মানবাধিকার দিবসে

মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান
Published : 17 August 2008, 11:12 AM
Updated : 10 Dec 2010, 09:17 AM

আজ থেকে বাষট্টি বছর আগে ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বরে সার্বজনীন মানবাধিক সনদ ঘোষণা করা হয়। সাত-আট দশকে 'মানবাধিকার' শব্দটি সভা-সমিতিতে তেমনভাবে উচ্চারিত বা আলোচিত না হলেও বর্তমানে প্রতিটি দেশে মানবাধিকার প্রশ্নটি গভীরভাবে আলোচিত হচ্ছে।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ভয়াবহ ধ্বংসলীলা মানুষ উদ্বেলিত হয়ে চিন্তা করে কিভাবে বিশ্বে স্বাধীনতা, ন্যায় বিচার ও শান্তির ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত করা যায়। মানবাধিকার সনদের প্রস্তাবনায় বলা হয় 'চূড়ান্ত পদক্ষেপ হিসেবে মানুষকে অত্যাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে বাধ্য করা না হয় মানবাধিকারসমূহকে অবশ্যই আইনের শাসন দ্বারা সংরক্ষিত করা উচিত।' ১৯৭১ সালে ওই প্রস্তাবনায় যে আশঙ্কার কথা বলা হয় সে নিদারুন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জনগণ অনন্যোপায় হয়ে চূড়ান্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।

অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধে গণতন্ত্রও মানবাধিকার যুদ্ধধ্বনি হিসাবে উচ্চারিত হয়। আমরা মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভ করার একবছরের মধ্যেই সংবিধান রচনা করি। আমাদের সংবিধানের প্রস্তবনার এবং ১১ অনুচ্ছেদে মৌলিক মানবাধিকারের শব্দদ্বয় উল্লেখ করি এবং তৃতীয় বিভাগে মৌলিক অধিকারের বিস্তারিত বিবরণ দিই। ৪৪ অনুচ্ছেদে মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিকার হিসাবে হাইকোর্ট বিভাগে মামলা রুজু করার অধিকারকে নিশ্চয়তা দান করা হয়।

পাশ্চাত্য দেশের একটা অহমিকা আছে যে, মানবাধিকার ধারণা তাদের চিন্তারফসল, বিশেষ করে তা ইহুদি-খ্রিষ্ঠান ধর্ম-ঐতিহ্য থেকে উদ্ভূত। পাশ্চাত্যের ইতিহাস ও আচরণ লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এই দাবির কোনো ভিত্তি নেই। ১৯৪৮ সালের আগেই বাংলাদেশের লোক তাদের ঐতিহ্য-সাহিত্য থেকে মানবাধিকারের ধারণ পেয়ে এসেছে। আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের কাছ থেকে আমরা ভাগ্যহত অসহায় মানুষ, নিপীড়িত ও অবহেলিত নারী এবং বঞ্চিত ও দারিদ্র্যক্লিষ্ট কৃষক শ্রমিকদের অধিকারের কথা শুনে এসেছি। নজরুল চিরন্তন বিদ্রোহের কথা বলেন। তিনি বলেন, আমি সেই দিন হব শান্ত যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না। নারী-পুরুষ বৈষম্য সম্পর্কে তিনি বলেছেন, পৃর্থিবীতে যেখানে যা কিছু ভালো কাজ হয়েছে তার অধৈক করেছে নারী। লিঙ্গবৈষম্যের ক্ষেত্রে লালন প্রশ্ন করেছেন স্বর্গে গিয়ে পূণ্যবান পুরুষ কিছু পেলে, পূণ্যবান নারী কী পাবেন। সমতার কথা বলতে গিয়ে তিনিই না বলেন, গরুর নানা রঙ কিন্তু দুধের রঙ সর্বত্র সাদা।

আমাদের সংবিধানে শুধু নাগরিকে জন্য নয়, যে কোনো মানুষ সে শরণার্থী বা সাময়িকভাবে অবস্থানরত হোক না কেন সংবিধানের ৩১, ৩২, ৩৩, ৩৪, ৩৫ ও ৪৪ অনুচ্ছেদে বর্ণিত মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রে আশ্রয় লাভের অধিকারী। এখানে বিশেষভাবে ৩১ অনুচ্ছেদের বিধান উল্লেখ করা প্রয়োজন। দেশের প্রত্যেক নাগরিকের মতো সাময়িকভাবে অবস্থানরত যে কোনো ব্যক্তির জন্যও আইনের আশ্রয়লাভ এবং আইনানুযায়ী এবং কেবল আইনানুসারী ব্যবহার লাভ একটি অবিচ্ছেদ অধিকার। আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোনো ব্যবহার করা যাবে না। যাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে।

মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিকার পাওয়ার কথা সরকারের নির্বাহী বিভাগের কাছ থেকে, বিশেষ করে আইন শৃঙ্খলা দপ্তরের কাছে। আদালতের কথা আসে শেষ আশ্রয় হিসেবে। আদালতের নাগাল পাওয়া সহজ নয়, এবং তা ব্যয়বহুল। আমাদের প্রশাসনের দক্ষতার অভাব রয়েছে। এনকাউন্টার এবং ক্রসফায়ারে আমরা যে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছি তা অত্যন্ত লজ্জাকর। আমাদের অন্যায় এত বৃদ্ধি পায় যে লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে বাধ্য হয়ে দায়মুক্তির আইন পাস করে একটা অনপনেয় কলঙ্ক এঁকে দিই দেশের কপালে। মানবাধিকার সংরক্ষণে আমাদের সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটাতে হবে। প্রশাসনকে। বিশেষভাবে আইনশৃঙ্খলা বিভাগকে আরও দক্ষ ও তৎপর হতে হবে। সুখের বিষয় অতিবিলম্বে হলেও দেশে একটা মানবাধিকার কমিশন গঠিত হয়েছে। আমরা সেই কমিশনের সাফল্য কামনা করি।

মানবাধিকার লঙ্ঘন ও যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে তা আমরা সর্বান্তকরণে সমর্থন জানাই। শাস্তিদান নিশ্চিত করার জন্য অকাট্য প্রমাণ সংগ্রহের কারণে বিচার বিলম্বিত না হওয়াই ভালো। অনেক দেরি হয়েছে। এ এমন এক অপরাধ যার সৎকার অনুষ্ঠান যথাশীঘ্র সম্ভব সম্পন্ন করার হোক। আমরা আক্রোশবশত কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করব না। যাদের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযোগ হচ্ছে তাদের স্নেহের পাত্র হিসেবে কোন অনুকম্পাও প্রকাশ করব না।

মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান: