পর্নোগ্রাফিতে পথশিশু ও আমাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা

জিনিয়া জাহিদ
Published : 14 June 2014, 05:13 PM
Updated : 14 June 2014, 05:13 PM

খবরটা পড়েই চমকে উঠেছিলাম। টিপু কিবরিয়া নামক একজন ব্যক্তি, যে কিনা শিশুদের নিয়েই লেখালেখি করে, শিশুদের দিয়ে পর্নো ভিডিও তৈরির অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছে। সন্দেহ নেই, এই ব্যক্তি মানসিক রোগী। রাজধানীর বুকে দীর্ঘ নয় বছর ধরে শিশুসাহিত্যিক সেজে ভদ্রতার মুখোশ পরে, অসহায় পথশিশুদের দিয়ে সে এই জঘন্য কাজ করে এসেছিল। আমাদের সৌভাগ্য যে, দেরিতে হলেও এই অপরাধী ও তার সহযোগীদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়েছে।

নাটক-সিনেমার শেষ দৃশ্যের মতো আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ভিলেন ধরা পড়েছে, কাজেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে দর্শকেরা পরিতৃপ্তির ঢেঁকুর এখন তুলতেই পারেন। কিন্তু আসলেই কি তাই? টিপু কিবরিয়া ও তার সহযোগীদের গ্রেপ্তারের দ্বারাই কি এ কাহিনি শেষ হয়ে যায়? এই ঘটনার গভীরে না গিয়েই কি আমরা পরিতৃপ্তি পেতে পারি? না, পারি না।

কারণ এই পথশিশুরা আমাদেরই; তাদের প্রতি সামাজিক দায়বদ্ধতা আমরা অস্বীকার করতে পারি না। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে তাদের সুন্দর জীবনের অধিকার দিতে রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতেই হবে। দেশকে যতই ডিজিটাল বানানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাবার কথা বলি না কেন, এই পথশিশুদের উপেক্ষা করে তা কখনও-ই সম্ভব হবে না।

নারী-পুরুষের মুহূর্তের যৌনাকাঙ্ক্ষা, ধর্ষণ, অপরিকল্পিত যৌনাচার, অজ্ঞানতা ও উদাসীনতা– মূলত এসবের কারণে জন্ম নেয় অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত শিশু। জন্মই যেন তাদের আজন্ম অভিশাপ। জন্ম যাদের পথে, তাদের বেড়ে ওঠাও হয় পথে, খোলা আকাশের নিচে। আবার দেখা যায়, বৈধ বিয়ের ফসল যে পথশিশুরা, তারাও জন্মের পর থেকেই ব্যবহৃত হয় ভিক্ষাবৃত্তিতে। একটু বড় হলেই নিজের পেটের ধান্দাসহ পুরো পরিবারের দায়িত্ব এদের কাঁধে চেপে বসে।

বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, বাংলাদেশে প্রায় ৩,৮০,০০০ পথশিশু রয়েছে যাদের মধ্যে ৫৫ শতাংশ ঢাকায় থাকে। বাবা-মা আত্মীয়পরিজন ছাড়াই এদেরকে আমরা দেখি ফুটপাতে, বাজারে, বাণিজ্যিক এলাকায়, লঞ্চঘাটে, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়, কমলাপুর রেলস্টেশনে, হোটেলে, পার্কে, স্টেডিয়ামে– কোথায় নেই এরা!

নিজের ও পরিবারের খাবার জোগাতে এরা ফুল বিক্রি করে, জিনিস ফেরি করে, ময়লা কুড়ায়, ইট ভাঙে, রিকশা চালায়, ভিক্ষা করে। এসব পথশিশুকে দিয়ে নেতারা মিছিলের দৈর্ঘ্য বাড়ান, হরতালে পিকেটিংসহ যাবতীয় জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনে এগিয়ে দেন। গডফাদারেরা চুরি, ছিনতাই, মাদক পাচারসহ বিভিন্ন অপরাধে এদেরকে ব্যবহার করেন।

এই যখন এদের জীবন ও জীবিকার অবস্থা, তখন এর সঙ্গে যুক্ত হয় যৌন হয়রানি (Child abuse/ Child maltreatment)। এখানে উল্লেখ্য যে, ১৮ বছরের নিচে যে কোনো শিশুকে শুধু ধর্ষণ বা যৌন সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য করাকেই শিশু যৌন নির্যাতন বলা হয় তা নয়। এর সঙ্গে, শিশুর সংবেদনশীল স্থানে হাত দেওয়া, গোপন স্থান দেখার জন্য শিশুকে তার কাপড় খুলতে বাধ্য করা, অশ্লীল ছবি তুলতে বাধ্য করা, জোরপূর্বক খারাপভাবে চুমু খাওয়া, অশ্লীল ছবি দেখানো– এসবও যৌন নির্যাতনের পর্যায়ে পড়ে।

আমাদের দেশের পত্রপত্রিকা খুললেই যেখানে দেখা যায় পিতামাতার নিরাপদ আশ্রয়ে থেকেও শিশুরা ধর্ষণ বা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে– সেখানে খোলা আকাশের নিচে বাস করা এই অরক্ষিত পথশিশুরা যে প্রতিনিয়ত যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, তা বলা বাহুল্য।

সেইভ দ্য চিলড্রেনের একটি গবেষণায় দেখা যায় যে, বাংলাদেশে যেসব শিশু যৌন হয়রানির শিকার হয় তাদের ৫২ ভাগ মেয়েশিশু আর ৪৮ ভাগ ছেলেশিশু। ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, আমাদের দেশের মেয়ে পথশিশুরা প্রতিনিয়তই নানা রকম যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। একটু বড় হতেই এদের মধ্যে বেশিরভাগ পাচার হয়ে যায় ভারতসহ দেশের অভ্যন্তরেই, যৌনপল্লীগুলোতে। অন্যদিকে সেইভ দ্য চিলড্রেনের তথ্যানুযায়ী, পথশিশুদের মধ্যে ছেলেশিশুদের একাংশ উটের জকি হিসেবে পাচার হয়ে যায় মধ্যপ্রাচ্যে।

মেয়েশিশুদের যৌন নির্যাতন নিয়ে যত কথা শোনা যায়, ছেলেশিশুদের যৌন নির্যাতন নিয়ে আমরা তেমন একটা মাথা ঘামাই না। মেয়েদের যৌন নির্যাতনের ঘটনাগুলো অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তান ধারণ বা সংবেদনশীল বিষয় বলে মিডিয়ার দ্বারা যতটা প্রকাশ হয়, ছেলেদের যৌন নির্যাতনের কাহিনিগুলো তেমনভাবে প্রকাশ হয় না। আর এর জন্য আড়ালেই থেকে যাচ্ছে ছেলেশিশুদের যৌন নির্যাতনের বিষয়টি। আমরা মনে করি, ছেলেদের আবার হারানোর ভয় কী! এদের জন্য রাতের অন্ধকার, অপরিচিত ব্যক্তি কোনো কিছুতেই যেন আতঙ্কের কিছু নেই।

অথচ শিশুসাহিত্যিক পরিচয়ের আড়ালে ভয়ংকর লোক টিপু কিবরিয়া আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল ছেলেশিশুরাও কত অসহায়। কত ভয়ংকর ঘৃণ্য কাজে তাদের ব্যবহার করা যায়! পথশিশুরা যখন যৌন হয়রানির শিকার হয়, তখন তাদের জাত-পাত-ধর্ম-লিঙ্গ কোনো কিছুই অপরাধীদের বিবেচনায় আসে না। বিকৃত রুচির মানুষের কাম চরিতার্থ করাই মূখ্য হয়ে ওঠে।

আমেরিকার ডিপার্টমেন্ট অব হেলথ অ্যান্ড হিউম্যান সার্ভিসেসের জরিপ অনুযায়ী, শতকরা ৩০ ভাগ ব্যক্তি যারা নিজেরা শৈশবে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিল, তারাই বড় হয়ে শিশু নির্যাতন করে থাকে। আমাদের দেশে যেহেতু এই প্রেক্ষাপটে তেমন কোনো গবেষণা হয়নি, তাই ধারণা করা যেতে পারে যে, এই শিশু নির্যাতনকারীরাও একসময় হয়তো নিপীড়নের শিকার হয়েছে; আর তাই তারা পরে ভয়াবহ অপরাধচক্রে জড়িয়ে পড়েছে।

এ জন্যই টিপু কিবরিয়াকে বিচারের আওতায় আনার পাশাপাশি, তার মনস্তাত্ত্বিক বিষয়াদি নিয়েও গবেষণা করা যেতে পারে। উন্মুক্ত হতে পারে কেন এবং কী কারণে শিশুদেরকে এই বিকৃত রুচির অপরাধীরা যৌন হয়রানি করে থাকে।

পর্নোগ্রাফির মাধ্যমে যৌনানুভূতি ভালোভাবে বোঝার আগেই এসব ছেলেশিশুকে সমকামে বাধ্য করা হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণায় দেখা যায়, যে শিশুরা যৌন হয়রানির শিকার হয় তারা শারীরিক, মানসিক ও আচরণগত বিভিন্ন সমস্যায় ভোগে। এদের অধিকাংশই পরবর্তীতে মাদকাসক্ত হয় এবং অস্বাভাবিক ও অস্বাস্থ্যকর যৌন জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এর সামাজিক পরিণতি কত ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে তা হয়তো আমরা কল্পনাও করতে পারছি না।

খেয়াল করে দেখুন, আমাদের চারপাশে আজকাল মানসিক বিকারগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা যেন দিনদিন বেড়েই চলেছে। চারপাশে কী রকম নৃশংস অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। কারা এসব অপরাধের সঙ্গে জড়িত, কাদেরকে দিয়ে গডফাদারেরা নৃশংসভাবে মানুষ খুন করিয়ে নিচ্ছে?

সন্দেহ নেই, অশিক্ষা, অযত্ন, অবহেলা ও যৌন নির্যাতনের শিকার পথশিশুদের একটি অংশ বড় হয়ে সামাজিক বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এর ফলে সমাজের নিরাপত্তা যেমন বিঘ্নিত হচ্ছে, তেমনি এই শ্রেণির মানুষের সংখ্যা যত বাড়বে, একটা সময় দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হতে বাধ্য।

টিপু কিবরিয়ার মতো ভয়ংকর বিকৃত রুচির অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির পাশাপাশি, পর্নোগ্রাফিতে যেসব পথশিশু ব্যবহৃত হয়েছে, তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের রক্ষণাবেক্ষণ অত্যন্ত জরুরি। শিশু যৌন নির্যাতন রোধে সচেতনতা সৃষ্টিতে দেশি-বিদেশি এনজিও-এর সঙ্গে সর্বাগ্রে এগিয়ে আসতে হবে সরকারি সংস্থাগুলোকে। যৌন নির্যাতনের শিকার অসহায় পথশিশুদের রক্ষণাবেক্ষণ না করে উপেক্ষা করা মানেই সামাজিক ব্যাধিকে মহামারী আকারে ছড়িয়ে দেওয়া।

প্রশ্ন হল, এই সামাজিক ব্যাধি রুখে দিতে আমরা সাধারণ জনগণ, সর্বোপরি সরকার কতখানি আন্তরিক? কতখানি প্রস্তুত?

তথ্যসূত্র:

১.

২.

৩.

৪.

জিনিয়া জাহিদ: অস্ট্রেলিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ ও গবেষক।