আমাদের সরদার স্যার

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 16 June 2014, 02:14 AM
Updated : 16 June 2014, 02:14 AM

১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হই। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ভর্তি হওয়ার পর আমার প্রথম ক্লাসই ছিল সরদার স্যারের। প্রথম দিন ক্লাসে সরদার স্যারকে দেখে অবশ্য ভীষণ হতাশ হয়েছিলাম। নাম শুনে ভেবেছিলাম, মানুষটি নিশ্চয়ই আনিস স্যারের (আনিসুজ্জামান) মতো লম্বা-চওড়া-সুদর্শন হবেন!

কিন্তু এ কী! ছোটখাট একজন মানুষ। চোয়াল ভাঙা। মোটা ফ্রেমের চশমা পরেন। কোটরাগত চোখ। আস্তে আস্তে ভেবে কথা বলেন। বলেন যত, বিরতি দেন তার চেয়ে বেশি। ভাবেন আরও বেশি। আপাদমস্তক একজন ভাবুক কিসিমের মানুষ। এই মানুষই দর্শনকোষ লিখেছেন! অবিশ্বাস্য লাগছিল।

সরদার স্যার আমাদের রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাস পড়াতেন। সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল, হবস, লক, রুশো। স্যার এমনভাবে তাদের চিন্তা-ভাবনা-তত্ত্ব-দর্শনের কথা বলতেন যেsন, ওই সব চিন্তাবিদেরা সকলে স্যারের পরিবারের সদস্য। স্যারের সঙ্গে পরামর্শ করেই তারা ওসব কথা বলেছেন বা লিখেছেন। থেমে থেমে ভেবে ভেবে নিচুস্বরে কিন্তু অত্যন্ত দৃঢ় উচ্চারণে স্যার কথা বলতেন। নিজেই হারিয়ে যেতেন সেই সব মহান চিন্তাবিদদের চিন্তার দিগন্তে। আময়া তারুণ্যের বেপরোয়া অস্থিরতা নিয়েও মন্ত্রমুগ্ধের মতো স্যারের কথা শুনতাম। বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়েছি কতদিন। অথচ সরদার স্যারের ক্লাসের সেই কথাগুলো এখনও স্মৃতির পর্দায় অমলিন জেগে আছে।

স্যারের প্রতিটি কথা ছিল লিখে রাখবার মতো। ভাবনার খোরাক। তিনি আমাদের সব সময় বলতেন, ভাব, চিন্তা কর, অনুসন্ধান করে। খোঁজ। কোনো প্রশ্নের সোজাসুজি উত্তর দিতেন না। তাঁর সব কথা ছিল দার্শনিকতা বা চিন্তার ছাপযুক্ত। বলতেন সবই, কিন্তু গতানুগতিকভাবে নয়, একটু ঘুরিয়ে, দৃষ্টান্তসহ।

সরদার স্যার বলতেন, মনে রেখ, চিন্তা ছাড়া কোনো কিছু চিন্তা করার কথা চিন্তাও করা যায় না। কাজেই তোমরা প্রশ্ন কর, উত্তর খোঁজ, চিন্তা কর। এই যে আমি সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল, হবস, লক, রুশো পড়াই-উনারা কী বলেছেন? উনারা প্রশ্ন করেছেন, প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন। আর এ জন্য চিন্তা করেছেন।

একদিন স্যার ক্লাসে প্রশ্ন করেছিলেন, বল তো, মানুষ মরণশীল না অমরণশীল? আমরা একযোগে জবাব দিয়েছিলাম, মানুষ মরণশীল! স্যার খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলেন। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, না, মানুষ অমরণশীল! রাম মরণশীল, শ্যাম মরণশীল, যদু মরণশীল, মধু মরণশীল, সরদার মরণশীল। কিন্তু মানুষ অমরণশীল। মনুষ্যত্ব, চিন্তা, বুদ্ধির সমাহার হল মানুষ। মানুষ-সত্তার কখনও মরণ হয় না। ব্যক্তি মরে, মানুষ মরে না। সামস্টিক মানুষের মরণ হয় না। যদ্দিন পৃথিবী নামক গ্রহ থাকবে, তদ্দিন মানুষ থাকবে। মানুষ অমরণশীল! বলতে দ্বিধা নেই সেদিন প্রথম মানবসত্তাকে এমনভাবে উপলব্ধি করতে শিখেছিলাম, আর তা শিখিয়েছিলেন সরদার স্যার!

আমরা 'ফাঁকিবাজ ছাত্ররা' লেখাপড়ায় সব সময়ই শর্টকার্ট রাস্তা খুঁজতাম। প্রায়ই জানতে চাইতাম, স্যার, আমাদের সিলেবাস কী, কী কী প্রশ্ন আসতে পারে। এখানে বলা বাহুল্য, অন্য স্যারদের কাছে আমরা খুব সহজেই এ প্রশ্নের জবাব পেতাম। কিন্তু সরদার স্যার কখনও এ ব্যাপারে কিছু বলতেন না। তিনি বলতেন, গোটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই তোমাদের সিলেবাস। এই যে গোলাগুলি, মারামারি (উল্লেখ্য, আমাদের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব ছিল নিয়মিত ঘটনা), হরতাল ধর্মঘট, লাশ, খুন– সবই তোমাদের সিলেবাস। যে কোনো বিষয়েই তোমাদের প্রশ্ন আসতে পারে।

সরদার স্যার শিক্ষার্থীদের অনুসন্ধানের বিষয়টিকে খুব বেশি গুরুত্ব দিতেন। একদিন ক্লাসে বলেছিলেন, ''একজন মানুষ যদি তোমাদের কাছে জানতে চায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিটা কোথায়? তোমরা তাকে বলে দিলে। আর ওই ভদ্রলোক যদি একই বিষয় আমার কাছে জানতে চায় এবং আমি বলি যে আমি জানি না– তাহলে তাকে কে সাহায্য করল? তোমরা, না আমি?''

এর উত্তরে আমরা সমস্বরে বললাম, ''স্যার, আমরা।''

স্যার যথারীতি খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, ''না, আমি।''

তারপর ব্যাখ্যা দিলেন, ''আমি যখন আগন্তুক ভদ্রলোককে বললাম যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিটা কোথায় তা আমি জানি না, তখন সে ঘুরতে থাকবে, হয়তো সে ঘুরতে ঘুরতে রেজিস্টার ভবন চিনবে, ভিসির বাড়ি চিনবে, কলাভবন চিনবে, মধুরকেন্টিন চিনবে, তারপর একসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি চিনবে। কিন্তু তোমরা যখন বলবে, আপনি সোজা চলে যান সেখানে দেখবেন ডান দিকে রোকেয়া হল, তার উলটো দিকে লাইব্রেরি– তখন আসলে তোমরা তার জানার বা অনুসন্ধানের ক্ষেত্রটি ছোট করে দিচ্ছ। সে হয়তো সহজে লাইব্রেরি পাবে, কিন্তু আরও অনেক কিছুই চিনবে না। তোমরা তার জানার সুযোগটা সংকীর্ণ করে দিয়েছ।''

আজ মনে হয়, সরদার স্যারের মতো এভাবে ভাবতে জীবনে আমাদের আর কে শিখিয়েছেন? আর কে-ই বা শেখাবেন?

স্যার কখনও ক্লাস ফাঁকি দেননি। কোনোদিন দেরি করে আসেননি। বরং দেখেছি সময়ের আগেই তিনি ক্লাসে উপস্থিত হয়েছেন। করিডোরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেছেন, কখন অন্য স্যার ক্লাসরুম খালি করে দেবেন। একদিন স্যার ক্লাসে বলছিলেন, ''আমার বত্রিশ বছর শিক্ষকতা জীবনে মাত্র একজন ছাত্রকে দেখেছি, যে কখনও দেরি করেনি, পড়া ফাঁকি দেয়নি, ক্লাস ফাঁকি দেয়নি সেই ছাত্রটি হচ্ছে….'' বলে একটু থামলেন। আমরা সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম, স্যার কোন সে সৌভাগ্যবানের নাম বলেন, আমাদের মধ্যে কেউ কেউ নিজের নামটি শোনার জন্যও ব্যগ্র হচ্ছিল, কিন্তু স্যার আমাদের সবাইকে হতাশ করে উদাস কিন্তু দৃঢ় ভঙ্গিতে বললেন, ''সেই ছাত্রটির নাম হচ্ছে সরদার ফজলুল করিম!''

এমন কথা এভাবে সরদার স্যার ছাড়া আর কে বলতে পারতেন?

ছাত্রজীবনে দেখছি, সরদার স্যার কারও প্রতি কখনও বিশেষ বিরাগ বা অনুরাগ দেখাননি। তার কাছে সবাই সমান স্নেহভাজন ছিল। কোনো শিক্ষার্থীকে বেশি প্রশ্রয় দেওয়া কিংবা কাউকে উপেক্ষা করা– এমন ঘটনা সরদার স্যারের ক্ষেত্রে ঘটেছে বলে কারও জানা নেই।

সরদার স্যার কখনও ছাত্রছাত্রীদের কারও কাছ থেকে কোনো বিশেষ সুবিধা নিতেন না। নিজে ঋজু শরীর নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে নিয়ম মেনে ব্যাংক থেকে টাকা তুলেছেন, বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানির বিল পরিশোধ করেছেন। শিক্ষার্থীরা সব সময়ই স্যারকে সামনে যাওয়ার সুযোগ করে দিতে চাইতেন। কিন্তু স্যার আপোষহীন। কোনোদিন এই সুযোগ নিতেন না। বেশি পীড়াপীড়ি করলে মৃদু হেসে ধমক দিতেন। বলতেন, ''তোমরা কি আমাকে বৃদ্ধ ভাব?এই তো আমি তোমাদের মতো বেশ তরুণ আছি।''

হ্যাঁ, স্যার সত্যি চিরতরুণ ছিলেন।

সরদার স্যার সারাজীবন ছিল সমাজতান্ত্রিক আদর্শের অনুসারী। নব্বইয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সমাজতান্ত্রিক দেশগুেলার বিপর্যয়ের পর আশাহত আমরা, সুযোগ হলেই প্রশ্ন করতাম, ''স্যার, সমাজতন্ত্র কি তবে ব্যর্থ?''

স্যার স্বভাবসুলভ কায়দায় বলতেন, ''অনুসন্ধান কর। উত্তর খোঁজ। এ সম্পর্কিত তোমাদের চিন্তা আমাকে জানাবে।''

তারপর গম্ভীর হয়ে বলতেন, ''সমাজতন্ত্র একটা আদর্শ। আদর্শ কখনও ব্যর্থ হয় না। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা সাময়িক বিপর্য়য়ের সম্মুখীন। এর পেছনে অনেক কারণ আছে, অনেক ভুল আছে। তাই বলে কার্লমার্কসের সমাজতান্ত্রিক যে আদর্শ তা কখনও ব্যর্থ হতে পারে না।''

''সমাজতন্ত্র আবার কবে প্রতিষ্ঠিত হবে? কার্লমার্কসের আদর্শ কবে বাস্তবায়িত হবে? আমি বলব, এই তো মাত্র দশ হাজার কোটি বছর পর। মনে রেখ, মানুষের সভ্যতা একদিনে গড়ে উঠেনি। শত শত হাজার হাজার বছর ধরে সভ্যতার একেকটা পর্ব রচিত হয়েছে। রাতারাতি কোনো আদর্শিক সমাজ তৈরি হয় না। এর জন্য নিরন্তর সংগ্রাম করে যেতে হয়। অনেক চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্যে দিয়ে একটা সমাজ তৈরি হয়, বিবর্তিত হয়। এটা এক বছর, দুই বছর কিংবা একশ দু'শ বছরের ব্যাপার না। প্রয়োজনে সেই কাঙ্ক্ষিত সমাজ নির্মাণের জন্য আমাদের হাজার কোটি বছর অপেক্ষা করতে হতে পারে।''

স্যার বলতেন, ''কোনো ব্যবস্থাই চূড়ান্ত নয়। সমাজতন্ত্রও কোনো চূড়ান্ত ব্যবস্থা নয়। হয়তো এর চেয়ে আরও অনেক ভালো ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। তখন আমরা সেই ব্যবস্থার জন্য সংগ্রাম করব।''

স্যার আরও বলতেন, ''সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এগুলো হয়তো ইউটোপিয়া। তবে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা বা অর্জনের জন্য যে সংগ্রাম এবং আকাঙ্ক্ষা তাই সমাজতন্ত্র। গণতন্ত্রও তাই। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বা অর্জনের জন্য যে আকাঙ্ক্ষা বা লড়াই তাই গণতন্ত্র। প্রকৃত গণতন্ত্র বা সমাজতন্ত্র হয়তো ডুমুরের ফুল।''

গণতন্ত্রকে সরদার স্যার বলতেন, গণের তন্ত্র। অর্থাৎ গণমানুষ বা সাধারণ মানুষের তন্ত্র। সাধারণ মানুষ যে ব্যবস্থায় সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তাদের মতামত অনুযায়ী শাসক-শাসিতের সম্পর্ক ও উৎপাদন নির্ভর করে, তাই গণতন্ত্র। আমরা তেমন সমাজ এখনও পাইনি। গণতন্ত্রে আসলে 'সাধারণ মানুষের' নামে 'কতিপয় ব্যক্তি'ই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তারাই রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। সেই দিক থেকে গণতন্ত্রকে 'কতিপয়তন্ত্র' বলাটা মোটেও বেঠিক নয়।

ছাত্রজীবন শেষে এক পর্যায়ে যখন সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত হই, তখন একাধিকবার সরদার স্যারের সাক্ষাৎকার গ্রহণের চেষ্টা করেছি। অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক সত্ত্বেও স্যার কখনও সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হননি। তিনি বলতেন, ''তোমরা কোনো বুদ্ধিজীবীর কাছে যাও। আমি সাধারণ মানুষ। আমি সাক্ষাৎকার দেওয়ার মতো নিজেকে উপযুক্ত মনে করি না। তোমরা আমার সঙ্গে গল্প কর। আমার কাছে যা জানার জেনে নাও। কিন্তু সাক্ষাৎকার নয়। আমার সঙ্গে গল্প করার পর যদি তোমরা তা আমার নামে ছেপে দাও তবে আমি অস্বীকার করব!''

এই হলেন আমাদের সরদার স্যার। ভীষণ জেদি, একরোখা, আদর্শে স্থিত একজন অসীম উচ্চতাসম্পন্ন অন্য মানুষ। একবার শ্যামলীর চিলেকোঠার বাসায় স্যার ছোটবেলার গল্প বলছিলেন। কথা প্রসঙ্গে বাবার কথা আসতেই স্যার গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন, ''আমার বাবার মতো মহৎ আমি পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়জনকে পাইনি। আমার বাবা ছিলেন কৃষক। তিনি আমাকে কৃষিকাজে না পাঠিয়ে স্কুলে এবং কলেজে পড়ার সুযোগ করে দেন। একজন গ্রামীণ কৃষক যদি তার সন্তানকে কৃষিকাজে সহযোগী হিসেবে পান, সেটা তাঁর জন্য অনেক স্বস্তির ও সহায়ক হয়। আমার বাবা কী অসীম উদার ও মহৎ যে আমাকে পড়ার সুযোগ দিয়েছেন, হালচাষ করতে দিয়ে তাঁর আরাম-আয়েশের সহযোগী বানাননি।''

সরদার স্যারের কাহিনি এই ক্ষুদ্র পরিসরে লিখে শেষ করা যাবে না। তিনি পরিবার, সমাজ, যার প্রতি যতটুকু কর্তব্য– তা আজীবন পালন করে গেছেন। তাঁর কর্তব্যনিষ্ঠার কাহিনি এ যুগে সত্যিই বিরল। স্ত্রী, কন্যা, পুত্র, পুত্রবধূ– যার জন্য যতটুকু করা প্রয়োজন তিনি হাসিমুখে তার সবটুকুই করেছেন। শিক্ষার্থীদের প্রতি দায়, জ্ঞানের প্রতি দায়, আদর্শের প্রতি দায়, সর্বোপরি সমাজের প্রতি তাঁর দায়-সব দায় পরিশোধের চেষ্টা তিনি আমৃত্যু করে গেছেন।

তিনি সমাজকে দিয়েছেন অনেক, বেঁচেছেন সংগ্রাম করে। তাঁর নাটকীয় রাজনৈতিক জীবন, জেলজীবনের অভিজ্ঞতা বৃথা যায়নি। তিনি আমাদের শিখিয়ে গেছেন, জীবন কীভাবে জয়ী করতে হয়– আদর্শ দিয়ে, দৃঢ়তা দিয়ে, সততা ও নিষ্ঠা দিয়ে, কাজ দিয়ে। স্যার বলতেন, আমার মেয়ে ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা সবাই চেষ্টা করুক না কেন মৃত্যু আমাকে নিতে আসবেই। মৃত্যুকে স্যার পরোয়া করেন নি। মৃত্যু তাঁর কাছে জন্মের মতোই স্বাভাবিক।

একজন প্রকৃত দার্শনিক ও জ্ঞানসাধকের মতোই সন্ন্যাসতুল্য জীবনযাপন করেছেন। সদাহাস্যময়, রসিকজন, চিন্তাশীল এবং স্বল্পাহারী সরদার ফজলুল করিমের সুদীর্ঘ জীবন আমাদের কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যময়।

তিনি জন্মেছিলেন ১ মে, ১৯২৫ সালে। ২০১৪ সালের ১ মে তার ঊননব্বই বছর পূর্ণ হয়েছে! ছাত্রজীবনে সরদার স্যার ছিলেন তুখোড় মেধাবী। কর্মজীবনে ঢুকেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা পেশায়। পার্টির নির্দেশে চাকরি ছেড়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গিয়েছিলেন, ধরা পড়ে জেল খেটেছেন। পুরো পাকিস্তান আমলটাই তাঁর জেলজীবন। জেল থেকে জেলে গিয়ে ভেঙে পড়েননি, মনোবল হারাননি, পাঠ থেকে বিচ্যুত হননি। চিন্ত করা, অভিজ্ঞতা অর্জন করা আর তা লিখে প্রকাশ করার ব্যাপক অভিজ্ঞতা তিনি অনুভব করেছেন। জীবনসংগ্রামকে ইতিবাচকভাবে নিয়ে জীবনকে উপভোগ করে তুলেছিলেন সরদার স্যার। জীবনে তুচ্ছ চাওয়া-পাওয়ার হিসাব কষেননি। ভালোবাসার ভৃত্যরূপে নিজেকে প্রকাশ করেছেন বারবার।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরই এসেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, বাংলা একাডেমিতে। বাংলা একাডেমির সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যক্ষরূপে তিনি দায়িত্ব পালন (১৯৬০-১৯৭১) করেছিলেন। পরবর্তী পর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষকতা করেছেন। সে সঙ্গে লিখেছেন 'দর্শন কোষ', 'নানা কথার পরের কথা', 'নানা কথা', 'রুমির আম্মা', 'গল্পে গল্প চল্লিশের দশকের ঢাকা', 'যুক্তিবিদ্যা', 'সেই সে কাল', 'কিছু স্মৃতি কিছু কথা', 'আমাদের সাহিত্য', 'নূহের কিশতি', 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পূর্ববঙ্গীয় সমাজ'। অসামান্য সৃজনশীলতায় অনুবাদ করেছেন 'প্লেটোর সংলাপ;, এঙ্গেলসের 'অ্যান্টি ড্যুরিং', প্লেটোর 'রিপাবলিক', রুশোর 'সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট'সহ নানা গ্রন্থ।

নিরন্তর প্রশ্ন করা, সরলভাবে সুগভীর প্রশ্নোত্তর দিয়ে দার্শনিক জিজ্ঞাসা চরিতার্থ করেছেন এবং তরুণদের উদ্দীপ্ত করতে পেরেছিলেন। 'জীবন জয়ী হবে' গ্রন্থে পাওয়া যায় তাঁর জীবন সংগ্রামের ইতিকথা।

সরদার স্যার 'মৃত্যুকে তুচ্ছ করে' শনিবার রাতে রাজশানীর শমরিতা হাসপাতাল থেকে 'জীবনকে জয়ী করে' চলে গেলেন। স্যারের যারা 'ব্যর্থ' অনুরাগী আছি, তারা সবাই মিলে স্যারের কর্মময় আদর্শনিষ্ঠ জীবনকে যদি সামান্যতমও অনুসরণ করতে পারতাম, ছড়িয়ে দিতে পারতাম, তাহলে সমাজের প্রতি দায়শোধের অন্তত প্রাথমিক কাজটা সম্পন্ন হত।