মোদির ‘শরবত’ ও ভারতের ভবিষ্যত

হাসান তারিক চৌধুরী
Published : 20 May 2014, 02:54 AM
Updated : 20 May 2014, 02:54 AM

এবারের ভারতীয় লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির প্রচারণা অতীতের সমস্ত রেকর্ড ছাড়িয়ে গিয়েছে। প্রচারণার ব্যাপ্তি এতটাই ছড়িয়ে গিয়েছিল যে, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ তো বটেই, এমনকি শিশুদের মুখেও ভারতের নির্বাচনী শ্লোগান শোনা গেছে। আমার নয় বছরের পুত্র হাসান তাহসিনের মুখেও আমাকে শুনতে হয়েছে, "আব কি বার, মোদি কি সরকার!''

তার কাছেই শুনেছি যে, কার্টুন চ্যানেলগুলোতেও নাকি নির্বাচনের প্রচারণা চালানো হয়েছে। ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো চাইলে পয়সা দিয়ে প্রাইভেট চ্যানেলগুলোতে এ রকম প্রচারণা চালাতে পারে। দেখা গেছে, টেলিভিশনে পয়সা দিয়ে প্রচার চালানোর এই প্রতিযোগিতায় ক্ষমতাসীন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোট থেকে মোদির বিজেপিই সবচেয়ে এগিয়ে ছিল।

এবারের লোকসভা নির্বাচনের সবচেয়ে উল্লেখ করার মতো বিষয় হল, নির্বাচন ঘিরে এই বিশাল প্রচারণা মানুষকে শুধু রাজনীতি সম্পর্কেই আগ্রহী করে তোলেনি, উপরন্তু, ভোটাধিকার সম্পর্কেও আগের তুলনায় সচেতন করেছে। ভোটের সময়ে বলিউডেও নির্মিত হয়েছে ভোটার সচেতনতামূলক বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র, 'রিটার্ন অব ভূতনাথ'। বলিউডি সুপার স্টার অমিতাভ বচ্চন ছিলেন এই ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রে।

কংগ্রেসের দুর্নীতি ও জনগণের আস্থা

রাজনীতি, সংস্কৃতি ও মিডিয়ার এ রকম নানামুখী ভূমিকা এবারের লোকসভা নির্বাচনে ৬৬ শতাংশ ভারতীয়কে ভোটদানে উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছে, যা বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নিঃসন্দেহে এক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। যে সংখ্যক মানুষ এই ভোট-প্রক্রিয়ায় অংশ নিল সেই ব্যাপক মানুষের স্বার্থ ভারতের নতুন সরকার দেখবে কি না, সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।

ভারতের গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, শ্রী নরেন্দ্র মোদি ১৮ মে বিজেপির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে দেখা করে নতুন সরকার গঠন নিয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু করে দিয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে, শীঘ্রই ভারতবাসী মোদির সরকারের অবয়বটি দেখতে পাবে।

ভারতের ১৬তম লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির রাজনৈতিক প্রচারণা পদ্ধতি প্রমাণ করেছে, সেকেলে পদ্ধতির রাজনীতির দিন ফুরিয়ে এসেছে। মোদি তার আধুনিক প্রচারণার প্রবল হাওয়া দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি আর অদক্ষতার চূড়ায় দাঁড়িয়ে থেকে শুধুমাত্র ধর্মনিরপেক্ষতার তকমা আর পারিবারিক ঐতিহ্য ফেরি করে জনগণের মন জয় করা যায় না।

সে কারণে ভারতের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের নেতৃত্বদানকারী দল হওয়া সত্ত্বেও, নেহেরু পরিবারের কংগ্রেসকে এবার মোদির কাছে ধরাশায়ী হতে হয়েছে। বেশিরভাগ কংগ্রেসবিরোধী ভোট জমা পড়েছে বিজেপি তথা মোদির বাক্সে।

যদিও বিদায়ী কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকার ভারতবাসীকে প্রায় ১০ শতাংশ পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি এনে দিতে পেরেছিল, কিন্তু কয়লা কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে নানা দুর্নীতি দলটি সম্পর্কে জনগণের আস্থার জায়গায় এতটাই চিড় ধরিয়েছিল যে, মানুষ দলটিকে আর সমর্থন দেওয়ার যুক্তি খুঁজে পায়নি। তাছাড়া গ্রামীণ জনগণের কল্যাণে কংগ্রেস তার প্রতিশ্রুতি বজায় রাখতে পারেনি। বিজেপি তাদের সেই ক্ষোভের পুরোটাই নিজেদের ভোটে কাজে লাগিয়েছে।

নব্য ফ্যাসিবাদের নব্য কৌশল

এটাও ঠিক যে, নব্য ফ্যাসিবাদকে এবার নবায়িত রূপেই ভারতে ফেরি করেছেন একসময়ের চা-ওয়ালা মোদি। সংঘ পরিবারের হয়ে হিমালয়ের পাদদেশে ৮ বছরের সন্ন্যাসজীবনে মোদি রপ্ত করেছিলেন মানুষকে মোহগ্রস্ত করার কৌশল। মার্কিন মুল্লুকে পড়াশোনা করেছেন পাবলিক রিলেশন আর ইমেজ ম্যানেজমেন্ট নিয়ে। বিজেপির উগ্র-সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী মতাদর্শ 'হিন্দুত্ববাদ' ফেরি করতে তিনি এসব বিদ্যাই কাজে লাগিয়েছেন।

গুজরাট মডেল তথা উন্নয়নের চিনির প্রলেপে 'হিন্দুত্ববাদকেই' বিপনন করেছেন মোদি। আগ্রা, জম্মু-কাশ্মীর এবং উত্তর প্রদেশ, এ তিনটি অঞ্চলের নির্বাচনী জনসভায় দেওয়া মোদির ভাষণ শোনার সুযোগ হয়েছে আমার। এসব জনসভায় তিনি সীমান্ত ও ভৌগলিক অখণ্ডতা রক্ষা প্রসঙ্গে কংগ্রেসের সমালোচনা করতে গিয়ে যে ভাষায় কথা বলেছেন তার সঙ্গে হিটলার ও মুসোলিনির কোনো তফাৎ নেই। উগ্র ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জজবা তুলে তিনি দেশপ্রেমের চ্যাম্পিয়ন হবার চেষ্টা করেছেন। নাড়া দেওয়ার চেষ্টা করেছেন ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর অনুভূতি।

মোদির এই উগ্র ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বার্তা যদি তার সরকারের নীতিতেও অব্যাহত থাকে তা অত্র অঞ্চলে এক ভয়াবহ উত্তেজনার সৃষ্টি করবে। যা তথাকথিত অবৈধ বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠানোর নাম করে ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে। 'হিন্দুত্ববাদী' নাথুরাম গডসে অহিংস আন্দোলনের নায়ক মহাত্মা গান্ধীর উপর গুলি চালিয়ে যে হিংসার জন্ম দিয়েছিল, নতুন করে মোদি অন্য কৌশলে সেই হিংসার পথই ধরছেন।

কর্পোরেট পুঁজির আঞ্চলিক বিস্তার

ভারতের তথাকথিত মোদি-হাওয়া কর্পোরেট পুঁজির দানবকে মানুষের সামনে ফুলের মালা পরিয়ে হাজির করেছে। বলা হচ্ছে, এই কর্পোরেট পুঁজির সহযোগিতায় মোদি মানুষকে নতুন নতুন শহর উপহার দেবেন। ভারতে চালু হবে ইউরোপের মতো বুলেট ট্রেন। গড়ে উঠবে নতুন নতুন শিল্প-কারখানা। বিদেশি বিনিয়োগ এবং কর্পোরেট অর্থায়নে বাড়বে কর্মসংস্থান।

মোদি আরও বলছেন, এসব করতে তিনি ভারতীয় অর্থনীতির ওপর রাষ্ট্রের ঐতিহ্যগত নিয়ন্ত্রণ ভেঙে দেবেন। এর জন্য মোদি তিনটি শ্লোগান ঠিক করেছেন। সেগুলো হল–

১. ছোট আকারের সরকার;

২. আমলাতন্ত্র হ্রাস;

৩. বেসরকারি উদ্যোগ বৃদ্ধি।

মোদির এ রকম শ্লোগান ভারতীয় কর্পোরেট পুঁজিকে বেশ আকৃষ্ট করতে পেরেছে। যার ফলে আম্বানি গ্রুপের মতো বিশাল পুঁজি মোদির নির্বাচনী প্রচারণার অর্থায়নে মুক্তহস্তে এগিয়ে এসেছে। ব্যয় করেছে শত কোটি রুপি। কিন্তু কর্পোরেট পুঁজির সাফাই গাইতে গিয়ে মোদি যে সত্য আড়াল করে গেছেন তা হল, কর্পোরেট পুঁজির লুটপাটের প্রসঙ্গ।

গুজরাট মডেলের গুণগান গাইতে গিয়ে মোদি একবারও বলেননি যে তিনি গুজরাটে লাসেন এন্ড টুবরো, ফোর্ড ইন্ডিয়া এবং এসার স্টিলের মতো কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানকে সরকারি জমি পানির দামে তুলে দিয়েছেন। সম্প্রতি ভারত সরকারের অডিটর জেনারেলের প্রতিবেদনে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

মোদির এই নীতি চালু থাকলে সঙ্গত কারণেই সারা ভারতে জনগণের সম্পদের ওপর কর্পোরেট লুণ্ঠন আরও বাড়বে। আম্বানি গ্রুপের মতো মুনাফাখোর প্রতিষ্ঠান মোদির জন্য ব্যয়িত অর্থ তুলে নেবার জন্য স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠবে। তখন বিজেপির সরকার ৮১৪ মিলিয়ন ভোটারের স্বার্থ স্থগিত রেখে আম্বানির স্বার্থই দেখবে। কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থ দেখতে গিয়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় খাতে, বিশেষ করে কৃষিতে ভর্তুকি কমাবে। বাড়বে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের দাম।

লালফিতার বদলে লাল গালিচার ভাঁওতা

এবারের লোকসভা নির্বাচনে ১২০ মিলিয়ন তরুণ প্রথমবারের মতো ভোটার হয়েছেন, যারা মোট ভোটারের ২০ শতাংশ। এদেরকে মোদি স্মার্ট ফোন, ল্যাপটপ আর কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে চাকরির স্বপ্ন দেখিয়েছেন। বলেছেন এখন থেকে লাল ফিতার দৌরাত্ম্যের বদলে কর্মসংস্থান এবং বিনিয়োগকে লালগালিচা সম্বর্ধনা দেওয়া হবে। কিন্তু কর্পোরেট লুণ্ঠনের ইতিহাস প্রমাণ করে, জাতীয় অর্থনীতির সুষম বিকাশ ছাড়া এই কর্মসংস্থান কখনওই সম্ভব নয়।

অন্যদিকে মোদি আবার বলছেন, তিনি চীনের উন্নয়ন মডেল অনুসরণ করবেন। তারও কোনো রূপরেখা নেই আসলে। তাই ওয়াল সিট্রট জার্নাল পত্রিকা তাদের ১৭ মে সংখ্যায় লিখেছে–

''আসলেই মোদি কীভাবে ভারতের অর্থনীতি পাল্টাবেন তার কোনো বিস্তারিত রূপরেখা এখনও নেই।''

সবচেয়ে বড় কথা হল, নির্বাচনে দলীয় ইমেজ পাশ কাটিয়ে ব্যক্তি ইমেজ ধরে এগুবার কৌশল নিলেও, সংঘ পরিবার রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যক্তি মোদির ভাবনায় যথেষ্ট ছাড় দেবে কিনা সেটিও নিশ্চিত নয়।

ফলে উগ্র জাতীয়তাবাদ, আধুনিক কর্পোরেট উন্নয়ন মডেল এবং হিন্দুত্ববাদের যে 'শরবত' মোদি বিক্রির চেষ্টা করছেন, তার বিতরণ ব্যবস্থা আটকেও যেতে পারে। তাই আজ ভারতের শেয়ার বাজার চাঙ্গা হয়ে উঠলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হবে না। মোদির 'শরবত' সঙ্গত কারণেই ভারতীয় রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বদহজমের কারণ ঘটাবে। বেকারত্ব, গ্রামীণ অসন্তোষ এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির তুফান উঠতে পারে, যা হবে মোদি-হাওয়ার চেয়েও প্রবলতর।

ভারতের পিছিয়ে পড়া রাজ্যগুলো দারিদ্র বণ্টনের নীতির বদলে পুঁজিবাদী উন্নয়নের চুইয়ে পড়া নীতির ঝলকে যেটুকু আকৃষ্ট হয়েছিলেন, কর্পোরেট পুঁজি এবং ফিন্যান্স পুঁজির লুণ্ঠনে সে আকর্ষণ তার চেয়েও দ্বিগুণ বিকর্ষণে পরিণত হবে। সে বিকর্ষণের সুযোগ যদি ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ ও বামপন্থী মহল কাজে লাগাতে পারেন, তাহলেই প্রকৃত ভারত জিতবে।

হাসান তারিক চৌধুরী: আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ।