Published : 08 Jul 2014, 09:26 AM
বিশ্বকাপ শেষের প্রায় কাছাকাছি। সৌভাগ্যবশত বিভিন্ন মাধ্যমে বিশ্বকাপ নিয়ে বিস্তর কলমবাজি, মতান্তরে কী-বোর্ডবাজি করলাম। অনেকে তাতে অংশগ্রহণও করলেন। সবাইকে ধন্যবাদ এভাবে সাড়া দেওয়ায়। শীঘ্রই বিশ্বকাপের যবনিকা নামতে যাচ্ছে। কিছু কিছু কলমবাজিরও। যেমন, পূর্বাভাস সম্পর্কিত বিশ্লেষণগুলির। পোস্টমর্টেম অবশ্য আরও কিছুদিন চলবে। তা চলুক।
সেমিফাইনালগুলো নিয়ে কিছু বলি।
সবচেয়ে ভালো দিক হল, যে চারটা দল সেমিফাইনালে আছে তারা সবাই নিঃসন্দেহে নিজেদেরকে কাপের অন্যতম দাবিদার প্রমাণ করেই এই পর্যন্ত এসেছে। যারা বাদ পড়েছে তাদের কারও জন্য এ রকম মনে হচ্ছে না যে, "আহারে, কত ভালো দলটা, একটুর জন্য বাদ গেল।"
আবার যে কটা টাইব্রেকার হল, তুলনামূলকভাবে যোগ্যতর দলই প্রতিটাতে উতরেছে। নাকে-মুখে ৯০ + ৩০ মিনিট পার করে 'ছুৎ' করে কী একটা জাদু দেখিয়ে টাইব্রেকারের উপর ভর করে পরের ধাপে কেউ ঢোকেনি। বোঝা যাচ্ছে, সবগুলো দলই টাইব্রেকারকে খুব সিরিয়াসলি নিয়ে সেজন্য স্ট্র্যাটিজি নির্ধারণ ও পৃথক অনুশীলন করেছে।
বত্রিশ বছর হয়ে গেল বিশ্বকাপে টাইব্রেকার প্রচলনের। চার ধাপে নকআউটের মতোই টাইব্রেকারও এখন এক প্রতিষ্ঠিত সত্য। কোনো নিরীক্ষা নয়, অথচ এখনও কেউ কেউ এটা মানতে পারেন না। আর কোনো কোনো মিডিয়া তো 'ভাগ্যপরীক্ষা'– এই গান গাইতে গাইতে কান পচিয়ে দিল। তাদেরই-বা দোষ কী দেব? কিছু শ্রোতা-দর্শক-পাঠক যদি তা শুনতে-পড়তে চায়, তারাই-বা কেন তা পরিবেশন করবে না?
ভাগ্যপরীক্ষা হল এফর্টলেস বা মিনিমাম এফর্টে যেটা হয়, যেমন টস। যে জিনিস নিয়ে রীতিমতো অনুশীলন চলছে, স্ট্র্যাটিজি ঠিক করা হচ্ছে, এমনকি এবার তো দেখা গেল বিশেষজ্ঞ গোলকিপারও আনা হয়েছে কেবলই টাইব্রেকার মাথায় রেখে, সেখানে টাইব্রেকারকে ভাগ্যপরীক্ষা নাম দেওয়াটা এবং এই নামে বর্ণনা করার চেষ্টাকে অর্বাচিনতা বলে গণ্য করা হবে না কোন যুক্তিতে?
টাইব্রেকার যদি এতটাই অগ্রহণযোগ্য হয়, তাহলে অমীমাংসিত থাকা নকআউটের খেলায় ফলাফলটা আসবে কীভাবে? নকআউটই-বা হবে কীভাবে?
কয়েক দশক আগে বাতিল করে দেওয়া ম্যাচ রিপ্লেই কি তাহলে আবার ফিরিয়ে আনতে হবে টাইব্রেকারের বিকল্প হিসেবে? তার জন্য যে সাফারিং, সেটার কী হবে? ওটা কেন বাতিল করা হয়েছিল, তা জানতে তো কারও আর এখন বাকি নেই।
৯০ মিনিটের পর আরও ৩০ মিনিট দেওয়া হল, খেলে ফল বের করার জন্য। এরপরেও ফল বের করতে না পারলে এটা ধরে নেওয়া কি খুবই অন্যয় যে "এই দুটি দল খেলে আর ফল বের করতে পারবে না?" আর তা যদি অন্যায় না হয়, তাহলে ফল বের করার জন্য কিছু প্লেয়ারের বিশেষ কোনো স্কিল পরীক্ষার যদি ব্যবস্থা নেওয়া হয়, সেটা ভাগ্যপরীক্ষার শর্ত পূরণ করে কীভাবে?
প্রশ্ন হল, বিশেষ স্কীলটা কী। সকল খেলোয়াড়দের জন্য তা হল স্পট কিকে উৎকর্ষতা যাচাই, আর গোলকিপারের জন্য স্পট কিক রুখতে পারার সক্ষমতা যাচাই। এই দুটো ব্যাপারই অনুশীলন করা এবং অনুশীলনের মাধ্যমে উৎকর্ষতা অর্জন সম্ভব। গত বত্রিশ বছর ধরে এটা হয়েও আসছে। এবারের বেশিরভাগ খেলোয়াড়ের জন্মের আগে থেকে। তারা কিন্তু জন্ম থেকেই জানে ও মানে যে, এটা ফুটবলের অংশ। আর কতদিন পার হলে সবাই সেটা জানবে ও মানবে? এরপরেও এটা ভাগ্যপরীক্ষা হয় কীভাবে?
হাজার হাজার বার কয়েন-টসের অনুশীলন করেও কিন্তু একজন অধিনায়ক বলতে পারবেন না যে, "আমি টসে জেতায় অনেক দক্ষতা অর্জন করেছি"। কিন্তু কয়েক শত বার স্পটকিক প্র্যাকটিস করেই একজন খেলোয়াড় যদি দাবি করেন যে, "আমি এখন স্পট কিক থেকে গোল করার ব্যাপারে অনেক কনফিডেন্ট'', তাকে "না, ওটা ভাগ্যপরীক্ষা, প্র্যাকটিস করার কিছু নেই"– এই ঝাড়ি গেলানো যাবে কীভাবে?
যাহোক, মূল প্রসঙ্গে যাই। বলছিলাম, চারটা দলই নিঃসন্দেহে যৌক্তিকভাবে শিরোপার দাবিদার। সেখান থেকে শেষ পর্যন্ত কে যে ফসল তুলে আনবে সেটা পরিষ্কার করে কারও পক্ষে বলা সম্ভব হচ্ছে না। প্রতিটা দলেরই অনেক সামর্থ্য আছে, আবার কিছু কিছু দুর্বলতাও আছে। খেলার দিন তারা নিজেদের সামর্থ্যের কতটা ব্যবহার করতে পারে আর প্রতিপক্ষের দুর্বলতার কতটা সুযোগ নিতে পারে সেটাই নির্ধারণ করে দেবে শেষ হাসিটা কে হাসবে।
এক এক করে এসবের বিশ্লেষণ করা যাক। পছন্দ অপছন্দ নয়, কেবলই বর্ণানুক্রমে।
প্রথম থেকেই আর্জেন্টিনার অতি-মেসি নির্ভরতাটাকে এবং ডি মারিয়া ও হিগুয়েনের নিস্প্রভ পারফরমেন্সকে তাদের দুর্বলতা বলেই মনে হচ্ছিল। কারণ একজন প্লেয়ার-নির্ভর দলের ট্যাকটিকস খুব সহজেই পড়ে ফেলা ও তা ভাঙার জন্য প্রতিষেধক বের করা সম্ভব। দেখা গেল তারপরও তাদের এই ট্যাকটিকস দিয়েই সাফল্যের সঙ্গেই তারা গ্রুপ পর্ব পার করল। রাউন্ড অব সিক্সটিনে গিয়ে যে উনত্রিশ বার তারা সবাই মিলে আক্রমণ চালাল, তার এগারোটিই ডি মোরিয়ার পা থেকে। এটা কি কাকতাল, নাকি পরিবর্তিত ট্যাকটিকস?
যখনই তারা বুঝল, প্রতিপক্ষ মেসিকে রুখতে ব্যস্ত, তারা এতদিন নিস্প্রভের ভান করা (?) ডি মোরিয়াকে আক্রমণের কেন্দ্রে নিয়ে এল, যার জন্য প্রতিপক্ষের সম্ভবত বিশেষ কোনো প্রস্তুতি বা পরিকল্পনা ছিল না। কোয়ার্টার ফাইনালে ঘটল আরেক চমক। এদিন নিশ্চয়ই মেসি ছাড়াও ডি মোরিয়াও ছিল প্রতিপক্ষের লক্ষ্য, অর্থাৎ পরিকল্পনার অংশ। আর এদিন তারা আক্রমণের কেন্দ্রে নিয়ে এল হিগুয়েনকে।
চমৎকার ডিসেপশন প্ল্যান। বোঝা গেল, এতদিন ধরে আন্ডার পারফর্ম (?) করার ভানটা ছিল আসলে গ্র্যান্ড স্ট্র্যাটিজির অংশ। সেমিফাইনালে কি তারা অন্য কাউকে কেন্দ্রে এনে তাকে দিয়ে আক্রমণ শানাবে? এত রিসোর্স কি আছে তাদের? যদি থাকে তাহলে আগের খেলাগুলোর মতো সেমিফাইনালেও ক্লিন ব্রেক অর্জন করা সম্ভব হবে। আর না হলে কঠিন হবে। তবে হবে না, এটা বলা যাবে না।
এই পর্যায়ে দুর্বলতা বলতে একটাই, ডিফেন্স তেমন কোনো কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়েনি। নেদারল্যান্ডের সঙ্গে সেই রকম কোনো পরীক্ষায় পড়লে তারা সেটা কীভাবে হ্যান্ডেল করবে, তা বলা যাচ্ছে না।
ব্রাজিল মূলত নেইমার-কেন্দ্রিকই ছিল। সঙ্গে আরও কিছু খেলোয়াড়ের ব্যক্তিগত পারফরমেন্স-নির্ভর। ওরা জ্বলে উঠতে পারলে সহজ জয় করায়ত্ত করেছে। না হলে কষ্টে জিতেছে। নেইমারের উপস্থিতির কারণে আরও কিছু খেলোয়াড় ব্যক্তিগত দক্ষতা দেখানো থেকে বঞ্চিত ছিলেন। নেইমারের অনুপস্থিতি মূল পরিকল্পনায় সমস্যা ঘটাবে কিন্তু অন্যদের দক্ষতা দেখানোর ও দল হিসেবেও নির্ভার হয়ে খেলার অনুপ্রেরণা দেবে। অন্যয়ের শিকার হলে পোয়টিক জাজমেন্ট পাবার একটা অদৃশ্য অনুপ্রেরণা যে তৈরি হয়, সেটার সুযোগ তারা নিতে পারেন কিনা দেখার অপেক্ষায় রইলাম।
শুরু থেকে সকল বিভাগে যে যে সমন্বয়হীনতা চোখে পড়ছিল, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা অনেক কমে গেছে বলেই মনে হচ্ছে। এখান থেকেও তারা কিছু সুবিধা বের করতে পারে কিনা, সেটাও দেখার অপেক্ষায় থাকলাম। আর স্বাগতিক হিসেবে চাপের পাশাপাশি সমর্থনের কিছু বাড়তি সুবিধা তো থাকবেই।
জার্মানি ও নেদারল্যান্ড উভয়েই প্রথম থেকেই প্রতিপক্ষের উপরে একটা চূড়ান্ত আধিপত্য বিস্তার করে খেলার মনোভাব নিয়ে শুরু করে। প্রতিপক্ষ এটা একবার সামাল দিতে পারলে ওরা কেমন যেন খেই হারিয়ে ফেলে। ওদের কোনো প্লান-বি আছে কিনা, আর থাকলেও সেটা যে কী বোঝা কঠিন হয়ে পড়ে। তবে এই চূড়ান্ত আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টাটা সফল করতে পারলে প্রতিপক্ষ সহজেই আত্মসমর্পণ করে। স্পেন ও পর্তুগাল যা করেছিল।
খেলার দিন কোনটা যে ঘটবে, আগে থেকে বলা যাচ্ছে না। তবে প্লান-বি না থাকার কারণে এই পর্যায়ে মানে সেমিফাইনালে ভালোই সমস্যায় পড়ে যেতে পারে দুদল। এই দুটি দলেরই প্রধান শক্তি হল দলের গভীরতা এবং আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের চেয়ে সংঘবদ্ধতায় এগিয়ে থাকাটা। এটার ব্যবহার তারা কতটা করতে পারে, সেটা দেখতে চাই।
এই পর্যায়ে এবারের বিশ্বকাপে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হল, কোনো ফেভারিট বা আন্ডারডগ নেই। শিরোপার জন্য চারটি দলই প্রায় সমান সম্ভাব্য। পার্থক্য যেটা আছে, তা উনিশ-বিশ। আর ফাইনালটা তো ওয়াইড ওপেন। আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনা-জার্মান ফাইনাল যতটা সম্ভব ব্রাজিল-নেদারল্যান্ড বা জার্মান-নেদারল্যান্ড ফাইনালও ততটাই সম্ভাব্য। আর সেই ফাইনালে বিজয়ী হতে পারে এই চার দলের যে কেউই।
সেমিফাইনাল পর্বে এসেও যে কোনো দল কোনো রকম নির্ভারতা অর্জন করতে পারেনি আর তাদের শক্তিরও যে একটা প্যারিটি তৈরি হয়েছে, এটা নিঃসন্দেহে ফুটবলের একটি বিজয়, যাকে ফিফারও একটি সাফল্য বলে গণ্য করা যায়।
আরও কিছু মনোমুগ্ধকর ফুটবল বিনোদন পাবার অপেক্ষায় থাকলাম।