মাউন্ট উনজেনে রবি ঠাকুর

শোয়েব সাঈদ
Published : 10 May 2014, 03:33 AM
Updated : 10 May 2014, 03:33 AM

পেশাজীবী আর পত্রপত্রিকার কলাম লেখকের দ্বৈত-সত্ত্বার মুশকিলটা হল রুটিরুজির টানে সার্বক্ষণিক ব্যস্ততার মাঝেও স্বীয় স্পেশালাইজেশন থেকে যোজন যোজন দূরের শিল্প, সাহিত্য আর রাজনীতির ভিন্নতর ভুবনে সাবলীল সন্তরণের অভ্যাসটাকে শাণিত রাখার প্রয়োজনেই কলম চালিয়ে যেতে হয়।

অবশ্য এখন কলম না হলেও চলে– পিসি, কী-বোর্ডের নিবেদিতপ্রাণ কীগুলোই এক একটি 'ঝর্ণা কলম'। ইংরেজি কীবোর্ডে অভ্রু ফন্টে বাংলা তো ভালোই লেখা যাচ্ছে। তবে দ্বৈত-সত্ত্বার লেখকদের লিখবার জন্যে 'সময় ব্যবস্থাপনাটি' জটিল হয়ে যায় যখন একসঙ্গে অনেকগুলো ভাবনা এসে খোঁচাতে থাকে।

এমনি এক ভাবনা জটিলতায় হঠাৎ করেই মস্তিস্কের নিউরনগুলোতে একটা অনুরণন, একটু ফিসফিসানি, "এমন দিনে তারে বলা যায়", কী বলা যায়? আরে, চারদিকে তো বাজছে 'এসো হে বৈশাখ এসো এসো'। বৈশাখ, এ তো শুধু নববর্ষের মাস নয়, কবিগুরুর জন্মমাসও যে বটে। পঁচিশে বৈশাখ উপলক্ষে রবিঠাকুরকে নিয়ে কেতাবী ধরনের কোনো লেখা নয়, ভাবছি সহজবোধ্য কী লিখা যায়। কবিগুরু আর ফেলে আসা জাপানকে নিয়ে কিছু একটা তো মন্দ নয়।

আমি চঞ্চলও হে, আমি সুদূরেরও পিয়াসী। ওগো সুদূর, বিপুলও সুদূর তুমি যে বাঁজাও ব্যাকুলও বাঁশরী। সুদূরের তরে কবিগুরুর এই ব্যাকুলতাটুকু শুধু সাহিত্যে নয়, কবিগুরুর ব্যক্তিগত জীবনাচারে বিশ্বভ্রমণ বা প্রাচ্য-প্রতীচীর আবাহনজনিত ব্যাপক কর্মযজ্ঞ থেকেও সহজে অনুমেয়। বাংলা ভাষা, সাহিত্য আর বাঙালিদের আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পরিচিতির ক্ষেত্রে কবিগুরু সক্রিয় ছিলেন সমান্তরালভাবে দুটো ফ্রন্টলাইনে। একটি তাঁর অমর সাহিত্যকর্ম, অন্যটি বিশাল আন্তঃমহাদেশীয় বন্ধুবান্ধব ও তৎসংশ্লিষ্ট বিশ্বভ্রমণ। আজ থেকে প্রায় শতবর্ষ আগে এক বঙ্গসন্তানের পাঁচটি মহাদেশের তিরিশটি দেশ ভ্রমণ এবং কোনো কোনো দেশে বহুবার ভ্রমণ চাট্টিখানি ব্যাপার নয়।

বর্তমান এবং সাবেক পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য এবং তাদের প্রভাববলয়ভুক্ত ইউরোপ কিংবা পেট্রোলিয়ামসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্য সম্পর্কে আমরা যতটা ওয়াকিবহাল, ঠিক ততটা নই বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক পরাশক্তি জাপান সম্পর্কে। ধর্মীয়, ঔপনিবেশিক, সামরিক কিংবা রাজনৈতিক সম্পর্কহীনতা এবং সর্বোপরি বিদেশিদের প্রতি ঐতিহাসিক এবং প্রথাগতভাবেই উদাসীন জাপানিজ সংস্কৃতি এবং সামাজিক আবহ মূলত এই দূরত্বের জন্যে দায়ী।

মজার ব্যাপার হল, বহিঃবিশ্ব সম্পর্কে উদাসীন এই জাপানিদের জাপান ৬ বার ভ্রমণ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। নেতাজি সুভাষ বসু আর রবিঠাকুর– এই দুই বঙ্গসন্তানকে ইতিহাসের প্রতি অনুরক্ত এমন জাপানিরা ভালোভাবেই চেনেন এবং জানেন। শ্মশ্রুমণ্ডিত রবিঠাকুর এবং তার সাহিত্য জাপানি বালক ইয়াসুনারি কাওয়াবাতাকে মুগ্ধ করেছিলে একজন প্রাচীন ওরিয়েন্টাল যাদুকরের মতোই এবং ইনি সেই কাওয়াবাতা যিনি ১৯৬৮ সালে সাহিত্যে নোবেল পান প্রথম জাপানিজ হিসেবে কবিগুরুর হেঁটে যাওয়া পথ ধরেই।

জাপানের চারটি বড় দ্বীপের মধ্যে একটি কিয়ুশু দ্বীপ। মূলত দক্ষিণ-পশ্চিম জাপান বলে পরিচিত এই কিয়ুশু দ্বীপ সাতটি প্রিফেকচার নিয়ে গঠিত। পূর্ব চীন সাগরের পূর্ব তীরে অবস্থিত নাগাসাকি হচ্ছে কিয়ুশু দ্বীপের সর্বপশ্চিমের প্রিফেকচার, যার অপর প্রান্তে আছে চীনের মেগাসিটি সাংহাই।

এই হচ্ছে সেই নাগাসাকি যেটি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আণবিক বোমার দ্বিতীয় শিকার। নাগাসাকির বহুল পরিচিত টুরিস্ট স্পট হচ্ছে মাউন্ট উনজেন, ৪৯২১ ফুট উচ্চতার এই আগ্নেয়গিরিটি জাপানের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ অগ্নুৎপাতের জন্যে কুখ্যাত হয়ে আছে। এখানকার সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান হচ্ছে, উনজেন জিগকু বা হেল অর্থাৎ উনজেন দোযখ।

এখানে সেখানে ওনসেন (হটস্প্রিং) বা উষ্ণ প্রসবনের বুদবুদ। কোথাও ক্যালসিয়ামের আধিক্যে সাদা গরম পানি, কোথাও আয়রনের আধিক্যে লাল গরম পানি। সালফারের গন্ধ চারদিকে। জীবাণুনাশক এবং ত্বক-বান্ধব গুণাবলীর জন্যে বিখ্যাত এ পানি। এ পানিতে কিছুক্ষণ চুবিয়ে রাখলে ডিম সিদ্ধ হয়ে যায় এবং সালফারের গন্ধবিশিষ্ট এই ডিম খুবই স্বাস্থ্যকর ও উপাদেয়।

নাগাসাকি সিটি থেকে ফেরার পথে ইচ্ছে হল মাউন্ট উনজেনের জিগকু দেখার। জিগকুর খুব কাছেই একটি হোটেল ছিল বিশ্রামের স্থান। হোটেলটির বাইরের অবয়ব ট্র্যাডিশনাল জাপানি ধাঁচের এবং ভেতরটি অত্যাধুনিক। হঠাৎ হোটেলের সামনের বাগানের কালো স্টোনের উপর চোখে পড়ল 'ইন্ডিয়ান' শব্দটি। দেখলাম, লেখা আছে রবিঠাকুরের এই হোটেলে রাত্রিযাপনের কথা।

খুবই আশ্চর্য হলাম। কবিগুরুর জাপান সফর, বিশেষ করে নোবেলপ্রাপ্তির পর ১৯১৬-১৭ এর দিকের সফরের কথা আমার জানা ছিল যার অধিকাংশই বড় বড় শহরকেন্দ্রিক। এই দুর্গম ভলকানিক অঞ্চলে রবিঠাকুরের উপস্থিতি, তাও আবার বিংশ শতাব্দীর প্রথমাংশের অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থায়, আশ্চর্য হবারই কথা।

সূত্রটা মেলানোর চেষ্টায় ঘণ্টাখানেকের জন্যে রবীন্দ্র-গবেষক হতে হল ইন্টারনেটের অলিগলি বেয়ে। নাগাসাকি বরাবরই সমুদ্রবন্দর হিসেবে খ্যাত ছিল বিশেষ করে চীন ও অবশিষ্ট এশিয়ার এন্ট্রিপোর্ট হিসেবে এবং হয়তো এই খ্যাতিই ছিল আণবিক আঘাতের সম্ভাব্য একটি কারণ।

১৯২৪ সালের এপ্রিল মাসে রবিঠাকুর সাংহাই গিয়েছিলেন ধারাবাহিক লেকচারে অংশ নিতে। লেকচার শেষে পূর্ব চীন সাগর পাড়ি দিয়ে জাপানে আসা এবং মে মাসে নাগাসাকির এই দুর্গম অঞ্চল দিয়ে শর্টকাটে মূল ভূখণ্ডে যাবার সময় উনজেনের পাদদেশে রাত্রিযাপন সম্ভাব্য একটি কারণ।

আশ্চর্য হলেও অনুভূতিটা আবেগময়। এক বাঙালি সেলিব্রেটির পদধূলি ঐতিহাসিকভাবে বিদেশিদের প্রতি শীতল জাপানিরাও ভুলতে দেয়নি, বরং শ্রদ্ধা আর অহংকারে আগলে রেখেছে।

ড. শোয়েব সাঈদ: বায়োটেক নির্বাহী, কানাডা।