সত্যভক্ত হোন

আতাউস সামাদ
Published : 30 Dec 2009, 05:46 PM
Updated : 30 Dec 2009, 05:46 PM

বাংলাদেশে বেশির ভাগ মানুষ ধরেই নেন যে, রাজনীতিবিদদের কথায় আর কাজে মিল থাকবে না। আমার পরিচিত রাজনৈতিক নেতাদের বলতে শুনেছি যে তাঁদের কর্মী ও সমর্থকদের চাঙ্গা রাখার জন্য প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে 'গরম' কথা মাঝে মাঝে বলতেই হয়।

আর  যেহেতু দুই পক্ষই এটা জানে এবং করে তাই কাজটা 'জায়েজ'। আবার অনেক রাজনীতিবিদ মনে করেন যে, মঞ্চে উঠে বক্তৃতা দিয়ে যদি সমবেত জনতার কাছ থেকে তুমুল করতালি পাওয়া না যায় তাহলে তো নেতা হওয়া গেল না।

আর যিনি ইতিমধ্যেই নেতা হয়েছেন তিনি মনে করেন যে, বক্তৃতা দিয়ে হাততালি পাওয়া না গেলে তো আর নেতৃত্ব থাকে না। সম্ভবত, এসব ভাবনা থেকেই 'মেঠো বক্তৃতা' শব্দগুচ্ছের সৃষ্ঠি হয়েছে। সম্পূরক একটি ধারণা হলো যে, মেঠো বক্তৃতা পুরোপুরি বস্তুনিষ্ঠ বা তথ্য-নির্ভর হতে পারে না।

একবার এক নেতা সত্য-অসত্যের উদার সংমিশ্রনে বক্তৃতা করার পর তাঁকে বিনীতভাবে বলেছিলাম যে, তিনি যেসব ভুল তথ্য দিয়েছেন জেনে বুঝে সেগুলো রিপোর্ট করি কী করে? তাঁর উত্তর ছিল, 'আপনারা খালি ঠিক -বেঠিক খোঁজেন কেন? পাবলিক জানে আমি কী করতাছি আর কিয়ের লাইগ্যা করতাছি!' আমি আর কথা বাড়াই নাই। তাঁর বক্তৃতার যেটুকু নিরাপদে লেখা যায় সেটুকুই রিপোর্ট করেছিলাম।

আলোচ্য রাজনৈতিক নেতার উপর রাগও করি নাই, কারণ এমন আরেক জন নেতার সাথে পরিচয় ছিল যিনি জনসভায় বক্তৃতা করার পর হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলতেন যে, 'বক্তৃতায় যা বলতে চেয়েছিলাম তা সবটা বলতে পারি নাই। বাকিটা এখানে লেখা আছে। বক্তৃতার রিপোর্টের সাথে যোগ করে দেবেন।'

কিন্তু মেঠো বক্তৃতা এক কথা আর কোন গুরুগম্ভীর অনুষ্ঠান অথবা জাতীয় সংসদে ভাষণ আরেক কথা। দ্বিতীয় শ্রেণীভুক্ত স্থানগুলিতে যখন প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপদেষ্টা, বিরোধী দলীয় নেত্রী, দলের বিশিষ্ট কর্মকর্তা বা জাতীয় সংসদ সদস্য ভাষণ দেন বা বক্তব্য রাখেন তখন ধরে নেওয়া হয় যে, তাঁর মন্তব্য যুক্তিনির্ভর এবং তাঁর দেওয়া তথ্য সঠিক।

দুঃখের সাথে লক্ষ্য করছি আজকাল অতীব দায়িত্বপূর্ণ পদে আসীন ব্যক্তিদের উপরও এ বিষয়ে আস্থা রাখা যাচ্ছে না। কয়েকটা উদাহরণ দেই।

গত ২৯ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী সেতু উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত এক বছরে তাঁর সরকার যেসব ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করেছে বলে তিনি মনে করেন সেগুলির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিতে গিয়ে বললেন যে, তাঁর দলের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দ্রব্যমূল্য কমিয়ে আনা হয়েছে এবং তাঁরা ক্ষমতা গ্রহণ করার সময় যেখানে চালের দাম ছিল ৪৮ টাকা কেজি এখন তার দাম নেমে এসছে মাত্র ২২ টাকা কেজি দরে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর এ দাবি সঠিক নয়।

১/১১ খ্যাত প্রক্রিয়ায় যে সরকার ২০০৭ ও ২০০৮ সালে দেশ শাসন করেছে তাদের আমলে মোটা চালের মূল্য ৩৩ টাকা কেজি পর্যন্ত পৌছেছিল। তারা ক্ষমতা ত্যাগ করার আগেই সে দাম কমে এসেছিল ২৭ টাকা কেজি হারে।

বর্তমান মহাজোট বা আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর তা কমতে কমতে ২২ টাকা কেজিতে এসেছিল, দিন কয়েক দেশের তিন-চার জায়গায় ১৮ টাকা কেজি দরেও বিক্রি হয়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি চালের দাম আবার কিছুটা বাড়তির দিকে।

খাদ্যমন্ত্রী ড. রাজ্জাকই ২৯ ডিসেম্বর বলেছেন যে, ভারতে চালের দাম বাড়ছে এই অজুহাত দেখিয়ে বাংলাদেশে কিছু কিছু ব্যবসায়ী এখানেও চালের মূল্য বাড়াচ্ছেন, এবং এই ধারা অব্যাহত থাকলে সরকার তার ভান্ডার থেকে কম দামে চাল বিক্রি করবে।

ইতোমধ্যে টিসিবি'র তথ্য অনুযায়ী গত ২৪ ডিসেম্বর ঢাকায় মোটা চালের দাম ছিল কেজি প্রতি প্রকার ভেদে ২৫ টাকা ও ২৬ টাকা (প্রধান মন্ত্রী বর্ণিত ২২ টাকা নয়)।  আর টিসিবি'র তথ্য মতেই ২৪ ডিসেম্বর মাঝারি ও সরু চালের দাম প্রকারভেদে ছিল কেজি প্রতি ৩৪ টাকা থেকে ৪৫ টাকা। একজন ক্রেতা বলেছেন, সেদিন বেশি মিহি চালের দাম ছিল কেজি প্রতি ৪৮ টাকা।

প্রধানমন্ত্রী সেদিনই আরও বলেছিলেন যে, গত এক বছরে বাংলাদেশের দুর্নাম যে, দেশটি দুর্নীতিতে বিশ্বসেরা এবং জঙ্গিতে ভরা তা কেটে গেছে। একথা নিশ্চয়ই স্বস্তিদায়ক।

কিন্তু এটাও তো সত্যি সে ট্র্যান্সপ্যারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান সবচেয়ে খারাপ দেখা যায় ২০০১ সালের রিপোটের্, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকতেই। বিএনপি বা জোট সরকারের আমলে সেই অবস্থান থেকে উঠে আসতে পারেনি বাংলাদেশ।

পরিবর্তন এসেছে দুই কারণে, এক. ইতিমধ্যে বাংলাদেশের চেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের খবর পাওয়া গেছে এবং দুই. গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের (২০০৭-২০০৮) আমলে দুর্নীতি দমন কমিশনকে কার্যকর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল বলে।

অবশ্য, সেই সময় যে ওই কমিশনকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছিল তা এখন জানা জানি হবার পর সেই মূল্যায়ন পাল্টে যেতে পারে। তবে তা পরের কথা। আপাতত বিবেচ্য হলো যে, আওয়ামী লীগ এ যাত্রায় ক্ষমতায় আসার আগেই, ২০০৮ সালের টিআই রিপোর্টে বাংলাদেশকে এক নম্বর দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের অবস্থান থেকে সরিয়ে এনে সামান্য হলেও তার চেয়ে ভাল অবস্থানে দেখানো হয়েছিল।

আর জঙ্গী দমনের ক্ষেত্রে বিএনপি বা জোট সরকারের আমলেই শীর্ষ জঙ্গি নেতাদের ধরে ফেলে র‌্যাব ও পুলিশ। তখন তাদের বিচারও হয় আর গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তাদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। জঙ্গি বিরোধী অভিযান বর্তমান সরকারের সময়ও চালু আছে এবং তার সাফল্যের ধারাবাহিকতা রয়েছে, এটা হলো প্রকৃত পরিস্থিতি।

মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে বেশ কয়েক জন এবং সংসদ উপনেতাও প্রায়ই বেশ 'গরম' কথা বলছেন। তাঁরা লক্ষ্য করছেন না যে, তাঁদের অনেক কথাই ভুল বা অসত্য বা বেঠিক বলে পরবর্তীতে দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য যার গতি সরকারি দাবি সত্ত্বেও ঊর্ধমুখী।

আইন-শৃংখলা ও মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কেও সরকারি দাবি ও বাস্তবতার পরস্পর বিরোধিতা বিভিন্ন পর্যবেক্ষক সংগঠন তথ্য ও পরিসংখ্যান দিয়ে দেখিয়েছেন।

এই লেখায় আমি আসলে উচ্চ দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদেরকে বস্তুনিষ্ঠ ও সত্যভক্ত হতে অনুরোধ করতে চাইছি। অহেতুক সমালোচনা করা আমার উদ্দেশ্য নয়, তা বিণীতভাবে জানিয়ে রাখছি। যাঁরা দেশ চালাচ্ছেন বা চালাবেন, তাঁদের বস্তুনিষ্ঠ ও সত্যানুসন্ধানী হওয়া প্রয়োজন, যতখানি না তাঁদের নিজেদের জন্য তার চেয়ে অনেক বেশি দেশের মানুষের জন্য।

প্রথমত, সরকারি ক্ষমতা যাদের হাতে তাঁদের সিদ্ধান্ত ও কাজ দেশের সব মানুষের জীবন কোন না কোন ভাবে ছুঁয়ে যাবে। সরকার ভালভাবে দেশ চালালে দেশের লোক ভাল থাকবে, এতো জানা কথা। সরকার কূকা- ঘটালে দেশে যে অশান্তি হয় তাও আমাদের অভিজ্ঞতায় আছে।

এখন প্রকৃত পরিস্থিতি ও সত্য ঘটনা না জানলে সরকার ভাল কাজ করার জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে কি করে? দ্বিতীয়ত, দেশের নেত্রী-নেতারা যদি অসত্য বা ভুল করতে থাকেন তাহলে আমাদের সন্তানেরা সততা ও দায়িত্বশীলতার মূল্য শিখবে কী করে? এদিক থেকে বিরোধী দলীয় নেত্রী-নেতাদেরও অনেক দায়িত্ব আছে।