় না।

নারীর পোশাক কী হবে, তা কে নির্ধারণ করবে? উদার গণতন্ত্র বলে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি– নারীর। দুর্ভাগ্যবশত, বিশ্বের বহু সমাজে ও শাসনপ্রণালিতে পুরুষতন্ত্রের প্রাধান্য এতই প্রবল যে, নারীরা নয়, তাদের পরিবার বা সমাজ, প্রায়শ রাষ্ট্রও তাদের হয়ে এই সিদ্ধান্তটি নিয়ে থাকে। আমাদের সমাজে এক শ্রেণির মানুষ নারীদের পোশাক-আশাক, আচার-আচরণ স্থির করতে ব্যস্ত। সেই উদ্যোগ সচরাচর নারীর শরীর আবৃত রাখবার উদ্যোগ। পাশাপাশি এটাও ঠিক যে, নারীশরীর আবৃত রাখা চলবে না, এমন বিধানও কিন্তু প্রকারান্তরে তার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ।

প্রসঙ্গত, পশ্চিমি আদর্শে গড়ে তোলা আধুনিক তুরস্কের রূপকার মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক হিজাবকে ইসলামি পোশাক গণ্য করতেন। তাই তার ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্কে এই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ হয়। নব্বই বছর ধরে তা বলবৎ ছিল। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছিল, 'ধর্মনিরপেক্ষতা' কি এ ক্ষেত্রে তুর্কি নারীর পোশাকের স্বাধীনতা ও তার মানবাধিকারও লঙ্ঘন করেনি? মৌলবাদের মতো ধর্মনিরপেক্ষতাও কি এ ক্ষেত্রে এক ধরনের গোঁড়ামি হয়ে ওঠে না? এই বিষয়ে তর্ক ও বিবাদ চলছিল। আন্দোলনও।

এ প্রেক্ষিতেই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী এরদোগান ২০০২ সালেই নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন হিজাবসংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের। তিনি কথা রেখেছেন। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এতে এক পক্ষ খুশি হয়েছেন। আবার, এই সিদ্ধান্ত এক শ্রেণির কাছে প্রশ্নবিদ্ধও হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের মধ্যে অটোমান খলিফাদের যুগের ইসলামি মৌলবাদ ফিরিয়ে আনার সংকেত পেয়েছেন তারা। ইসলামি মৌলবাদের বর্তমান আন্তর্জাতিক প্রসারের প্রেক্ষিতে প্রশ্নটি উপেক্ষণীয় নয়।

বর্তমান বিশ্বে ইসলাম অনুসারীদের মধ্যে হিজাব পরা না-পরা নিয়ে এক বিরাট তর্ক বা দ্বন্দ্ব চলছে। অনেক দেশে এ নিয়ে আন্দোলন পর্যন্ত হচ্ছে। এই তর্ক প্রাসঙ্গিক। হিজাব বা অনুরূপ পোশাক যে ভাবে প্রচলিত হয়েছে, তার পেছনে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পশ্চাৎপদতার প্রভাব অবশ্যই প্রবল। পুরুষ শাসনের একটি অস্ত্র হিসেবেই একে কাজে লাগানো হয়েছে। যে নারী 'স্বেচ্ছা'য় হিজাব পরতে চাচ্ছেন, তার ইচ্ছা কতখানি যথার্থ স্ব-ইচ্ছা এবং কতখানি সামাজিক অনুশাসন আত্মস্থ করবার ফল, তাও অবশ্যই বড় প্রশ্ন।

কিন্তু সেই বিতর্কের মোকাবিলা সামাজিক সাংস্কৃতিক পরিসরেই করা দরকার, নিষেধাজ্ঞা জারি করে নয়। অবশ্যই পোশাকের যৌক্তিকতা বা ব্যবহারিকতার প্রশ্নটি বিচার করতে হবে। ব্যক্তির পছন্দের স্বাধীনতাও শিরোধার্য করতে হবে। ধর্ম বা অন্য কোনো অজুহাত দেখিয়ে কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া যাবে না।

মেয়েরা কী পরবেন, সেটা তারাই ঠিক করবেন। এর ওপর নিশ্চয়ই কোনো কথা চলতে পারে না। অন্তত একটা আধুনিক, গণতান্ত্রিক দেশে। বিশেষ করে এ দেশে রাস্তাঘাটে মেয়েদের বিরুদ্ধে হিংসার ঘটনা ঘটলেই যেভাবে এক শ্রেণির মানুষ তাদের পোশাককে এ জন্য দায়ী করতে শুরু করেন, তাতে এই স্বাধীনতার কথাটা বিশেষভাবে বলা দরকার। কিন্তু এই সূত্রেই একটা অন্য প্রশ্ন তোলা যায়। তোলা দরকার। মেয়েরা যা পরেন, যেভাবে পরেন, তা কি তাদের নিজস্ব রুচি-পছন্দ অনুসারেই? না কি, তাঁদের বেলায় পোশাক মানে সত্যিই পররুচির খেলা?

নারীর কাছে 'পররুচি'-র অর্থ আসলে পুরুষের রুচি, যার ভিত্তিতে তাদের পরিধান নির্ধারিত হয়ে থাকে। পোশাকের স্বাধীনতার বা স্বাচ্ছন্দ্যের নামে মেয়েরা যা পরেন, পরতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন, আজও তা সুকৌশলে আমাদের পুরুষশাসিত সমাজই নির্ধারণ করে দেয়। এ খেলা নতুন নয়, অতি প্রাচীন। দেবী সরস্বতীকে 'কুচযুগ শোভিত মুক্তাহারে' করে গড়ে তুলেছিল যে প্রাচীন পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, তার দৃষ্টির সবটাই কি সত্য-শোভন-সুন্দর ছিল? না কি, তার পিছনে ছিল কিছু অবচেতন অবদমিত যৌন-আকাঙ্ক্ষাও?

কালিদাসের নায়িকারাও তো কেউ আকাশ থেকে পড়েননি। সেকালের নারীসমাজও কিন্তু সেই নায়িকাদের দেবীর আসনে বসিয়ে, তাদের 'আইডল' হিসেবে গ্রহণ করে নিজেদেরও সাজিয়ে তুলেছিল সেই রকমই আবরণ আর আভরণে। নারীর সেই 'স্বর্গীয় রূপ'-এর নির্মাতারা আজও বর্তমান। এবং তাঁরা আজও সেই পুরুষশাসিত সমাজেরই প্রতিনিধি। তারাই নির্ধারণ করে চলেছেন নারীর পোশাকের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতা, আজও। তাদের নিবিড় ইচ্ছাগুলোই আজকের দুনিয়ায় ফ্যাশন স্টেটমেন্ট হয়ে শোভা পায় নারীর দেহে।

পশ্চিম হোক বা পূর্ব, ভোগবাদ হোক বা রক্ষণশীলতা, বোরখা হোক বা মিনি স্কার্ট– পুরুষচক্ষুই আজও নিয়ন্ত্রণ করে নারীর পোশাকের স্বাধীনতা।

ক্ষমতাবান, সমাজ-অধিপতি পুরুষ নারীকে সেই দৃষ্টিভঙ্গি উপহার দিতে পারেনি, যাতে বাহ্যিক নয়, অন্তরের সৌন্দর্যই হয়ে ওঠে মর্যাদার মাপকাঠি। অতিপ্রাচীন পুরুষশাসিত সমাজের পথ বেয়ে আজও সমাজের অধিকাংশ নারীকেই শৈশব থেকে কোনো আত্মপরিচয় গড়ে তোলার শিক্ষা দেওয়া হয় না, দেওয়া হয় না চিত্রাঙ্গদার মতো কোনো আত্মানুসন্ধানের ব্রতের ঠিকানা। তারা জেনেবুঝে বসে থাকে যে, তারা নারীই।

এখানে বলে রাখা দরকার, যে আমাদের সমাজে এখনও বেশিরভাগ বিধি-বিধানই ধর্মের নামে চাপিয়ে দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে সামাজিক প্রেক্ষিত ও বাস্তবতা খুব একটা বিবেচনায় নেওয়া হয় না। ধর্মের আলোচনাও আমাদের মানবাধিকারের দৃষ্টিতে করা দরকার। রাষ্ট্রীয় বিধিবিধানও মানবাধিকারের যুক্তি উপেক্ষা করে বলবৎ হতে পারে না।

ধর্ম কিংবা রাষ্ট্রীয় বিধান যদি সবার অধিকার রক্ষা করতে না পারে তাহলে সেটা নিয়েই ভাবার অবকাশ রয়েছে। পরিবার, নারী-পুরুষের বিয়ে, সন্তানধারণ, পোশাক, ধর্মীয় বিধান মেনে চলা ইত্যাদি পিতৃতান্ত্রিক বিশ্বাস। এর বাইরেও মানুষের পরিচয় আছে, বিশ্বাস আছে, জীবন আছে। তাদের মানবাধিকার নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে। এটা যদি ধর্মীয় কোনো বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়, তাহলে আমাদের ভাবতে হবে আমরা 'মার্জিনালাইজড' মানুষের ইচ্ছা-স্বাধীনতা-মানবাধিকারে গুরুত্ব দেব, নাকি ধর্মীয় বিধান মেনে ভিন্নতা অনুসরণকারীদের অধিকার ঝেড়ে ফেলব?

পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা সমাজ-সংসারের একটা ছক এঁকে দিয়েছে। একেই আমরা প্রাকৃতিক বা ধর্মীয় বিধান হিসেবে মেনে নিয়েছি। এর বাইরে জগৎ হতে পারে, হওয়া সম্ভব– এটা ভাবতে সমাজ, সমাজের প্রথাবদ্ধ মানুষেরা ভাবতে নারাজ। এই বিশ্বাস ভাঙতে গেলে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। 'পৃথিবীর ভবিষ্যৎ' নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়।

জীবনযাপনের অনেক পথ আছে। পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা এর কয়েকটাকে বড় করে দেখিয়েছে, বিশেষ মাহাত্ম্য দিয়েছে গায়ের জোরে। নারী এই, পুরুষ এই– এই রকমই তাদের হতে হবে, এমন পোশাক পরতে হবে, এভাবে চলতে হবে, এভাবে যৌনতার চর্চা করতে হবে, এটা আমাদের বদ্ধমূল ধারণা। পুরুষতান্ত্রিক ধ্যানধারণা আমাদের মধ্যে এই 'মূল্যবোধ' দৃঢ়ভাবে প্রোথিত করে দিয়েছে।

কিন্তু মনে রাখা দরকার, বহুজনকে নিয়েই আমাদের সমাজ। সমাজের প্রত্যেকে যেন নিজের মতো বাঁচতে পারে, নিজের পছন্দ অনুযায়ী চলতে পারে সেটাই আজকের যুগের মানবাধিকারের মূল কথা। পরস্পরের অধিকার রক্ষা করাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। সমাজে যারা ভিন্ন চিন্তা করে, প্রচলিত ব্যবস্থার বাইরে ভিন্ন ভাবে বাঁচতে চায়, অন্যের কোনো ক্ষতি না করে, কারও উপর জোর-জবরদস্তি না করে নিজের রুচি ও পছন্দ অনুযায়ী জীবনাচরণ নির্ধারণ করে, তবে তার বা তাদের অধিকার ও মর্যাদায় গুরুত্ব দেওয়া, তার অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়টি সামনে আনাই আজকের আধুনিক সমাজের মূল ভাবনা হওয়া উচিত।

যা কিছু চলে আসছে ধর্ম কিংবা সামাজিক নিয়ম হিসেবে, যা আমরা বাইরে থেকে দেখে অভ্যস্ত, এই 'বাইরের ঠিক' সব সময় ঠিক নয়। ভেতরের বা সত্তার বিকাশই আসল কথা। সত্তাকে উপলব্ধি করতে হয়। তবে তাকে চিনতে পারা যায়। আমাদের সমাজে প্রচলিত ধর্মতান্ত্রিক ও পিতৃতন্ত্রের খাঁচায় সবাইকে 'ফিট' করতে চাওয়া হয়। কেউ ফিট না করলে তাকে বাধ্য করা হয়। যে ফিট করছে না তাকে তার মতো থাকতে দেওয়াটাই যে মানবাধিকারের মূল কথা– এটা সামাজিক মানুষেরা, এমনকি রাষ্ট্র পর্যন্ত প্রায়শই ভুলে যায়।

সমাজে কোনো কিছুই ধ্রুব বা চিরন্তন সত্য নয়। আমরা নিজেরা যেমন 'স্বাধীন' হব, ঠিক তেমনি অন্যের স্বাধীনতারও মর্যাদা ও সম্মান দেব। আর স্বাধীনতা হচ্ছে একই পথে চলমান দুইজন পথিকের একজনের হাতের ছড়ি অন্য জনের নাকের ডগার মধ্যে সুসামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবধান। যার হাতে ছড়ি দরকার সে অবশ্যই তা ব্যবহার করবে। কিন্তু আরেক জনের নাকের ডগাকে তা যেন স্পর্শ না করে।

আমাদের জীবন আমরা কীভাবে চালাবো, এটা আমাদের সিদ্ধান্ত। কিন্তু যারা ভিন্ন ভাবে ভিন্ন চিন্তা নিয়ে জীবন চালায়, চালাতে চায়, তাদের সহযোগিতা করব কিনা, তাদের স্বীকৃতি দেব কিনা, সেটাই আসল কথা। এই ভিন্নতা স্বীকার করা, তাদের সমর্থন দেওয়া এবং তাদের সকলকে একীভূত করাই মানবাধিকার সমুন্নত সমাজ প্রতিষ্ঠার শর্ত।

একে-অপরকে জানা, জানানো, এক-অপরে মিলে আমরা। একে-অপরকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া, পরস্পরকে জানা-বোঝার মাধ্যমে একটি সমাজ নির্মাণ হতে পারে আমাদের যৌথ আকাঙ্ক্ষা। মনে রাখতে হবে, কোনো রকম বৈষম্য, বিভেদ, ব্যবধান, উপেক্ষা, অবজ্ঞা, জুলুম, চাপিয়ে দেওয়া বিধান, ধর্মের বিধান দেখিয়ে বিকশিত ও আধুনিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যাবে না।