হরতালের উৎসে সরকার, সমাধানেও

শওকত মাহমুদ
Published : 2 Dec 2010, 06:15 PM
Updated : 2 Dec 2010, 06:15 PM

কোনও 'গোলমাল' (আন্দোলন)-এর সময় ঘরের বাইরে না যেতে মায়েরা বরাবরই সন্তানদের সতর্ক করে দেন। তারপরও দেশ-মাতৃকার টানে ঘরের বাইরে যায় বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীরা। ইতিহাসের উল্টো পথে বেশি এগোব না। নব্বই-এর স্বৈরাচার-বিরোধী সংগ্রামে যুবসমাজ আপোসহীনভাবে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার ডাকে ঘর থেকে রাস্তায় গেছে।

গত মাসে যে দুটি হরতাল হয়েছে, তার গতানুগতিক মূল্যায়নে না গিয়ে বলতে পারি, সরকারের জন্যে দুটি বড় অঘটন ঘটে গেছে। এক. দেশ পরিচালনায় মহাজোট সরকারের ব্যর্থতায় ক্ষুব্ধ দেশবাসীর মনে বেগম জিয়াকে এক কাপড়ে ৪০ বছরের নিবাস থেকে বের করে দেয়ার ঘটনাটি স্ফুলিঙ্গের মতো দ্রোহ তৈরি করেছে। হরতালের স্বতঃস্ফূর্ততাই এর প্রমাণ। দ্বিতীয়তঃ বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে আরও একটি নজীরবিহীন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে।

এতকাল দেখেছি, হরতাল আহবানকারীরা পিকেটিংয়ের জন্য রাস্তায় নেমেছে, মিছিল করেছে। কিন্তু পুলিশ তখনই লাঠিপেটা শুরু করেছে যখন পিকেটাররা বোমা ফাটিয়েছে, যানবাহনে আগুন ধরাতে চেয়েছে বা এক কথায় সহিংসতার সূত্রপাত যখন ঘটেছে এবং গ্রেফতারও চলেছে। কিন্তু এবার দুটি হরতালের অভিজ্ঞতা হল, পিকেটিং বা মিছিলের আগেই, হরতাল-ডাকা বিএনপির নিরীহ কর্মী রাস্তায় চোখে পড়লেই পুলিশ তাকে টেনে-হিঁচড়ে প্রিজন ভ্যানে তুলেছে। সিলেটে সাবেক এমপিকে কোমরে রশি বেঁধে তোলা হয়েছে। মহিলাদের বুকে পুরুষ পুলিশেরা হাত দিয়ে গ্রেফতার করেছে। বরিশালে এক রাজনৈতিক কর্মী পুলিশের তাড়া খেয়ে নদীতে পড়ে গেছে। পুলিশ তাকে সেখানে থেকে তুলে নিয়ে হাজতে ঢুকিয়েছে।

কুমিল্লার বুড়িচং ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া দুটি থানায় (বাংলাদেশের সর্বত্র) হরতালের কয়েকদিন আগে থেকেই বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মীদের রাস্তায় পর্যন্ত নামতে দেওয়া হয় নি। মায়েরা এসব দেখে আশ্চর্য। তাছাড়া যখন তারা দেখলেন, হরতালের আগের রাতগুলোতে গ্রামে গ্রামে ঢুকে পুলিশ নিরীহ কর্মীদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে, তখন তাদের বুকফাটা কান্না। এমন তো দেখি নি বাংলাদেশে! ওই মায়েরাই এখন সন্তানদের পাঠাবে জুলমবাজ, মানবাধিকার লংঘনকারী সরকারের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামতে। অত্যাচারী পুলিশও এক সময় গুটিয়ে যাবে।

দুটি হরতালের রাজনৈতিক গুরুত্ব সেখানেই। বেগম জিয়া এর মাধ্যমে মানুষে-মানুষে, ঘরে-ঘরে ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে তাপ ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন। আর বাংলাদেশের জনগণ জুলুমের ব্লাস্ট ফার্নেসে কঠিনভাবে তৈরি হচ্ছেন।

পর্যবেক্ষক মহল বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করছেন যে সরকার তরফের সুশীল ছলনায় অনেক সময় প্রতিপক্ষের কেউ কেউ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। হরতাল আমাদের ক্ষতি করে – এমন জোরদার প্রচারণা হচ্ছে। কিন্তু হরতাল কেন হচ্ছে সে নিয়ে কোন কথা নেই। হরতালের আগে গণগ্রেফতার নিয়ে সামান্য হল্লাও নেই সুশীল সমাজে। বেগম জিয়া হরতাল ডেকে তো সরকারের ফ্যাসিবাদী চরিত্রকে খোলতাই করছেন আর শেখ হাসিনাও সেই ফাঁদে পা দিচ্ছেন। ক্রমাগত অসহায়ত্বে ঠেলে দেওয়া জনগণের পক্ষে বিরোধী দল তো হরতাল করবেই। আর হরতালকে কুটির শিল্প তো বর্তমান সরকারই বানাচ্ছে। হরতাল-ডাক-দেয়া বিরোধী দলকে ঘরে বসিয়ে রাখা হবে – তাও সরকারের মর্জিমাফিক। ফ্যাসিবাদের পক্ষে গান গাওয়া বুদ্ধিজীবী হাবার্ট মারকিউয তিরিশের দশকে কতকগুলো শব্দ চালু করেছিলেন। যেমন, defensive violence (আত্মরক্ষামূলক সহিংসতা) repressive tolerance (নির্যাতনমূলক সহিংতা)। সরকারকে পরামর্শদাতারা শান্তিপূর্ণ হরতাল ঠেকাতে সহিংস প্রতিরক্ষার কথা বলছেন এবং বাস্তবায়নও করাচ্ছেন। সর্বোচ্চ আদালতের রায় চূড়ান্ত হওয়া বা বেগম জিয়ার স্বেচ্ছায় বাড়ি ছাড়ার আগেই তাঁকে বলপূর্বক বের করে দেওয়ার দেশীয় নাম নির্যাতন, বিদেশী নাম সহিষ্ণুতা। ইটালীর মুসোলিনী বলত "Everything in the state. nothing outside the state." রাষ্ট্রীয় রাজনীতিকে একমুখী করা ফ্যাসিবাদের ধর্ম। এতে করে "all of society's institutions are wrapped around the state like sticks around the fascist blade."

দ্বিতীয় প্রচারণা হচ্ছে বিএনপি কেন একটি বাড়ি নিয়ে রাজনীতি করবে? এসব শুনে বিএনপি'র শুভাকাঙ্ক্ষীরাও এ দাবিটাকে হরতালের শেষ কারণ বলতে চায়। মহাজোট সরকারের মন্ত্রীসভা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে শহীদ মঈনুল রোডের ৬ নম্বর বাড়ির লীজ বাতিল করেছে; প্রধানমন্ত্রীর সার্বক্ষণিক প্রচারণাই ছিল ওই বাড়ির বিরুদ্ধে। সরকারই বাড়িটিকে রাজনৈতিক ইস্যু বানিয়েছে, এ নিয়ে বিএনপি রাজনীতি করবে না কেন? এই সরকারের আমলে প্রচুর বাড়ি ও জমি বেদখল হয়েছে। যোগ করলে আরও বড় আন্দোলন দাঁড়ায়। বেগম জিয়াকে উচ্ছেদ এবং অপমানের কারণেই বাংলাদেশের মানুষ ১৫ দিনের ব্যবধানে দু'টি হরতাল করল। এই সেন্টিমেন্টকে রাজনীতিতে অবহেলার সুযোগ কম। এই রায়কে বুক ফুলিয়ে বলতে অসুবিধা কোথায়?

হরতালে কয়টা ট্রেন চলল, কতো প্লেন উড়ল, পক্ষ-বিপক্ষের কেমন বড় মিছিল হল — সে সবের মূল্যায়ন এখন নিরর্থক। বর্তমান রাজনীতির ঝোঁক বুঝতে ঘরে ঘরে কান পাতুন — আন্দোলনের দামামা ক্ষীণ নয়। জনমত মানে আকাশ ফাটানো মেঘের গর্জন নয়। বরং মাটিতে মিশে থাকা শিশির বিন্দু।

জাতীয় দৈনিকগুলোর সম্পাদকদের সঙ্গে দুই নেত্রীর সংলাপের রেওয়াজ বহুদিন ধরে চলে আসছে। একজন সম্পাদক বলেন, বিরোধী নেত্রী বেগম জিয়াকে সংসদে যেতে বা হরতাল না দিতে বলা যায়। আরেক নেত্রী বিরোধী দলে থাকলে তাঁকে তো সংসদে যেতে অনুরোধ করতেই পরিবেশ পাই না।

তবে এখন হরতাল বা আন্দোলন বন্ধ করতে পারেন একমাত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সরকারের অগণতান্ত্রিক এবং ফ্যাসিবাদী কার্যকলাপই হরতাল ডেকে আনছে।

ফেসবুক লিংক । মতামত-বিশ্লেষণ