ফলাফল নয়, চাই মেধার মূল্যায়ন

আবু সালেহ সেকেন্দার
Published : 17 May 2014, 02:45 PM
Updated : 17 May 2014, 02:45 PM

প্রশ্নপত্র ফাঁসের কলঙ্ক মাথায় নিয়ে এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। ফাঁসকৃত প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা যে জিপিএ-৫ এর সংখ্যাবৃদ্ধি ও পাশের হার বাড়াতে মহৌষধ হিসেবে কাজ করে তা আবারও প্রমাণিত হয়েছে।

বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ক্ষেত্রে ২০১৪ সাল যেমন রেকর্ড ছুঁয়েছে, তেমনি এই বছরের এসএসসির ফলাফলও পাশের হার ও জিপিএ-৫ প্রাপ্তির দিক থেকে নতুন রেকর্ড গড়েছে। এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের ৯১ দশমিক ৩৪ শতাংশ পাশ করেছে। জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৪২ হাজার ২৭৬ জন। গত বছর এ হার ছিল যথাক্রমে ৮৯ দশমিক শূণ্য ৩ শতাংশ এবং ৯১ হাজার ২২৬ জন।

এই ফলাফলে আমাদের উচ্ছাসিত হওয়ার কথা হলেও, এর 'ভবিষ্যৎ ফলের চিন্তা' আমাদের চরমভাবে হতাশ করছে।

ফলাফলে যারা আনন্দের জোয়ারে ভাসছে, তাদের পরীক্ষার প্রস্তুতি ও পরীক্ষায় অংশগ্রহণ এত আনন্দময় ছিল না। বর্তমান মহাজোট সরকারের পূর্ববর্তী শাসনামলের শেষ সময়ে সারাদেশ রাজনৈতিকভাবে অস্থিরতার দিক থেকে রেকর্ড করেছে। বিরোধী দলের হরতাল-অবরোধের কারণে এসএসসি পরীক্ষার সময়সূচি বারবার পরিবর্তন করতে হয়েছে।

ফলে পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়া ও অংশগ্রহণের মতো অনুকূল পরিবেশ শিক্ষার্থীরা পায়নি। প্রতিকূল পরিবেশে পাশের হার ও জিপিএ প্রাপ্তির সংখ্যা যদি রের্কড ছুঁয়ে যায়, তবে অনুকূল পরিবেশে হয়তো কোনো শিক্ষার্থীই ফেল করত না। আরও একধাপ এগিয়ে বলা যায়, কেউই জিপিএ-৫ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হত না!

সদ্যপ্রকাশিত এসএসসির ফলাফলকে মেধার মূল্যায়ন বলা সত্যিই কঠিন। এই ফলাফল শতভাগ রাজনৈতিক, এমন অভিযোগ আছে। বলা হয়, শিক্ষায় সরকারের ধারাবাহিক সাফল্য ধরে রাখার চেষ্টার ফল এই রেজাল্ট। এই চেষ্টা দু'ভাবে হয়েছে:

এক. বৈধ পন্থা:

শিক্ষার্থীদের সমস্যাগুলো দূরীকরণ, সৃজনশীল ভীতি মুক্তকরণের পদক্ষেপ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি ইত্যাদি;

দুই. রাজনৈতিক: এটি পুরোপুরি অদৃশ্য শক্তির খেলা। যেখানে প্রশ্নপত্র ফাঁসের নাটক থেকে শুরু করে শিক্ষককে বেশি নম্বর প্রদানে প্ররোচিত করার মতো ঘটনা দৃশ্যমান।

প্রথমটি প্রমাণ করা গেলেও দ্বিতীয়টি প্রমাণ অসম্ভব। কিন্তু এসএসসির ফলাফলে জিপিএ-৫ পাওয়া ও পাশের হার বৃদ্ধির ক্ষেত্রে দ্বিতীয় পন্থাই কার্যকরী ভূমিকা রেখেছে। প্রথম পন্থায় সাফল্য গাণিতিক হারে; আর দ্বিতীয় পন্থায় সাফল্য জ্যামিতিক হারে হওয়াই বাঞ্চনীয়। বর্তমান ফলাফলে জিপিএ-৫ ও পাশের হারের জ্যামিতিক সাফল্যই বলে দেয় যে, এই ফলাফলে প্রথম পন্থা নয়, দ্বিতীয়টিই মূখ্য ভূমিকা রেখেছে।

পরিসংখ্যানের দিকে নজর দিলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে। ২০০১ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে যথাক্রমে ৭৬ জন (২০০১), ৩২৭ জন (২০০২), ১ হাজার ৩৮৯ জন (২০০৩), ৮ হাজার ৫৯৭ জন (২০০৪), ১৫ হাজার ৬৩১ জন (২০০৫), ২৪ হাজার ৩৮৪ জন (২০০৬), ২৫ হাজার ৭৩২ জন (২০০৭), ৪১ হাজার ৯১৭ জন (২০০৮), ৪৫ হাজার ৯৩৪ জন (২০০৯), ৬২ হাজার ১৩৪ জন (২০১০), ৬২ হাজার ২৮৮ জন (২০১১), ৮২ হাজার ২০১২ জন (২০১২) এবং ৯১ হাজার ২২৬ জন (২০১৩)।

এই পরিসংখ্যাই বলে দিচ্ছে যে, প্রতি বছরই জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা বা অস্থিতিশীলতা অথবা পরীক্ষার্থীর ভালো প্রস্তুতি বা অপ্রস্তুতি বা পরীক্ষার খাতায় ভালো লেখা বা না-লেখা জিপিএ-৫ প্রাপ্তি ও পাশের হার নির্ধারণ করে না। গত বছরের তুলনায় এ বছর অধিক জিপিএ-৫ পাবে ও অধিক হারে শিক্ষার্থী পাশ করবে এটাই বাস্তবতা।

এ ক্ষেত্রে যদি মেধার মূল্যায়ন হত, অর্থাৎ যদি জিপিএ-৫ প্রাপ্তি ও পাশ করার হার মেধার মূল্যায়নের ভিত্তিতে হত, তবে ওই হার অবশ্যই উঠানামা করত। কোনো বছর জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি হলে অন্য বছর নানা কারণে সেটি কমে যেত। এমন তো নয় যে, প্রতি বছরই আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হচ্ছে, যা সামগ্রিক ফলাফলে প্রভাব ফেলছে। বরং নানা কারণে ২০১৪ সালের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা-প্রস্তুতি ও পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অনুকূল পরিবেশ অন্য যে কোনো বছরের তুলনায় খারাপ ছিল। তাই এ বছর মেধার মূল্যায়নই ফলাফল নির্ধারণে ভূমিকা রাখলে, অন্য বছরের তুলনায় ফলাফল অবশ্যই খারাপ হওয়ার কথা।

সরকারের আন্তরিকতা ও উদ্যোগের কারণেই পূর্বের তুলনায় এখন অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থী শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ পাচ্ছে। ঝরে পড়ার হারও অনেক কম। এটা মহাজোট সরকারের এক বড় সাফল্য তাতে সন্দেহ নেই। বর্তমানে প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রতিটি স্তরেই পূর্বের মতো অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে না, সরকারের এই দাবি অযৌক্তিক নয়।

তাই বলে এটা কোনোভাবে প্রমাণিত হয় না যে, মেধাবী শিক্ষার্থীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বরং সরকার নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া সত্ত্বেও, শিক্ষার মান দিন দিন কমে যাচ্ছে এটা প্রমাণিত। মানহীন শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় পাশ করলেও, প্রকৃত মেধার মূল্যায়ন করা গেলে বলতে হয়, জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ার কথা নয়।

শিক্ষার্থীদের মান যে আগের তুলনায় কমে গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিপরীক্ষার একটি পরিসংখ্যান তা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। ওই পরিসংখ্যান বলছে, ২০১০, ২০১১, ২০১২ সালে ক, খ, ও গ ইউনিটের ভর্তিপরীক্ষায় জিপিএ-৫ অর্জনকারী শিক্ষার্থীদের যথাক্রমে ৫২, ৫৩ ও ৫৫ শতাংশ ফেল করেছে।

এই পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট যে, জিপিও-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ার অর্থ শিক্ষার মান বৃদ্ধি পাওয়া নয়। বরং এই পরিসংখ্যানে উল্টো চিত্র প্রকাশ পেয়েছে। ২০১০ সালের তুলনায় ২০১১ সালে এবং ২০১১ সালের তুলনায় ২০১২ সাল জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে। তেমনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিপরীক্ষায় ২০১০ সালের তুলনায় ২০১১ সালে এবং ২০১১ সালের তুলনায় ২০১২ সালে জিপিও-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর ভর্তিপরীক্ষায় ফেল করার সংখ্যাও বেড়েছে।

ওই পরিসংখ্যাই জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের গায়ে কলঙ্কের তিলক এঁকে দিচ্ছে। প্রমাণ করছে, দেশে জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়লেও শিক্ষার মান সেই তুলনায় বাড়েনি, সমালোচকদের এমন দাবি আপাতত মিথ্যে নয়। জ্যামিতিক হারে পাশের ও জিপিএ-৫ পাওয়ার হার বাড়লেও যদি গাণিতিক হারেও শিক্ষার মান বাড়ত, তবে কিছুটা হলেও স্বস্তি পাওয়া যেত। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন কথাই বলছে।

একজন শিক্ষক হিসেবেও জোর গলায় বলতে পারছি না যে, পাশের হার বৃদ্ধি বা জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ তাদের উপযুক্ত শিক্ষাপ্রাপ্তি অথবা তাদের দক্ষতা ও মানবৃদ্ধির কারণে তারা এমন ফলাফল অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। বরং আমাদের কাছে ক্লাসে পড়াতে যেয়ে এই বিষয়টি ধরা পড়ছে যে, মেধাবী ও দক্ষ শিক্ষার্থীর সংখ্যাই দিন দিন কমছে। অনেকে কেবলমাত্র পরীক্ষার পড়া গলাধকরণ করা ছাড়া বিকল্প কিছু ভাবতেই পারে না।

আমি প্রথম বর্ষে পড়াতে যেয়ে দেখেছি, পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্য কোনো বই পড়েনি এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৯৯ ভাগ। যদিও তাদের অনেকেরই এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় ঈর্ষণীয় ফলাফল রয়েছে।

আমরা যে সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলছি, সেই সৃজনশীলতাও অধিকাংশ শিক্ষার্থীর মধ্যে অনুপস্থিত। তাদের মৌলক জ্ঞান অনেক কম। অনেকের পাঠ্যপুস্তকের বাইরে অথবা একটি বিষয়ে অধিক সংখ্যক পাঠ্যপুস্তক পাঠে একেবারেই আগ্রহ নেই। তারা শর্টকার্ট রাস্তাতে পরীক্ষায় পাশ করতে ব্যস্ত। তাদের মনোভাব এমন যে, তারা পরীক্ষার খাতায় যাই লিখুক, অধিক নম্বর প্রাপ্তি তাদের অধিকার। যে শিক্ষক অধিক নম্বর প্রদান করেন না, তাকে অকাশ্য-অপ্রকাশ্য গাল-মন্দ করতেও তারা দ্বিধা করে না।

তাদের এমন মনোভাবের জন্য তাদের চেয়ে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাই দায়ী। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলের রাজনীতিকরণের দায়ভার কম নয়। ওই পরীক্ষাগুলোর ফলাফল তাদের মধ্যে এমন মনোভাব তৈরি করেছে যে, কম পড়লেও ভালো রেজাল্ট করা যায়। কারণ তারা ওই পর্যায়ে যে পরিমাণ লেখাপড়া বা পরিশ্রম করেছে, তার চেয়ে বেশি ভালো ফল পেয়েছে। ফলে তাদের মধ্যে এই ধারণা তৈরি হয়েছে যে, শিক্ষকরা চাইলেই নম্বর পাওয়া সম্ভব। লেখাপড়া ঠুঁটো জগন্নাথ!

এসব পরিসংখ্যানই আভাস দিচ্ছে যে, আগামী বিশ বছরের মধ্যে শতভাগ পরীক্ষার্থী পাশ করলে এবং শতভাগ শিক্ষার্থী পাশ করা বিদ্যালয়ের সংখ্যা শতভাগ হলেও হতে পারে। তখন প্রতিযোগিতা হবে জিপিও-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা নিয়ে। ২০৫০ সাল নাগাদ সেই লক্ষ্যও অর্জিত হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। অর্থাৎ পাশ করা বিদ্যালয়ের সংখ্যা শতভাগ এবং শতভাগ বিদ্যালয়ের শতভাগ শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে!

যদি এমনও হয়, তবে আমি অন্তত অবাক হব না। কারণ যেভাবে রাজনৈতিক বিবেচনায় জিপিএ-৫ প্রাপ্তির সংখ্যা বাড়ছে, এই সাফল্য ধরে রাখতে শেষ পর্যন্ত শতভাগ জিপিএ-৫ পাওয়া বা পাশকারীর সংখ্যায় যেয়ে ঠেকা ছাড়া রাজনীতিবিধদের কাছে অন্য কোনো বিকল্প থাকবে না।

অবশ্যই আমাদের প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে, আগামীতে শতভাগ পাশ করবে। আমাদেরও প্রধানমন্ত্রীর এই আশাবাদের সঙ্গে একমত হওয়া উচিত। কিন্তু ওই পাশ যেন রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, মেধার ভিত্তিতে হয়– এমন দাবিও আমাদের প্রধানমন্ত্রীর নিকট উত্থাপন করার এখনই সময়। গত সরকারের চেয়ে এই সরকার অথবা গত বছরের তুলনায় এই বছর অধিক সফল, সেই বিবেচনাই যেন পাশের হার বা জিপিএ-৫ প্রাপ্তির মানদণ্ড না হয়। প্রকৃত মেধাবীদের শতভাগ পাশ করলে বা জিপিএ-৫ পেলেও আমাদের আপত্তি নেই।

আর এর ব্যতিক্রম হলে ভবিষ্যৎ প্রজম্মের ওপরই নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। যখন তারা জিপিএ-৫ পাওয়ার পরও মানসম্পন্ন একটি কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে অথবা উঁচুমানের একটি বিষয়ে পড়তে বা দক্ষতার দাম দেয় এমন একটি প্রতিষ্ঠানে বা পেশায় চাকরি পেতে ব্যর্থ হবে, তখন তাদের মধ্যে হতাশা তৈরি করবে। আর এই হতাশাই একদিন যুবসমাজকে অবক্ষয়ের পথে নিয়ে যাবে।

তাই জিপিএ-৫ এর মহাবিস্ফোরণ অথবা অধিক পাশের হার চাই না। চাই দক্ষ জনশক্তি আর মেধার মূল্যায়ন।

আবু সালেহ সেকেন্দার: শিক্ষক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।