ডেমোক্রেসির শেষ কথা

আঞ্জুমান ইসলাম
Published : 18 May 2011, 03:08 PM
Updated : 18 May 2014, 06:54 PM

ডেমোক্রেসি আসলে কী, ডেমোক্রেটিক ফর্ম অব গভর্নমেন্ট কি আসলে ভালো না খারাপ সেই চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে অ্যারিস্টটলের সময় থেকেই। এসব আলোচনা সমালোচনার মধ্যেই নানান পরিবর্তন, পরিমার্জন, উত্তরণ ঘটিয়ে ডেমোক্রেসি অন্যসব রাষ্ট্রব্যবস্থার চেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।

তারপরও ডেমোক্রেসি নিয়ে আলোচনার শেষ নেই, বিশেষ করে বাংলাদেশে তো ডেমোক্রেসি প্রিয় একটি আলোচনার বিষয়। বাংলাদেশে ডেমোক্রেসি আছে না নেই, পুরো ডেমোক্রেসি নাকি আধা ডেমোক্রেসি বিদ্যমান, নাকি ডেমোক্রেসির নামে ছদ্মবেশে অন্যকিছু চলছে– এই নিয়েই চলছে আলোচনা দিনরাত।

ইদানিংকালের ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে সরগরম সব আলোচনা দেখে মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক যে, আমরা বাংলাদেশিরা ডেমোক্রেসি বলতে আসলে কী বুঝি কিংবা আমরা আসলে কেমন ডেমোক্রেসি চাই। আরেকটু ঘুরিয়ে বললে বলা যায়, যে ধরনের ডেমোক্রেসি বাংলাদেশে আছে বা যে ধরনের রাজনীতি আমরা আশা করি, তা কতটা কল্যাণ বয়ে আনছে বাংলাদেশের এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে। এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই এই লেখার অবতারণা।

প্রথমে ডেমোক্রেসির প্রচলিত ধারণাগুলো বলে, দেখার চেষ্টা করব কোন কোন নিয়ামকের উপস্থিতি ডেমোক্রেসির সাফল্যের সঙ্গে জড়িত, আর কোন পরিস্থিতিতে ডেমোক্রেসির অন্যতম নিয়ামক উপস্থিত থাকার পরও তা চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে।

স্যার উইনস্টন চার্চিল বলেছেন–

Democracy is the worst form of government except all others that have been tried.

যা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে এখন পর্যন্ত 'ভালো' বলে কোনো সরকার ব্যবস্থাই পাওয়া যায়নি বলেই নিকৃষ্ট হলেও ডেমোক্রেসিই এখন পর্যন্ত মন্দের ভালো। কেন ডেমোক্রেসি মন্দের ভালো?

জর্জ বার্নাড শ'র একটি বিখ্যাত উক্তি অনুযায়ী–

Democracy is a device that ensures we shall be governed no better than we deserve.

তীর্যকভাবে বললেও শ'র কথাটি যেন বাংলাদেশের ডেমোক্রেসির ব্যাপারেই সবচেয়ে বেশি খাটে। কেননা এখানে জনগণ প্রকৃত অর্থেই চায় তার কাতারেরই একজন দ্বারা পরিচালিত হতে; আর এ কারণে নিজের 'পারসপেকটিভ' থেকে ভালো-মন্দ বিচার করে ভোট দেয়।

তার উপর বাংলাদেশে তো ডেমোক্রেসি 'প্র্যাকটিস' করার সম্পূর্ণ নিজস্ব একটা ধরন আছে। কোনো এক নেতাকে আজকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসিয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ, আর তার কিছুদিন পর ওই ব্যক্তিকে আর ভোট না দিয়ে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে আত্মতৃপ্তি– এই হল বর্তমানে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের কাছে ডেমোক্রেসি বা 'সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ' কথাটির অর্থ।

আরও পরিস্কার করে বললে বলতে হয়, আমাদের কাছে ডেমোক্রেসির মানে হল 'ইচ্ছামতো' ভোট দিতে পারার অধিকার, আর সেই ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটাই আমরা নির্বাচনের একটি দিনে। মনের ক্ষোভ-ঝাল-রাগ মিটিয়ে নিজেদের 'ক্ষমতা' দেখানোকেই 'ডেমোক্রেসি' মনে করে খুশি থাকি। আর তাই কিছু রাজনৈতিক দলও 'ডেমোক্রেসি'কে রাজনীতির হাতিয়ার বানিয়ে 'এই হারাল প্রকৃত ডেমোক্রেসি' বলে বলে 'প্রকৃত' ডেমোক্রেসি নামের একটি মিথ তৈরি করতে সমর্থ হয়েছে। সেই মিথ প্রসঙ্গেই কিছু বলতে চাই এখানে।

আক্ষরিক অর্থ ধরলে, ডেমোক্রেসি হল জনগণের শাসন (শব্দটার উৎপত্তি দুটি গ্রিক শব্দ থেকে– Demos অর্থ people বা জনগণ এবং Kratia অর্থ rule বা শাসন)। আর সেই সংজ্ঞা অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের শাসন ব্যবস্থার (যেমন, মনারকি, ডিকটেটরশিপ, অ্যারিসটোক্রেসি, কমিউনিজম, সোশ্যালিজম, রিপাবলিক, ডেমোক্র্যাটিক, ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক ইত্যাদি) মধ্যে ডেমোক্রেসি এক ধরনের শাসনব্যবস্থা যেখানে জনগণের দ্বারাই রাষ্ট্র পরিচালিত হওয়ার কথা।

কিন্তু এই ধরনের শাসনব্যবস্থা গুটিকয়েক মানুষের দেশ ছাড়া সম্ভব নয়। কারণ সরকারে সব মানুষকে সঙ্কুলান অসম্ভব। আর সে কারণে 'প্রকৃত' ডেমোক্রেসি বলে আসলে কিছু নেই– এটা একটা আইডিয়াল সিচুয়েশান বা ইউটোপিয়ান ধারণাপ্রসূত সিস্টেম। বরং সাম্যের ভিত্তিতে রিপাবলিক বা জনপ্রতিনিধিরা যে সরকার গঠন করে সেটাই বর্তমানে ডেমোক্রেসির ব্যবহারিক রূপ।

তবে জনপ্রতিনিধির সঙ্গে যে ব্যাপারটি ডেমোক্রেটিক ব্যবস্থায় অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত তা হল শাসনতন্ত্র। সরকার এই শাসনতন্ত্র অনুযায়ী রাষ্ট্রপরিচালনা করবেন যেখানে জনগণের অধিকার, জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতা আর সরকারের শাসনের গণ্ডি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকবে। যার ফলে জনপ্রতিনিধি পরিবর্তন হলেও জনগণের অধিকার সংরক্ষিত থাকে আইন দ্বারা এবং এ কারণেই অন্যসব শাসন পদ্ধতির মধ্যে থেকে ডেমোক্রেসি সর্বজনগ্রাহ্য হয়েছে এবং ধীরে ধীরে অন্যসব শাসনব্যবস্থা থেকে শ্রেয়তর হয়ে উঠেছে।

সে সঙ্গে যেহেতু জনগণ আইন পরিবর্তন, পরিমার্জনে ভূমিকা রাখতে পারে তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে। তাই জনগণের চাওয়া ডেমোক্রেসিতে প্রতিফলিত হয়। আর সেজন্যই ডেমোক্রেসি দেশ, কাল ও পরিস্থিতিভেদে ভিন্ন রকম ও পরিবর্তনশীল।

যদিও বর্তমানে বাংলাদেশে ডেমোক্রেসি বলতে শুধু নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি ঠিক করার স্বাধীনতাকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়, কিন্তু জনগণের অধিকার রক্ষাকে শাসনব্যবস্থার অংশ হিসেবে বিবেচনা করার আইডিয়া থেকেই ডেমোক্রেসির উৎপত্তি।

এ কারণেই আধুনিক ডেমোক্রেসির প্রথম উদাহরণ হিসেবে ধরা হয় ১২১৫ সালে ইংল্যান্ডে প্রণীত 'ম্যাগনা কার্টা' বা ম্যাগনা চার্টারকে, যেখানে ইংল্যান্ডের রাজার ক্ষমতার সীমা-নির্ধারণী ব্যবস্থা হিসেবে এলাকার কৃষকদের অধিকার সংরক্ষণ এবং তৎকালীন ব্যারনসদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্যে সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়নের প্রস্তাব করা হয়।

ম্যাগনা কার্টায় ইংল্যান্ডের রাজার ক্ষমতা তেমন খর্ব করা হয়নি, কিন্তু এই চার্টারের মাধ্যমে তৎকালীন ব্যারনরা নিজেদের এলাকা ও চার্চে ইংল্যান্ডের রাজার আধিপত্যের সীমা টানার পাশাপাশি এটা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন যে, ইল্যান্ডের রাজাও আইনের উর্ধ্বে নয়। অর্থাৎ আইন দ্বারা জনগণের জীবনে শাসকের হস্তক্ষেপ ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণই আধুনিক ডেমোক্রেসির মূল কনসেপ্ট।

এই ম্যাগনা কার্টার তিনটি ধারা এখনও ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের আইনে বলবৎ আছে। ম্যাগনা কার্টায় সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন বা নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি ইত্যাদির কোনো উল্লেখ না থাকলেও জনতার অধিকার ও কল্যাণমূলক ব্যাবস্থার প্রতি ফোকাস করাই একে ডেমোক্রেসি প্রতিষ্ঠার জাজ্জ্বল্য উদাহরণে পরিণত করেছে।

অন্যদিকে জার্মানিতে ১৯৩৩ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে ৪৪ শতাংশ জনসমর্থন পাওয়া ন্যাশনাল ওয়ার্কাস পার্টি আর ৯ শতাংশ জনসমর্থন পাওয়া পিপলস পার্টির জোটের (যেই জোটকে পরবর্তীতে নাৎসি পার্টি হিসাবেই সকলে চেনে) ক্ষমতায় আসা ডেমোক্রেসির নিকৃষ্টতম উদাহরণ। জার্মানিতে তখন পার্লামেন্টারি ফর্ম অব গভর্নমেন্ট। চরমভাবে ইহুদি-ব্যবসায়ী-ক্যাপিটালিস্ট-বুর্জোয়াবিরোধী রাজনৈতিক মতবাদ পোষণকারী ন্যাশনাল ওয়ার্কার্স পার্টি এবং চরম কমিউনাল-মনার্কিস্ট-কনজারভেটিভ-জাতীয়তাবাদী পিপলস পার্টি একজোট হয়ে পার্লামেন্টে ৩৪০ আসন নিয়ে সরকার গঠন করে অ্যাডলফ হিটলারের নেতৃত্বে।

জনগণের কাছে প্রকাশ্যেই দুটি দলের ইহুদি-ব্যবসায়ী-কমিউনিস্ট-নন এরিয়ান-বুর্জোয়াবিরোধী ম্যান্ডেট তুলে ভোট চেয়েছেন তারা এবং ক্ষমতাগ্রহণের পরে প্রথম ভাষণে নিজেদের ম্যান্ডেট বাস্তবায়নের জন্যে ওইসব জনগোষ্ঠীকে নির্ধন করার কঠিন প্রত্যয় ব্যক্ত করে হিটলারের দেওয়া ভাষণে জনতা উত্তাল সম্মতি জানিয়েছিল।

এই হিটলার সরকারের ইকোনমিক্স ও এগ্রিকালচার মন্ত্রী হন পিপলস পার্টি নেতা বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও মিডিয়া মালিক আলফ্রেড হাগেনবার্গ আর পাবলিক এনলাইটমেন্ট ও প্রোপাগাণ্ডা মন্ত্রী (অবিশ্বাস্য শোনালেও এই মন্ত্রী পদটির অফিসিয়াল নামটি আসলেই এটি) হন জোসেফ গোয়েবেলস। হিটলারের বাগ্মিতা, হাগেনবার্গের মিডিয়া মালিকানা আর গোয়েবলসের প্রোপাগাণ্ডা ডেমোক্রাসিকে কীভাবে কলুষিত করছে তা বুঝতে জার্মান নাগরিকসহ সারা পৃথিবীকে অপরিসীম মূল্য দিতে হয়েছে দেড় দশকের বেশি সময় ধরে।

১৯৩৩ সালের ৩০ জানুয়ারি নির্বাচিত হয়ে চ্যান্সেলর হবার পরেই, ২৩ মার্চ পার্লামেন্টের অনুমোদন ছাড়াই আইন পাশের ক্ষমতা রেখে এন্যাব্লিং আইন জারি করান হিটলার। এরপর একের পর এক বাধ্যতামূলক বন্ধ্যাত্ব আইন (হেরিডিটারি রোগগ্রস্তদের), ইহুদি ব্যবসায়ী বয়কট আইন, হিউম্যান এক্সপেরিমেন্টেশন, এরিয়ান জার্মানদের জন্য ইহুদি বিবাহ নিষিদ্ধ করে ন্যুরেমবার্গ আইনের মতো একের পর এক মানবতাবিরোধী কাজ করার পরও জার্মান জনগণ নাৎসি পার্টির কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করে নিরঙ্কুশ সমর্থন দান করে ১৯৩৬ আর ১৯৩৮ সালের নির্বাচনে; ৯৯ শতাংশ শতাংশ ভোটার টার্ন আউটওয়ালা ওই দুটি নির্বাচনে ৯৭-৯৮ শতাংশ ভোট পেয়ে নির্বাচিত তথাকথিত 'ডেমোক্রেটিক' নাৎসি সরকার।

১৯৪০ থেকে ১৯৪৫ সালে সিস্টেমেটিকভাবে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে হত্যা করেছে ছয় মিলিয়ন ইহুদি আর পাঁচ মিলিয়ন পোলিশ, রোমানিয়ান, নন-এরিয়ান, মানসিক ও শারীরিক বিকলাঙ্গ, সমকামী, কমিউনিস্ট, সোশ্যালিস্ট, সোশ্যাল-ডেমোক্রেটিক ইত্যাদিসহ ভিন্নমতাবলম্বীদের। এছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষয়-ক্ষতি ও আরও ৩০ মিলিয়নেরও অধিক হতাহতের দায় তো আছেই।

ভোটের মাধ্যমে জনগণের রায় দেওয়ার ব্যবস্থা থাকার পরও, বহুদলের অংশগ্রহণের পরও, শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তনের মাধ্যমে জনগণের অধিকারহরণ রুখতে পারেনি হিটলার-গোয়েবলসের তৈরি ডেমোক্রেসির তৎকালীন জার্মান ভার্সান। এটি সম্ভব হয়েছিল মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে একটি জাতিকে অন্ধ জাতীয়তাবাদে উন্মত্ত করার মাধ্যমে।

এর ফল ভালো হয়নি নাৎসি পার্টির জন্যেও। ১৯৩৮ সালে ৯৮ শতাংশ জনসমর্থন থাকার পরও কিন্তু মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের দায়ে নাৎসি পার্টিকে চিরতরে নিষিদ্ধ করা হয় ১৯৪৫ সালে। শুধু তাই নয়, খোদ জার্মানিসহ বিশ্বের অনেক দেশেই প্রকাশ্যে নাৎসিবাদের আলোচনাও নিষিদ্ধ। চক্রান্তে অংশগ্রহণ, বিশ্ব শান্তি ধ্বংস, যুদ্ধাপরাধ, যুদ্ধে মদদ ও উস্কানি, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকায় আর্মি অফিসাদের সঙ্গে ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালে নাৎসি বাহিনী ও হিটলারের থার্ড রেইখ ক্যাবিনেটের পলিটিক্যাল ও ইকোনমিক লিডারদেরও বিচার করা হয়।

২০ নভেম্বর, ১৯৪৫ থেকে অক্টোবর ১৯৪৬ এর মধ্যে ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালে ২৩ জনের (হিটলার ও গোয়েবলস আত্মহত্যা করায় বিচার করা যায়নি) বিচার হয় যার মধ্যে ১২ জনের ফাঁসি হয়; কয়েকজন ফাঁসি কার্যকরের আগে নিজেই আত্মহত্যা করেন। জার্মান জনগণের কাছে নিরঙ্কুশ সমর্থন থাকার পরও, কিন্তু হিটলারকে কেউ ডেমোক্রেটিক বলে না।

তাই নির্বাচন, নির্বাচনে সকলের পার্টিসিপেশন, বেশি ভোটার টার্নআউট, জনসমর্থন, এ সবই ডেমোক্রেসির নিয়ামক হতে পারে, কিন্তু ডেমোক্রেসির মূল কথা হল মানবিকতা ও মানবতার প্রতি দায়বদ্ধতা, মানবাধিকারের সুরক্ষা ও সর্বোপরি আইনের প্রতি শাসকের শ্রদ্ধা।

সাধারণ বিচারে ধরে নেওয়া হয় যে, সুষ্ঠু, অবাধ ও বহুদলের অংশগ্রহণের নির্বাচনের মাধ্যমেই সম্ভব জনদরদী ও মানবাধিকারের সুরক্ষাকারী জনপ্রতিনিধি খুঁজে পাওয়া এবং এতেই একটি জাতির উন্নতি ও অগ্রগতির শক্তি নিহিত। কিন্তু আসলেই কি তাই? আসলেই কি বহু (বা সব দলের) অংশগ্রহণ উন্নতি ও অগ্রগতি ত্বরান্বিত করে?

১৯৩৩ সালে জার্মানির নির্বাচনে ছয়টি মেজর পার্টি লড়েছিল। এর মধ্যে হিটলারের নাৎসি পার্টি পেয়েছিল ৩৪০ আসন, আর ৩০৭ আসনের শক্তিশালী বিরোধী দল ছিল। কিন্তু ডেমোক্রেসির কতটা সুফল পেয়েছিল জার্মানরা? নাৎসি পার্টির অকুণ্ঠ জনসমর্থন থাকার পরও তাদের রাজনীতি করা তো দূরে থাকুক, নাৎসিজম সম্পর্কে কোনো রকম আলোচনা, এমনকি নাৎসি পার্টির সিম্বল 'স্বস্তিকা' নিষিদ্ধ। কানাডা, জার্মানিসহ সতেরো দেশে হলোকাস্টে মৃতের সংখ্যা নিয়ে সংশয় বা এ নিয়ে কোনো প্রকার অপব্যাখ্যামূলক আলোচনা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

সুতরাং শুধু বহু রাজনৈতিক দল, নির্বাচন আর জনসমর্থনের বিচার নয়, ডেমোক্রেসিকে যদি হতে হয় আর্থ-সামাজিক উন্নতির প্রধান নিয়ামক, তার জন্য প্রয়োজন আইনের শাসন আর মানবাধিকারের সুরক্ষা।

এশিয়ার দিকে তাকালে ব্যাপারটা আরও প্রকটভাবে উঠে আসে। ১৯৬৩ সালে স্বাধীনতা পাওয়া সিঙ্গাপুর (যেখানে স্বাধীনতার পর থেকে পিপলস অ্যাকশন পার্টি ক্ষমতায়), ১৯৫৭ সালে স্বাধীনতা পাওয়া মালয়শিয়া (যেখানে স্বাধীনতার পর থেকে ইউনাইটেড মালায়স ন্যাশনাল অর্গানাইজেশান নামের কোয়ালিশন ক্ষমতায়), জাপান (মাঝে বছর দুয়েক বাদে যেখানে ১৯৫৫ সাল থেকে ক্ষমতায় লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি) ইত্যাদি দেশগুলোতে মূলত একক পার্টির রাজনীতি বিদ্যমান থাকলেও, মানবাধিকার ও অর্থনৈতিক-সামাজিক সূচকের মাপে এই দেশগুলোতে অনেক বেশি ডেমোক্রেসি বিদ্যমান।

তথাকথিত বহুদলীয় ডেমোক্রেটিক দেশ, যেমন, ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তানের চেয়ে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ডেমোক্রেসির বাহবা কুড়ানো দেশ, ভারত যেখানে রাজ্য ও জাতীয় পর্যায় মিলিয়ে মূল রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৫০ এর উপরে, সেখানে দেড়মাসের বেশি সময় ধরে বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে (২০১৪ এর ইলেকশন ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) বিপুল উৎসব আমেজের মধ্যে ভোট হয়।

কিন্তু বাস্তবতা হল, ব্রিটিশের অধীন থেকে মুক্তির প্রায় সত্তর বছর পরেও, সেই দেশের অর্ধেক মানুষ এখনও খোলা আকাশের নিচে মলত্যাগ করে, প্রতি চারজনে একজন অক্ষরজ্ঞানহীন, প্রতি তিনজনে একজন ক্ষুধার্ত থাকে। সত্তর বছর ধরে তথাকথিত 'বহু' রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনসর্বস্ব ডেমোক্রেসি উপভোগ করে মানবাধিকার ও ক্ষুধার সূচকে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, সিঙ্গাপুর ইত্যাদি দেশের চেয়ে ভারতের অবস্থান অনেক পিছিয়ে।

অন্যদিকে, আধুনিক গণতন্ত্রের কথা উঠলেই যে নামটি সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয় তা হল ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা বা যুক্তরাষ্ট্র। ১৭৭৬ সালে গ্রেট ব্রিটেন থেকে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করে দেশটি। সেই স্বাধীনতা যুদ্ধে বিভিন্নভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে সাহায্য করেছিল ফ্রান্স। স্বাধীনতা অর্জনের পরপর, বর্তমান সময়ে প্রচলিত ডেমোক্রেসির যে ধারণা– অনেকগুলো রাজনৈতিক দল থাকবে, সব মানুষ ইচ্ছামতো 'আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দিব' গাইতে গাইতে পরিবার-পরিজন নিয়ে দলে দলে ভোট দিয়ে আসবে– সে রকম কোনো কনসেপ্টের উপর স্বাধীন যুক্তরাষ্ট্রে পথচলা শুরু হয়নি।

স্বাধীনতার পর 'ইলেকটরস'দের সমবেত ভোটে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন যুদ্ধকালীন কমান্ডার-ইন-চিফ জেনারেল জর্জ ওয়াশিংটন। সে সময় কোনো পার্টি-বেইসড পলিটিক্স ছিল না। ব্যক্তি হিসেবে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হতে পারতেন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বগণ এবং সবচেয়ে বেশি ইলেকটোরাল ভোটপ্রাপ্ত ব্যক্তি প্রেসিডেন্ট এবং দ্বিতীয় সব্বোর্চ ভোটপ্রাপ্ত হতেন ভাইস প্রেসিডেন্ট।

সে সময় এই ইলেকটরালদের নিযুক্ত করার পদ্ধতিটাও ছিল বর্তমান সময়ের চেয়ে ভিন্ন। প্রতিটা স্টেটই তাদের সিনেটর আর কংগ্রেসে রিপ্রেজেন্টেটিভের সংখ্যার সমান সংখ্যক ইলেকটরস নিযুক্ত করত এবং এই ইলেকটররা তাদের বিবেচনা অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীদের ভোটদান করতেন। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, সে সময় পিপলস রিপ্রেজেন্টেটিভ যারা ইলেকটরালদের সিলেক্ট করতেন, তারা কিন্তু সকল জনগণ বা সর্বসাধারণের ভোটে নির্বাচিত হতেন না। সে সময় ভোট দেবার অধিকার যে শুধু সাদা চামড়ার (ককেশান) পুরুষদেরই ছিল তাই নয়, ভোট দেওয়ার ন্যূন্যতম যোগ্যতা ছিল জমির মালিকানা এবং ট্যাক্সযোগ্য অর্থ উপার্জনকারী হিসেবে বিবেচিত হওয়া। অর্থাৎ মহিলা, জমির মালিক নয় এমন ব্যক্তি, ট্যাক্স প্রদানকারী নয় এমন দরিদ্র, স্থানীয় রেড ইন্ডিয়ান এবং সর্বোপরি কৃতদাস যুক্তরাষ্ট্রে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারত না।

খুব কম সংখ্যক সিভিল জনগণের সম্পৃক্ততা থাকার পরও যুক্তরাষ্ট্রকে ডেমোক্রেসি হিসেবেই আখ্যা দেওয়া হয়, কারণ কোনো না কোনোভাবে জনগণকে সম্পৃক্ত করে শাসক পরিবর্তনের একটা সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করা হত। অর্থাৎ, যে কেউ ইচ্ছা করলেই ভূখণ্ডের আগের শাসককে হঠিয়ে 'আমি আজকে এই ভূখণ্ডের কর্নধার' বলে দেশ শাসন শুরু করে দিতে পারত না। তাকে একটা সিস্টেমের মধ্যে দিয়ে আসতে হত যে, সিস্টেমের একেবারে বেসিক বা সর্বনিম্ন স্তরে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা যাচাইয়ের একটা ব্যবস্থা ছিল।

এখন সারা বিশ্বে যে পার্টিভিত্তিক নির্বাচন ডেমোক্রেসির মূলভিত্তি ধরা হয়, সেই পার্টিভিত্তিক রাজনীতির ঘোর বিরোধী ছিলেন সর্বজনস্বীকৃত যুক্তরাষ্ট্রের 'ফাদার অর দ্যা কান্ট্রি' জর্জ ওয়াশিংটন নিজেই। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে, এখন দলাদলি বা পার্টিজান রাজনীতির সময় নয়, বরং সবাই মিলে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যুদ্ধপরবর্তী দেশগঠনের দিকেই মনযোগী হওয়া উচিত। তিনি পার্টিজান রাজনীতির এতটাই বিপক্ষে ছিলেন যে ফেডারেল গভর্নমেন্টের (কেন্দ্রীয় সরকার) আধিপত্য ও আরও কিছু নীতিনির্ধারণী প্রশ্নে তাঁর সরকারের মধ্যে তৈরি হওয়া দ্বিপাক্ষিক বিভাজনের কারণে তাঁকে সরে যেতে হয় বা নিজেই তৃতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট ক্যান্ডিডেট হওয়া থেকে বিরত থাকেন।

কিন্তু জর্জ ওয়াশিংটন না চাইলেও তাঁর সময়েই দুই মতাদর্শের ব্যক্তিরা দুটি আলাদা রাজনৈতিক পার্টি গঠন করে। দলীয় আবহের মধ্যে জর্জ ওয়াশিংটন দুই দফায় আট বছর দেশপরিচালনার পর তৃতীয় টার্মে আর ইলেকশন না করে রাজনীতি থেকে ইস্তফা দেন এবং এরপরই যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে সুস্পষ্ট ভাগ সূচীত হয়।

একদিকে ছিলেন জন অ্যাডামসের শক্তিশালী ফেডারেল গভর্নমেন্ট নীতির সঙ্গে সহমত পোষণকারী 'ফেডারেলিস্ট' রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। আর অন্যদিকে ছিলেন তাঁর ভাইস প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসনের মতাদর্শ সমর্থনকারী শক্তিশালী স্টেট গভর্নমেন্ট ও রিপাবলিক চিন্তাধারী 'রিপাবলিক্যান-ডেমোক্রেটিক' নেতৃবৃন্দ।

এখানে একটা বিষয় স্মার্তব্য যে, সেই সময় নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট এক টিকেটে হত না (যাকে এখন বলে রানিং মেট).। যিনি সর্বোচ্চ ইলেকটরাল ভোট পেতেন তিনি হতেন প্রেসিডেন্ট। আর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ইলেকটরাল ভোটপ্রাপ্ত হতেন ভাইস প্রেসিডেন্ট।

কিন্তু সমস্যা বাধায় ১৭৯৬ সালের ইলেকশন। ১৭৯৬ সালেই প্রথম পার্টিগতভাবে ইলেকশন হয় যুক্তরাষ্ট্রে এবং 'ফেডারেলিস্ট' আর 'রিপাবলিকান-ডেমক্রেটিক', এই দুই পার্টি থেকেই একাধিক ক্যান্ডিডেট ছিলেন। সেই ইলেকশনে 'ফেডারেলিস্ট' প্রার্থী জন অ্যাডামস তাঁর নিজের দিকে অধিকাংশ ইলেকটোরাল ভোট টানতে সমর্থ হয়ে নিজে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেও, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোট কিন্তু অপর ফেডারেলিস্ট ক্যান্ডিডেট পাননি– পেয়েছিলেন রিপাবলিক্যান-ডেমোক্রেটিক নমিনি থমাস জেফারসন।

ফলে প্রেসিডেন্ট আর ভাইস প্রেসিডেন্ট পুরোপুরি দুই ভিন্ন মতাদর্শের হয়ে যান। এ থেকে উদ্ভূত সমস্যার কারণে এরপরের ইলেকশনে রানিং মেট সিস্টেম সংযোজন করা হয়; অর্থাৎ ইলেকশনে প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট জুটি হিসেবে কনটেস্ট করবেন এবং ভোট প্রয়োগের সময় এই জুটিকে আলাদাভাবে বিবেচনা করা যাবে না। এতে প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট যে একই দলের ও মতের হবেন তা নিশ্চিত করা যাবে।

এখানে লক্ষ্যণীয় হল জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নতি ফোকাসে রেখে যুক্তরাষ্ট্রে কীভাবে ডেমোক্রেটিক প্রক্রিয়ার রূপান্তর ঘটছিল।

যাইহোক, ভীষণ রকম টানাপড়েনের মধ্যে ফেডারেলিস্ট জন অ্যাডামস তাঁর প্রথম টার্ম শেষ করেন। ১৮০০ সালে ফেডারেলিস্ট টিকেট পান জন অ্যাড্যামস-চার্লস পিঙ্কনে জুটি এবং রিপাবলিক-ডেমোক্রেটিক টিকেটে থমাস জেফারসন-অ্যারন বার জুটি। ১৮০০ সালের ইলেকশনটিকে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে 'রেভলিউশনারি' হিসেবে ধরা হয়। এই ইলেকশনের মাধ্যমে দুটি রাজনৈতিক ধারার দ্বন্দ্ব প্রকটভাবে উঠে আসে। রিপাবলিক-ডেমোক্রেটদের প্রো-ফ্রেঞ্চ নীতি আর ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের বিপরীতে ফেডারেলিস্টদের প্রো-ব্রিটেন নীতি আর শক্তিশালী কেন্দ্রীয় ক্ষমতার মতাদর্শের লড়াইয়ে রিপাবলিক-ডেমোক্রেটরা জয়ী হন।

থমাস জেফারসন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরের প্রায় ত্রিশ বছর একচ্ছত্রভাবে ইলেকটরাল ভোটে জিতে ক্ষমতায় থাকে ডেমোক্রেট-রিপাবলিক পার্টি। এর মধ্যে ধীরে ধীরে ফেডারেলিস্ট পার্টির ক্ষয়িষ্ণু অবস্থা প্রকট হয়ে দেখা দেয়। এটা স্পষ্ট হতে থাকে যে, ফেডারেলিস্ট পার্টির প্রো-ব্রিটেন অবস্থান (যে বৃটেনের কাছ থেকে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে আমেরিকার স্বাধীনতাপ্রাপ্তি) এবং কেন্দ্রীয় সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণের ম্যান্ডেট জনগণের কাছে অ্যাপিল হারাচ্ছে।

সময়োপযোগী ট্যাক্স পলিসি, উন্নয়নের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা আর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নীতিতে পরিবর্তন আনতে না পারার কারণেই হোক আর ইলেকশনে হারার ভয়েই হোক, স্বাধীনতার মাত্র চল্লিশ বছর পরই, ১৮১৬ সালের ইলেকশনে ফেডারেলিস্ট পার্টি অংশ নেয়নি। যার ফলশ্রুতিতে ধীরে ধীরে ফেডারেলিস্ট পার্টি পুরোপুরি হারিয়ে যায়।

এখানে উল্লেখযোগ্য একটি ব্যাপার হল যে, সাধারণ মানুষ কিন্তু ফেডারেলিস্ট পার্টির নির্বাচনে অংশ না নেওয়া বা তারপর পুরোপুরি বিলুপ্তিকে ডেমোক্রেসির জন্যে হুমকি মনে করেনি, বরং সেই সময়কে (মূলত প্রেসিডেন্ট মনরোর ১৮১৭ -১৮২৫ টার্ম) 'এরা অব গুড ফিলিংস' বা শান্তির যুগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

কারণ সেই সময় প্রো-ব্রিটেন আর প্রো-ফ্রেঞ্চ, ফেডারেলিস্ট না রিপাবলিক, এসব বলে কাঁদা ছোঁড়াছুড়ির রাজনীতি বাদ দিয়ে জাতীয় ইস্যু এবং যুদ্ধপরবর্তী নাগরিক ঐক্য, জনগণের অধিকার আর অর্থনৈতিক উন্নতির উপরই ফোকাস থাকে রাজনৈতিক অঙ্গন ও সেই সঙ্গে জনণের। জাতীয় আলোচনা আর শাসনব্যবস্থায় ফোকাস পেতে শুরু করে থমাস জেফারসনের অমর উক্তি 'অল মেন আর ক্রিয়েটেড ইক্যুয়াল', যা তিনি যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে সংযুক্ত করেছিলেন।

সেই 'এরা অফ গুড ফিলিংস'-এর সময়টাতে বাই-পার্টিজান বা দুই দলের রাজনীতি না থাকায় জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর সমাধান ও উন্নতি যে দ্রুততার সঙ্গে হয়েছে, সেটা আসলেই প্রমাণ করেছে জর্জ ওয়াশিংটনের নির্দলীয় বা সর্বমতের সরকার কতটা জরুরি ছিল একটি সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের উন্নতি ও অগ্রগতি ত্বরান্বিত করার জন্যে। চল্লিশ বছর পরে এসেও যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ অনুধাবন করতে পেরেছিল কেন তাদের ফাদার অব দ্য কান্ট্রি দলাদলির রাজনীতি এড়িয়ে সবাই মিলে দেশগড়ার প্রতি এত বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন।

ঐতিহাসিকভাবে এই ডেমোক্রেসির নিয়ামকগুলোর কোনো কোনোটির উপস্থিতি আর অনুপস্থিতি কী ধরনের রাষ্ট্রপরিচালনার আর অর্থনৈতিক উন্নয়নের উদাহরণ তৈরি করেছে তা খুবই সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরলাম। শুরু করেছিলাম যেহেতু বাংলাদেশে প্রসঙ্গ দিয়ে, আর তাই বাংলাদেশ নিয়ে বলেই ডেমোক্রেসির এই আলোচনা শেষ করব।

ডেমোক্রেসিতে বহু রাজনৈতিক দলের উপস্থিতি ও নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ সন্দেহ নেই, কিন্তু এটা স্পষ্ট যে, সবার আগে আসে আইনের শাসন ও মানবাধিকারের সুরক্ষা। বাংলাদেশে বহুদলীয় ডেমোক্রেসির নামে বিগত বছরগুলোতে যা চলেছে তা ডেমোক্রেসির ধারণার সঙ্গে কতটা যায় সেটা সত্যিই ভাববার বিষয়। যে তিনটি মূল রাজনৈতিক দল স্বাধীনতার পর থেকে এই তেতাল্লিশ বছর দেশ পরিচালনা করছে, তার দুটিরই জন্ম সামরিক ব্যারাক থেকে। শাসনতন্ত্র রহিত করে আগে শাসক হয়ে পড়ে রাজনৈতিক দল গঠন করেছে তারা।

আর তা করতে গিয়ে ডেমোক্রেসিতে অপরিহার্য যে কনসেপ্ট– শাসনতন্ত্রের সুরক্ষা ও সেই অনুযায়ী সরকার পরিচালনা– তাকেই উপেক্ষা করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, ডেমোক্রেসি প্রতিষ্ঠার বাহানায় বিভিন্ন সময়ে আইনের শাসনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে রাজাকার-আলবদরসহ যুদ্ধাপরাধীদের মুক্ত করে তাদের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করা হয়েছ। 'বহুদলীয়' ডেমোক্রেসির নামে স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দলকেও রাজনীতিতে পুনর্বহাল করা হয়েছে।

বাংলাদেশের জাতির জনক ও তাঁর পরিবারের খুনিরাও মার্জনা পেয়ে রাজনৈতিক দল গঠন করতে পেরেছে এবং সংসদে আইনপ্রণেতা হিসেবেও বসেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার চিহ্নিত খুনি-ধর্ষকদের আইন ও বিচারের উর্ধেব উঠিয়ে তাদেরকেই আইন প্রণয়নকারী হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। এমনকি ১৯৭৪ সালের নৃশংস সাত খুনের দায়ে শাস্তিপ্রাপ্ত ছাত্রনেতাকেও ১৯৭৮ সালে আইন-বিচার থামিয়ে মুক্তি দেওয়া হয়েছে যে কিনা নিজেই রাজনৈতিক দল তৈরি করে 'বহুদলীয়' ডেমোক্রেসিকে সমুজ্জ্বল করতে এখনও বহাল তবিয়তে বর্তমান।

আর এই সবকিছুই হয়েছে আইনের শাসন রুদ্ধ করে, বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি আর প্রসারের মাধ্যমে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাই বহুদলের উপস্থিতি আছে ঠিকই, কিন্তু ডেমোক্রেসি কতটুকু আছে তা ভাববার বিষয়।

আর এ কারণে বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের প্রতি আহ্বান, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় কঠোর হন, বিচারহীনতার সংস্কৃতির সমাপ্তি টানুন আর মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করুন। এমন উদাহরণ তৈরি করুন যাতে সবাই আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও আস্থাশীল হয়। আর সেটি হলে ডেমোক্রেসি এমনিতেই ধরা দিবে। জনগণ প্রকৃত ডেমোক্রেসির সুফল ভোগ করবে, তাদের অধিকার রক্ষিত হবে আর আর্থ-সামাজিক উন্নতির মাধ্যমে দেশ এগিয়ে যাবে দ্রুতগতিতে।

পরিশেষে তাই আবারও বলি, ডেমোক্রেসি একটা কনসেপ্ট যা স্থান, কাল, পরিস্থিতি অনুযায়ী পরিবর্তনশীল। জনগণের চাওয়ার সঙ্গে ডেমোক্রেটিক প্রসেসও বদলায়। বদলায় নির্বাচনের ধরন, নির্বাচনে অংশগ্রহণ আর প্রার্থিতা। ডেমোক্রেসি কোনো অংকের থিওরি নয় যে এটা না হলে ডেমোক্রেসি থাকবে না আর ওটা হলেই বিশুদ্ধ ডেমোক্রেসি পাওয়া যাবে। শুধুমাত্র একটি প্রসেস বা নির্বাচন ফোকাস করে ডেমোক্রেসি থেকে সুফল পাওয়া যাবে না যদি না ডেমোক্রেসির মূল ভিত্তি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত করা যায়।

সরকার এবং জনগণ দু'পক্ষকেই সুনির্দিষ্ট আইনের কাছে দায়বদ্ধ থাকতে হবে। আর যথাযথ স্বচ্ছতার সঙ্গে সকলকে সেই দায়বদ্ধতার নিয়মিত অনুশীলন করতে হবে। আইনের শাসনের উদাহরণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

আর তবেই ডেমোক্রেসির সুফল মিলবে যা ডেমোক্রেসির শেষ কথা।

ড. আঞ্জুমান ইসলাম: পানি পরিশোধন ও পরিবেশ প্রকৌশলী।