বন্ধুত্বের প্রগাঢ়তা , লক্ষ্য কি ১০০০ বিলিয়ন ডলার?

কিউ আর ইসলাম
Published : 24 Nov 2010, 04:28 PM
Updated : 24 Nov 2010, 04:28 PM

ওবামা এ মাসের প্রথম সপ্তাহে তিন দিনের সফর শেষে ভারত ত্যাগ করলেন। সফরকালীন ভারতীয় সংসদে এই আমেরিকান রাষ্ট্র্রপতি দু'দেশের মধ্যে প্রগাঢ় সম্পর্কের কথা উল্ল্যেখ করে, 'ইন্ডিয়া হ্যাজ এমার্জড' ঘোষণা দিয়ে নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের স্থায়ী সদস্যপদ পেতে সমর্থন করবেন বলে আশা ব্যক্ত করলেন। তবে ওবামা বা তার উপদেষ্টারা কবে নাগাদ ও কীভাবে এটা নিশ্চিত করবেন এবং এ ব্যাপারে আমেরিকা কী দায়িত্ব পালন করবে সে ব্যাপারে কোন ইঙ্গিত দেয়া হয়নি। গত মাসে ভারত নিরাপত্তা পরিষদে দুবছরের জন্য অস্থায়ী সদস্যপদ লাভ করেছে। এই পরিষদের স্থায়ী সদস্যরা হল যুক্তরাজ্য, চীন, ফ্র্যান্স, রাশিয়া ও আমেরিকা।

ভারতের সাথে আমেরিকার এই বন্ধুত্বের সুত্রপাত বা প্রগাঢ়তা বৃদ্ধির শুরু হিন্দু জাতীয়তাবাদি দলের অটল বিহারী বাজপেয়ী সরকার আমলে আনবিক সরঞ্জাম সরবরাহ বিষয়ক চুক্তি থেকে। এই চুক্তি চুড়ান্ত হয় ২০০৫ সালে তৎকালীন আমেরিকান রাষ্ট্র্রপতি মিঃ জর্জ ডব্লিউ বুশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিঃ মনমোহন সিংহ (যিনি র্বতমানেও প্রধান মন্ত্রী) এর সাক্ষরের মাধ্যমে। মিঃ সিংহ তখন মিঃ বুশকে ওঅর্ম ও হিউমেন বা উষ্ণ ও সাধু ব্যাক্তি হিসেবে অভিহিত করেন। আমেরিকায় শ্বেত ভবন বা হোয়াইট হাউস এ এক সভা শেষে মিঃ সিং বলে ওঠেন "ভারতের জনগণ আপনাকে ভালোবাসেন্।" এ কথা বলার সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রীর জিহ্ববা আড়ষ্ট হয়ে আসে বলে আমেরিকান মিডিয়া উল্লেখ করে ।

এর পাঁচ বছর পর মিঃ সিং পুণরায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়ে আর একজন আমেরিকান রাষ্ট্র্রপতিকে অভ্যর্থনার সুযোগ পেলেন। এ মাসের শুরুতে আমেরিকান অর্থনীতিতে সে দেশের ফেডারেল রিজার্ভ এর ৬০ হাজার কোটি ডলার ঢেলে দেয়ার সিদ্ধান্তকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিঃ সিং সমর্থন দিয়েছেন। এই অর্থ দিয়ে আমেরিকান ট্রেজারি বন্ড ক্রয় করা হবে। অন্যদিকে জার্মানী, ব্রাজিল ও চীন এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। কারণ এতে ডলারের মান কমে যাওয়ায় এ সমস্ত দেশসমূহ আমদানি-রফতানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এমতাবস্থায় মিঃ সিং এর সমর্থন ফেডারেল রিজার্ভ এর পরিকল্পনায় দুর্লভ পররাষ্ট্র অনুমোদন বলে অভিহিত করা হয়েছে। বলাবাহুল্য মিঃ সিং এক সময় ভারতের অর্থমন্ত্রীও ছিলেন । যাহোক সবমিলে ভারত ও আমেরিকার মধ্যে এক প্রগাঢ় বন্ধুত্ব বিরাজ করছে।

অন্যদিকে ভারতের প্রতিবেশী ও চিরশত্র পাকিস্তানের সাথে আমেরিকার সম্পর্কের গুরুত্বও বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিওবা মাঝে মাঝে এই সম্পর্কে চিড় ধরছে তারপরেও নানাবিধ কারণে এই আমেরিকা-পাকিস্তান মৈত্রী জরুরী বলে আমেরিকান মিডিয়া মনে করছে। যেমন গত মাসে বর্ডার পোষ্টে ন্যাটো হেলিকপ্টারের গুলিতে কয়েকজন পাকসেনার মৃত্যুর পর পাকিস্তানের সীমানা দিয়ে আফগানিস্থানে ন্যাটো সেনাদের গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহ বন্ধ করে দেয় সে দেশের সরকার। পাকিস্তান সেনাবাহিনী তালিবানদের ধ্বংস করার যাবতীয় কর্মকান্ডে অংশগ্রহণে অনীহা প্রকাশ করে। আমেরিকা সরকারীভাবে ক্ষমা চাওয়ার পর অবশ্য এই সবররাহ পথ খুলে দেয়া হয়। আমেরিকা মনে করে যে তাদের সাথে পাকিস্তানের মৈত্রী আফগানিস্থানে যুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য অপরিহার্য্য।

আফগান যুদ্ধে জয়ী হতে পশ্চিমা দেশসমূহের কোম্পানীগুলোর সাথে সাবকন্ট্রাক্টে বেসরকারী নিরাপত্তা বাহিনী নিয়োগ ও সেনাশাসন ব্যার্থ হয়েছে। এ কাজে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেও কোন সফলতা আসেনি। পাকিস্তান সংসদীয় গণতন্ত্রকে "এশিয়ার সেরা ফেডারেল মডেল" হিসেবে আখ্যা দিয়ে দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য পাকিস্তান সরকারকে আমেরিকার পক্ষে বেশী বেশী কাজ করতে বলা হচ্ছে। পাকিস্তানে সাম্প্রতিক বন্যায় ক্ষতি পূরণে আমেরিকা সাহায্য করছে। দেশে পূনর্গঠণের লক্ষ্যে অর্থ সংগ্রহের জন্য উৎসাহ দেয়া হচ্ছে, প্রয়োজন হলে দীর্ঘকালীন বন্ধু চীনের সহযোগিতা নিতে হলেও। গত বছর আমেরিকান কংগ্রেস ৭৫০ কোটি ডলার অনুমোদন করেছে স্কুল, হাসপাতাল, এনার্জি প্লান্ট উন্নয়নের জন্য। আফগানিস্তানে ড্রোন আঘাতের জন্য আমেরিকান প্রস্তুতি ও নিয়ন্ত্রণ অপর্যাপ্ত। অন্যদিকে আমেরিকার ইউরোপীয় মিত্ররা এ যুদ্ধ থেকে ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে বা সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য আগ্রহী হচ্ছেনা। এ সমস্ত কারণে পাকিস্তানের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে।

আমেরিকার প্রবল ইচ্ছা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার শান্তিচুক্তি পূণরায় শুরু হোক। তাহলে পাকিস্তান বিদ্রোহী বা তালিবান যুদ্ধে আরো বেশী মনযোগ দিতে পারবে। তবে আমেরিকার সাথে বন্ধুত্বের খেসারতও আছে। আমেরিকান-ন্যাটো বাহিনীর সাথে পাকিস্তানকে নিজ ভূমিতেই বিদ্রোহী দমনে অংশ নিতে হচ্ছে। অনেক পাকিস্তানী সেনা নিহত হচ্ছে। অর্থনীতিতে ধ্বস্ নামছে বলে পাকিস্তানের সেনা বাহিনী প্রধান আশফাক পারভেজ কায়ানি রাষ্ট্রপতি আসিফ আরী জারদারীকে সতর্ক করেছে। ভারতকেও খেসারত দেয়ার উদাহরণ রয়েছে। এক আমেরিকান কোম্পানির ভারতীয় সাবসিডিয়ারীর কারখানায় ১৯৮৪ সালে বিষাক্ত গ্যাস নির্গত হলে ২,২৫০ জন সাথে সাথে এবং পরবর্তী সময়ে ১৫,০০০ হাজারেরও বেশী মৃত্যুবরণ করেন, প্রায় ৫ লক্ষ ব্যাক্তির উপর এর প্রভাব পড়ে, একটা গুরুত্বপূর্ণ শহরের প্রাণকেন্দ্রে বিষাক্ত বর্জ্যের স্তুপ তৈরী হয়। ওই কোম্পানী মাত্র ৪৭ কোটি ডলার পরিমাণ অর্থ দিয়ে চলে যায়। কোম্পানীর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা গ্রেপ্তার হলেও জামিন পেয়ে ভারত ত্যাগ করে আর কখনও ফিরে আসেনি। ঘটনার ২৬ বছর পরে ওই কোম্পানীর তখনকার আটজন কর্মকর্তার দন্ড হলেও সময়সীমা ছিল দু'বছর করে। এদর মধ্যে একজন আগেই মারা যায়। অথচ এই আমেরিকাই গাল্ফ অব মেক্সিকোতে তৈল নিঃসরণের জন্য দায়ী ব্রিটিশ পেট্রোলিয়ামকে দুই হাজার কোটি ডলারের একটি তহবিল তৈরী করতে বলেছে নিঃসরিত তৈল অপসারণের জন্য। এ ছাড়া অন্যান্য ক্ষতিপূরণের ব্যাপার তো আছেই।

তবে আমেরিকার স্বার্থ মনে হচ্ছে অন্য কিছূতে। যেখানে ভারতের স্বার্থও জড়িত থাকতে পারে। পাকিস্তান এ ব্যাপারে পক্ষে থেকে কাজ না করে বিপক্ষে গেলে মারাত্বক সমস্যা হতে পারে। আর তা হলো আফগানিস্তানের ভূগর্ভে সংরক্ষিত প্রায় এক হাজার বিলিয়ন বা ১ লক্ষ কোটি ডলার মূল্যের খনিজ দ্রব্য। বিশেষ করে লৌহ, তাম্র, কবাল্ট, সোনা এবং আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প ধাতব লিথিয়াম। আফগানিস্তান লিথিয়ামে এতই সমৃদ্ধ যে এ দেশকে 'সৌদি আরব অব লিথিয়াম' বলা যায়। ল্যাপটপ ও স্মার্ট ফোন এর ব্যাটারি তৈরীতে লিথিয়াম অপরিহার্য। আমেরিকান জিওলজিষ্টরা ও প্রতিরক্ষা অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয় পেন্টাগন এর কর্মকর্তাগণ অনুসন্ধান করে এই খনিজ সম্পদের অস্তিত্ব বের করেছেন। আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট সমস্ত তথ্য পরীক্ষা করে এর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। এর ফলে আফগানিস্তানে বিনিয়োগের জন্য বিদেশীদের উৎসাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। আফগানিস্তানে নিজস্ব কোন কারিগরি দক্ষতা, যোগ্যতা ও শিল্প না থাকায় তাদের খনিজ সম্পদের প্রতি অন্যদের দৃষ্টি পড়েছে।

ইতোমধ্যে চীন প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের মাধ্যমে আফগানিস্তানে 'আয়নাক তাম্র খনি'' পাওয়ার পর আরো খনির জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। আফগান খনিজ মন্ত্রী ত্রিশ লক্ষ ডলার ঘুষ নিয়ে চীনকে তার দেশে এই তাম্র খনি উন্নয়নের কাজ দিয়েছে বলে এক আমেরিকান কর্মকর্তা অভিযোগ করেছেন । আমেরিকার আশংকা চীন এই খনিজ সম্পদ উন্নয়নে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। উল্লেখ্য যে জ্বালানী তেল ও খনিজদ্রব্যের খোজে চীন আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশে তৎপর রয়েছে। নিজ দেশের উন্নয়নসহ শিল্প উৎপাদনে চীনে এখন খনিজ দ্রব্যের বিশাল প্রয়োজন। আফগানিস্তানকে এই খনিজ সম্পদ আহরণে অন্য দেশের সাহায্য নিতেই হবে। আবার এই বিশাল সম্পদ নিয়ে আফগানিস্তানে উপজাতীয় ও আঞ্চলিক নেতাদের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি হতে পারে। এটা দমন করতে প্রয়োজন হবে পাকিস্তানের সহায়তা ।

আমেরিকান জিওলজিষ্টরা ২০০৪ সালে কাবুলে পাওয়া আফগান জিওলজিকাল সার্ভের কিছু পুরানো চার্ট ও তথ্য থেকে এই খনিজ সম্পদের খবর পায়। পরে তারা জানতে পারে যে ১৯৮০ দশকে সোভিয়েত সরকার আফগান দখলের সময় এই চার্ট ও তথ্য সংগ্রহ করে। পরবর্তীকালে সোভিয়েত প্রস্থানের পর এগুলো আফগান জিওলজিস্টদের হস্তগত হয়। এগুলোর উপর ভিত্তি করে আমেরিকা ২০০৬ সালে এরিয়াল জরিপ শুরু করে। ইউএস নেভি ওরিয়ন পি-৩ এয়ারক্রাফটে এ্যাড্ভ্যান্সড গ্রাভিটি ও ম্যাগনেটিক মেজারমেন্ট যন্ত্রপাতি সংস্থাপন করে এই জরিপ কাজ চালানো হয়। পরবর্তীকালে অনুসন্ধান আরো জোরদার করা হয়। যাবতীয় অনুসন্ধান, পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে আমেরিকা এই বিশাল খনিজ সম্পদ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়। সাম্প্রতিক বাজার দর হিসেবে সারা আফগানিস্তান জুড়ে প্রায় ৪২ হাজার কোটি ডলার মূল্যের লৌহ, ২৮ হাজর কোটি ডলার মূল্যের তাম্র, ৮ হাজার কোটি ডলার মূল্যের নিওবিয়াম, ৫ হাজার কোটি ডলার মূল্যের কবাল্ট, আড়াই হাজার কেটি ডলার মূল্যের সোনা এবং ৬ হাজার কোটি ডলার মূল্যের আরো ১৭ রকমের খনিজ ধাতব রয়েছে।

চীন ও ভারত আফগানিস্তানের নিকটতম প্রতিবেশী। দু'দেশেই এখন উন্নয়নের জোয়ার। এই উন্নয়ন কাজের জন্য প্রয়োজন লৌহসহ নানা ধরণের ধাতবের। চীন ও ভারতে স্টীলের ব্যবহার বৃদ্ধিহার বছরে ৭-৮%। চীন গত বছর ৮.২ কিমি দীর্ঘ সুতং সেতু নির্মাণেই ব্যবহার করেছে ৬৫,০০০ টন স্টীল। প্রতি বছর চীনের প্রয়োজন প্রায় ৪৫ কোটি টন (বিশ্বে মোট ববহারের ৩৫%) এবং ভারতের ৫ কোটি টন স্টীল। আফগানিস্তান থেকে এই প্রয়োজন মেটাতে পারলে তা হবে সস্তা এবং সাশ্রয় হবে আফ্রিকা বা সুদুর কোন দেশ থেকে পরিবহন বাবদ খরচ। আর আমেরিকার বিশাল আয় হবে এই সম্পদ আহরণের পুরো অধিকার পেলে। ফলে মনে হচ্ছে আফগানিস্তানের এই খনিজ সম্পদ দখল থেকে রাশিয়া সরে গেলেও এখন শুরু হবে চীন ও আমেরিকার মধ্যে প্রতিদন্ধিতা। আর এ লক্ষ্যেই হয়ত আমেরিকার প্রয়োজন পাকিস্তানের সহায়তা আর ভারতের সাথে বন্ধুত্ব। নিজ সম্পদ রক্ষার জন্য আমেরিকার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আফগানিস্তানের জনগণের বন্ধু হয়ে দাঁড়াতে পারে চীন । হাত বাড়িয়ে দিতে পারে ইরান । আফগানিস্তানে এই লড়াইয়ের ফলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া উততপ্ত হয়ে উঠতে পারে মধ্য প্রাচ্যের মত।

কিউ আর ইসলাম:  প্রাবন্ধিক  ও গবেষক।  বর্তমানে জাইকার সহযোগিতায় এলজিইডি কর্তৃক বাস্তবায়িত ক্ষুদ্রাকার পানি সম্পদ উন্নয়ন প্রকল্পে কনস্যালট্যান্ট হিসেবে সংশ্লিস্ট আছেন। তিনি বাংলাদেশ ওয়াটার পার্টনারশীপ এর নির্বাহী কমিটির একজন সদস্যও।