কুরুক্ষেত্রে আম আদমী পার্টি

গর্গ চট্টোপাধ্যায়
Published : 6 May 2014, 11:26 AM
Updated : 6 May 2014, 11:26 AM

এই তো কয়েক মাস আগেই মনে হচ্ছিল যে সবকিছু ঠিক হয়েই আছে। ব্যাপক দুর্নীতি করা ইন্দিরা কংগ্রেসের দ্বিতীয় মেয়াদের সরকারের একদম ল্যাজে-গোবরে অবস্থা। একই সঙ্গে জনবিচ্ছিনতাটিও প্রকট হচ্ছিল এবং গুজরাট থেকে এসেছে এক পয়গম্বর।

পয়গম্বরের অতিমানবীয় চরিত্র নির্মাণ করতে পাবলিক রিলেশন এজেন্সিগুলো কম খরচা করেনি। সেই গুণ আর 'রাজপুত্র' রাহুল গান্ধীর দোষ, দুই মাইল ফলাফলও খুব পরিস্কার মনে হচ্ছিল। বিজেপি পাঁচ গোলে এগিয়ে, খেলা শেষের বাঁশি বাজা শুধু সময়ের অপেক্ষা। এখুনও অনেক কিছুই ঠিক হয়ে আছে। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ গুজরাটি পয়গম্বরকে আর ততটা দৈবীশক্তিযুক্ত বলে মনে হচ্ছে না।

যদিও সেই এখুন এগিয়ে। অরবিন্দ কেজরিওয়ালের নেতৃত্বে আম আদমী পার্টির উত্থানে এটুকু পরিস্কার যে বিজয়ী পক্ষ জিতে রাজনৈতিক ক্ষমতা, আইন-প্রণয়ন ক্ষমতা, পরিচালন ক্ষমতা, এমনকি মানবাধিকার লঙ্ঘন করার ক্ষমতাও পাবে, কিন্তু সততা ও নৈতিকতা নিয়ে বড় মুখে বলার ক্ষমতা থাকবে অধরাই।

বৈদ্যুতিন মিডিয়ার ফসল বলা হয়েছিল আম আদমী পার্টিকে। অনেক পণ্ডিতই বলেছিলেন যে, ক্যামেরাগুলি অন্যদিকে ঘুরে গেলে, ফোটো ও ভিডিও না তোলা হলে, জনমানস থেকেও দূর হবে এই দল।

ভাগ্যিস, ক্যামেরাঅলা ও ভিডিওঅলারা কীসের ওপর তাক করে বসে, তা দিয়ে দুনিয়ার বাস্তব চিত্র নির্ধারিত হয় না। তাই সত্তুরের মুখে ছাই ফেলে সে দল এখুন বিরাজমান, যদিও মিডিয়া অনেকটাই এড়িয়ে চলছে তাদের।

এই এড়ানোর একটা শুরু আছে। দিল্লিতে রাজ্য সরকার গঠনের পর আম আদমী পার্টি যখন পরিস্কারভাবে জানাল যে, তারা ওয়ালমার্টের মতো অতিকায় খুচরো ব্যবসায়ী সংস্থাকে ব্যবসা করতে অনুমতি দেবে না, তখনি বৃহৎ পুঁজির বংশবদ মিডিয়ার কোপদৃষ্টিতে পড়ল তারা। এতদসত্ত্বেও, দলটি কংগ্রেস ও বিজেপি, দুটি বৃহৎ দলের মহড়া নিয়েছে প্রতিটি পদক্ষেপে।

এর কারণ কিছুটা এই যে মূলত উত্তর ভারতকেন্দ্রিক এবং শহরকেন্দ্রিক দল হবার ফলে, ভারতবর্ষের রাজনীতির সবচেয়ে শক্তিশালী দুটি অক্ষ– শহর ও হিন্দি, এই দুইটাতেই তাদের প্রচার বেশি। ভারতবর্ষে প্রান্তীয় থেকে জাতীয় হয়ে উঠতে গেলে চাই হিন্দি-বলয় ও বৈভবশালী শহর, এই দুই ক্ষমতা কেন্দ্রে বার বার নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করা।

আম আদমী পার্টি এই লক্ষে বেশ সফল। কিন্তু অন্য দুই বৃহৎ পার্টির সঙ্গে তাদের যে ভিন্নতা, সেটাও বেশ পরিস্কার এবং যার ফলে অনেকেরই খুব খারাপ জায়গায় হাত পড়েছে। আম আদমী পার্টি অবলীলাক্রমে তাদের দলের ফান্ডে টাকা দেওয়া সকল ব্যক্তির নামধাম প্রকাশ করে চলেছে এবং অন্য দলগুলিকেও তা করতে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে।

ক্ষমতাশালীদের কালো টাকায় বলিয়ান দলগুলি, বলাই বাহুল্য, এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেনি, কিন্তু নৈতিকতার লড়াইতে আম আদমী পার্টি নিজেদের একটা স্বকীয় অবস্থান রেখেছে। সেটাও অনেকের কাছেই পরিস্কার। ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড়লোক ব্যবসা-গোষ্ঠী গুজরাটের আম্বানিদের দুর্নীতি নিয়ে আম আদমী পার্টি সরব হয়েছে। বৃহৎ পুঁজিপতির টাকাতেই কংগ্রেস, বিজেপি দুই-এর উননে ভাত গরম হয়।

তাই আম্বানির নাম এসে পড়ায় তারা রে-রে করে উঠেছে, একসঙ্গে, এক গলায়। এই অভূতপূর্ব ঐক্য ভারতবর্ষের জনগণের দুর্ভাগ্য। কিন্তু এও ঠিক যে সাধারণ মানুষ, আমার আপনার মতো কেউ, যদি সাহস করে ক্ষমতাশালী কারুকে বলে, রাজা তোর কাপড় কই, তাহলে দেশের মানুষ জানতে পারলে, মনে মনে ঠিকই বলে, 'বাঘের বাচ্চা, সাবাস'।

বাঘের বাচ্চা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে প্রতিটি নগরে-গ্রামে। তাদেরই একত্র করতে চায় আম আদমী পার্টি। মানুষের এই সব ব্যাপারে সাবাসী দেবার প্রবণতার কারণেই তাদের অন্যান্য ফন্দিতে অন্যত্র মনোনিবেশ করাতে বৃহৎ দলগুলি সদা সচেষ্ট। যেমন বিজেপি আজ বলছে 'শক্তিশালী' নেতৃত্ব, প্রথমে ভারত ধরনের কিছু সর্বত্তাহীন স্লোগান। আশা, এইভাবে শ্রদ্ধা ও আশা, দুই-ই জাগবে তাদের ষণ্ডা নেতার প্রতি। অনেক ওয়েব সাইট, টিভি চ্যানেল, সংবাদপত্র, বুদ্ধিজীবী গত কয় মাস নিরন্তর এই প্রকল্পেই যুক্ত।

অরবিন্দ কেজরিওয়াল ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, নরেন্দ্র মোদী যেখান থেকে লড়বেন, সেখানেই তার বিরুদ্ধে লড়বেন। ২০১৪ এর লোকসভা নির্বাচনে মোদী লড়ছেন বেনারস (কাশী) থেকে। বলা হয়, নিরবিছিন্নভাবে আবাদ থাকা পৃথিবীর সবচেয়ে পুরানো শহর এটি। এখানেই আগের শিব-বিশ্বনাথ মন্দির চূর্ণ করে দিল্লির মঙ্গোল সম্রাট ঔরঙ্গজেব আলমগীর একটা বিরাট মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন।

বিজেপির দখলে থাকা এই আসনটি তথাকথিতভাবে নিরাপদ। তার প্রথম রাজনৈতিক রেলি করার জন্য যখন অরবিন্দ বেনারসে ঢোকেন, তখন তার গায়ে দুর্বৃত্তরা পচা ডিম ও কালি ছোঁড়ে। নরেন্দ্র মোদীর গুজরাতে যেসব বৃহৎ ব্যবসায়ীকে জলের দরে ভূমি, উপকূল, নদী, নালা, জঙ্গল বিলিয়ে দেওয়া হয়েছে, দেওয়া হয়েছে বন্দর গড়ার, খনিজ উত্তোলনের অধিকার, দেওয়া হয়েছে কর-ছাড় ও কোটি কোটি টাকা ভর্তুকি, তাদেরই উপহারে ল্যাংটা রাজার নির্বাচন-প্রচার সফরের বিমানের তেলের দাম আসে।

আরও আসে ডিম-কালি ছোঁড়া বীরপুঙ্গবদের দিনের শেষের মদ-মাংসের খরচা। অরবিন্দ ও আম আদমী পার্টি বেনারসকে বেছেছে খুব বুদ্ধি করে। কারণ নরেন্দ্র মোদীর কেন্দ্রের খবর না দিয়ে উপায় নেই। বৈরি মাধ্যম থেকে যতটা প্রচার পাওয়া যায়। ইস্ত্রি-করা কুর্তা-পাজামা পরা ও প্রধানমন্ত্রিত্বের দাবিদারের উচ্চতা যেন একটু খাটো দেখাচ্ছে কালি-ডিম মাখা হাফশার্ট-পরা আম আদমী অরবিন্দের সামনে।

মোদীই জিতবেন, কিন্তু জিতে সুখ পাবেন না। আম আদমী পার্টির পরিকল্পনা দীর্ঘমেয়াদী। আদতে তারা ভারতবর্ষের কংগ্রেসের জায়গাটি দখল করতে চায়। হয়ে উঠতে চায় একটি ধর্মনিরপেক্ষ জনবাদী ভারতব্যাপী বিকল্প। তাদের ২০১৪ এর লাফালাফি আসলে এর পরের নির্বাচনের জন্য গা-গরম করার প্রচেষ্টা।

কুরুক্ষেত্র দেরি আছে। আপাতত ইন্দ্রপ্রস্থে কৌরব-রাজত্ব আসবে বলেই মনে হয়।

গর্গ চট্টোপাধ্যায়: মানসবিজ্ঞান-এর (কগনিটিভ সায়েন্স) গবেষক।