একজন ‘বাস্তুহারা’র প্রতিকৃতি

ফরহাদ মাহমুদ
Published : 25 Nov 2010, 04:02 PM
Updated : 25 Nov 2010, 04:02 PM

কয়েক দিন আগে বর্তমান বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে টিভি চ্যানেলগুলোতে কাঁদতে দেখে সবার মতো আমারও খুব খারাপ লেগেছে। সেদিনই তাঁকে সেনানিবাসের বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে হয়েছিল। তিনি বারবার রুমালে চোখ মুছছিলেন, আর সাড়ে তিন দশকের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটির কথা বলছিলেন। তিনি সংবাদ সম্মেলনে জানান, বাড়ি থেকে তাঁকে এক কাপড়ে বের করে দেওয়া হয়েছে। সেনাসদস্যদের বিরুদ্ধে তিনি দুর্ব্যবহারেরও অভিযোগ করেছিলেন। অবশ্য, সেনাবাহিনীর জনসংযোগ বিভাগ বা আইএসপিআর এর পাল্টা বক্তব্য দিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, হাইকোর্টের দেওয়া সময়সীমা শেষ হয়ে যাওয়ায় তিনি স্বেচ্ছায় বাড়ি ছেড়ে চলে যান।

তারা উল্টো অভিযোগ করেছেন, একটি বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি করার জন্য তিনি বরং সেনাসদস্যদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছেন। এমনকি, গালিগালাজও করেছেন। এখন কোন বক্তব্য সঠিক তা বলা মুশকিল। তবে, একটি বিষয়ে তাঁর বক্তব্য অনেকের মতোই আমার কাছেও হাস্যকর মনে হয়েছে। সেটি হলো, সেনানিবাসের বাড়ি হারিয়ে তিনি এখন 'বাস্তুহারায়' পরিণত হয়েছেন। তাই বাস্তুহারা প্রসঙ্গটি নিয়ে দুয়েকটি হালকা কথার এই অবতারণা।

আমার কৈশোর কেটেছে গ্রামে। শহরের প্রতি ছিল দুর্নিবার আকর্ষণ। আর তাই সে সময় ঘর-পালানোর একটি বদ-অভ্যাস আমার মধ্যে গড়ে উঠেছিল। পালিয়ে আসার কারণে শহরে কোনো আত্মীয়ের বাসায় উঠতাম না। আমার সঙ্গী হতো আমার সমবয়সী এক খালাতো ভাই। আমাদের রাত কেটে যেত নির্মাণাধীন কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন। ট্রেন তখন ফুলবাড়িয়া স্টেশনেই যাতায়াত করত। মাঝে মাঝে রাতে সেখানেও ঘুমাতাম। সে সময় কমলাপুর ও ফুলবাড়িয়া স্টেশনে অনেক বাস্তুহারাকে দেখেছি।

শীতের এক রাতে কমলাপুর স্টেশনে শুয়ে আছি। কনকনে শীত, সেই সঙ্গে জোড় উত্তুরে বাতাস। সুঁইয়ের মতো শরীরে বিঁধে যাচ্ছে। স্টেশনের মোটা থামের আড়ালে জবু-থবু বসে আছি। সারা রাত ঘুমাতে পারিনি। অথচ সে রাতেও সেই প্লাটফর্মে শতাধিক পরিবারকে দেখেছি, কোনো রকমে ছেঁড়া কাথা মুড়ি দিয়ে সন্তান-সন্তুতিসহ আধমরার মতো শুয়ে থাকতে। তারাই তো সত্যিকারের বাস্তুহারা। কারো ঘরবাড়ি কেড়ে নিয়েছে সর্বনাশা নদী। কেউ দায়-দেনায় সর্বস্ব হারিয়ে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে স্টেশনের প্লাটফর্মে আশ্রয় নিয়েছে। কেউবা কাজের আশায়, বেঁচে থাকার মতো জীবিকা অর্জনের জন্য ঢাকায় এসে প্লাটফর্মে ঠাঁই নিয়েছে। এ ছাড়া তাদের সামনে আর কোনো পথ খোলা ছিল না। তারাই প্রকৃত বাস্তুহারা। বর্তমানে শুধু রেল স্টেশন বা লঞ্চ টার্মিনালই নয়, যেকোনো রাস্তার ফুটপাতে হাজার হাজার পরিবারকে শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায় খোলা আকাশের নিচে বসবাস করতে দেখা যায়। প্রকৃত বাস্তুহারা তো তারা। সারা দুনিয়াই এ রকম কোটি কোটি বাস্তুহারা রয়েছে। যাদের জীবনের দুঃখকষ্টের চিত্র কল্পনা করলেও চোখের কোণায় জল জমে যায়। কিন্তু তিন তিনবারের প্রধানমন্ত্রীর নিজেকে 'বাস্তুহারা' দাবি করেন কীভাবে? তাঁর এই দাবির পেছনে কী যুক্তি আছে? একটু খতিয়ে দেখা যাক।

সরকারিভাবে তাঁকে দুটি বাড়ি দেওয়া হয়েছিল। সেনানিবাসের বাড়িটি ছাড়তে হলেও গুলশানের মতো অভিজাত এলাকায় ৩১ কাঠা জমির ওপর তাঁর আরেকটি বাড়ি রয়েছে। আত্মীয়-স্বজন এবং পরিবারের সদস্যদেরও অনেকের সরকারিভাবে পাওয়া প্লট বা বাড়ি রয়েছে। সর্বোপরি, বিরোধী দলীয় নেত্রী হিসেবে তাঁর জন্য বরাদ্দ করা একটি সরকারি বাড়ি সম্পূর্ণ খালি পড়ে রয়েছে। তারপরও তিনি 'বাস্তুহারা' হন কী করে? তাঁর এভাবে নিজেকে 'বাস্তুহারা' দাবি করা কি প্রকৃত বাস্তুহারাদের সঙ্গে পরিহাস করার শামিল নয়? সম্ভবত সে কারণেই সেদিন বাস্তুহারা কল্যাণ সমিতির একজন নেতা ঠাট্টা করে বলছিলেন, 'আমরা তাহলে ওনাকে সমিতির সদস্য করে নিলেই পারি!'

শুধু তাই নয়, দিনাজপুর শহরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মা 'রানীমাতা' নামে সমধিক পরিচিত। সেই মায়ের নামে সেখানে রয়েছে প্রাসাদোপম 'তৈয়বা ভবন'। দিনাজপুরে কান্তজির মন্দির বানিয়েছিলেন যে মহারাজা, তিনি সেখানে পাঁচটি বড় দিঘি কাটিয়েছিলেন। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মাতাসাগর। ৪৬ একর জমির ওপর কাটা এ দিঘিটি তীরবর্তী কিছু জমিসহ লিজ দেওয়া হয়েছিল খালেদা জিয়ার বাবাকে। জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনামলেই এ লিজ দেওয়া হয়েছিল। জানা যায়, লিজের জন্য মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল চার লাখ টাকার মতো, যা তিনি কখনো জমা দেননি। অথচ মাতাসাগর ভোগদখল করে আসছিলেন তারা। ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হন। ইতিমধ্যে তাঁরা বাবা মারা গেছেন। সম্ভবত ১৯৯৪ সালে সেই মাতাসাগরের লিজ হস্তাস্তর করা হয় তৎকালীন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী ফজলুর রহমান পটল ও তাঁর ভাইদের নামে এবং তখন লিজের টাকা পরিশোধ করা হয়।

দিনাজপুর পৌরসভার অবিভক্ত বাংলার এককালীন চেয়ারম্যান বাবু যতীন্দ্র মোহন সেনের বাড়িটা লিজ দেওয়া হয়েছিল খালেদা জিয়ার মা তৈয়বা বেগমের গড়া একটি এনজিওকে। সেই এনজিওটির কমিটিতে তাদেরই আত্মীয়স্বজন এবং বিএনপির কিছু লোক রয়েছেন। পঞ্চগড়ে ঐতিহ্যবাহী জাজ ডিস্টিলারির মালিক হয়েছিলেন তার ছেলে ও ভাগ্নে। সেখানেও প্রচুর সম্পত্তি রয়েছে। বগুড়ায়ও তাঁর স্বামীর এবং পরবর্তীকালে ছেলের অর্জিত বেশ জায়গাজমি ও বিশাল বিশাল স্থাপনা রয়েছে। খালেদা জিয়ার বাবার আদি বাড়ি ছিল বৃহত্তর নোয়াখালীর ছাগলনাইয়ায়। তিনি সেখান থেকে নির্বাচনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। সেখানেও জমিজমার অধিকার তারা ছাড়েননি। সাভারেও তাদের নামে-বেনামে অনেক জমি আছে। ছোট ভাই ইস্কান্দারের সেখানেও রীতিমতো রাজত্ব রয়েছে। সারা দেশে তাদের এ রকম আরও কত সম্পত্তি রয়েছে, তার সব হিসাব আমাদের জানা নেই। একটি পরিবারের অনেক সম্পত্তি থাকতেই পারে। তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অধিকার আমাদের নেই। কিন্তু রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি আইনবহির্ভূতভাবে যদি কাউকে দেওয়া হয়, তাহলে প্রশ্ন ওঠাটা স্বাভাবিক। আর তিন তিনবারের প্রধানমন্ত্রী অশ্রুসজল চোখে নিজেকে 'বাস্তুহারা' দাবি করাটা সম্ভবত সঙ্গতও নয়।

প্রথমেই বলেছি, বেগম খালেদা জিয়ার বাড়ি ছাড়া কিংবা উচ্ছেদের ব্যাপারে দু ধরনের মতই আমরা পেয়েছি। কোনটি বিশ্বাসযোগ্য তা ভবিষ্যৎই বলতে পারবে। তবে কিছু ঘটনার কথা এখানে উল্লেখ করা যায়। যেদিন খালেদা জিয়া বাড়িটি ছেড়ে যান, তার আগের দিন দৈনিক প্রথম আলো প্রধান শিরোনামে যে খবরটি ছাপা হয়েছিল, তা প্রণিধানযোগ্য। 'বাড়ি ছাড়ার প্রস্তুতি খালেদার' শিরোনামের খবরটিতে বলা হয়, তিনি ১ নভেম্বর থেকেই বাড়ি ছাড়ার প্রস্তুতি নিতে থাকেন এবং বাড়ির মালামাল সরিয়ে নিতে শুরু করেন। এ কাজে তিনি সেনাবাহিনীর সহায়তাও চেয়েছিলেন। ১, ৪, ৯ ও ১০ নভেম্বর অর্ধশতাধিক কার্টন মালামাল, কয়েকটি বড় ব্যাগ, স্টিলের বড় ট্রাংক ইত্যাদি সরিয়ে নেওয়া হয়। অধিকাংশ মালামাল নেওয়া হয় ছোটভাই এস্কান্দার ও ছেটো ছেলে কোকোর শাশুড়ির বাসায়। খবরে বলা হয়, খালেদা জিয়া বাড়ি ছাড়ার ব্যাপারে মনস্থির করে ফেলেছেন এবং পরদিন (১৩ নভেম্বর) বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সেই ক্ষেত্রে আইএসপিআরের দাবিকে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তা ছাড়া হাইকোর্টের রায়ের বিপরীতে আপিল করার সময় স্থগিতাদেশ না চাওয়াটাও বিশেষ অর্থ বহন করে। এ নিয়ে খোদ বিএনপির আইনজীবীদের মধ্যেই ভিন্নমত রয়েছে। অনেকে একে একটি বড় ভুল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

যাহোক, আমরা চাই মহাজোট সরকার বিরোধী দলীয় নেতার সেনানিবাসের বাড়ির ব্যাপারে সর্বোচ্চ ধৈর্য ও সংযমের পরিচয় দেবে। কোথাও যেন কোনো রকম বাড়াবাড়ি না হয়, সে ব্যাপারে সরকার সর্বোচ্চ সতর্ক থাকবে। এ ব্যাপারে কেউ যেন অনাহুত কোনো বক্তব্য দিয়ে অযথা পরিস্থিতি ঘোলাটে না করে, সেদিকে সরকারকে সাবধান হতে হবে। বিরোধী দলীয় নেতার প্রতি দেশবাসীর স্বাভাবিকভাবেই একটি সহমর্মিতা থাকবে। এ ব্যাপারে আদালত যেভাবে রায় দেবে সেভাবেই ব্যবস্থা নিতে হবে। আর বিরোধী দলীয় নেতারও উচিত হবে, এ ব্যাপারে যা সত্যি তাই প্রকাশ করা। জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হলে তা হিতে-বিপরীত হবে। আর এই ইস্যুতে হরতাল ডেকে কিছুদিন আগে অনেক রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতি করা হয়েছে। আবারও হরতাল ডাকা হয়েছে। দেশের উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক বিকাশের স্বার্থে, সর্বোপরি জনগণের দুর্ভোগের কথা বিবেচনা করে হরতালের রাজনীতি বিসর্জন দেওয়া উচিত বলে অনেকেই মন্তব্য করেছেন। তাই আগামী ৩০ নভেম্বরের হরতাল প্রত্যাহার করে নেওয়াটাই সম্ভবত বিএনপির জন্য সবচেয়ে সমীচিন হবে। বিষয়গুলো বিরোধী দলকে আন্তরিকভাবে ভেবে দেখার অনুরোধ জানাচ্ছি।