ঐতিহ্যবাহী গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ কি বিলুপ্তির পথে

নাসিম ফেরদৌস
Published : 25 May 2014, 08:44 AM
Updated : 25 May 2014, 08:44 AM

যুক্তরাষ্ট্রের ফোর্ড ফাউন্ডেশন ও ওকলাহোমা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহায়তায় ১৯৬১ সালে ঢাকায় একটি গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি বাংলাদেশের প্রথম এবং বহুদিন দেশের একমাত্র গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ ছিল। এর অবকাঠামো, শিক্ষার কারিকুলাম ও শিক্ষক নিয়োগের কাঠামো ওকলাহোমা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশের, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের গার্হস্থ্য অর্থনীতি শিক্ষার ধারায় প্রণীত হয়।

গার্হস্থ্য অর্থনীতি বায়োলজিক্যাল বিজ্ঞানের অধীনে পড়ে। এটি এমন একটি ডিসিপ্লিন যেখানে বহু পাঠ্যবিষয়ের সমন্বয় ঘটেছে। তৎকালীন বাংলাদেশের শিক্ষানীতির ধারাবাহিকতায় এই কলেজে তিনটি ধাপ ছিল। যথা– দু'বছরের এইচএসসি, দু'বছরের বিএসসি এবং সর্বশেষে দু'বছরের এমএসসি।

গার্হস্থ্য অর্থনীতি বহুপাঠবিশিষ্ট ডিসিপ্লিন হওয়াতে এই কলেজের ডিগ্রি ও মাস্টার্স কারিকুলামে যে সকল মূল বিষয় অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছিল। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে গৃহায়ণ ও গৃহ ব্যবস্থাপনা (Home Management), শিশু বিকাশ ও পারিবারিক সম্পর্ক (Child Development & Family Relations), বস্ত্রপরিচ্ছদ ও বয়ন শিল্প (Clothing & Textile), খাদ্য ও পুষ্টি (Food & Nutrition) এবং ব্যবহারিক শিল্পকলা (Related Arts)।

এই প্রাথমিক ছয়টি বিষয়ের অন্তর্ভূক্ত ছিল আরও অনেকগুলো বিষয়; যেমন রসায়ন, জীববিজ্ঞান, পদার্থ বিজ্ঞান, অর্থনীতি, বায়োকেমিস্ট্রি, ফিজিওলোজি ইত্যাদি। এ সকল বিষয়ের সমন্বয়ে গঠিত হয় গার্হস্থ্য অর্থনীতি শিক্ষাধারা।

আমার মনে পড়ে, আমি যখন এই কলেজ থেকে পাশ করে প্রথম বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, তখন আমাকে আমার এক শুভাকাঙ্ক্ষী বলেছিলেন, তুমি তো 'সকল বিষয়ের সবজান্তা, কোনো বিষয়ের মাস্টার না'… তুমি কি করে বিসিএস পরীক্ষা দিবে?

আজ প্রায় চল্লিশ বছর পর মনে হয় সেই 'সবজান্তা' বিদ্যা সবচেয়ে বেশি কাজে লেগেছে আমার জীবনে। একটি বিশেষ বিষয় আলোকিত হয়ে বাকি সব বিষয়ে অন্ধ থাকার চেয়ে, সব বিষয়ে একটু বেশি আলোকিত হয়ে একটি বিষয়ে মাস্টার হওয়া অনেক ভালো নয় কি?

আমার জীবনে যা কিছু অর্জন তার প্রায় সবটার সঙ্গে বার বার এই 'সবজান্তা' কথাটার মিল খুঁজে পাই। আমরা যারা মূলধারার গার্হস্থ্য অর্থনীতি পড়েছি, তারা জীবনকে একটু ভিন্নধারায় দেখি এবং পরিচালনা করতে পারি বলে আমার দৃঢ়বিশ্বাস। আমি আমার শিক্ষকবৃন্দ ও ফোর্ড ফাউন্ডেশনের মিস বনির কাছে ঋণী। আমাদের সময় যুক্তরাষ্ট্র থেকে আগত মিস বনি ছিলেন কলেজের অ্যাডমিনিসট্রেটর।

কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, গত দুই দশক ধরে এই কলেজের উন্নতির নামে ধাপে ধাপে অবনতি ঘটেছে। ১৯৮৫-৮৬ সালে স্নাতক সম্মান এবং ১ বছরের স্নাতকোত্তর কোর্স চালু করার মাধ্যমে এই ডিসিপ্লিনের মূলধারার শিক্ষাকে পাঁচ ভাগে ভাগ করে প্রতিটি বিষয়ে অনার্স চালু করা হয়। যার ফলশ্রুতিতে আজকে এই কলেজে পাঁচটি ভিন্ন বিষয় একক শিক্ষাদানের মাধ্যমে মূলধারার শিক্ষাটি বিনিষ্ট হয়ে গেছে। বিশেষ করে যেখানে পর্যাপ্ত সংখ্যক বিশেষজ্ঞ শিক্ষকের বড় অভাব।

এই বিভাজন কোনো সময়ই কোনো কর্তৃপক্ষ অনুমোদন করেছেন বলে জানা নেই। বরং বিভিন্ন সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা ডাইরেক্টরেটে সকল অনিয়মের বিরুদ্ধে কলেজ কর্তৃপক্ষকে বার বার সতর্ক করেছেন বলে জানা যায়। কিন্তু তাতে টনক নড়েনি কারও। পর্যায়ক্রমে এক ভুলের উপর আরেক ভুল করে কলেজের শিক্ষাব্যবস্থাটিকে আরও ঘোলাটে করা হয়েছে।

গার্হস্থ্য অর্থনীতিকে যে পাঁচটি ডিপার্টমেন্টে পরিণত করা হয়েছে সে সকল বিষয়ে অন্যান্য জায়গায় সমমানের ডিগ্রি নেওয়া সম্ভব। যেমন, খাদ্য ও পুষ্টির জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, ক্লোদিং অ্যান্ড টেক্সটাইলেরর জন্য রয়েছে টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অন্তর্ভূক্ত আছে শিশু বিকাশ।

মজার ব্যপার হল, দেশের একমাত্র গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজটিকে ভেঙে টুকরো করার প্রক্রিয়া যখন শুরু হয়, প্রায় একই সময়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন কলেজে গার্হস্থ্য অর্থনীতি একটি সমন্নিত বিষয় হিসেবে চালু করা হয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আরেকটি নতুন গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজও চালু হয়। এছাড়া ঢাকার ইডেন মহিলা কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা কলেজে (পাস ও স্নাতক) এবং রাজশাহীর মাদার বক্স কলেজ গার্হস্থ্য অর্থনীতিকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করে।

তাই প্রশ্ন জাগে, কেন ঢাকার প্রথম গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজকে ধীরে ধীরে ভেঙে টুকরো করে ধংসের পথে ঢেলে দেওয়া হচ্ছে?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা সরকারের অনুমোদন ছাড়া এই বিভাজনের কারণে কলেজে নানাবিধ, বিশেষ করে, শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে অনেক জটিলতাও সৃষ্টি হয়েছে। এর চেয়ে বড় দুঃখ হচ্ছে, এই কলেজের ছাত্রীরা তাদের অজান্তে ভীষণভাবে ঠকে গেছে। তারা একটি দৃশ্যমান শিক্ষা থেকে সরে এসে একটি 'সরু দৃষ্টির' শিক্ষার শিকার। তাদের ডিগ্রি দুর্বল। তারা মাত্র একটি বিষয় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন, কিন্তু গার্হস্থ্য অর্থনীতির মূলধারার যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন করেন না।

মূলত যারা খাদ্য ও পুষ্টি পড়েন, তারা এ বিষয়ের বাইরে গার্হস্থ্য অর্থনীতির অন্যান্য বিষয়ে খুবই সীমিত জ্ঞান রাখেন। তাই এ কলেজ থেকে পাশ্চাত্য দেশে ক্রেডিট ট্রান্সফার করে গার্হস্থ্য অর্থনীতিতে উচ্চশিক্ষা লাভের পথ বন্ধ হয়ে গেছে।

গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা অন্যান্য কলেজসমূহের মতোই একটি উপাদানকল্প কলেজ। ঢাকা মেডিকেল কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাদানকল্প আরেকটি কলেজ। একবার ভেবে দেখুন, ডিএমসি যদি বহু পাঠ্যবিষয়ে সমন্বিত এমবিবিএসকে ভেঙে শুধুমাত্র অ্যানাটমিতে স্নাতক (সমমান) ডিগ্রি প্রদান করত, তাহলে কী হত? আমরা কি একজন সম্পূর্ণ তৈরি ডাক্তার পেতাম?

আমরা পেতাম অ্যানাটমি বিশেষজ্ঞ, প্যাথলজি বিশেষজ্ঞ ইত্যাদি। সৌভাগ্যবান বাংলাদেশি যে এখনও একজন সম্পূর্ণ ডাক্তারের চিকিৎসা পায়, যিনি কলেজ থেকে প্রথমে সম্মিলিতভাবে সকল প্রয়োজনীয় বিষয়ে অধ্যায়ন করে এমবিবিএস পাশ করেন, তারপর প্রয়োজনবোধে বিশেষজ্ঞ হওয়ার জন্য একটি বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। গার্হস্থ্য অর্থনীতি এ রকমই একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেখানে সামগ্রিক শিক্ষা প্রদান তার প্রধান লক্ষ্য।

তবে যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গার্হস্থ্য অর্থনীতির কিছু বিষয়ে বিশেষজ্ঞ তৈরির দাবি অযৌক্তিক নয়। কিন্তু সেটা সঠিকভাবে প্রণীত হতে হবে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে গার্হস্থ্য অর্থনীতি কীভাবে পড়ানো হয় তার দিকে নজর দিলে বিষয়টি পরিস্কার হবে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও পাকিস্তানে গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজগুলোতে মূলধারার শিক্ষার প্রচলন এখনও সিংহভাগ।

এসব ক্ষেত্রে স্নাতক কারিকুলামের ৭০ শতাংশ কোর্স মূলধারায় প্রণীত আর ৩০ শতাংশ বিশেষায়িত। অর্থাৎ স্নাতক পর্যায়ে মূল পাঁচটি বিষয়ই অন্তর্ভূক্ত। তবে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ১০০ ভাগই বিশেষায়িত বিষয়ে কোর্স নির্ধারণ করা হয়। সমগ্র বিশ্বে যে কোনো কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ অথবা বিএস করতে হলে চার বছরের মূলধারার শিক্ষা গ্রহণ বাধ্যতামূলক। তারপর আসে বিশেষায়িত শিক্ষা।

ঢাকার গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজকে যদি আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরিয়ে নিতে হয় তাহলে অবশ্যই বর্তমান শিক্ষাধারাকে আবারও ঢেলে সাজাতে হবে। এই ঢেলে সাজানো নিম্নরূপ হতে পারে, যেমনটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (IER) এ চালু আছে।

বিএসসি সমমান ডিগ্রি লাভের জন্য চার বছরের প্রথম দু'বছর সামগ্রিক একটি কারিকুলাম থাকবে। পরবর্তী দু'বছর একটি সামগ্রিক শিক্ষা ধারায় চলমান থাকতে পারে। এতে শুধুমাত্র বিএসসি (গার্হস্থ্য অর্থনীতি) ডিগ্রি দেওয়া হবে। অথবা এই দ্বিতীয় অংশের দু'বছরে বিশেষায়িত শিক্ষা বেছে নেবার অপশন থাকতে পারে। একটি বিষয়ে 'মেজর' এবং একটি বিষয়ে 'মাইনর' করার সুযোগ থাকতে পারে। অথবা শেষের দু'বছরে দুটি বিষয়ে মেজর করার সম্ভাবনাও রাখা যেতে পারে।

এ ধরনের নানা মিশ্রণ দ্বারা স্নাতক ও স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি দেওয়া যেতে পারে। এতে একজন ছাত্রী একটি অসম্পূর্ণ শিক্ষা থেকে রেহাই পাবেন এবং পাশ করা ছাত্রীদের চাকরির সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যাবে। আবার ক্রেডিট ট্রান্সফার করে বিদেশে অধ্যায়নের সুযোগ পুনঃস্থাপন হবে।

শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে জটিলতারও অবসান ঘটবে। সকল শিক্ষকের সকল বিষয়ে মৌলিক জ্ঞান থাকার কারণে তারা স্নাতক পর্যায়ে সব বিষয়ে পড়াতে পারবেন। এছাড়া তার নিজের বিশেষায়িত স্নাতকোত্তর ডিগ্রি থাকলে তিনি সে বিষয়েও পড়াতে পারবেন।

এভাবে এই কলেজকে অনেক সমৃদ্ধ, সম্প্রসারিত এবং সত্যিকারের ঐতিহ্যবাহী কলেজে পরিণত করা সম্ভব। প্রয়োজন শুধু ব্যতিক্রমধর্মী চিন্তার যা আনতে পারে কলেজের এবং ছাত্রীসমাজের জন্য সুফল।

এ ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অবশ্যই অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে যাতে সকল সৃষ্ট জটিলতার অবসান ঘটিয়ে বিশ্বমানের শিক্ষা প্রদান করে আবারও গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ মাথা সোজা করে দাঁড়াতে পারে। এই কলেজ থেকে পাশ করা ছাত্রীরা শিক্ষকতা ছাড়াও অন্য সকল প্রতিযোগিতামূলক ও সম্ভাবনাময় চাকরি পেতে পারেন।

নাসিম ফেরদৌস: প্রাক্তন ছাত্রী, গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ; সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার।