সুষমার সফর: প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

লাইলুফার ইয়াসমিন
Published : 3 July 2014, 04:41 AM
Updated : 3 July 2014, 04:41 AM

ভারতের সাম্প্রতিক জাতীয় নির্বাচন এবং দিল্লির মসনদে নতুন সরকারের আরোহণ বাংলাদেশের জন্য বিরাট উদ্বেগের বিষয় ছিল। রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে কংগ্রেসের বিদায় (যে কংগ্রেস বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের চিরকালীন ও বিশ্বস্ত মিত্র বলেই বিবেচিত) ভবিষ্যতে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের রূপটি কেমন হবে তা নিয়ে ব্যাপক জল্পনার জন্ম দেয়।

তবু আওয়ামী লীগ ও বিএনপি, দুটি দলই ভারতের নতুন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে অভিনন্দন জানাতে দেরি করেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে আহবান জানিয়েছেন যেন তাঁর প্রথম বিদেশ সফরের জন্য তিনি বাংলাদেশকেই বেছে নেন, যেন দেশ দুটি স্বাভাবিক ও ঘনিষ্ঠ উন্নয়ন সহযোগী হয়ে ওঠে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী তাঁর প্রথম সফরের জন্য ভুটানকে বেছে নিলেন। কিন্তু তাঁর বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক মন্ত্রী সুষমা স্বরাজ তাঁর দ্বিতীয় সফরে ঢাকায় এলেন। বাংলাদেশের দিক থেকে এই সফরের প্রভাব নিয়ে বিপুল উত্তেজনা দেখা গেছে, স্থানীয় পত্রপত্রিকায় যে সংখ্যক লেখালেখি প্রকাশ হয়েছে, তার বিচারে বলতে হয়। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে স্থলসীমা চুক্তি (এলবিএ) এবং বাংলাদেশের অংশে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে অনেক উচ্চাশা তৈরি হয়েছিল।

অন্যদিকে, ভারতের পত্রপত্রিকাগুলো এটি স্পষ্ট করেছিল যে, সুষমার এই সফর শুভেচ্ছা সফর মাত্র, তাই এ সফরে তিনি কোনো গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা নিয়ে আলোচনা করবেন না, যদিও বাংলাদেশ থেকে ভারতে অবৈধ অভিবাসনের ব্যাপারে ভারতের উদ্বেগ বাড়ছে, তবু। এক কথায়, সুষমার সফরটা বড়জোর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে ঝালাই করে নেওয়ার একটা উদ্যোগ।

তিন দিনের ব্যস্ত সফরের প্রথম দিনের সকালে সুষমা দেখা করলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলীর সঙ্গে। দুপুরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাত করতে গিয়ে তাঁর হাতে মোদির পক্ষ থেকে ভারত সফরের আমন্ত্রণপত্র তুলে দেন সুষমা। সারাদিন অনেকগুলো সভা করে সাংবাদিক সম্মেলনে এটা জানানো হল যে, তিস্তা ও স্থলসীমা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এরপর সুষমা বিরোধী দলের নেত্রী রওশন এরশাদ এবং বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করলেন।

তিস্তার পানি বণ্টন এবং স্থলসীমা ইস্যু দুটো দু'দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মধ্যে অনেক দিন ধরেই জ্বলন্ত ইস্যু হয়ে রয়েছে। ২০১১ সালে তখনকার ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর নিয়ে বাংলাদেশ খুবই উদ্বেল ছিল, যদিও তখন বিজেপি, তৃণমূল ও অসম গণপরিষেদের আপত্তির মুখে সেটা ভেস্তে যায়। পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূল কংগ্রেসের নেত্রী মমতা ব্যানার্জি সাবেক কংগ্রেস সরকারকে তিস্তা ইস্যুতে পশ্চিবঙ্গের উদ্বেগ উপেক্ষা করার দায়ে অভিযুক্ত করেছিলেন। এবার ঢাকায় 'ঝালাই সফরে' আসার আগে সুষমা মমতাকে অপ্রত্যাশিতভাবে ফোন করেন তাকে দিল্লির পদক্ষেপ সম্পর্কে একটু জানিয়ে রাখতে। এটা আজ পরিষ্কার হয়েছে যে, ভারতের পক্ষে এই ইস্যুতে 'অভ্যন্তরীন আলোচনা' চলছে।

