প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে একটি সম্ভাব্য সমাধান

ওয়ালিউল্লাহ ফুয়াদ
Published : 18 June 2014, 03:44 PM
Updated : 18 June 2014, 03:44 PM

বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম সমস্যার নাম প্রশ্নপত্র ফাঁস। বিশেষভাবে বলতে গেলে, কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত যে কোনো পরীক্ষার প্রধান সমস্যা হল প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং এর সঙ্গে রয়েছে প্রশ্নপত্র ফাঁসের গুজব। এই প্রশ্নপত্র ফাঁসের গুজব যে শুধু গুজবই, ব্যাপারটা তা নয়। এটি অনেক সময় বাস্তবে পরিণত হয় এবং হচ্ছে।

তাই যারা আমাদের মতো পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছে, পড়াশোনা তো আছেই, এর পাশাপাশি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ, ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে হলেও এই প্রশ্নফাঁসের গুজব তাকে আরও বেশি আচ্ছন্ন করে ফেলে এবং পরীক্ষার্থীরা পড়াশুনা বাদ দিয়ে 'ফাঁস হওয়া' প্রশ্নপত্র সংগ্রহেই বেশি মনোযোগী হয়ে পড়ে।

এটাও অসম্ভব নয় যে, এই প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা কাজে লাগিয়ে কেউ কেউ ব্যক্তিগত শত্রুতা বা হিংসাবশত ইচ্ছাকৃতভাবে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের নামে অন্য একটা মনগড়া প্রশ্ন দিয়ে দিচ্ছে কোনো পরীক্ষার্থীকে। এমনিতেই পড়াশুনাসহ পরীক্ষার চিন্তা, সঙ্গে যুক্ত হয় প্রশ্নপত্র ফাঁসের গুজব, সব মিলিয়ে একজন শিক্ষার্থীর অবস্থা হয় অবর্ণনীয়। তাই আমরা সকলেই চাই, চিরতরে অবসান হোক এই প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ হওয়া; সঙ্গে এই প্রশ্নপত্র ফাঁসের গুজবও ছড়ানো বা রটানোরও কোনো রকম সুযোগ না থাকে।

কিন্তু সত্যি কি এই প্রশ্ন ফাঁস ও ফাঁসের গুজব বন্ধ করা সম্ভব? হ্যাঁ, অবশ্যই সম্ভব। আমি প্রশ্নপত্র ফাঁসের এই ব্যাপারটিকে সময়ের প্রেক্ষিতে অত্যন্ত সাধারণ ঘটনা হিসেবেই দেখি। আর সাধারণ ঘটনার সমাধানও অতিসাধারণ মানের– শুধু প্রয়োজন সময়োপযোগী ব্যবস্থা।

প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনার সমস্যার সমাধান করতে হলে প্রথমেই আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন থেকে শুরু করে পরীক্ষার শুরুতে পরীক্ষার্থীদের হাতে যাওয়া পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়াটিতে। তাহলেই দেখা যাবে কেন ও কীভাবে ফাঁস হচ্ছে এবং পাওয়া যাবে এই সমস্যার সমাধানও।

এক নজরে আলোকপাত করা যাক, প্রশ্নপত্র প্রণয়নের পুরো প্রক্রিয়া। প্রথমেই প্রশ্নপত্র বিভিন্ন শিক্ষক মহোদয়ের কাছ থেকে পাওয়ার পর তা মডারেশন (moderation) করা হয়। এই কপিটি কম্পিউটারে টাইপ কবার পর পাঠানো হয় প্রেসে। প্রেসে লক্ষ লক্ষ কপি ছাপানোর পর তা প্যাকেটিং করে পাঠানো হয় নির্দিষ্ট এলাকাতে। বিভিন্ন অঞ্চলে সাধারণত এই প্রশ্নপত্র পরীক্ষার আগের দিনই পৌঁছানো হয়।

পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হাজারো নিষ্ঠাবান মানুষ জড়িত থাকেন। প্রক্রিয়াতে যদিও কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকে এবং সম্পাদন করা হয় অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে, তারপরও বর্তমানের তথ্যপ্রযুক্তির যুগে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙে ফেলা যায় অনেকভাবেই।

এখন দেখা যাক, এই প্রক্রিয়ার দুর্বল দিকগুলো। প্রথমেই আসি টাইপের জায়গায়। প্রশ্নপত্র প্রথমে কম্পিউটারে টাইপ করা হয়। বর্তমানে এমন সব সফটওয়্যার পাওয়া যায় যার সাহায্যে ডিলিটকৃত ফাইল তো অবশ্যই, হার্ড ড্রাইভ, পেন ড্রাইভ বা মেমোরি কার্ড ফরম্যাট করার পরও সেই সব ফাইল বা ডাটা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব, অতি সহজেই। টাইপ করার পর এই সফট কপি বা হার্ড কপি পাঠানো হয় প্রেসে, যেখানে লক্ষ লক্ষ কপি ছাপানো হচ্ছে।

এখন তো পুরো বিষয়টি পরিষ্কার। এই ধাপটিতে মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে প্রশ্নপত্র বের করা, কপি করা, ছবি তোলা (কারণ অধিকাংশ মানুষের পকেটে মোবাইলের মধ্যে ক্যামেরা আছে) অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। যদিও প্রেসে সঙ্গে কোনো কিছু নিয়ে প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষেধ এবং নিরাপত্তাও অত্যন্ত শক্তিশালী, তারপরও সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

প্যাকেজিং-এর পর প্রশ্নপত্রগুলো পাঠানো হয় নির্দিষ্ট এলাকাতে এবং সেখানে সংরক্ষণ করা হয়। এই ধাপই অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এখানে রক্ষকেরাই ভক্ষকের ভূমিকায় পালন হতে পারে এবং হওয়ার জন্য যথেষ্ট সুযোগ আছে। দু-তিনজন একত্রে মিলে করলে সেখানে আলামত পাওয়াটাই অস্বাভাবিক এবং দোষীদের চিহ্নিত করে প্রমাণ করাটা অত্যন্ত দুরুহ। ঘটনাটি খুবই সাধারণ মানের।

আমাদের সমাজে হাজারে দু-চার-পাঁচ জন অসৎ ব্যক্তি থাকবে না, এটা না ভাবাটাই অন্বাভাবিক। শুধুমাত্র এই অল্প কিছু মানুষের অসততা ও অপকর্মের কারণে পুরো ব্যবস্থাকে খারাপ ও কলুষিত বলা অনুচিত। তেমনি হাজারো মানুষের সততা ও নিষ্ঠাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অপমান করাও মেনে নেওয়া যায় না। তদুপরি, সরকারের শিক্ষা ব্যবস্থা-কেন্দ্রিক সকল সাফল্য ম্নান হতে দেওয়া যায় না। সর্বোপরি, যারা আজকের পরীক্ষার্থী তারাই আগামীর ভবিষ্যত, তাদের জীবন নিয়ে এমন ছিনিমিনি খেলা চিরতরে বন্ধ করতে হবে।

এখন মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, এখন কেন এমন হচ্ছে, আগে তো এমনভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁস হত না। উত্তরটা খুবই সরল। আমাদের দেশের প্রশ্নপত্র প্রণয়ন থেকে শুরু করে বিতরণের শেষ ধাপ পর্যন্ত প্রযুক্তিগত কাঠামো আজ থেকে ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর আগে যা ছিল, আজও প্রায় সে রকমই আছে। কিন্তু কালের বহমানে প্রযুক্তি এগিয়ে গিয়েছে অনেক বেশি।

আজ থেকে প্রায় ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর পিছনে ফিরে তাকাই, দেখা যাবে, তখন প্রশ্নপত্র লেখা হত হাতে অথবা টাইপ মেশিনে, এক কথায় বলতে গেলে যা আজ জাদুঘরে। সেখানে কম্পিউটারের মতো ব্যাকআপের কোনো সিস্টেম ছিল না। সে সময় কপির মাধ্যম বলতে গেলে বলা যায় কার্বন পেপারই; ক্যামেরা তো দূরে থাক, ফটোকপির মেশিনই ছিল না; থাকলেও তাতে ফিল্ম ভরে নেগেটিভ এর মাধ্যমে ওয়াশ করতে হত, যা সময়-সাপেক্ষ।

যখন প্রশ্নপত্রগুলো বিভিন্ন এলাকাতে পাঠানো হয় তখন হাজারো কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ভিতর থেকে ৪-৫ জন অসৎ ব্যক্তি থাকবে না এবং কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে প্যাকেট খুলে একটি ছবি তুলে তা আবার বন্ধ করে রাখবে না, এমন না ভাবাই অস্বাভাবিক বলে মনে করি।

আগের দিনেও যে এমন হত না তা বলা যায় না (খারাপ মানুষ সবকালেই ছিল), কিন্তু তখন যদি কেউ হঠাৎ করে প্রশ্নপত্র পেত, তা রাতের বেলা একই এলাকার এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পাঠানোই দুঃসাধ্য ছিল। সে কারণে তা ২-৪ জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত। তখন মোবাইল ফোন তো বাদই দিলাম, টিএন্ডটি ফোনই-বা ক'জনের কাছে ছিল। আর তথ্য আদান-প্রদানের মূল মাধ্যমই ছিল ডাক, যা নিয়ে আলোচনা পুরাই বৃথা!

আর এখন প্রত্যেকের কাছে মোবাইল ফোন। একটি এসএমএস পাঠালে একসঙ্গে যতজনের নাম্বার ইনক্লুড করা আছে, সবার কাছে একসঙ্গে চলে যায়। ইন্টারনেট ও ফেসবুক, সেটা তো তথ্যপ্রযুক্তির বৈপ্লবিক অধ্যায়ের আরেক নাম। কোনো ব্যক্তি বা কোনো পরীক্ষার্থী কোনোভাবে কোনো প্রশ্ন জানতে পারলে (হোক না গুজব, যা অনেক সময় পুরোটাই বাস্তবে পরিণত হয়) ফেসবুকে পোস্ট করলে কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে ফ্রেন্ড লিস্টের সবাই জানতে পারছে।

এভাবেই বিশেষ করে পরীক্ষার আগের রাতে একজন থেকে আরেকজন করতে করতে কয়েক মিনিটের ব্যবধানে প্রায় দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে, যা একসময়ের প্রেক্ষাপটে শুধুই স্বপ্ন, সেটা বেশি দিন আগের কথা নয়। উপরন্তু, প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে তো বিভিন্ন পেইজ ও গ্রুপই খোলা হয়েছে যার সদস্য সংখ্যা এরই মধ্যে কয়েক লাখ ছাড়িয়ে গিয়েছে, অর্থাৎ এদের যে কোনো একজনের একটি পোন্ট করার মাধ্যমে তা দেশ তো বটেই পৃথিবীব্যাপী লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে।

আর এভাবেই নিরানব্বই শতাংশ মানুষের সততা, নিষ্ঠাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মাত্র এক শতাংশ, হয়তো এর চেয়েও কম কিছু মানুষ পুরো জাতির ভবিষ্যত অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিবে, তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এ ঘটনায় দোষী আসলে কেউ নয়, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তো নয়ই। দোষী হিসেবে যদি কাউকে অপরাধী সাব্যস্ত করতে হয়, তাহলে বলতে হয় আসল দোষী হল প্রযুক্তি। হ্যাঁ, প্রযুক্তির এই উৎকৃষ্টতার কারণেই এই সাময়িক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে যা আজ প্রকট আকার ধারণ করেছে।

তাহলে এর সমাধান কী? সমস্যার পথ ধরেই এর সমাধান সম্ভব। অর্থাৎ যেখান থেকে সমস্যার উৎপত্তি, সেখানেই সমস্যার সমাধান। হ্যাঁ, এই তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমেই প্রশ্নপত্র ফাঁস সমস্যার সমাধান করতে হবে। কাঁটা দিয়েই কাঁটা তুলতে হবে।

তাকানো যাক একটি সম্ভাব্য সমাধানের দিকে। প্রশ্নপত্র ফাঁস তো অবশ্যই, সঙ্গে গুজবও বন্ধ করতে হবে যাতে অযথা কেউ কোনো পরীক্ষার্থীর মাথা নষ্ট করতে না পারে। এর একমাত্র সমাধান হল পরীক্ষার দিন সকালবেলা প্রশ্নপত্র ছাপানো এবং বিতরণ করা। মনে প্রশ্ন জাগতে পারে এটা কীভাবে সম্ভব? হ্যাঁ, সম্ভব এবং খুব ভালোভাবেই সম্ভব।

প্রথমেই দেখি মডারেশনের ব্যাপারটা। মডারেশন করা হবে একাধিক, অর্থাৎ কমপক্ষে ৪-৫ সেট প্রশ্নপত্র তৈরি করা হবে। প্রত্যেক সেটের মডারেশনের ব্যক্তি হবেন ভিন্ন। যিনি মডারেশন করবেন, তিনি নিজেই টাইপ করবেন হেড অব কনসার্ন ডিপার্টমেন্টের (যেমন শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান) এর নিজস্ব ল্যাপটপে, যা কিনা শুধুমাত্র ওই নির্দিষ্ট সেট প্রশ্নপত্র তৈরিতেই ব্যবহৃত হবে। মডারেশনের পর ল্যাপটপটি লকারে রেখে দেওয়া হবে। ব্যাকআপ হিসেবে আরও ২-১ টি পেন ড্রাইভও। এতে করে পরীক্ষার দিন সকালের আগ পর্যন্ত প্রশ্নপত্র দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তির হাতে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

পরীক্ষার দিন সকাল বেলা (পরীক্ষা ১০ টায় শুরু হলে সকাল ৭:৩০মিনিটে ) সবার উপস্থিতিতে (দায়িত্বপ্রাপ্ত ৪-৫ জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা) লকার খোলার পর লটারির মাধ্যমে ১ সেট প্রশ্নপত্র সিলেক্ট করা হবে।

এখন আসি বিতরণ ব্যবস্থায়। পরীক্ষার জন্য যতগুলো কেন্দ্র থাকবে, সবগুলো কেন্দ্রের থেকে একটি কক্ষ সিলেক্ট করে সেই রুমের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করতে হবে, অর্থাৎ সকাল থেকে ওই রুমের আশেপাশে কেউ যেতে পারবে না। চার-পাঁচটি সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে রুমের বাইরের ও ভিতরের সকল কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা হবে।

পরীক্ষার দিন সকালবেলা, একজন ম্যাজিস্ট্রেট, কেন্দ্র প্রধান, কনসার্ন ডিপার্টমেন্টের মনোনীত ব্যক্তি, একজন কম্পিউটার অপারেটর, চার-পাঁচ জন ব্যক্তি (যারা প্যাকেটিং-এর কাজ করবেন) সম্পূর্ণ চেকআপ হওয়ার পর রুমে প্রবেশ করবেন। পরীক্ষা শুরুর আগ পর্যন্ত তারা কোনোভাবেই বাইরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন না।

রুমের ভিতর যন্ত্রপাতি হিসেবে থাকবে দুটি ল্যাপটপ (যার একটির নাম্বারিং করা থাকবে ১, যা ব্যবহৃত হবে, অপরটির ২, যা ব্যাকআপ হিসেবে থাকবে), ৫-৬ টি লেজার প্রিন্টার, মডেম (নির্দিষ্ট কোম্পানির, হতে পারে তা রাষ্ট্রীয় কোম্পানিও), প্রয়োজনীয় কাগজ এবং প্রশ্নপত্র প্যাকেটিং-এর কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি।

এখন প্রশ্নপত্র পাঠানো এবং গ্রহণ করার ব্যাপারে আসি। প্রথমে একটি শক্তিশালী সার্ভার তৈরি করতে হবে। যেটাতে আগে থেকে ইনপুট দেওয়া ম্যাক নাম্বার সম্বলিত ল্যাপটপই রিড করতে পারবে, এর বাইরের কোনো ল্যাপটপ বা কম্পিউটার কোনোভাবেই রিড করতে পারবে না, যা কোনো কঠিন বিষয় নয়। কোন কোন ল্যাপটপ রিড করছে এবং ক'টার সময় করছে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে উঠে যাবে।

সাধারণত কেন্দ্রের ১ নম্বর ল্যাপটপই রিড করবে। ইমারজেন্সি ছাড়া ২ নম্বর ল্যাপটপ ব্যবহার করা যাবে না; করলে কারণসহ ব্যাখ্যা করতে হবে, সতর্কতার অংশ হিসেবে।

সকাল ৮ টা বা এর কিছু সময় আগে প্রশ্নপত্রটি সার্ভারে আপলোড করা হবে এবং কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সকল কেন্দ্রের ল্যাপটপে পৌঁছে যাবে। পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ল্যাপটপ থেকে ইন্টারনেটের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির সামনে, এটিও সতর্কতার অংশ হিসেবে (যদিও এই ম্যাক নাম্বার সম্বলিত ল্যাপটপ দিয়ে ইন্টারনেটের অন্য কোনো পেইজ ব্রাউজ করা সম্ভব নয়, তাতে প্রশ্নপত্রটি ফরোয়ার্ড করারও কোনো সুযোগ নেই)। ইন্টারনেটের এই বিষয়টি খুব সহজেই কেন্দ্রীয়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব।

এখন নজর দেওয়া যাক প্রশ্নপত্রগুলো ছাপানোর দিকে। সাধারণত কোনো কেন্দ্রের পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ৩ হাজারের বেশি হয় না। সে ক্ষেত্রে একটি প্রিন্টারে কমপক্ষে মিনিটে ২৫ টি প্রিন্ট হলে ৩০০০ হাজার কপি ছাপাতে ২০-২২ মিনিটের বেশি লাগে না। পরবর্তী ১৫-২০ মিনিটের মধ্যে তা প্যাকেটিং-সম্পন্ন। এখনও তো ৯টাই বাজেনি। পরবর্তী আরও ৩০ মিনিট না হয় থাকল, ব্যাকআপ সময় হিসেবে। ৯:৩০ মিনিটে প্রশ্নপত্রগুলো বের করে ১০ মিনিটের মধ্যে হলে হলে পৌঁছাতে হবে। আর এভাবেই সকাল ১০ টায় পরীক্ষা শুরু।

এই পদ্ধতিতে কোন জায়গা দিয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস হতে পারে, সে বিষয়টি কর্তৃপক্ষের পুরো নজরদারিতে রাখা সম্ভব। তারপরেও আমরা মানুষ, আমরাই প্রতিটা ব্যবস্থার দুর্বল দিক বের করে অসৎ পথে পা বাড়াই। সে হিসেবে কোনো ব্যবস্থাই এবসলিউট নয়। যদি কোনো কারণে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েও যায়, সে ক্ষেত্রে দোষীকে খুব সহজেই শনাক্ত করা সম্ভব। আর প্রশ্নপত্র ফাঁস হলেও তা কমপক্ষে সাড়ে আটটা থেকে নয়টার আগে নয়। সে সময় তো পরীক্ষার্থী পরীক্ষার উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বেরই হয়ে যায় এবং সলভ করার পর্যাপ্ত সময়ও পাবে না।

এখন মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, আমাদের দেশের প্রযুক্তিগত কাঠামো কি এতটাই শক্তিশালী? এমন নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে খরচও তো একটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার। প্রথম কথা হল, আমাদের দেশের প্রযুক্তি আজ বেশ শক্তিশালী, দেশে-বিদেশে আমাদের দেশের সাইবার সিকিউরিটি ও সফটওয়্যার বিশেষজ্ঞরা সাফল্যের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। তাদেরকে এ ক্ষেত্রে ইনক্লুড করতে হবে প্রয়োজনে।

আর ইনফ্রাস্ট্রাকচার তো অলরেডি আছেই। আমার জানামতে, এমন কোনো থানা নেই, যেখানে সবগুলো মোবাইল কোম্পানির মধ্যে একটিরও নেটওয়ার্ক নেই (পাহাড় অঞ্চল ছাড়া)। আর নেটওয়ার্ক থাকা মানেই ইন্টারনেটও আছে। আর যদি খুব সমস্যা হয়, তাহলে আশেপাশের ২-৩ কেন্দ্রের পরীক্ষা স্থানান্তর করে একটি কেন্দ্রে নিলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যায় (যা সারা দেশে দু-চার-পাঁচটিতে হলেও হতে পারে যা খুব বড় কোনো বিষয় নয়)।

এখন আলোকপাত করতে চাই খরচের দিকটিতে। একটি কেন্দ্রকে এক লক্ষ বিশ থেকে দেড় লক্ষ টাকার মধ্যে তৈরি করা যাবে বর্তমান বাজারের প্রেক্ষিতে। কারণ হিসেবে দুটি ল্যাপটপের দাম ৫৫-৬০ হাজার, ৫-৬ টি লেজার প্রিন্টারের দাম ৫০-৬০ হাজার টাকা এবং ৫-৬ টি শক্তিশালী সিসি ক্যামেরা। সব কেন্দ্রের খরচের সঙ্গে যুক্ত হবে একটি শক্তিশালী সার্ভার তৈরির খরচ যা হবে কয়েক লক্ষ টাকা।

বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় পাবলিক পরীক্ষা হল পিএসসি যার কেন্দ্রের সংখ্যা কমবেশি ৬০০। দেখা যাচ্ছে, এই পরীক্ষার জন্য প্রযুক্তিগত কাঠামো ১২-১৫ কোটি টাকার মধ্যেই সম্ভব, যা এককালীন খরচ। সঙ্গে যুক্ত থাকবে রক্ষণাবেক্ষণ খরচ। এই কাঠামো দিয়ে শুধু পিএসসি কেন, জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসিসহ যে কোনো কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষা খুব সহজেই নেওয়া সম্ভব। আর খরচ বর্তমানের তুলনায় কয়েক গুণ কম। বর্তমানে প্রেস থেকে শুরু করে সংরক্ষণ খরচ তো আছেই, সঙ্গে পরিবহন খরচ এতটাই যে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

অর্থনৈতিক দিকটির আরেকটি কথা না বললেই নয়, তা হল প্রশ্নপত্র নিয়ে বিশেষ করে পরীক্ষার আগে রাতে কোটি টাকার যে ব্যবসা বা খেলা চলে তা চিরতরে বন্ধ করতে হবে।

আসছে সামনে ভর্তিযুদ্ধ, অর্থাৎ উচ্চশিক্ষার জন্য বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তিপরীক্ষা, এর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হল মেডিকেল কলেজ ভর্তিপরীক্ষা যা দেশব্যপী একযোগে এক প্রশ্নপত্রে অনুষ্ঠিত হয় মাত্র ২৫-৩০ টি কেন্দ্রে, যা এই পদ্ধতির মাধ্যমে পরিচালনা করা খুবই সহজ।

বলছি না আমি যে প্রস্তাবটা করলাম এখানে সেটাই একমাত্র উপায় প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকানোর। কিন্তু এই লেখার মাধ্যমে আমি এটাই বোঝাতে চেয়েছি যে প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ করার কার্যকর উপায় আছে এবং সেটা খুব জটিল বা ব্যয়সাপেক্ষ কোনো পদ্ধতি নয়। প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে পত্রিকা আর মিডিয়াতে শুধু হেডলাইন বা ব্রেকিং নিউজ না করে, এর সম্ভাব্য সমাধানের দিকে এগিয়ে আসুন দেশের তথ্যপ্রযুক্তিবিদগণ– এটাই প্রত্যাশা।

যখন গত বছর প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারণে মেডিকেল ভর্তিপরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছিল, মেডিকেলের শিক্ষার্থী হিসেবে বিষয়টি আমাকে আহত করে ভীষণভাবে। তাই আশা করছি, প্রশ্নপত্রের দিক থেকে ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রথম ধাপটির শুরু হোক না, আমার বিষয় থেকেই।

ওয়ালিউল্লাহ ফুয়াদ: মেডিক্যাল শিক্ষার্থী।