স্বাধীনতা মানে দায়িত্ব

আলিমুল হক
Published : 8 Dec 2010, 03:24 PM
Updated : 8 Dec 2010, 03:24 PM

কথাশিল্পী সেলিনা হোসেন লিখেছেন: "বিজয় দিবসকে নিয়ে স্মৃতিচারণের সময় বৃহস্পতিবারই টানে বেশি। বৃহস্পতিবারের সাথে দেশের বড় ঘটনার নাড়ীর যোগ স্থাপিত হয়ে গেছে যেন।" ইতিহাসের দিকে তাকালে তার কথার যথার্থতার প্রমাণ পাই। অনেকে বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ রোপিত হয়েছিলো ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। ঘটনাচক্রে সে-দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ হানাদার বাহিনীর বর্বর আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে, আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়ে গিয়েছিলো বাংলাদেশে স্বাধীনতা-যুদ্ধ। সে-দিনটিও ছিল বৃহস্পতিবার। আর নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর পাকিস্তানী জেনারেল নিয়াজী যে-দিন মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন, জন্ম নিয়েছিলো স্বাধীন বাংলাদেশেরসে-দিন অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরও ছিল ওই বৃহস্পতিবার! তিন বৃহস্পতিবারের শেষ বৃহস্পতিবারে বাংলাদেশের এবং বাংলাদেশের মানুষের জন্য 'বৃহস্পতি' ছিল যথার্থই তুঙ্গে!!
লেখাটা যখন লিখছি, হঠাৎ কৌতুহলবশে চোখ বুলালাম ক্যালেন্ডারের পাতায়। চলতি বছর ২৬ মার্চ ছিল শুক্রবার। কিন্তু ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস? বৃহস্পতিবার!!! কথাশিল্পী 'বিজয় দিবসকে নিয়ে স্মৃতিচারণ' করেছেন; বলেছেন দেশের বড় ঘটনার সাথে বৃহস্পতিবারের নাড়ীর যোগ থাকার কথা। আমার পক্ষে স্মৃতিচারণ করা সম্ভব নয়। আমি বিজয় দেখিনি। একাত্তরে শিশু ছিলাম। বড় হয়ে অবশ্য পড়েছি অনেক; পড়েছি মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, পড়েছি হানাদারদের বর্বরতা আর তাদের এদেশীয় দালালদের অপকর্মের কথা। শুনেছিও অনেক। বড় ভাই কে এম আনিছ-উল-হক মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন; কিশোর মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের অনেক ঘটনার বিবরণ শুনেছি তার মুখে (আর মনে মনে তাঁকে করেছি ঈর্ষা। হায়! মুক্তিযুদ্ধের সময় যদি বড় থাকতাম!!) । শুনেছি আব্বার মুখেও। গভীর রাতে দরজা-জানালা লাগিয়ে দুরু দুরু বক্ষে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনতেন আব্বা। শুনেছি দিনের পর দিন নফল রোজা রেখে ও নামাজ পড়ে বঙ্গবন্ধুর জন্য তার দোয়া করবার কথা; শুনেছি কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ভেসে-আসা মেজর জিয়ার দৃপ্তকণ্ঠ শুনে আব্বার উদ্বেলিত হবার কথা। কিন্তু এই শোনায় বা পড়ায় কি মনের তৃষ্ণা মেটে? দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করবার সৌভাগ্য থেকে আমরা কালের আবর্তে পড়ে বঞ্চিতই থেকে গেলাম। কতবড় ভাগ্য তাদের, যাঁরা দেশের পক্ষে লড়াই করে কেউ হয়েছেন শহীদ, কেউ হয়েছেন গাজী। জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি সশ্রদ্ধ সালাম আর হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা।
মার্কিন স্টেট্সম্যান প্যাট্রিক হেনরি (Patrick Henry) বলেছিলেন: "অন্যদের কথা জানি না, আমার চাই স্বাধীনতা অথবা মৃত্যু।" অনুমান করি, দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা তেমনি কোনো মন্ত্র বুকে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এক অসম যুদ্ধে। আর বিশ্ববাসী অবাক হয়ে দেখলো, সে-যুদ্ধে মাত্র নয় মাসে দেশের অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধারা ছিনিয়ে আনলো স্বাধীনতার লাল সূর্য! কিন্তু কী আশ্চর্য, সে-স্বাধীনতা অর্জনের এতোগুলো বছর পরও, রচিত হলো না মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের পূর্ণাঙ্গ ও নিখুঁত ইতিহাস! আজো মুক্তিযোদ্ধাদের একটি নিখুঁত ও সর্বজনগ্রাহ্য তালিকা প্রকাশ করতে পারেনি কোনো সরকার!! স্বাধীনতা অর্জনের এতোগুলো বছর পরও আমরা জানি না তাদের সবার নাম-ঠিকানা, যাঁরা মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদার বাহিনী ও তাদের এ-দেশীয় দোসরদের হাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন। শুনেছি, স্বাধীনতার পর এদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করবার জন্য সরকারীভাবে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিলো। কিন্তু, রহস্যজনকভাবে, সে-উদ্যোগের ফলাফল দেশবাসীর সামনে প্রকাশ করা হয়নি। এই একই কথা খাটে বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ড তদন্ত কমিটির রিপোর্টের ক্ষেত্রেও। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিলো বলে আমরা জানি। শুনেছি, বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ড কারা ঘটিয়েছিলো তা তদন্ত করে দেখবার জন্য স্বাধীনতার পর একটি তদন্ত-কমিটি গঠন করা হয়েছিলো। তদন্ত-কমিটির রিপোর্ট আজো দিনের আলো দেখেনি!! এ-লজ্জা রাখি কোথায়? আমার মনে একাত্তরের কোনো স্মৃতি নেই, আছে একাত্তরকে ঘিরে একরাশ প্রশ্ন। বিশ্বাস করি, এসব প্রশ্ন শুধু আমাকেই নয়, সম্ভবত তাড়িত করে তরুণ প্রজন্মের অনেককেই। কিন্তু কে দেবে উত্তর?
জর্জ বার্নাড শ (George Bernard Shaw)ি বলেছেন: "স্বাধীনতা মানে দায়িত্ব।" মুক্তিযোদ্ধারা, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে, দেশের স্বাধীনতা এনে দিয়ে দেশের নেতা-নেত্রীদের ওপর যে-গুরুদায়িত্ব দিয়ে গেছেন, সে-দায়িত্ব কি ঠিকঠাক মতো পালিত হয়েছে? মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট একটা স্বাধীন দেশের মানুষের জন্য চারধরনের স্বাধীনতার কথা বলেছিলেনÑএক. বাক্-স্বাধীনতা; দুই. ধর্ম পালনের স্বাধীনতা; তিন. অভাব থেকে স্বাধীনতা; চার. সবধরনের ভয়-ভীতি থেকে স্বাধীনতা। বস্তুত দেশের মানুষের জন্য ওই চার ধরনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা-ই ছিল সেই গুরু দায়িত্ব। মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশকে বিশ্বের মানচিত্রে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবার পর কয়েক দশক কেটে গেছে। এখনও দেখছি, বাক-স্বাধীনতা ও ধর্ম পালনের স্বাধীনতা থাকলেও, বাকি দুটি স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত দেশের সিংহভাগ মানুষ। উন্নত জীবন তো দূরের কথা, কোনোরকমে বেঁচে-বর্তে থাকবার জন্য প্রয়োজনীয় জীবনোপকরণের অভাবে এখনো কাতর তারা। এঁদের অনেকের মাথা গোঁজার ঠাঁই নাই, অন্ন নাই, বস্ত্র নাই, শিক্ষা নাই। যেটুকু আছে, সেটুকু নিয়েই চলে তাদের নিরন্তর জীবন-সংগ্রাম। এঁরা ভোগে অপুষ্টিতে, মরে প্রতিরোধযোগ্য অসুখ-বিসুখে। আর সব ধরনের ভয়-ভীতি থেকে স্বাধীনতা তো বলতে গেলে ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে কারুরই নাই। বেকারত্বের ভয়, আমলাতান্ত্রিক জটিলতার ভয়, দুর্নীতির ভয়, কায়েমী স্বার্থবাদীদের দ্বারা নানাভাবে শোষিত ও অত্যাচারিত হবার ভয় এবং সর্বোপরি জানমাল ও ইজ্জত খোয়ানোর ভয়। আজো এতো ভয় কেনো আমাদের মনে? এ-ভয় দূর করবার দায়িত্ব কে নেবে?
আইরিশ দার্শনিক এডমান্ড বার্ক (Edmund Burke) একটু কঠিন করেই বলেছিলেন: "আমাদের দ্বারা দেশকে ভালোবাসাতে হলে, দেশকে ভালোবাসার যোগ্য করে গড়ে তোলা উচিত।" দেশপ্রেমিকদের কাছে খানিকটা রূঢ় শোনালেও, বার্কের কথার তাৎপর্য উপলব্দি করা প্রয়োজন। বস্তুত, বার্ক যথার্থই বলেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে: 'দেশকে ভালোবাসার যোগ্য করে গড়ে তোলার' অর্থ কী? দেশকে সুখী ও সমৃদ্ধশালী করে গড়ে তোলা। স্বাধীনতা অর্জনের এতোগুলো বছর পরও, এ-কথা না-বলে উপায় নেই যে, দেশের অধিকাংশ মানুষের জন্য এদেশকে 'সুখী' ও 'সমৃদ্ধশালী' করে গড়ে তোলা হয়নি বা যায়নি। একাত্তরে আমরা ভৌগোলিক স্বাধীনতা পেয়েছিলাম, পেয়েছিলাম রাজনৈতিক স্বাধীনতা। সে-স্বাধীনতাকে পুঁজি করে, দেশের মানুষের জন্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এনে দেয়ার পবিত্র দায়িত্ব যাদের ওপর পর্যায়ক্রমে বর্তেছিল, তাঁরা অনেকক্ষেত্রে হয়েছেন ব্যর্থ। এ-ব্যর্থতার পেছনের কারণগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো দূর করবার দায়িত্ব যেমন সরকারের, তেমনি বিরোধী দলগুলোরও। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে মতবিরোধ থাকবে এবং থাকা-ই স্বাভাবিক। কিন্তু দেশের ও দশের স্বার্থের প্রশ্নে ,সমাজের সকল বিবেকবান মহলেরই উচিত একযোগে কাজ করা। এখানে বিভেদ নয়, ঐক্য চাই।
না, বলছি না যে, স্বাধীনতার পর জাতি হিসেবে আমাদের এ-পর্যন্তকার অর্জন নগণ্য। সত্যি বলতে কি, 'স্বাধীনতা'-ই ছিল জাতি হিসেবে আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। এরপর বিগত কয়েক দশকে আমরা এমন অনেক কিছুই অর্জন করেছি, যা নিয়ে গর্ব করা যায়। সাবেক তত্তাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান এ-প্রসঙ্গে লিখেছেন: "মানবসম্পদ উন্নয়ন, পরিবার-পরিকল্পনা, খাদ্য-নিরাপত্তা, দুর্ভিক্ষ থেকে মুক্তি, দুর্যোগ মোকাবিলা ইত্যাদি কার্যক্রমে আমাদের অর্জন দেশে ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হয়েছে।" এ-সত্য অস্বীকার করছি না। কিন্তু একাত্তরে পাওয়া স্বাধীনতাকে কাজে লাগিয়ে আমরা কি আরো সামনে এগিয়ে যেতে পারতাম না? সে-সুযোগ কি আমাদের সামনে ছিল না? এম হাফিজউদ্দিন খানই লিখছেন: "…সঠিক নীতি নির্ধারণ ও কর্মপন্থা গ্রহণ করা হলে, আমরা আরো অনেক বেশি অগ্রগতি…অর্জন করতে সক্ষম হতাম এবং হয়তো আমাদের পক্ষে পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র ও দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকার শীর্ষে অবস্থান থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব হতো। আমরা এ-সুযোগ হেলায় হারিয়েছি।" আমি বিনয়ের সাথে বলি, এখনো সময় আছে। স্বাধীনতার সুফল ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়ার সুযোগ শেষ হয়ে যায়নি। 'আরো ভালো' নয়, বরং 'যথাসাধ্য ভালো'-র কথা-ই এখানে বলছি।
শেষ করবার আগে দুটি কথা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন: "সত্য যে কঠিন/ কঠিনেরে ভালোবাসিলাম/ সে কখনো করে না বঞ্চনা।" মহান মুক্তিযুদ্ধের সত্য ইতিহাস অনেকের কাছে মেনে নেয়া কঠিন হতে পারে। কিন্তু সত্যের প্রকৃতির কারণেই, তাকে আমাদের গ্রহণ করা উচিত নির্দ্বিধায়। স্বাধীনতা-যুদ্ধে যাঁরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাদের সবাইকে দিতে হবে যথাযথ সম্মান। যার যতটুকু সম্মান ও মর্যাদা প্রাপ্য, তাকে ততটুকু দিতে যেন আমরা কার্পণ্য না-করি। করলে, আমাদের দীনতাই শুধু তাতে প্রকাশ পাবে, যাকে বা যাদেরকে অমর্যাদা করা হয়েছে বা হচ্ছে তার বা তাদের কোনো ক্ষতি হবে না। আমি নিশ্চিত, অন্তত আগামী প্রজন্ম তেমন কার্পণ্য দেখাবে না।