এলবিএ বিল– যেটি দুটি দেশের সীমানা পুনঃনির্ধারণ এবং ছিটমহল ও এগুলোর অধিবাসীদের ভাগ্যে কী ঘটবে তা নির্ধারণের সঙ্গে সম্পর্কিত— বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের মধ্যে যে সহজে প্রবেশগম্যতা বিদ্যমান, তার প্রেক্ষিতে আরেকটি সংবেদনশীল ইস্যু। এটা জানা গেছে যে, ভারতের জাতীয় পার্লামেন্ট, রাজ্যসভা বিলটি সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছে এবং এটা দ্রুত চূড়ান্ত করার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রত্যাশামতো, কোলকাতায় সম্প্রতি গ্রেপ্তার হওয়া বাংলাদেশের সাত খুনের আসামি নূর হোসেনকে হস্তান্তর করার ব্যাপারে কথা বলেছে বাংলাদেশ।

ভারতের দিক থেকে জ্বলন্ত ইস্যু হল বিশেষত এর উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বাংলাদেশিদের অবৈধ প্রবেশের (তাদের ভাষায়) বিষয়টি। জাতীয় নির্বাচনের প্রচারাভিযানে বিজেপির প্রচারকরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে,তারা ভারতে বসবাসকারী সব অবৈধ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠাবেন। ভারতের প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জি জানিয়েছেন যে,বিজেপির নতুন সরকার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিষয়ে কাজ করতে গেলে অগ্রাধিকার দেবে অবৈধ বাংলাদেশিদের ইস্যুটি। এরই অংশ হিসেবে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্র্রণালয় ন্যাশনাল রেজিস্টার ফর সিটিজেন (এলআরসি) প্রক্রিয়াটি আপডেট করতে কাজ করেছে। এটি সবচেয়ে আগে, ১৯৭১ সালে আসামের নির্বাচনের সময় তৈরি করা হয়েছিল, এই প্রক্রিয়াতে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর ভারতে প্রবেশকারী বাংলাদেশিদের সবাই 'অবৈধ' বলে বিবেচিত হবে। বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ এই স্পর্শকাতর ইস্যুতে নিরবতা ধরে রেখেছেন, ভারতসহ বিশ্বের যে কোনো দেশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী তৎপরতা চালাতে নিজেদের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দেবেন না বলে তারা ভারতকে নিশ্চয়তা দিয়েছেন।

এই সফর থেকে বাংলাদেশের জন্য দৃশ্যমান সাফল্য এই যে, আমরা ভারতের কাছ থেকে ভিসা-সহজীকরণের প্রস্তাব পেয়েছি। যার অধীনে তেরো বছরের নিচের শিশু ও পঁয়ষট্টি-ঊর্ধ্ব ব্যক্তিরা ৫ বছরের মাল্টিপল ভিসা পাবেন। তাছাড়া সুষমা চেয়েছিলেন যে,বাংলাদেশি নাগরিকদের অন-অ্যারাইভাল ভিসা সুবিধা এবং তেরোর কম ও পঁয়ষট্টি-ঊর্ধ্বদের ভিসা-ফ্রি এন্ট্রির সুযোগ দিতে। যতটুকু জানা গেছে, আসামের আপত্তির কারণে প্রস্তাবটি তিনি দিতে পারেননি।

প্রত্যাশামতো, সুষমার সফরে আমরা বেশি কিছু পাইনি, শুধু ভারতের সেই নীতিগুলোরই পুনরাবৃত্তি ছাড়া, যেমন তারা বাংলাদেশের প্রয়োজন উপলব্ধি করে কখনও কোনো সুনির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেয় না। ভারতের সংবিধানের ফেডারেল প্রকৃতির কথা মনে রাখলে, দ্বিপাক্ষিক ইস্যুর সমাধান কেন্দ্র একা করতে পারে না। ভারতের বৈদেশিক নীতি নির্ধারণে কূটনৈতিক তৎপরতার যে উপাদানটি রয়ে গেছে সেটি সচরাচর শেষ হয় না।

বলা হচ্ছে যে, উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবারের নির্বাচনী রাজনীতিতে (বিজেপি, কংগ্রেস উভয়ের তরফেই) অন্যান্য অঞ্চলের ‍তুলনায় অনেক পিছিয়ে রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে এ এলাকাই তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এ প্রেক্ষিতে যে কেউ নির্দ্বিধায় বলতে পারেন যে, ভারতের অভ্যন্তরীন রাজনৈতিক মেরুকরণের শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ-ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক।

যারা মনে করেন যে, ছোট্ট দেশ বলে আমাদের কাছে দরকষাকষির তেমন সুযোগ নেই, তাদের দুবার ভাবা উচিত। আমরা আয়তনে ছোট রাষ্ট্র হতে পারি, কিন্তু আমাদের অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান প্রবৃদ্ধি আন্তর্জাতিক সমাজের মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে। অর্থনীতিবিদ জন ও নিল বাংলাদেশকে নেক্টট-১১ (এন-১১)-এর অন্তর্ভুক্ত করেছেন, এন-১১ ভুক্ত দেশগুলোর একুশ শতকের বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে উঠবার সম্ভাবনা রয়েছে।

বাংলাদেশের বাজারের ব্যাপক আয়তন গত যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে চীনের। চীন আমাদের চট্টগ্রাম বন্দরের আধুনিকায়নে বিনিয়োগ করছে, সে সঙ্গে গভীর সমুদ্রে কনটেইনার সুবিধা নির্মাণের জন্য সাহায্য করেছে। এসব গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্টে বিনিয়োগ ছাড়াও, গত জুনে সে দেশে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় বাংলাদেশের সঙ্গে একযোগে কাজ করার ব্যাপারে চীন কিছু চুক্তিও স্বাক্ষর করেছে। দুদেশ যৌথভাবে ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লা-চালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনসহ অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহযোগিতার চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। দুর্যাগের সময় উদ্ধারের যন্ত্রপাতির জোগান দিতে এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য গবেষণায় সাহায্য করতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটি, সোনাদিয়া দ্বীপের বন্দর সুবিধা নির্মাণের দ্বিতীয় পর্যায়ে বড় অংকের অর্থ জোগানোর ব্যাপারেও অঙ্গীকার করেছে। এটি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে আঞ্চলিক বিভিন্ন লেনদেনে একটি কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠবে। যদিও বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত চীনের সঙ্গে এসব বিষয়ে কোনো চুক্তি চূড়ান্ত করেনি, এটাও ধারণা করা হচ্ছে যে, এসব ডিলের ক্ষেত্রে চীনই তালিকার উপরের দিকে থাকবে। যদিও বাংলাদেশের ব্যাপারে চীনের আগ্রহের বিষয়টি ভারতের মনোযোগের বাইরে নয়।

সম্প্রতি ভারতের বিখ্যাত কৌশল বিষয়ক বক্তা রাজা মোহন এ ব্যাপারে অভিযোগ করেছেন যে, প্রতিবেশিদের সঙ্গে দ্রুত ঝামেলা মেটাতে ভারতের গড়িমসি বঙ্গোপসাগরে চীনের প্রবেশ সহজ করে দিচ্ছে। তার অভিযোগের পুরোটাই হয়তো সত্যি নয়, তবে এ অঞ্চলে নিজের শক্তিতেই বাংলাদেশ প্রধান ভূমিকা নিয়ে নিয়েছে। সম্প্রতি মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধের ব্যাপারে একটি সাফল্য এসেছে বাংলাদেশের ঘরে। ২ জুলাই ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে এমন একটি বিরোধের সালিশির রায় পাওয়া যাবে।

এমন প্রেক্ষিতে ভারতের উচিত বাংলাদেশের উদ্যোগগুলো মনে রাখা। শুধু এ জন্য নয় যে,বাংলাদেশ ভারতের নিরাপত্তা ইস্যুতে যথেষ্ট মনোযোগ দিচ্ছে, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে জরুরি প্রয়োজনে সাহায্যও করছে। বাংলাদেশ সম্প্রতি তার এলাকা ও অবকাঠামো ব্যবহার করে অন্ধ্র প্রদেশ থেকে ত্রিপুরায় রিলিফ দ্রব্য পাঠানোর অনুমতি দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ২০১২ সালে ভারতের রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত অয়েল অ্যান্ড ন্যাচারাল গ্যাস কর্পোরেশনকে দক্ষিণ ত্রিপুরায় একটি পাওয়ার প্রজেক্টে যন্ত্রপাতি পাঠানোর অনুমতি দিয়ে একই রকম সৌজন্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে এসব করতে গিয়ে বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে কোনো ট্রানজিট বিলও নেবে না।

বাংলাদেশের এতসব উদ্যোগের পরও দেখা যাচ্ছে, ভারতের বিভিন্ন অংশে বাংলাদেশের সঙ্গে দৃঢ় দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক গড়তে অনীহা কাজ করছে। নতুন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর বৈদেশিক নীতিতে আঞ্চলিক সম্পর্কগুলোকে অগ্রাধিকার দেবেন বলেছেন। ভিসা তুলনামূলক সহজীকরণের উদ্যোগের মতো হঠাৎ কোনো পদক্ষেপ সাম্প্রতিক অতীতের পুনরাবৃত্তিরই ইঙ্গিত করে। ফেডারেল ইন্ডিয়া কীভাবে ভবিষ্যতে এসব বাধা কাটিয়ে উঠবে? সুষমার এই শুভেচ্ছা সফর বাংলাদেশের জন্য কতটা কংক্রিট সাফল্য বয়ে আনবে?

এখনকার অবস্থায় মনে হয়, একমাত্র কোনো হারকিউলিয়ান ইফোর্টই বাংলাদেশকে ভারতের কাছ থেকে তার প্রাপ্যগুলো আদায়ে সাহায্য করতে পারে।

লাইলুফার ইয়াসমিন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক।