Published : 14 May 2014, 10:22 PM
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলির অভ্যন্তরীন ব্যবস্থাপনা কতটা কার্যকরী? এই প্রশ্নটা বেশি করে সামনে এসে পড়ে যখনই দেশে কোনো নির্বাচন লাগে। আর নির্বাচন মানেই প্রার্থী বাছাই ও তা নিয়ে কনফ্লিক্ট।
এই কনফ্লিক্টগুলি সময় সময় এমনই তিক্ততার পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে যে, প্রায়ই মনে হয়, দলগুলিতে সত্যিই কি কনফ্লিক্ট রিজলুশনের (যাকে বিরোধ-নিষ্পত্তি বলে ডাকা হয়, যদিও বিরোধ আর কনফ্লিক্ট শব্দ দুটি সমান তীব্রতাসম্পন্ন নেতিবাচক অবস্থান নির্দেশ করে না) কোনো পদ্ধতি আছে, না কি নেই?
সংগঠন হিসেবে রাজনৈতিক দলগুলি অনেক দিক দিয়েই আর দশটা অরাজনৈতিক সংগঠনের মতোই এমন একটি প্রতিষ্ঠান যার একটি প্রোডাক্ট আছে (রাজনৈতিক মতবাদ), সেই প্রোডাক্টের গ্রাহক আছে (সমর্থক, ভোটার), গ্রাহক বাড়াবার চাপ ও প্রত্যাশা আছে (মার্কেটিং, সেলিং) আর আছে আয়-ব্যয় (অর্থায়ন বিকল্প), হিসাব-রক্ষণ (অ্যাকাউন্টিং), বৈতনিক-অবৈতনিক কর্মীবাহিনী ব্যবস্থাপনা (এইচআর)।
একটি সুসমন্বিত (ওয়েল কো-অর্ডিনেটেড) অভ্যন্তরীন ব্যবস্থাপনা ছাড়া যে কোনো প্রতিষ্ঠানের মতোই সুষ্ঠুভাবে দল পরিচালনা সহজ নয়। নিশ্চয়ই দলসমূহে কোনো না কোনো অভ্যন্তরীন ব্যবস্থাপনা আছেও। কিন্তু দলের সবচেয়ে ক্রুসিয়াল সময়, মানে, নির্বাচনের সময়ে দৃশ্যমান হওয়া অনিস্পন্ন বিরোধের চিত্র থেকে তার কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ারই কথা।
"আমাদের দলে কোনো কনফ্লিক্ট ননেই"-– এটা বলে এই দেশে কেউ কেউ আত্মপ্রসাদ পেতে চাইতেই পারেন, কিন্তু যে দলে সত্যিই কনফ্লিট নেই, সেটা কি কোনো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হবার যোগ্যতা রাখে? গণতন্ত্র মানেই যেখানে নানা মত, নানা পথের মানুষের ইউনিয়ন বা একতাবদ্ধ হওয়া। সেখানে 'কনফ্লিট নেই' কথাটা কি গণতন্ত্রচর্চ্চা বিবর্জিত একটা ধারণা নয়?
সঠিক বর্ণনা হতে পারত এ রকম– "আমাদের দলে কনফ্লিক্ট রিজলুশনের জন্য স্বচ্ছ একটি প্রক্রিয়া আছে যে জন্য বিরোধ প্রায় নেই বললেই চলে"– আর তা হতে পারত খুবই প্রশংসনীয় একটি অবস্থা।
এইসব অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, সাধারণভাবে এদেশের রাজনৈতিক দলসমূহে কনফ্লিক্ট রিজলুশনে দৃশ্যমান কোনো স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতামূলক পদ্ধতির বড় রকমের ঘাটতি হয়তো রয়েছে। আর যে কারণে বড় বড় বিরোধ পুষে রেখেই তাদেরকে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। এই অবস্থার মধ্যে দলসমূহে অভ্যন্তরীন ব্যবস্থাপনা আদৌ আছে কিনা, থাকলেও তা কার্যকরী কিনা, সে প্রশ্ন সামনে আসাটা খুবই যৌক্তিক।
বিষয়টা একটু বিশ্লেষণ করা যাক।
মোটা দাগে প্রায় সব প্রধান রাজনৈতিক দলসমূহে দুই ধরনের সাংগঠনিক কাঠামোর বিভাজন চোখে পড়ে–
