রাজীব হত্যা, ‘ট্রোজান হর্স’ এবং মূল্যবোধ

সীনা আক্তার
Published : 5 July 2014, 08:30 PM
Updated : 5 July 2014, 08:30 PM

২০১৩ সালে শাহবাগ আন্দোলন গড়ে ওঠার সময় অন্যতম আলোচিত ঘটনা ছিল ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারের নৃশংস হত্যাকাণ্ড। তাকে হত্যা করা হয়েছে ধর্মের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গীর কারণে। গোয়েন্দা পুলিশ এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে আট তরুণকে অভিযুক্ত করেছে, যা আদালতে বিচারাধীন। এই তরুণরা সবাই দেশের এক নামকরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, যারা দেশের বিভিন্ন জেলায় বাংলা এবং ইংরেজি মাধ্যম স্কুল-কলেজে পড়াশোনা শেষে উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে।

একই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী কাজী নাফিস সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অভিযুক্ত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে কারাদণ্ড ভোগ করছে। সে ঢাকা শহরের নামকরা বেসরকারি স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করেছে। ক'দিন আগে সন্ত্রাসবাদে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রে রাহাতুল আশিকিম খান নামে আরেক বাংলাদেশি তরুণকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

রাজীবের করুণ মৃত্যু এবং আমেরিকায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড– এসবের মূল কারণ এই তরুণদের চরমপন্থী মতাদর্শ এবং তৎপরতা। অনেকের গৎবাঁধা ধারণা, কেবল মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থায় চরমপন্থী মূল্যবোধের বিস্তার ঘটে এবং মূলধারার বাংলা-ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থা এসবের বাইরে, 'নিরাপদ'! এই ভ্রান্ত ধারণার জ্বলন্ত প্রমাণ উপরোল্লিখিত তরুণদের অতীত শিক্ষা-পরিবেশ।

তাই বলা যায়, মাদ্রাসা শিক্ষা যেমন সবসময় চরমপন্থা নয়, একইভাবে মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থা সবসময় চরমপন্থার বাইরে নয়। এ কারণে মূলধারার বাংলা-ইংরেজি শিক্ষা ব্যবস্থায় কী ধরনের মূল্যবোধ এবং মতাদর্শের বিকাশ হচ্ছে তা নজরদারি করা অতিগুরুত্বপূর্ণ এবং সময়ের দাবি। কারণ আমাদের কিশোর-তরুণদের মানস গঠন এবং সমাজ-সংস্কৃতির ভবিষ্যতের সঙ্গে জড়িত। একই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে জাতি হিসেবে আমাদের মূল্যবোধ, 'বাংলাদেশি মূল্যবোধ' সুস্পষ্টভাবে প্রচার করা এবং সকলকে, বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের তা অনুধাবন এবং অনুসরণে উৎসাহিত করা।

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, সম্প্রতি ব্রিটিশ মূল্যবোধ (British value) এবং (ইসলাম) ধর্মীয় চরমপন্থা নিয়ে সে দেশে রীতিমতো তোলপাড় চলছে। এর প্রেক্ষিতে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন বিশেষভাবে এই মূল্যবোধ সুস্পষ্ট করেছেন এভাবে–

''ব্রিটিশ মূল্যবোধ হচ্ছে সব ধরনের স্বাধীনতায় বিশ্বাস, অন্যদের প্রতি সহনশীলতা, ব্যক্তিগত এবং সামাজিক দায়িত্ব গ্রহণ, আইনের শাসন এবং ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠানের প্রতি সম্মান প্রদর্শন…।''

সরকারি-বেসরকারি-ধর্মীয় বা যে কোনো ধরনের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রতিটা স্কুলের এবং প্রত্যেক শিশু-কিশোরকে এই মূল্যবোধ শিক্ষায় উৎসাহিত করা উচিত বলে তিনি গুরুত্বারোপ করেছেন। একই সঙ্গে ব্রিটিশ সরকার 'চরমপন্থা'র বর্ধিত সংজ্ঞা প্রচার করছে–

''মৌলিক ব্রিটিশ মূল্যবোধের মৌখিক বা সক্রিয় বিরোধিতা করা হচ্ছে চরমপন্থা এবং এই মূল্যবোধ হচ্ছে গণতন্ত্র, আইনের শাসন, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, পারস্পরিক সম্মান এবং বিভিন্ন ধর্ম ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীলতা।''

সরকার এই মূল্যবোধের উপর অধিক জোর দিচ্ছে যাতে মুসলিম কিশোর-তরুণরা উগ্রপন্থীকরণ প্রক্রিয়া এবং চরমপন্থা (radicalisation & extremism) থেকে দূরে এবং নিরাপদ থাকতে পারে।

বিশেষ দুটি কারণে এই চরমপন্থা এবং মূল্যবোধের বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে, যা আমাদের দেশের জন্যও প্রযোজ্য মনে করি। এক– যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম শহরে মুসলিম গভর্নরদের দ্বারা পরিচালিত ২৫টি 'সরকারি' মাধ্যমিক এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে তথাকথিত 'ট্রোজান হর্স' ষড়যন্ত্র। দুই– সিরিয়া যুদ্ধে ব্রিটিশ মুসলিম কিশোর-তরুণদের অংশগ্রহণ। তদন্তে অভিযুক্ত বার্মিংহামের এই বিদ্যালয়গুলিতে কৌশলে সাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ চর্চা হচ্ছিল, যা চরমপন্থার বৃদ্ধি ও বিস্তার ঘটাতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

আরও অভিযোগ উঠেছে যে, এই বিদ্যালয়গুলিতে ব্রিটিশ মূল্যবোধের আলোকে শিক্ষাদান হচ্ছে না। তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লিখিত কয়েকটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ হচ্ছে, কিছু সংখ্যক গভর্নর ধর্মনিরপেক্ষ (non faith) এই বিদ্যালয়গুলিতে একটি সংকীর্ণ (ধর্ম) বিশ্বাসভিত্তিক মতাদর্শ আরোপ ও প্রচার করার চেষ্টা করছে; শিশু-কিশোরদের সকল ধর্ম-সংস্কৃতির প্রতি সহনশীলতা তৈরিতে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে না; শিশু-কিশোরদের চরমপন্থী মতাদর্শ থেকে দূরে রাখার জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

সক্রিয়ভাবে সংকীর্ণ-পশ্চাৎপদ মূল্যবোধ এবং ধর্মবিশ্বাসে উৎসাহদান– যা বৃহত্তর সমাজ-সংস্কৃতির সঙ্গে শিশু-কিশোরদের মানসিক দূরত্ব তৈরি করে তাদের অরক্ষিত ও ঝুঁকিপূর্ণ করছে। শিক্ষার্থীদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সঙ্গীত শিক্ষা কারিকুলাম থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। কিছু বিদ্যালয়ে মেয়ে এবং ছেলেদের প্রতি সম-বিবেচনা ও সম-আচরণ করা হচ্ছে না। এসব তৎপরতা কৌশলে সংগঠিত হচ্ছিল বলে একে বলা হচ্ছে 'ট্রোজান হর্স' ষড়যন্ত্র।

'ট্রোজান হর্স' হচ্ছে গ্রিক পুরাণের কাহিনী যার উৎস ট্রয়ের যুদ্ধ। গ্রিকরা ট্রয় নগরীতে প্রবেশের জন্য যুদ্ধ-কৌশল হিসেবে এক বিশাল কাঠের ঘোড়া তৈরি করে, যার মধ্যে সৈন্যরা লুকিয়ে থাকে। কাঠের ঘোড়াটিকে ট্রয় শহরের বাইরে ফেলে রেখে গ্রিক সৈন্যরা ট্রয় এলাকা থেকে চলে যাবার ভান করে। অন্যদিকে পরিত্যক্ত কাঠের ঘোড়াটিকে সাফল্যের বিজয়স্মারক মনে করে ট্রয় সৈন্যরা তা শহরে নিয়ে যায়। সুযোগ বুঝে গ্রিক সৈন্যরা কাঠের ঘোড়া থেকে বের হয়ে ট্রয় শহরের দখল নেয়।

আমাদের দেশে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষকরা শিশু-কিশোরদের কী ধরনের নৈতিকতা-মূল্যবোধ শিক্ষায় উৎসাহদান করেন? সেখানে বহিরাগতদের প্রবেশ, তৎপরতা এবং 'ট্রোজান হর্স' ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে আমরা কতটা সচেতন? আমরা সাধারণত কোনো বিষয়ে চরম পরিণতি প্রকাশ পেলেই নড়াচড়া করি। তারপরও প্রায়ই ঘটনার মূল অনুসন্ধান করা হয় না বা ঘটনার উৎস নিয়ে গবেষণার আলোকে ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না।

উদাহরণ হিসেবে আবার আসছি রাজীব হত্যা এবং নাফিজের ঘটনা প্রসঙ্গে। সাধারণত তরুণদের চরমপন্থী মতাদর্শ একদিনে তৈরি হয় না। বলা হয় শিশু-কিশোর বয়সেই মানুষ পারিবারিক-সামাজিক-ধর্মীয় মূল্যবোধ, মতাদর্শ, নৈতিক শিক্ষা রপ্ত করে। ঘটনাক্রমে আমরা রাজীব হত্যায় সংশ্লিষ্ট ওই আট তরুণ এবং নাফিজের উগ্র ধর্মীয় মতাদর্শ বিষয়ে অবগত হয়েছি, এদের বাইরে হয়তো আরও অনেক কিশোর-তরুণ আছে যাদের সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা নেই। কীভাবে, কোন ধরনের শিক্ষায় এবং কাদের সংস্পর্শে উল্লিখিত এই তরুণরা উগ্রপন্থী মতাদর্শে দীক্ষিত হয়েছে বিস্তারিত জানা যায়নি। যথাযথভাবে এদের মনোবিশ্লেষণের মাধ্যমেই তা জানা যেতে পারে, যা অন্য তরুণদের জন্য সতর্কতামূলক কর্মপরিকল্পনায় সহায়ক হতে পারে।

অভিযুক্ত তরুণদের বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কিছুটা তদন্ত হয়েছিল শুনেছি, কিন্তু তারপর কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে জানি না। একইভাবে এই তরুণদের কলেজ এবং স্কুলের শিক্ষা ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক পরিবেশের ব্যাপারে কোনো তদন্ত হয়েছে কি না জানা নেই। জাতি-ধর্ম-লিঙ্গ-শ্রেণি নির্বিশেষে সহমর্মিতা-সহনশীলতা, নৈতিকতা এবং মূল্যবোধ শিক্ষাদানে এসব স্কুল-কলেজ কতটা নির্ভরযোগ্যভাবে দায়িত্ব পালন করছে তা কি আমরা জানি?

আমাদের দেশে মোটামুটি চার ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় মূলধারার শিক্ষা ও মাদ্রাসা শিক্ষা। অন্যদিকে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় আছে ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা ও কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা। আমরা জানি, মাদ্রাসায় ইসলামি মূল্যবোধ অগ্রাধিকার দেওয়া হয় এবং সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় সর্বজনীন মূল্যবোধে গুরুত্ব দেওয়া হয়। ইসলামি মূল্যবোধ এবং উগ্রপন্থী মতাদর্শ সমার্থক নয়। অন্যভাবে বলা যায় ইসলাম ধর্মে চরমপন্থার স্থান নেই। কিন্তু লজ্জা ও উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে বর্তমান বিশ্বে অধিকাংশ উগ্র জঙ্গী তৎপরতার সঙ্গে মুসলিমরা জড়িত– তাতে মনে হয় যেন ধর্মের সঙ্গেই চরমপন্থার বসবাস।

তার মানে কোনো ব্যক্তি-গোষ্ঠীর হীন স্বার্থে ধর্মকে (কু) কৌশলে ব্যবহার করা হচ্ছে এবং তা করা হচ্ছে বিশেষ করে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে। যে কোনো শিক্ষাব্যবস্থায় কৌশলে শিশু-কিশোরদের উগ্রপন্থী মতাদর্শ দীক্ষা দেওয়া এবং যে কোনো ধরনের চরমপন্থায় উৎসাহদান সমাজ-সংস্কৃতির জন্য ভয়ানক বিপদজনক, যা দেশ-জাতির ভবিষ্যতের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ হতে পারে।

অনেক অভিভাবক সর্বজনীন অথবা ইসলামি মূল্যবোধে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য তাদের ছেলেমেয়েদের নামকরা বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করেন। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃক শিশু-কিশোরদের ধর্মীয় মূল্যবোধের নামে কোনো প্রকার উগ্রপন্থী মতাদর্শ এবং চরমপন্থায় উৎসাহদান রীতিমতো অন্যায়, প্রতারণাও বটে– যা উক্ত শিক্ষার্থী, তাদের অভিভাবক এবং দেশ ও সমাজের প্রতি প্রতারণা। সরকারের সীমিত নজরদারি এবং অভিভাবকদের সচেতনতার অভাবে এ ধরনের প্রতারণামূলক তৎপরতা সংগঠিত হতে পারে।

তাই এ বিষয়ে সরকারি-বেসরকারি মূলধারার বাংলা, ইংরেজি, মাদ্রাসা কোনো ব্যবস্থাকেই পুরোপুরি নিরাপদ ভাবাটা বোকামি। এ ব্যাপারে অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। কারণ আমরা আর কোনো তরুণের জীবনে রাজীব, নাফিজের মতো পরিণতি চাই না। সতর্কতামূলক বার্তা হিসেবে এদের ঘটনাগুলোই যথেষ্ট। তাছাড়া আজকের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা আগামী পাঁচ থেকে দশ বছরের মধ্যে মূল্যবান ভোটার হয়ে উঠবে, যারা নির্ধারণ করবে আমাদের ভবিষ্যত সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতি-অর্থনীতির গতিপথ।

সে জন্যই এই শিশু-কিশোরদের সঠিক মূল্যবোধ, মতাদর্শ গঠনে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়া অত্যাবশ্যক।

ড. সীনা আক্তার: লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের পোস্ট গ্র্যাজুয়েট, প্যারেন্টিং পেশাজীবী।