এরপরও থাকতে পারেন না মায়া

তৌফিক ইমরোজ খালিদী
Published : 10 May 2014, 06:25 AM
Updated : 10 May 2014, 06:25 AM

মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া একটি বিবৃতি দিয়েছেন এবং সেটি দিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের কাগজে। দাবি করেছেন, দেশজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী অপরাধের সঙ্গে তার পরিবারের একজনেরও সম্পৃক্ততা নেই। সোজা কথায়, পিঠ বাঁচাতে চেয়েছেন তার মেয়ের জামাই, সাবেক লেফটেনেন্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মাহমুদের। ইনি অপসারিত হয়েছেন, তবে আদালতে এখনও দোষী সাব্যস্ত হননি।

দেখাই যাচ্ছে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী নিজের পরিবারের দুর্যোগ সামাল দিতে ব্যর্থ হয়েছেন।

প্রথমত, ঘটনাটির তদন্ত চলছে। যা কিছু তদন্ত বাধাগ্রস্ত করতে পারে তা-ই অগ্রহণযোগ্য। দুর্ভাগ্যজনক হল, মন্ত্রী অন্যরকম ভেবেছেন। তিনি স্রেফ ভুলে গেছেন যে, শীতলক্ষ্যায় হতভাগ্য সাতটি মরদেহ ভেসে ওঠার আগেই তার জামাতা র‍্যাবের নারায়ণগঞ্জ ইউনিট-প্রধানের চাকরি খুইয়েছেন। অর্থাৎ তারেক সাঈদ মাহমুদ প্রথমেই সন্দেহভাজন হিসেবে তদন্ত প্রক্রিয়ায় ঢুকে গেছেন। সুতরাং বিবৃতি দেওয়ার মধ্য দিয়ে মন্ত্রীও তদন্তে ব্যাঘাত ঘটিয়েছেন।

২৭ এপ্রিল নারায়ণঞ্জের কাউন্সিলর, একজন স্থানীয় আইনজীবী ও আরও ৫ জনের অপহরণের খবর যখন আসে, তখন সবেমাত্র সুপরিচিত এক পরিবেশকর্মীর স্বামীর 'অপহরণ' ও 'ফিরিয়ে দেওয়ার' কাণ্ডটি সম্পন্ন হয়েছে। ৩৬ ঘণ্টার ওই চমকপ্রদ ঘটনাপ্রবাহের রেশ তখনও কাটেনি; আর তখনই প্রাচীন নদীটিতে লাশগুলো ভেসে উঠল। ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, খুনিরা ছিলেন পেশাদার এবং তাদের সব কাজেই ছিল পেশাদারিত্ব।

নিহত কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের শ্বশুর তখনও পর্যন্ত (৪ মে) এই দাবি করেননি যে, এই সাতজনকে হত্যা করতে র‍্যাব অফিসাররা ছয় কোটি টাকা নিয়েছেন। ক্ষমতার বলয়ে থাকা জামাতা এরই মধ্যে, ২৯ এপ্রিল, 'এলিট ফোর্স' থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে স্বগৃহে, অর্থাৎ সেনাবাহিনীতে, প্রত্যাবর্তন করেছেন। একই সময়ে একজন মেজর ও একজন লেফটেন্যান্ট কমান্ডারকেও র‍্যাব থেকে বের করে দেওয়া হয়।

সেনাবাহিনী এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে কাজ করেছে। এক দণ্ড অপেক্ষা না করেই তারা তাদের তাৎক্ষণিকভাবে চাকরিচ্যুত করে। নৌবাহিনীও কালক্ষেপণ করেনি। ওইদিনই র‍্যাব-১১ তে কর্মরত মন্ত্রী-জামাতার সহযোগীকে বরখাস্ত করা হয়। দেখা গেল, সশস্ত্র বাহিনীর জনসংযোগ দপ্তরও দ্রুততার সঙ্গে গণমাধ্যমকে জানিয়ে দিল।

ঘটনার পর থেকে নেওয়া পদক্ষেপগুলো দেখে সুবিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকারকে আন্তরিক বলেই মনে হয়েছে। র‍্যাব-১১ এর প্রধানকে সরানোর দিনই জেলার পুলিশপ্রধানকে বদলি করা হয়। পরের দিন জেলা প্রশাসককে সরানো হয়। এর ক'দিন পর, ৭ মে, তদন্তে ন্যূনতম প্রভাব বিস্তার করতে পারেন, এমন ৮১ জন পুলিশ কর্মকর্তাকে নারায়ণগঞ্জ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। তার একদিন পর, শুক্রবার, রাজশাহী র‍্যাবের এমন এক কর্মকর্তাকে র‍্যাব-১১ এর দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয় যিনি অপেক্ষাকৃত সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন।

শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক ছিল বলেই মনে হচ্ছিল। কিন্ত অকস্মাৎ মন্ত্রী মায়া তার পেশিশক্তি প্রদর্শন করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি যে বিবৃতি দিয়েছেন, সেটি ওই অফিসারদের মতো তাকেও রাস্তা মাপতে বলার পক্ষে যথেষ্ট যুক্তির যোগIন দেয়।

বিবৃতিতে মায়া বলেছেন, গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে তার পরিবারকে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করায় তিনি গভীরভাবে বেদনাহত। সেগুলো তার এবং তার পরিবারের মানহানি ঘটিয়েছে। তিনি আরও বলেন, তিনি চান দোষীদের আইনের আওতায় আনা হোক।

কিন্তু বিবৃতির আসল উদ্দেশ্য তিনি স্পষ্ট করেছেন এভাবে: "আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে জানিয়ে রাখতে চাই, এ হত্যাকাণ্ড সম্পর্কিত মামলায় অভিযুক্তদের সঙ্গে আমার পরিবারের কোনো সদস্যের কখনওই কোনো রকম যোগাযোগ বা ব্যবসায়িক লেনদেন বা সম্পর্ক ছিল না।"

এই বিবৃতির দু'দিন আগেই যে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে তার জামাতাকে চাকুরিচ্যুত করা হয়েছে এটা মন্ত্রীর মাথায় আসেনি। এও বলতে হয়, সেনাবাহিনী, তার প্রথা এবং বৈশিষ্ট্যের অন্যথায়, সেই ঘটনা চেপে যাওয়ার কোনো চেষ্টাও করেনি, বরং ব্যবস্থা নিতে পেরে সশস্ত্রবাহিনীকে গর্বিতই মনে হয়েছে। আইএসপিআরের কাজের ধারা সম্পর্কে যার সামান্য ধারণাও আছে তিনি এটা বুঝতে পারবেন।

খেতাবপ্রাপ্ত একজন মুক্তিযোদ্ধার (অমুক্তিযোদ্ধা হলেও বিষয়টা একই থাকে) সব রকম অধিকার রয়েছে তার পরিবারের কোনো সদস্যকে রক্ষা করার (বর্তমান ক্ষেত্রে সদস্যটি শুধু তার মেয়ের জামাই, আপাতত; 'আপাতত', কারণ আরও কিছু বিশ্বাসযোগ্য তথ্য আদালতে আমলযোগ্য নয় বলে খুলে বলা হচ্ছে না)। কিন্তু এখানেই তিনি স্বার্থ-দ্বিত্বের উদাহরণ সৃষ্টি করছেন। একজন কেবিনেট সদস্য ক্ষমতার চূড়ান্ত অপব্যবহারে অভিযুক্ত তার জামাতাকে রক্ষার চেষ্টা করছেন।

মায়া তার বিবৃতিতে বলেছেন, তার পরিবার নিয়ে গণমাধ্যমে অনেক কথাবার্তার মধ্যেও নিজেকে সংযত রেখেছিলেন, কোনো মন্তব্য করে তিনি তদন্তে 'প্রভাব' বিস্তার করতে চাননি। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে এই, ব্যক্তিগত বিবৃতির আড়ালে তিনি এক অর্থে শাসিয়েছেন পুলিশ, র‍্যাব ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটিগুলোকে: ''আমার পরিবারের কারও গায়ে হাত লাগাতে যেও না, ওরা নির্দোষ''।

নির্দোষ? হয়তো, হয়তো নয়। কিন্তু তাতে তারা যে তদন্তাধীন সে সত্য পাল্টে যায় না।

মন্ত্রীর বিবৃতির প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা আগেই র‍্যাবের পদস্থ সূত্র বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান অপরাধ প্রতিবেদকের কাছে স্বীকার করেছেন, র‍্যাবের চলমান তদন্তে তাদের অফিসারদের হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতার পক্ষে প্রমাণ মিলেছে।

এই ঘটনাপ্রবাহ মন্ত্রীর জন্য দুর্যোগবহ। তিনি ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে যখন প্রতিমন্ত্রী ছিলেন, তার ও তার বেপরোয়া পুত্রদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের পরও পার পেয়ে গেছিলেন। কিন্তু এই দফাতেও একই রকম ঘটলে মন্ত্রী মায়া যাঁর তত্ত্বাবধানে রয়েছেন সেই প্রধানমন্ত্রী তাঁর নিজের প্রতি সুবিচার করবেন না।

[বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ইংরেজি সংস্করণের অপিনয়নে প্রকাশিত আর্টিকেল থেকে বাংলা ভাষান্তর করেছেন: অনিন্দ্য রহমান]