১. জিওগ্রাফিক ডিভিশন বা এলাকাভিত্তিক ভৌগোলিক সাংগঠনিক কাঠামো; যেমন, বিভাগীয়, জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন, পৌরসভা, ওয়ার্ড পর্যায়ের সংগঠন;
২. স্ট্র্যাটা-ভিত্তিক হোমোজিনিয়াস ডিভিশন বা পেশা/ লিঙ্গ/ বয়স/ লক্ষ্যভিত্তিক সাংগঠনিক কাঠামো; যেমন, মহিলা, ছাত্র, যুব, স্বেচ্ছাসেবক, বিবিধ পেশা ভিত্তি করে গড়ে তোলা সাংগঠনিক কাঠামো।
এই দুই ধরনের সাংগঠনিক বিভাজনের কারণে বিরোধের একটা বীজ শুরুতেই বপন হয়ে থাকে। কীভাবে, তা খোলাসা করে বলছি।
একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে, একজন কর্মী দুভাবে বিভাজিত সংগঠনগুলোতেই অংশগ্রহণ করতে সক্ষম। এই দ্বৈত-সক্ষমতা তার জন্য সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই বেশি সৃষ্টি করে।
প্রথমেই এটা তার জন্য একটা সেলফ-কনফ্লিক্টের বা স্ব-বিরোধের কারণ হতে পারে যে, আমি কোথায় যাব, কোথা থেকে শুরু করব, কোনটা নিয়ে লেগে থাকব? যেটাকে 'ইউনিটি অব গোল'-এর অভাব হিসেবে চিহ্নিত করার সুযোগ আছে। একই সঙ্গে তার সামনে দ্বৈত-নেতৃত্ব এসে দাঁড়ানোরও সুযোগ সৃষ্টি হয়। একটি পেশাগত/ডেমোগ্রাফিক বিভাজন থেকে অন্যটি ভৌগোলিক বিভাজন থেকে।
প্রকৃত ঘটনা আরও জটিল রূপ ধারণ করতে পারে কারও কারও জন্য। ধরা যাক, একজন পেশাজীবী যুব-মহিলা রাজনীতিতে সক্রিয় হতে চাচ্ছেন। তার সেলফ-কনফ্লিক্ট হবে কোথা থেকে শুরু করবেন তা নিয়ে। তিনি স্ট্রাটাভিত্তিক, মহিলা সংগঠন, যুব সংগঠন, বা পেশাজীবী সংগঠন থেকে উপযুক্তটা বেছে নেওয়ার পাশাপাশি ভৌগোলিকভাবে বিভাজিত নিজের স্থায়ী বা স্বামীর স্থায়ী বা বর্তমান ওয়ার্ড বা ইউনিয়ন সংগঠনে অন্তর্ভুক্ত হওয়া নিয়েও দোটানায় পড়তে পারেন।
দোটানাটা এই জন্য যে, এই প্রত্যেকটি সংগঠন তার জন্য ভিন্ন ভিন্ন সুযোগ দিচ্ছে যা তার রাজনৈতিক লক্ষ অর্জন ও সাংগঠনিক দক্ষতা দেখানোর জন্য সমান ভূমিকা রাখে না। আর এ সব ক্ষেত্রে তার পছন্দের সংগঠন থেকে তার উপরে বাড়তি চাপ আসাটাও বিরল নয়। 'এইটা তো উনার নিজের এলাকা নয়', 'উনি তো এখানে থাকেনই না', 'উনি তো অস্থানীয়' — এই সবই উল্লিখিত চাপের উদাহরণ।
এই পরিস্থিতির উন্নয়নে এমন ব্যবস্থা থাকা জরুরি যেন বেছে নেওয়া সংগঠনে কাজ করতে ইচ্ছুক কেউ কোনো চাপ বোধ না করেন বরং চাপ প্রদানকারীকে চিহ্নিত করা ও বিভেদসৃষ্টিকারী হিসেবে শৃংখলার আওতায় আনা সম্ভব হয়।
একই সঙ্গে, এ রকম একজন কর্মীকে একাধিক নেতার কাছে দায়বদ্ধ থাকার প্রয়োজনও দেখা দিতে পারে, যদি তিনি একই সঙ্গে দু'ধরনের বিভাজনে সক্রিয় হতে চান। বেশিরভাগ কর্মীকেই সেটা হতে দেখা যায়ও। এই দ্বৈত-দায়বদ্ধতা কোনো সুস্থ ব্যবস্থাপনার চর্চ্চা হতে পারে না। দুই ধরনের সংগঠনে কর্মীর ভূমিকা কতটা লাইন আর কতটা স্টাফ/টেকনিকাল সেটা নির্দিষ্ট করে এই সমস্যা নিরসন করা সম্ভব।
দলগুলিতে যদি এই রকমের ভিন্নমুখী কাঠামো রাখার প্রয়োজন থাকেই, তা বিন্যস্ত হওয়া উচিত খুবই দক্ষভাবে ম্যাট্রিক্স অর্গানাইজেশনের আদলে। আর ম্যাট্রিক্স সংগঠনগুলিতে যে রকম সচেতনভাবে কনফ্লিক্ট রিজলুশন টেকনিক ব্যবহার করা হয়, দ্বৈত নেতৃত্ব-পরিহারের প্রচেষ্টা থাকে (ভূমিকা ও দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করার মাধ্যমে)– এখানেও তা প্রয়োগ করাটা জরুরি হয়ে দাঁড়াবে।
আর সেটা করতে যা করণীয় তা হল, লেভেলগুলির ভূমিকা এমনভাবে সুনির্দিষ্ট করা যেন কে লাইন রোলে আছে আর কে স্টাফ বা টেকনিকাল রোলে আছে তা যেন পরিস্কারভাবে বোঝা যায়। এর সঙ্গে সুপারভাইজরি রোলগুলিও স্পষ্ট করা জরুরি।
এ সব শুরু করার আগে প্রথমেই নির্ধারণ করে নিতে হবে রাজনৈতিক ইউনিট বা একক কী। যেহেতু দিনের শেষে লক্ষ্য হল প্রত্যেক কনস্টিটিউয়েন্সি থেকে কনফ্লিক্ট রিজলভ করে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতামূলক পদ্ধতিতে একজন নেতা বের করে আনা– তাই এক একটি কনস্টিটিউয়েন্সিকে এক একটি ইউনিট বিবেচনা করাই সবচেয়ে যৌক্তিক। এরপরে ওই ইউনিট (বা কনস্টিটিউয়েন্সি)-এর অভ্যন্তরীন উপসংগঠন (সাব-ইউনিট) গুলিকে চিহ্নিত করে তাদের স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন।
মনে রাখতে হবে, এই ইউনিটগুলোই মূল লাইন অর্গানাইজেশন। আর সাব-ইউনিটগুলি তার ফিডার অর্গানাইজেশন।
ধরা যাক, আমার বর্তমান কনস্টিটিউয়েন্সিটি ভৌগোলিকভাবে ৪ টি ওয়ার্ডে বিভক্ত। তাহলে এখানে সাব-ইউনিট হিসেবে চারটি ওয়ার্ড কমিটি থাকতে পারে যা থেকে এক বা দুজন পদাধিকার বলে ইউনিট কমিটির সদস্য হবেন। বাকি থাকছে মহিলা/ যুব/ ছাত্র ইত্যাদি সমন্বয়ে গড়া ডেমোগ্রাফিক স্ট্র্যাটা ও বিভিন্ন পেশাভিত্তিক প্রফেশনাল স্ট্র্যাটাগুলোর প্রতিনিধিত্ব।
এরা সব সাব-ইউনিটেই বিদ্যমান। তাদের নিয়ে যে ইউনিট পর্যায়ের সংগঠন তা করা যেতে পারে নিচের ম্যাট্রিক্স-এর মতো করে। আর হ্যাঁ, তারাও ইউনিট কমিটিতে পদাধিকার বলে এক বা দুজন করে অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারেন। তাদের ভূমিকাও সুনির্দিষ্ট করা প্রয়োজন যা থেকে বোঝা যাবে ইউনিট কমিটিতে তারা কতটা লাইন রোলে থাকবেন বা ভূমিকা রাখবেন অথবা কতটা স্টাফ বা টেকনিকাল রোলে থাকবেন।
ইউনিট কমিটির প্রধান নির্বাচিত হতে পারেন ওয়ার্ড কমিটগুলোর রিপ্রেজেন্টেটিভদের মধ্য থেকে অথবা অন্যদেরকে নিয়ে অন্য কোনো পদ্ধতিতে যা অবশ্যই গণতান্ত্রিক বা অন্য কোনো জানা উপায়ে। তবে যেভাবেই তা ঘটুক, পুরো পদ্ধতি স্বচ্ছ ও পূর্বঘোষিত পন্থায় ঘটা বাঞ্ছনীয়। আর তা করা গেলে বিরোধের উৎস গোড়াতেই একেবারে নির্মুল করা না যাক, সীমিত করে আনা সম্ভব হবে।
আর স্ট্র্যাটা কমিটির সদস্যরা কেবলই টেকনিকাল বা পেশাগত উপদেষ্টা হবেন, নাকি কিছু লাইন রোলও প্লে করবেন সেটাও পরিস্কার থাকতে হবে। এভাবে সদস্য ভোটে বা অন্য কোনো পদ্ধতিতে কন্সটিটিউয়েন্সি-ভিত্তিক ইউনিট সংগঠন তৈরি করা হলে কনফ্লিক্ট বন্ধ হবে না ঠিক, কিন্তু তা সমাধানের দৃশ্যমান স্বচ্ছ একটা পদ্ধতি চালু করা যাবে।
এই ইউনিটগুলি যথাযথভাবে নিয়ম নেমে পরিচালিত হচ্ছে কিনা তা দেখাশুনার জন্য বিভিন্ন পর্যায়ের সুপারভাইজরি কমিটি থাকতে পারে। যেমন, জেলার সবগুলি ইউনিট কমিটির উপরের দিকের এক বা দুজনকে নিয়ে জেলা কমিটি হতে পারে। এই জেলা কমিটির ভূমিকা হবে ইউনিট কমিটির বিরোধ নিষ্পত্তি করা ও নিয়মানুযায়ী সংগঠন পরিচালিত হচ্ছে কিনা তা তদারকি করা। পাশাপাশি তারা গ্রিভান্স হ্যান্ডেলিং-এর কাজও করতে পারেন।
এভাবে সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ে ভূমিকা, দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতা সুনির্দিষ্ট করা গেলে দলের মধ্যে অধিক গণতন্ত্রের চর্চ্চা, স্বচ্ছ বিরোধ নিষ্পত্তি, গ্রিভান্স হ্যান্ডেলিং, সর্বোপরি শৃঙ্খলা আনা সম্ভব। স্ট্র্যাটা-ভিত্তিক সংগঠনগুলির মধ্যেও একইভাবে উর্ধতন সুপারভাইজরি সংগঠন তৈরি করা সম্ভব। তবে তাদের ভূমিকা ও দায়িত্ব খুবই পরিস্কারভাবে বর্ণনা করা প্রয়োজন।
রাজনৈতিক দলগুলি কীভাবে পরিচালিত হবে, তা তারা নিজেরাই ঠিক করুন। তবে তা করতে গিয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হবার সুযোগ, স্পয়েলার ক্যান্ডিডেট তৈরির পথ রাখা, বিরোধ জিইয়ে রাখা, কারও জন্যই কাম্য নয়। না জনগণের, না নেতৃবৃন্দের, না দলের।
একইভাবে, সোজা বা বাঁকা, কোনো একভাবে মনোনয়ন জিতে নিয়ে এটা বলে বেড়ানোও শোভন বা রাজনৈতিক শিষ্টাচারভুক্ত নয় যে 'ওমুক না-পাওয়ার বেদনা থেকেই এই রকম বলে বেড়াচ্ছেন বা বিরোধিতা করছেন বা বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন'।
দিনের শেষে এইসব কর্মকাণ্ডই দলের দুর্বলতা নির্দেশক। একটু তুলনা করে ব্যাখ্যা করি।
এমন একটি সিলেকশন প্রক্রিয়ায় বা পরীক্ষায় কথা ভাবুন যেখানে একজনই নির্বাচিত বা প্রথম হবেন। কখন আমরা তা মেনে নিই? যখন পদ্ধতিটা থাকে স্বচ্ছ ও প্রেডিক্টেবল। তথ্য থাকে উন্মুক্ত। আর এর ব্যত্যয় ঘটলে, শুধু পদ্ধতি নয়, যারা তা চালাচ্ছেন সেই পুরো সংগঠনটিকেই সেই দুর্বলতার দায়ভার বইতে হয়।
রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সময় এসেছে সিদ্ধান্ত নেবার, তারা কতদিন আর নিজেদের দলকে এই দুর্বলতার মধ্যে রাখবেন, এই দায় বয়ে বেড়াতে বাধ্য করবেন, সেটা ঠিক করার। এ থেকে উত্তরণে তারা কি একটি শক্তিশালী অভ্যন্তরীন ব্যবস্থাপনা চান, নাকি "যা চলছে যেভাবে চলছে, চলুক না" এই মত ধরে রাখতে চান, সেটা প্রকাশ্য হওয়ার দাবি কিন্তু দিন দিন বাড়তেই থাকবে।
কাজী আহমদ পারভেজ: শিক্ষক, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি।