জাগো যুববন্ধুরা, মুক্তির সংগ্রামে

মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান
Published : 18 Dec 2010, 07:20 PM
Updated : 18 Dec 2010, 07:20 PM

আমরা এ বছরটা ভালোই কাটালাম। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এবং শিশুমৃত্যুহার কমানোর ক্ষেত্রে সাফল্যের জন্য আমাদের প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিকভাবে পুরস্কৃত হয়েছেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানে কলেরা ও যক্ষা রোগনির্ণয়ে আমাদের বিজ্ঞানীরা উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছেন। তাঁরা ডায়ারিয়া প্রতিরোধে শিশুদের জন্য টিকা আবিষ্কার করেছেন। কৃষিবিজ্ঞানীরা পাটের জিনোম এবং খরাবান্ধব ধানবীজ আবিষ্কার করেছেন। আমাদের ক্রিকেটাররা দেশবিদেশে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করেছেন। বঙ্গসন্তানেরা বিদেশে সুকর্ম করে প্রশংসা অর্জন করেছেন। ফটিকছড়ির ছেলে ড. শুভ রায় কৃত্রিম কিডনি তৈরি করেছেন। ২৩ মে ২০১০ ভোর ৫টা ৫ মিনিটে মুসা ইব্রাহিম এভারেস্টের চূড়ায় বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা উড়িয়েছেন। এ পটভূমিতে আমরা বড় আশা করে তোমাদের দিকে তাকিয়ে আছি। দেশ বা সমাজের উন্নয়নকর্ম জটিল, কঠিন ও বিচিত্র এবং মোটেই সহজ ও স্বচ্ছ নয়। সমাজের সব দায়িত্ব কেবল নির্বাচিত প্রতিনিধির ওপর ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া যায় না। আজ সারা পৃথিবীতে রাজনীতিবিদদের ভাবমূর্তি মেঘাচ্ছন্ন। নিজেদের বেতন-ভাতা, সুবিধাদি এবং বিশেষ অধিকার সম্পর্কে এরা উদগ্রভাবে সচেতন। পৃথিবীর সর্বত্র এদের দেখা যায়। নির্বাচনের কড়ি সংগ্রহে নামকরা রাজনীতিকরা ধরা খেয়েছেন ইউরোপে। এক্ষেত্রে আমরা অবশ্য ধরাছোঁয়ার বাইরে।

পাশ্চাত্যের যে সব দেশে গণতান্ত্রিক পুঁজি ঐতিহ্যগতভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত সে সব দেশের গণতন্ত্রে ফাটল দেখা যাচ্ছে। ওই সব দেশের কেচ্ছা-কেলেঙ্কারির কথা তুলে দরিদ্র দেশের ফকির-মিসকিন গণতন্ত্রের পান্ডারা নিজেদের অনিয়ম ঢাকতে অজুহাত প্রদর্শন করে থাকেন।

১৯৮৯ সালে বার্লিন প্রাচীর ভাঙার পর বিশ্বের অর্ধেকের বেশি মানুষ এখন কোনো না কোনো গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় বসবাস করছে। সম্প্রতি 'দি ইকোনোমিস্ট' পত্রিকার বিশেষ বিভাগ ইকোনোমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট কর্তৃক ২০১০ সালের গণতন্ত্রের সূচকের একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। পাঁচটি বিষয় Ñ নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও বহুত্ববাদ, জনগণের স্বাধীনতা, সরকারের কর্মপদ্ধতি, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি Ñ বিবেচনা করে বলা হয়েছে পূর্ণ গণতন্ত্র রয়েছে ২৬টি দেশে। এক্ষেত্রে নরওয়ের স্থান শীর্ষে। সুইডেন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে গণতন্ত্র-চর্চায় অবনতি ঘটেছে। ৫৩টি ত্র"টিযুক্ত গণতন্ত্রের মধ্যে ভারত একটি। বাংলাদেশের অবস্থান রয়েছে তৃতীয় শ্রেণীতে, সঙ্কর শাসনব্যবস্থার দেশসমূহের মধ্যে। তবে যেখানে বহু উন্নয়নশীল দেশ গণতন্ত্রের সূচকে পিছিয়ে পড়েছে, সেখানে বাংলাদেশ আট ধাপ এগিয়ে বর্তমানে ৮৩তম স্থানে আছে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা চালু রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে ও আফ্রিকায়।

গণতন্ত্রের সূচকে প্রথম শ্রেণীতে উঠতে আমাদের আরো দুই শ্রেণী পার হতে হবে। পাঁচটির প্রতিটি ক্ষেত্রে নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও বহুত্ববাদ, জনগণের স্বাধীনতা, সরকারের কর্মপদ্ধতি, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে আমাদের অনেক ঘাটতি রয়েছে। সেই ঘাটতি দূর করে আমাদের নাগরিক সম্পদ বৃদ্ধি করতে হবে। এ ব্যাপারে তরুণ প্রজন্মকে এগিয়ে এসে বয়স্কদের বিড়ম্বনা লাঘব করে দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে হবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন রুজভেল্ট ১৯৪১ সালের জানুয়ারি মাসে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অভিষ্ট লক্ষ্য হিসেবে চার স্বাধীনতার কথা উল্লেখ করেন। বাক্-স্বাধীনতা, আরাধনার স্বাধীনতা এবং অভাব ও ভয় থেকে স্বাধীনতা। আমি মনে করি, আমরা আরেকটি ভয়ে আতঙ্কিত। সে ভয় হচ্ছে নির্বাচনে হেরে যাবার ভয়। যতদিন না আমরা এই ভয় থেকে মুক্ত হচ্ছি ততদিন আমাদের নির্বাচন হবে ব্যয়বহুল, জবরদস্তিমূলক, বিদ্ধিষ্ট ও পঙ্কিল। তরুণ প্রজন্মকে আমাদের শেখাতে হবে নির্বাচন বা প্রতিযোগিতায়-প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফলাফলকে মেনে নিতে হবে। হাসিমুখে না হলেও গোমড়ামুখে নিমরাজি হয়ে। তরুণ প্রজন্মকে জবাবদিহি ও দায়িত্ববোধ রপ্ত করতে হবে। গুরু বা লঘু অসদাচরণকে 'কী হয়েছে তাতে' বলে যেন তারা বেপরোয়া না হয়।

আজকাল রাষ্ট্রীয় কর্তব্য অভাবিতভাবে বেসরকারিকরণের চেষ্টা হচ্ছে। ইউরোপের কোথাও কোথাও কারাগারের প্রশাসন বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। বেসরকারিভাবে পাশের দেশে বন্দর বিদ্যুৎকেন্দ্র ও রেলপথ নির্মিত হচ্ছে। সংস্কারকর্ম দেখাশোনার জন্য বেসরকারি সংস্থার ওপর নির্ভর করা হচ্ছে। রাষ্ট্রের কর্তব্যকর্মের কিছু ভার সুশীল সমাজের ঘাড়ে এসে পড়েছে। সুশীল সমাজের আওতায় সমাজহিতৈষী, দেশশুভানুধ্যায়ী থেকে আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপর দালাল-মুৎসদ্দি সবাই স্থান করে নেয়। এরা অনেকে বহির্দেশীয় সম্মানে ইজ্জতপ্রাপ্ত। এদের মধ্যে ভালো-মন্দ সবাই আছে ভূমিদস্যু থেকে কোটি কোটি টাকার কর ফাঁকিবাজ বাজিকররাও। স্বেচ্ছায় কোটি কোটি টাকা আপসে বান্ধব সরকারের হাতে তুলে দিয়ে আইন-নির্ধারিত দন্ড জরিমানা থেকে এরা সহজে পরিত্রাণ পায়। ঋণগ্রস্ত ফতুর কৃষককে ভিটেমাটি উচ্ছেদ করতে সরকারের দাবি আদায় আইন নিরপেক্ষভাবে তৎপর থাকে। নিঃসহায়দের বিরুদ্ধে আইন কদমে চলে, বিত্তবানদের ক্ষেত্রে আইন চলে দুলকি চালে । এসম্পর্কে সকল আমলের আইনমন্ত্রীরা আমাদের আশ্বাস দিয়ে এসেছেন যে, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে।

আমাদের সমাজ নেতাকেন্দ্রিক। বিভাময় নেতা অন্তর্ধান করলে আমরা চোখে আঁধার দেখি। আঁধারের বিরুদ্ধে মাতম না করে একটি প্রদীপ জ্বালানো তো মঙ্গলময়। আমাদের মাঝে বিরাট, মহান সর্বপ্রভাবী তেমন রোল-মডেল বা আদর্শপুরুষ নেই। সে একদিক থেকে ভালো। তোমরা নিজের কর্মের দ্বারা, সেবার দ্বারা এবং প্রয়োজনে সাধারণ মানুষকে হাত ধরে এগিয়ে পথ দেখিয়ে শুভঙ্কর ও মুর্তিমান হও। পাড়া-প্রতিবেশী সকলের জন্য কোনো না কোনো সাহায্যে আস। যারা পতিত, নিঃসহায় বা পথভ্রষ্ট তাদের প্রতি বিমুখ হবে না। সমাজে যেভাবে সন্ত্রাস মাদকতা এবং উম্মাদনা বৃদ্ধি পাচ্ছে, হঠকারী অপরাধীদের বিরুদ্ধে আমাদের একযোগে দাঁড়াতে হবে।

সব দোষ নন্দ ঘোষ ব'লে সরকারের ঘাড়ে চাপিয়ে ছিদ্রান্বেষী আত্মতৃপ্তি লাভ করতে পারে। তাতে কোনো উপকার বা লাভ হবে না। কপাল গুণে সরকার ভালো হতে পারে, মন্দও হতে পারে। স্বীয় উদ্যোগে কীভাবে আমরা আমাদের অবস্থার উন্নতি করতে পারি, সে সম্পর্কে আমাদেরকে সচেতন থাকতে হবে। আমরা যদি নিজের সন্তান-সন্ততিকে শায়েস্তা করার জন্য পুলিশের হাতে তুলে না দিতে চাই, তবে নিজেদেরকে সংশোধন করার জন্য আত্মশাসনের ওপর নির্ভর করতে হবে। আমাদের নিজেদের মধ্যকার বিরোধ আলোচনা বা সালিশের মাধ্যমে আমরা নিষ্পন্ন করে যেন অযথা মামলা-মোকদ্দমা করে অর্থ ও সময়ের অপচয় না করি। আমরা নিজেরা অযথা হয়রানিতে পড়বো না বা অপরকেও আমরা অযথা কোনো হয়রানিতে ফেলবো না।

আমাদের দেশের মোট শ্রমশক্তির শতকরা ৪০ ভাগ যুবক। এই শ্রমশক্তি সবচেয়ে প্রবর্তনক্ষম, উদ্যমী, গতিশীল এবং সৃজনশীল। এত বিরাট শক্তিকে দিকনির্দেশনা দেওয়া ও দেখভাল করার ক্ষমতা সরকারের একার নেই। সরকারকে আমরা কীভাবে সাহায্য করতে পারি এবং এ ব্যাপারে কল্যাণ ও উন্নয়নের জন্য যুব প্রতিষ্ঠানগুলোকে কীভাবে সরকার সহায়তা দান করতে পারে, সে সম্পর্কে সদিচ্ছা ও সোৎসাহে একটা কার্যক্ষম কর্মপন্থা উদ্ভাবন করতে হবে। আত্মকর্মসংস্থান, পরিবেশ-সংরক্ষণ, দারিদ্র্য-দূরীকরণ, নারীর ক্ষমতায়ন এবং মা ও শিশুর স্বাস্থ্য পরিচর্যার ক্ষেত্রে বেকার বা ঊননিয়োজিত যুব কর্মশক্তি কীভাবে আমরা ব্যবহার করতে পারি, সে-সম্পর্কে আমাদের চিন্তা করতে হবে।

আজকাল দেশের ছাত্রপ্রতিষ্ঠানগুলোর নেতৃবৃন্দের কেউ কেউ ছাত্রই নয়। শিং ভেঙ্গে ৩২ থেকে ৩৫ বছরের আদু ভাইয়েরা ভিড় জমিয়েছে। অজুহাতপ্রিয় রাজনৈতিক মুরব্বিরা তাদের হয়ে ওকালতি করেন, 'বড় ভাইদের কাছ থেকে ছোট ভাইয়েরা শিখবে না?' দেশের সাধারণ লোক যে ছাত্রদের এক সময় সমীহ করত এবং স্নেহ করে ঘরে জায়াগির রাখত তারা এখন সেই ছাত্র-নামধারী ব্যক্তিদের সঙ্গ পরিহার করতে চায়। দূর থেকে তারা ভয় পায় চাঁদাবাজ ও ধান্ধাবাজ, ফন্দিবাজ দুর্বৃত্তদের।

সাধারণ জনগণের রাজনৈতিক চেতনা উদ্রেক করতে দেশের যুবকরা এক সময় 'জাগো, বাঙালী জাগো' বলে চোঙা ফুঁকেছে। দেশের লোক যে জেগেছে তা বলতেই হবে। শিক্ষার প্রসার ঘটেছে, দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে। নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি থেকে এটা বোঝা যায়। নির্বাচনে ছাত্রদের চোঙা ফোঁকার জন্য আর প্রয়োজন নেই। আর শব্দবিবর্ধক যন্ত্র মাইক তো হাতের কাছেই।

বন্ধুগণ, দেশের জন্য কাজ করলে দেশকে ভালবাসতে হবে, দেশের ভালো-মন্দয়, দেশের সুযোগে-দুর্যোগে। আজ থেকে বারো বছর আগে এক মানব উন্নয়ন কেন্দ্রের রিপোর্টে বলা হয়, ১৯৯৪ সালের সর্বোচ্চ মানব উন্নয়ন স্তরে পৌঁছতে বাংলাদেশের আরো ১৩৭ বছর লাগবে, আর ততদিনে পৃথিবী এগিয়ে যাবে আরো ৪২ বছর। আমাদের সামনে এক কঠিন পরীক্ষা। প্রায় দেড়শ-দু'শ বছরের পিছিয়ে পড়া থেকে এক দ্রুত উল্লম্ফন প্রক্রিয়ায় পার হয়ে আমাদের একবিংশ শতাব্দীর অগ্রযাত্রায় শামিল হতে হবে। তোমাদের যাত্রা শুভ হোক!

আজ 'আত্মশক্তিতে বলীয়ান ব্যক্তি কখনও দরিদ্র থাকতে পারে না' এই বিশ্বাসে অনুপ্রাণিত স্বেচ্ছাব্রতী উজ্জীবকদের দশম পুনর্মিলন। বন্ধুগণ, তোমাদের কথাই ভেবে নজরুল বলেছিলেন, 'যৌবনের এ ধর্ম, বন্ধু, সংহার করি জরা। অজয় অমর করিয়া রাখে এ প্রাচীনা বসুন্ধরা'। বন্ধুগণ, রবীন্দ্রনাথের কথায় বলি, জাগো 'নির্মল নেত্রে রাত্রির পরপারে, জাগো অন্তরক্ষেত্রে মুক্তির অধিকারে'।

সকলকে ধন্যবাদ!

* ১৮ ডিসেম্বর ২০১০, দি হাঙ্গার প্রজেক্ট-বাংলাদেশের দশম উজ্জীবক পুনর্মিলন ২০১০-এ প্রধান অতিথির বক্তব্য