দরকার রাজনৈতিক বিবেচনার অর্থনৈতিক ন্যায়সঙ্গতা

এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম
Published : 8 June 2014, 04:19 AM
Updated : 8 June 2014, 04:19 AM

বাজেট পেশের পরই বাজেটের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিশ্লেষণ স্বাভাবিক ঘটনা। ২০১৪-২০১৫ এর প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে বলতে গেলে আমি প্রথমে ভালো দিকগুলোই বলব। এখানে কিছুটা উচ্চাভিলাষের প্রতিফলন আছে যে ব্যাপারে আমার মূলত আপত্তি নেই। তবে আমার সমস্যা হচ্ছে এখানেই যে, যে কোনো উচ্চাভিলাষের যদি বাস্তব ভিত্তি না থাকে তাহলে সেটি 'অভিলাষ'ই রয়ে যায়, সেটা কার্যকর করা সম্ভব হয় না।

এটি হচ্ছে একটি দিক। আরেকটি দিক হল, প্রাধিকার যেগুলোতে দেওয়া হয়েছে— যেমন যোগাযোগ খাত, বিদ্যুৎ খাত— এ ব্যাপারে আমার তেমন আপত্তি নেই। কিন্তু এখানে প্রশ্ন আসবে সময়মতো বাস্তবায়ন ও গুণগত মান নিশ্চিতকরণ নিয়ে।

মোটামুটি এই হচ্ছে ভালো দিক। আর খারাপ দিক বলি আর যা-ই বলি, বাজেটে যে এস্টিমেটগুলো দেওয়া হয়েছে, তা খুব কনভিন্সিং নয়। আমি এখানে বাজেটের ম্যাক্রো-ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক নিয়ে আলোচনা করব।

প্রথমেই মনে রাখতে হবে যে, বাজেটের আকার নির্ভর করে আমরা অভ্যন্তরীন রাজস্ব থেকে কতটুকু বা কীভাবে অর্থ আহরণ করতে পারব তার ওপর। বাকিটা হল আমরা ঋণ কতটা নেব বা কোত্থেকে বা কোন সূত্র থেকে নেব। এই দুটোর যোগফল হচ্ছে বাজেটের আকার।

অভ্যন্তরীন রাজস্বের কথা যদি আমরা চিন্তা করি তবে এর মধ্যে সবচেয়ে বড় উৎস হচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর রাজস্ব। এই কর রাজস্বের যে টার্গেট এবার ধরা হয়েছে তা হল ১ লাখ ৪৯ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা, অর্থাৎ প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার। আমি দুটো বিবেচনায় মনে করি, এই টার্গেট অর্জন প্রায় অসম্ভব। দুঃসাধ্য তো অবশ্যই, আমার মনে হয় সম্পূর্ণভাবে অসম্ভব বললেও অত্যুক্তি হবে না।

এর একটা প্রেক্ষিত হচ্ছে যে, চলতি অর্থবছরে আমরা দেখতে পাচ্ছি, গত দশ মাসে ৯০ হাজার ৭০৪ কোটি টাকা অর্জন হয়েছে। তার মানে মাসে গড়ে পড়ছে ৯ হাজার কোটি টাকার একটু বেশি। সাধারণত বছরের শেষের দিকে কর রাজস্ব আহরণটা একটু বেশি হয়। সে হিসেবে ৯ হাজার কোটি টাকার দুই তৃতীয়াংশ প্রতি মাসে বেড়ে গেলে, অর্থাৎ বাকি দু'মাসে ১৫ হাজার কোটি টাকা করে ধরলে মোট ৩০ হাজার কোটি টাকা অর্জিত হতে পারে। তার মানে মোট ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার মতো আসে।

আমার এই এস্টিমেট সরকার যে রিভাইজড এস্টিমেট করেছে, ১ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ১ লাখ পঁচিশ হাজার কোটি টাকার মতো, তার প্রায় কাছাকাছি। কিন্তু আমি মনে করি, ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকাও সম্ভবত অর্জন করা সম্ভব হবে না। ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকায় যেতে হলে, কর রাজস্ব আহরণে ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি হতে হবে।

প্রথমত, ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনও-ই হয়নি। দ্বিতীয়ত, কর আহরণ নির্ভর করে সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর। আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, ২০১২-১৩ অর্থবছরের তুলনায় প্রতিটি ট্যাক্স, ইনকাম ট্যাক্স, ভ্যালু এডেড ট্যাক্স, ইমপোর্ট, গ্রোথ গত অর্থবছরের তুলনায় এ অর্থবছরে অনেক কম।

আগামী অর্থবছরে যে সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বড় রকমের গতিশীলতা আসবে সেটা ভাবাও বাস্তবসম্মত নয়। তার কারণ হল, রাজনৈতিক অঙ্গনের অস্থিরতা এখন কম হলেও যথেষ্ট অনিশ্চয়তা আছে। অনেকের মনেই শঙ্কা আছে যে, বিশেষ করে রোজার পরে এই অস্থিরতা আরও তীব্রতর হবে। বর্তমানে যে আপাত শান্ত পরিস্থিতি আছে, তা বজায় থাকবে না। এখন যে পরিপূর্ণ শান্তি বিরাজ করছে সেটা বলাও ঠিক নয়। এখনও আমরা দেখছি প্রায়ই কোথাও না কোথাও একবেলা বা আধাবেলা হরতাল হচ্ছে বা রাস্তা অবরোধ হচ্ছে।

আবার এর সঙ্গে একটি নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে; দেশে গুম, খুন ইত্যাদি তীব্রতর হয়েছে। গুম যারা হয়েছেন তাদের বেশ ক'জন কিন্তু ব্যবসায়ী। এই যে জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা সম্পর্কে অনিশ্চয়তা, তাতে আমার মনে হয় না যে, আগামী অর্থবছরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে খুব বড় রকমের গতিশীলতা আসবে। সেটা যদি না হয়, তাহলে রাজস্ব আহরণের মাত্রা আরও পিছিয়ে যাবে।

অন্য যে দুটো অভ্যন্তরীন সূত্র আছে, নন-এনবিআর ট্যাক্স এবং নন-ট্যাক্স রেভিনিউ, সেখানে খুব বড় মাত্রায় টার্গেট ধরা হয়নি। আর এগুলো সার্বিক রাজস্বের খুব স্বল্প মাত্রা। এতে যদি সামান্য কিছু ঘাটতি পড়েও তাতে খুব একটা বড় প্রভাব পড়বে না।

আরেকটি বিষয় হচ্ছে বৈদেশিক সাহায্য। টার্গেট ধরা হয়েছে ২৪ হাজার কোটি টাকার মতো। এখানেও আমাদের যে প্রেক্ষিত, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বৈদেশিক সাহায্যের অবমুক্তি ঘটেছে, ২০১২-১৩ অর্থবছরে; ১৪,৩৮৬ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের গত ৯ মাসে অবমুক্তি ঘটেছে ১০,৩৮১ কোটি টাকা। এতে যদি গতি আরও কিছুটা বাড়ে, বাকি ৩ মাসে, তাতেও আমার মনে হয় ১৭ হাজার কোটি টাকার বেশি অবমুক্ত করা সম্ভব হবে না। সেখান থেকে যদি ২৪ হাজার কোটি টাকার টার্গেট পূরণ করতে হয় তাহলেও ৪০ শতাংশ বেশি। এই এত বড় মাত্রায়, এটাও অবমুক্তি সম্ভব নয়।

এই যদি অবস্থা হয়, তাহলে সরকার বাধ্য হবে ব্যাংক থেকে ধার করতে। ইতোমধ্যেই যে টার্গেট রাখা হয়েছে সরকারের বাজেটের ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে; ৩১,২২১ কোটি টাকা। এটা হলে বাংলাদেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ মাত্রার ব্যাংক-বরোয়িং। কিন্তু এর একটা কুফল হল, এটি মূল্যস্ফীতির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

ফিসক্যাল বছর ২০১১ তে এমন একটি অভিজ্ঞতা আছে আমাদের। সেবার ১৯,৩৮৩ কোটি টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছিল যেটি সাম্প্রতিক ইতিহাসের সর্বোচ্চ। তার ফলশ্রুতিতে ফিসক্যাল বছর ২০১২ তে সর্বোচ্চ মুদ্রাস্ফীতি হয়েছিল, ১০.৬ শতাংশ। কাজেই যেটি ঠিক করা হয়েছে এটিও সমর্থনযোগ্য নয়। আর যদি সরকারের ব্যয়ের মাত্রা ঠিক রাখতে হয়, তবে অন্য জায়গায় ঘাটতি হলে এটা আরও বেড়ে যাবে।

ব্যয়ের ক্ষেত্রে যে বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা বা এডিপি, সেখানে টার্গেট ধরা হয়েছে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা। এখানেও যদি বর্তমান প্রেক্ষিত দেখি, চলতি অর্থবছরে ১০ মাসে ৫৫ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। টাকার অংকে ৩৬ হাজার কোটি টাকা। তার মানে মাসে গড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা।

মে-জুনের শেষের দিকে কাজের মাত্রা বাড়ে। ৩ হাজার কোটি টাকা থেকে যদি ৭-৮ হাজার কোটি টাকা বা ৯ হাজার কোটি টাকা হয়, তাহলে ৫৪ হাজার বা ধরে নিলাম ৫৫ হাজার কোটি টাকা বাড়বে। ৫৪ হাজার কোটি টাকা থেকে ৮০ হাজার কোটি টাকায় যাওয়া মানে ৪৫ শতাংশ বৃদ্ধি।

এডিপি বাস্তবায়নে আমাদের যে প্রশাসনিক দুর্বলতা ও অন্যান্য যেসব জটিলতা আছে, সেই প্রবিন্ধকতাগুলো আগামী এক বছরে কীভাবে নিরসন হবে, বিশেষ করে প্রশাসনিক দক্ষতার কীভাবে উন্নতি হবে, বাজেটে সে ব্যাপারে আশ্বাস নেই বা তার কোনো ইঙ্গিতও দেওয়া হয়নি। সুতরাং আমি মনে করি, এডিপি বাস্তবায়নও সম্ভব হবে না। তবে এই ব্যর্থতার একটি সুফল আছে। তাতে বাজেট ঘাটতি কম হবে, আর তখন ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার কম ঋণ গ্রহণ করবে।

এবার আসছি নন-ডেভলপমেন্ট এক্সপেনডিচারেরর প্রসঙ্গে। তার মধ্যে একটি বড় আইটেম হচ্ছে নন-ডেভলপমেন্ট ক্যাপিটাল এক্সপেনডিচার। কিছু কিছু খরচ সরকারকে করতেই হবে। যেমন, সরকারি কর্মচারিদের বেতন-ভাতা, পেনশন ও অতীতে যে ঋণ নেওয়া হয়েছে তার সুদ— এসব সরকারের আইনগত দায়িত্ব।

আরেকটি বড় আইটেম যেটি, সেটি হচ্ছে ইনভেস্টমেন্ট ইন শেয়ারস অ্যান্ড ইকুইটিস। এটি হল সরকারের যেসব কোম্পানি আছে, সেগুলোর শেয়ার বা ইকুইটিতে বিনিয়োগ করা। এ খাতে প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়েছে।

আমি কীসের মধ্যে বিনিয়োগ করতে যাচ্ছি? কোম্পানিগুলোর বেশিরভাগই হচ্ছে লোকসানে চলছে। যেমন আমি জুট মিল কর্পোরেশনের কথা বলি। তারা তাদের পাট কেনার পয়সা দিতে পারে না। সরকারের কাছ থেকে ধার নিয়ে মুল্য শোধ করে। সুগার মিল কর্পোরেশন আখের পয়সা দিতে পারে না, স্টাফদের বেতন দিতে পারে না। এর কম আরও অন্যান্য প্রষ্ঠিানে এ ধরনের পরিস্থিতি বিদ্যমান। সেখানে এ শেয়ারের ইকুইটি নেওযার তো কোনো অর্থ হয় না।

এখানে যেটা করা উচিত, প্রাইভেটাইজেশনটা আরও জোরদার করা। এ কাজ তো সম্পূর্ণ স্তিমিত হয়ে আছে। এ সমস্ত প্রতিষ্ঠানের সরকারেরর কাছে ও ব্যাংকিং সিস্টেমের কাছে বিশাল অংকের ঋণের দায়ভার আছে। কিন্তু এ ব্যাপারে বাজেটে কোনো উল্লেখ নেই, কোনো বছরই থাকে না। এ পর্যন্ত যে কটা বাজেট দেওয়া হয়েছে, আমি কয়েক বার উল্লেখ করেছি কথাটা, কিন্তু এটা নিয়ে কিছু করা হচ্ছে না। আমি তাই মনে করি, টাকাটা পুরো জলে ফেলে দেওয়া হচ্ছে।

আরেকটি বিষয় হচ্ছে কন্টিনজেন্ট লায়াবিলিটি। এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেকে যারা ব্যাংকের কাছ থেকে ধার করে, মূলত তারা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে বেশি ধার করে। তারা ধারগুলো শোধ করতে পারে না বা পারবে না জেনেই ব্যাংকগুলো তাদের কাছ থেকে গ্যারান্টি চায়। একে সভরেন গ্যারন্টি বলা হয়। কোম্পানিগুলো ফেল করলে ব্যাংকগুলো কিন্তু সরকারের কাছ থেকে দাবি করতে পারে। সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করে এই দাবি পরিশোধের জন্য বলতে পারে।

এখানে সেটাও হয় না। কারণ তারা তো সরকারি ব্যাংক, সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করবে না। তার ফলে ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থা ক্রমশই দুর্বল হয়ে পড়ে। তাদের ক্যাপিটাল ঘাটতি হয়। এগুলো সব ক্লাসিফাইড লোনে চলে যায়। সরকারকে আবার ব্যাংকগুলোকে রি-ক্যাপিটালাইজ করার জন্য টাকা দিতে হয়। এ অর্থবছরে বোধহয় প্রায় ছ' হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। বেশ বড় অংকের টাকা। এখানে কিন্তু আরেকটি সমস্যা রয়ে যাচ্ছে যেটির সমাধানের কোনো দিকনির্দেশনা আমি বাজেটে পাইনি।

বাজেটের ট্যাক্স প্রপোজালগুলো নিয়ে একটু বলতে চাই। পারসোনাল ইনকাম ট্যাক্সের করমুক্তির সীমা কিছু কিছু গ্রুপের জন্য বাড়ানো হয়েছে। যেমন, নারীদের জন্য। কিন্তু সাধারণভাবে করমুক্ত সীমা যে ২ লাখ বিশ হাজার টাকা ছিল সেটিই রাখা হয়েছে। এটা নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে। তবে মূল্যস্ফীতি যে হারে বেড়েছে, তাতে প্রকৃত আয় কমে গেছে। সুরাং এখানে বোধহয় একটা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা ছিল। এবং যেটাদাবি ছিল, সেটা করা হয়নি।

আবার অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে, আনলিস্টেড কোম্পানি যেগুলো, যাদের কোম্পানি স্টক এক্সচেঞ্জে লিস্টেড নয়, কোনো আইপিও নেই, তাদের করের হার সাড়ে ৩৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩৫ করা হয়েছে। কিন্তু লিস্টেড কোম্পানিগুলোর করের হার যে সাড়ে ২৭ শতাংশ ছিল সেটিই রাখা হয়েছে। লিস্টেড আনলিস্টেড কোম্পানিগুলোর মদ্যে যে ডিফারেনশিযঅল ছিল, সেটি কমে গেছে। এমনিতেই আমাদের দেশে ভালো কোম্পানিগুলো আসতে চায় না। তার মধ্যে করের হারের ডিফারেনশিয়াল কমে যাওয়া, এটা আরেকটা প্রণোদনা জোগাবে আর কী। করের হার কমালে আমার মনে হয় দুটোই কমানো উচিত ছিল, সমতা বজায় রাখার জন্য।

বিভিন্ন ক্ষেত্রে করের মাত্রা কমানো হয়েছে। যেমন, ট্যাক্স হলিডের সময় বাড়ানো হয়েছে। যে সব শিল্পে বিনিয়োগ করলে ট্যাক্স হলিডে পাওয়া যাবে সেই কাভারেজ বাড়ানো হয়েছে। গারমেন্ট এক্সপোর্টারদের যে টার্নওভার ট্যাক্স দিতে হয়, সেটার হার কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। আবার এমনিতে কিছু কিছু জায়গায় কর বাড়ানো হয়েছে। এসবের সার্বিক রেভিনিউ ইমপ্লিকেশনটা দেখতে চাই। অর্থাৎ আমি যেটি কমাচ্ছি তাতে কতটা রেভিনিউ লস হবে, বা যেটি কমাচ্ছি তাতে কতটা রেভিনিউ গেইন হবে, এই যে এস্টিমেট, সেটা আমি যে টার্গেট ঠিক করেছি ৫০ হাজার, তার সঙ্গে কনসিসটেন্ট কিনা তা দেখা দরকার ছিল।

আসলে বেশিরভাগ সিদ্ধান্তই নেওয়া হয় রাজনৈতিক বিবেচনা থেকে, ঠিক অর্থনৈতিক বিবেচনা এখানে কাজ করে না। যেমন গারমেন্টের এক্সপোর্টরদের টার্নওভার ট্যাক্স কমিযে দেওয়া প্রসঙ্গে বলতে চাই। গারমেন্টের এক্সপোর্টরদের পারফরমেন্স কিন্তু ভালো, যতই রানা প্লাজা বা এ জাতীয় ঘটনা ঘটুক না কেন। বাইরের বিশ্বে কিছু মন্দার কাল গেছে, ২০০৮-০৯ য়ের পরবর্তীকালে, ২০১২-১৩ তেও কিছুটা মন্দার পরিস্থিতি ছিল। তারপরও গারমেন্টের প্রবৃদ্ধির হার ১৫-১৬ পারসেন্ট।

আরেকটি বিষয় যেটি আমি গারমেন্ট এক্সপোর্টারদের সঙ্গে কথা হলে প্রায়ই তাদের বলি যে, আগে বিনিমিয় হার ছিল ৬৯ টাকা, সেখান থেকে ৮৪ টাকায় পৌঁছে গেছিল, এখন ৭৭-৭৮ টাকা পাওয়া যাচ্ছে— একে তো বলা হয় 'উইন্ডফল গেইন'— তারপরও তাদের টার্নওভার ট্যাক্স কমানোর কোনো প্রয়োজন তো দেখি না।

তবে এসবের মূলে কাজ করে প্রেশার। গারমেন্ট মালিকরা সরকারকে সবসময় বলবে, আমরা এত লোকের কর্মসংস্থান করছি, আমাদের এখানে এত মহিলা কাজ করে, আমাদের ট্যাক্স বেনিফিট না দিলে আমাদের ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যাবে ইত্যাদি। এভাবে তারা চাপ সৃষ্টি করলে সরকার তাদের কাছে নতি স্বীকার করে ফেলে।

বাজেটের আকার বাড়ে, কারণ জিডিপি তো বাড়ছে। সুতরাং একই অনুপাতে দেওয়া হলেও আবার বেড়ে যাবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যে, আকারের মাত্রাটা কী ও সে অনুযায়ী বাস্তবায়ন করা কতটা সম্ভব। যেমন, এডিপির আকার ৮৬ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছিল। সংশোধিত বাজেটে এর আকার ৫৫ হাজার করার কথা বলা হযেছিল।

কিন্তু সেখানেও আবার একটি রাজনৈতিক বিষয় এসে গেল। অর্থমন্ত্রী ও পরিকল্পনা মন্ত্রীর মধ্যে বাকবিতণ্ডা শুরু হল যেটি মিডিয়াতেও খবর হয়েছে। এর ফলে এটি বাড়িয়ে ৬০ হাজার কোটি টাকা করা হল। আমি তো এখনও মনে করি, এটি ৫৫ হাজার কোটি টাকা রাখাই যুক্তিসঙ্গত হত, তাহলে হয়তো ৫৩-৫৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা সম্ভব হত। এখন যা করা হয়েছে তা সংশোধিত বাজেটের ওপর ৬ হাজার কোটি টাকা অব্যবহৃত রয়ে যাবে। সুতরাং এক বছর পরে একচুয়েল যে ফল দেখা যাবে তাতে বোঝা যাবে যে আসল বাজেট প্রস্তাবিত বাজেটের চেয়ে বড়।

যে কোনো দেশের বাজেটেই একটা রাজনৈতিক প্রভাব থাকবেই। এর কারণ হচ্ছে বাজেটের যে প্রক্রিয়া, এটা লেজিসলেটিভের মাধ্যমে অনুমোদিত হয়। এখন কথা হচ্ছে যে, এসব পলিটিক্যাল প্রভাবের অর্থনৈতিক জাস্টিফিকেশন থাকা জরুরি। জনগণকে কনভিন্স করে যদি করা যায়, তাহলে জনগণও বুঝতেপারবে।

আমাদের সিস্টেমের মধ্যে সেসব নেই। আমাদের বাজেট সংক্রান্ত একটি স্ট্যান্ডিং কমিটি রয়েছে। তারা কেবল আলোচনা করতে পারে, কিন্তু তারা বাজেট পেশ হওয়ার আগে দেখতেও পারে না বাজেটটি কেমন হয়েছে। ফলে সেখান থেকেও কোনো সাজেশন আসার সুযোগ নেই।

আরেকটি বিষয় হল, যে দলই এখানে ক্ষমতায় আসে, যেহেতু প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন নিয়েই বাজেট পেশ করা হয়, সেখানে কোনো সংশোধনী আনতে দলের সাংসদরা রাজি হন না।

ড. এ বি মির্জা মোহাম্মদ আজিজুল ইসলাম: সাবেক তত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা।