‘সংখ্যালঘুরা’ যে কারণে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক

অনুপম দেব কানুনজ্ঞ
Published : 19 June 2014, 11:06 AM
Updated : 19 June 2014, 11:06 AM

প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি 'সংখ্যালঘু শব্দটির ব্যবহারের কারণে। এই শব্দটির ব্যবহার অনেকের মতো আমাকেও বিব্রত করে। 'সংখ্যালঘু' শব্দটির মধ্যেই কেমন যেন কোনো একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে হেয় প্রতিপন্ন করার অর্থ নিহিত আছে।

শুধু সংখ্যালঘু বললে যে কোনো ক্ষেত্রে সংখ্যায় কম যারা তাদেরকেই বোঝায়। সুতরাং যারা কোনো একটি নির্বাচনে কম ভোট পেয়ে হেরে গেছে, তারাও এই অর্থে সংখ্যালঘুই হয়ে যায়। আবার দেশে পুরুষের চেয়ে নারীরা সংখ্যায় কম বলে তাদেরকেও সংখ্যালঘু বলা চলে। এমনকি, যারা বাঁহাতি, তারাও এই যুক্তিতে সংখ্যালঘু।

সুতরাং একটা সমাধানে আসা যায় 'ধর্মীয় সংখ্যালঘু' শব্দ ব্যবহার করে।

শব্দটি একেবারে এড়িয়ে যেতে চাইলে শুধু 'হিন্দু' বলা যায়। সে ক্ষেত্রেও বাংলাদেশে বসবাসরত বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এবং অন্য ধর্মাবলম্বীদের অস্বীকার করা হয়। সে ক্ষেত্রে হয়তো 'অমুসলিম' শব্দটি ব্যবহার করা যায়। কিন্তু ঝামেলা রয়েই যায়। অমুসলিম বললে একদিকে মুসলিম আর অন্যদিকে বাকি সব ধর্মের অনুসারীদের দুই পক্ষ তৈরি হয়ে যায়, যা আসলে অনভিপ্রেত।

তারপরও চলুন দেখি আন্তর্জাতিকভাবে সংখ্যালঘু বলতে কাদের বোঝায়।

সংখ্যালঘুদের অধিকার বিষয়ে জাতিসংঘ সনদে বলা হয়েছে–

"জাতীয়, ধমীর্য় এবং জাতীয় সংখ্যালঘু"।

UN Special Rapporteur Francesco Capotorti এর মতে–

''সংখ্যালঘু হচ্ছে কোনো একটি দেশের মোট জনসংখ্যার তুলনায় জাতিগত, ধর্মীয় অথবা ভাষাগত বৈশিষ্ট্যে সংখ্যালঘু দল বা গোত্র, যারা সুনিদির্ষ্টভাবে তাদের সংস্কৃতি, রীতি-নীতি, ধর্ম বা ভাষাগত বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণে তৎপর।''

ইউরোপীয় পরিষদ ১৯৯৩ অনুসারে–

''সংখ্যালঘু হচ্ছে–

রাষ্ট্রের একটি জনগোষ্ঠী যারা;

(ক) রাষ্ট্রের নাগরিক এবং রাষ্ট্রীয় সীমানায় বসবাস করে;

(খ) রাষ্ট্রের সঙ্গে দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ;

(গ) সুনিদির্ষ্ট জাতিগত বৈশিষ্ট্য, সংস্কৃতি, ধর্ম বা ভাষাগত বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান;

(ঘ) পর্যাপ্ত প্রতিনিধিত্বশীল, যদিও সংখ্যায় রাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার অথবা রাষ্ট্রের কোনো অঞ্চলের জনসংখ্যার তুলনায় সংখ্যালঘু;

(ঙ) তাদের সংস্কৃতি, রীতি-নীতি, ধর্ম বা ভাষা রাষ্ট্রের সংস্কৃতি, রীতি-নীতি,ভাষা বা ধর্মের সঙ্গে সংরক্ষণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।''

যদিও আমি অংকে বেশ কাঁচা, তবুও এবার চলুন সবাই মিলে একটু অংক করি। দেখে নিই যে, জামায়াতে ইসলামীর হামলার প্রেক্ষিতে 'সংখ্যালঘু' শব্দটি অত্যধিক ব্যবহৃত হয়, তাদের তুলনামূলক সংখ্যাগত একটি বিশ্লেষণ।

প্রথম অংশ:

২০০৬-এ UNHCR-এর সর্বশেষ তথ্য (১) অনুযায়ী বাংলাদেশে অমুসলিম জনগোষ্ঠীর অনুপাত ১৪-১৬ শতাংশ, ধরে নিলাম ৭ বছর পরের হিসাব অনুযায়ী সেটা কমে এখন ১০ শতাংশ, সেই হিসাবে যদি বাংলাদেশের মোট লোকসংখ্যা ১৬ কোটি হয়, তাহলে অমুসলিম লোকের সংখ্যা ১৬ কোটি এর ১০ শতাংশ = ১ কোটি ৬০ লাখ।

দ্বিতীয় অংশ:

নির্বাচন কমিশনের সর্বশেষ তথ্য (২) অনুযায়ী ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ভোট পেয়েছে ৪.৭ শতাংশ, মোট ভোট = ৩২৮৯৯৬৭, অর্থাৎ প্রায় ৩৩ লাখ। জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করায় এখানে বিএনপি ও অন্যান্য দলেরও কিছু ভোট আছে। যেহেতু অন্য আসনেও দলটির কিছু ভোট আছে এবং ভোটার নয় এমন অনেকেও হয়তো এই মতধারায় বিশ্বাসী, তাই তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম এই সংখ্যাটা ৫০ লাখ।

এবার আসুন অংকের মূল প্রশ্নে। উল্লিখিত পরিসংখ্যান অনুসারে, আন্তর্জাতিক সংজ্ঞা অনুযায়ী সত্যিকারের সংখ্যালঘু কারা?

তারপরও তর্কের খাতিরে, ভিন্ন কোনো শব্দ গৃহীত হওয়ার আগ পর্যন্ত হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানদের 'সংখ্যালঘু' ধরেই এবার একটু মূল আলোচনায় যাওয়া যাক।

মুক্তিযুদ্ধের যে অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ, সবার জন্য বাংলাদেশ, সমাজতন্ত্র ইত্যাদি যেসব চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান রচিত হয়েছিল, বিভিন্ন বিকৃতিমূলক সংশোধনীর মাধ্যমে সেই জনগণের সংবিধান কবর দিয়ে আমাদের উপহার দেওয়া হয়েছিল এক পরস্পরবিরোধী ধারায় ঠাসা সংবিধান।

যে সংবিধান রাষ্ট্রের সব নাগরিকের সমান অধিকারের কথা বলে, সেই সংবিধানেই রাষ্ট্রের ধর্ম ঘোষণা করা আছে ইসলাম। একটু ইতিহাসের দিকে নজর বোলালে লক্ষ্য করা যায়, এই সংবিধান সংশোধনীর সঙ্গে সঙ্গে সংশোধনীর নায়কদের সহায়তায় এদেশে মৌলবাদও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।

৬ এপ্রিল, ১৯৭৯ যে পঞ্চদশ সংশোধনী করা হয়, তাতে সংবিধানের মৌলিক কিছু পরিবর্তন করা হয়, যা আদৌ করার ক্ষমতা কারও আছে কি না, সে ব্যাপারেই রয়েছে বিতর্ক।

সংবিধানের মূলনীতি হতে "সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা" বাদ পড়ে ১৯৭৮ সালে। এছাড়াও "বিসমিল্লাহির-রহমানির রহিম (দয়াময়, পরম দয়ালু, আল্লাহের নামে)" সংবিধানে সংযোজিত হয় ২২ এপ্রিল, ১৯৭৮। আর এই বিধানগুলো বৈধতা পায় পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে।

সংবিধানের প্রথম সংশোধনী ছিল ১৭ জুলাই, ১৯৭৩। আর সেই সংশোধনীতে সংবিধানে যুদ্ধাপরাধী ও অন্যান্য গণবিরোধীদের বিচারের আওতায় আনার বিধান যুক্ত করা হয়েছিল।

কিন্তু ১৯৭৫ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে শেখ মুজিবর রহমান সপরিবারে নিহত হলে, আর কয়েকটি অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থান শেষে ১৯৭৭ সালে ক্ষমতায় আসেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। ১৯৭১ সালের পর জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকলেও, ১৯৭৭ সাল থেকে জামায়াতের নেতারা দেশে ফিরতে থাকেন। ১৯৭৯ সালের মে মাসে পাকিস্তানি পাসপোর্টধারী রাজাকার শিরোমণি গোলাম আযম দেশে ফেরত আসেন।

জামায়াত দল হিসেবে বৈধতা না পেলেও, ১৯৭৯-এর নির্বাচনে ৬ জন জামায়াত নেতা ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক লীগের ব্যানারে নির্বাচনে জয়লাভ করেন। জিয়াউর রহমান রাজাকার শাহ আজিজুর রহমানকে (যিনি দেশে ফিরে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন) প্রধানমন্ত্রীও বানান।

শুরু হয় জামায়াতের উত্থান।

১৯৮১ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমান নিহত হলে ১৯৮২ সালে ক্ষমতায় আসেন আরেক সামরিক শাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ। ১৯৮৮ সালের নির্বাচন বিএনপি-আওয়ামী লীগ বর্জন করেছিল।

কিন্তু নির্বাচনে জিতে এরশাদের জাতীয় পার্টি ৭ জুন বাংলাদেশের সংসদে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী পাশ করে। সংবিধানের পাঁচটি ধারায় তখন সংশোধনী আনা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামের স্বীকৃতি।

এদিকে এরশাদ বুঝেছিলেন, ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে তার অন্য কোনো দলের সমর্থন লাগবেই। ফলশ্রুতিতে জামায়াতের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়। মূলধারার রাজনীতিতে ঘটে রাজাকারদের উত্থান।

অবশ্য এরপরও যে জামায়াতের উত্থান থেমে থেকেছে তা নয়। ১৯৯২ সালে শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গণআদালতে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে বিচার শুরু হলে, খালেদা জিয়ার বিএনপি সরকার উলটো জাহানারা ইমামের বিরুদ্ধেই রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করে। সেই মামলা নিয়েই মারা যান শহীদজননী।

আবার ৯৬-এ বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে যুগপৎ আন্দোলনের নামে জামায়াতের সঙ্গে হাত মেলায় আওয়ামী লীগও।

২০০১ সালে আগের ভুল শুধরিয়ে রীতিমতো জোট গঠন করে জামায়াতকে রাষ্ট্রক্ষমতায় নিয়ে আসে বিএনপি। '৭১-এ যারা ছিল গণবিরোধী, ২০০১-এ তারাই হয় জনপ্রতিনিধি।

২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তার ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধের বিচারের ইস্যু নিয়ে আসার আগ পর্যন্ত আসলে প্রত্যেকটি সরকারই কোনো না কোনোভাবে স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াতের উত্থানে সহায়তাই করেছে।

২০০৮ সালে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ আরেকটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। আর তা হল ১৯৭২-এর সংবিধান পুনঃপ্রবর্তন করা। অবশ্য '৭২ নয়, বরং আমার ব্যক্তিগত মতামত হল, ফেরত যাওয়া উচিত '৭৩-এর সংবিধানে। কারণ যুদ্ধাপরাধীর বিচারের মতো গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় '৭৩-এ সংযোজিত হয়েছিল।

সেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আমরা দেখলাম দুটি মামলা দ্রুতগতি পেল। আদালত রায়ও দিল পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী বাতিল করে। কিন্তু জিয়াউর রহমান ও এরশাদের পুরো শাসনামলকে আদালত বাতিল করে দিলেও, সংবিধানে তাদের অনেক সংশোধনী এখনও রয়েই গেছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা মুখে যতই 'সবার সমান অধিকার', 'রাষ্ট্রের ও আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান' এবং আরও নানা মুখভরা বুলি বলি না কেন, দেশের একজন হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের লোক যখন সংবিধান পড়তে চায়, তখন কিন্তু তাকে 'বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম' বলেই তা শুরু করতে হয়।

রাষ্ট্রের ধর্ম যখন ইসলাম হয়, তখন অন্য ধর্মাবলম্বীরা সেই ইসলামি রাষ্ট্রে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকই হয় বটে। আর দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকরা তো প্রথম শ্রেণির সমান সুযোগ-সুবিধা পাবে না, এটাই স্বাভাবিক। আর তারই ফলাফল আমরা ২০০১ সালে সারা দেশে দেখেছি, ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩-তে যুদ্ধাপরাধী সাঈদীর মামলার রায় হওয়ার পর দেখছি, ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সালের নির্বাচনের পরও দেখলাম।

এ বিষয়ে আমরা মনে হয় নেপালের কাছ থেকে শিক্ষা নিতে পারি। একদা হিন্দু রাজ্য হিসেবে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত নেপাল ২০০৭ সালের ১৫ জানুয়ারি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে নিজের নতুন সংবিধান রচনা করে।

রাষ্ট্রের সব নাগরিকের 'সত্যিকারের' সমান অধিকার নিশ্চিত করার আগ পর্যন্ত মানুষের মনোজগত থেকে এই সংখালঘুত্বের (এবং সংখ্যাগুরুত্বও বটে) হীনমন্য ধারণা মুছে ফেলা কখনও-ই সম্ভব নয়।

সূত্র:

(১)

(২)